সেটা ১৯১6। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তৃতীয় বছর। ইংল্যান্ডে যুবকদের যুদ্ধে যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক। দেশজুরে দেশপ্রেমের বন্যা। কেম্বব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই তৈরী হয়েছে অস্থায়ী সেনাহাঁসপাতাল।

সেই গণহিস্টারিয়ার বাজারেও বেঁকে বসলেন বিশ্ববিখ্যাত গণিতবিদ এবং দার্শনিক বিট্রান্ড রাশেল। লাগাতার লিখতে লাগলেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে। বক্তব্য সিম্পল। এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলাতে লাভবান দেশের শিল্পগোষ্ঠী- ইম্পিরিয়ালিস্ট ডিজাইনের চক্রান্তের শিকার সাধারন মানুষ।

ট্রিনিটি কলেজ থেকে বহিস্কৃত হলেন সেই বছর। ১০০ পাউন্ড ফাইন হল। বললেন ফাইন দেব না-জেলে যাব। সেটা হল না। বন্ধুরা ফাইন দিয়ে দিল। তাতেও দমলেন না-চালিয়ে গেলেন যুদ্ধবিরোধি, শান্তির পক্ষে প্রচার। এবার সত্যিই দেশোদ্রোহিতার অপরাধে ছমাসের জেল। জেলে বসেই লিখলেন তার অসামান্য বায়োগ্রাফি=

I found prison in many ways quite agreeable. I had no engagements, no difficult decisions to make, no fear of callers, no interruptions to my work. I read enormously; I wrote a book, “Introduction to Mathematical Philosophy”… and began the work for “Analysis of Mind”

— The Autobiography of Bertrand Russel

ট্রিনিটিতে শান্তিকামী মানুষে পক্ষে শুধু রাশেলই ছিলেন না-ছিলেন থমাস হার্ডি। রামানুজমের মেন্টর। এই সময়টাতে যুদ্ধবিরোধি মনোভাবের জন্য ( না হার্ডি যুদ্ধ বিরোধি লেখালেখি করতেন না ) হার্ডিকে প্রায় একঘরে হতে হয় বৃটেনে। রামানুজমের ওপরে সদ্যমুক্ত সিনেমা, ম্যান হু নিউ ইনফিনিটিতে এর অসাধারন চিত্রায়ন করেছেন পরিচালক।

আরো ছিলেন আর্থার এডিংটন। আইনস্টাইন তখন শত্রু দেশের বিজ্ঞানী। জেনারেল থিওরী অব রিলেটিভিটি আবিস্কার করেছেন বছর চারেক আগে। কিন্ত সূর্য্যগ্রহণের অপেক্ষায় আছেন কখন তার তত্ত্ব প্রমানিত হবে। আগের সূর্য্যগ্রহনে কিছুই হয় নি-কারন যুদ্ধ চলছে। কেম্ব্রিজে এডিংটন ঘোষনা করলেন-তিনিই করবেন আইনস্টাইনের তত্ত্বর পরীক্ষা। গোটা বৃটেন জুরে ঘৃণার শিকার হলেন এডিংটন -কিন্ত তিনি অনড়। ইতিহাস সৃষ্টি হল ১৯১৯ সালে। সাউথ আফ্রিকায় পূর্নগ্রাস সূর্য্যগ্রহণ থেকে তিনিই প্রথম প্রমান করলেন নক্ষত্রথেকে আসা আলোর রেখা, সূর্য্যের অভিকর্ষ বলে বেঁকে যাচ্ছে-আইনস্টাইনের সমীকরন মেনে। বিংশ শতাব্দির বিজ্ঞানের ইতিহাসের সব থেকে গুরুত্বপূর্ন ঘটনা। এডিংটন বলেছিলেন যুদ্ধ সভ্যতার পরিপন্থি-বিজ্ঞান সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার হাতিয়ার। তাই তিনি আর্ক এনিমি জার্মানীর বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সাথে কাজ করেই প্রমান করবেন, এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা, জাতিবৈরিতার উর্ধে উঠে বিজ্ঞানীর সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

ফ্রাংকলি স্পিকিং আমি জাতিয়তাবাদ দেশপ্রেম ইত্যাদি ব্যপারে ভীত। দেশের প্রতি প্রেম ভালোবাসা নিঃসন্দেহে ভাল। কিন্ত ফেসবুকে যখন পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে গালাগাল ভেসে আসে, দেখি ঘৃণার বন্যা পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে, তখন নিজের মনেই অজান্তে কাঁপি-এত ঘৃণা কেন? পাকিস্তান এবং পাকিস্তানি এক না। পাকিস্তান দেশটা একটা কৃত্রিম সৃষ্টি-থাকাই উচিত না। ওটা পাঁচটা স্বতন্ত্র প্রদেশে ভাগ করে দেওয়া উচিত। বালুচ, সিন্ধ ওরা স্বাধীন হৌক। পাকিস্তানি মিলিটারীর থেকে মুক্তি পাক। এসব নিয়ে আমার দ্বিমত নেই। কিন্ত পাকিস্তানি কারা? বৃটিশ চক্রান্তের ফসল পাকি মিলিটারীর হাতে ধুঁকতে থাকা ভারতীয়দের মতন সাধারন মানুষ। তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা কেন? কেন বৃটিশদের বিরুদ্ধে না, যারা পাকিস্তান নামে একটা কৃত্রিম দেশ তৈরী করে দিয়ে গেল যাতে ভারতকে গোদের ওপর বিষফোঁড়া নিয়ে বাঁচতে হয়।

ইরাক আক্রমনের সময়, আফগানিস্থান আক্রমনের সময় আমেরিকান টিভিতেও জনগণকে দেশপ্রেমের আবেগে ভাশানো হয়েছে। তার পরবর্তীকালে কি হয়েছে আমরা জানি। ভারতে এখন সেই ফেজ। সব মিডিয়া, সর্বত্রই দেশপ্রেমের বন্যা বইছে। সার্জিক্যাল এটাক। এটাতে অবশ্য আমার দেশ আমেরিকা হচ্ছে এক্সপার্ট।

কিন্ত যে প্রশ্নটা আমরা করি না-সেটা হচ্ছে এই যে টেররিজম, সন্ত্রাস এর মূল ত শুধু অর্থ বা অস্ত্র না। ধর্ম এবং আদর্শবাদ ও বটে। এবং খুব পরিস্কার ভাবেই এর মূলে ইসলাম যা আরব সংস্কৃতির সাম্রাজ্যবাদের ধর্মীয় মোরক। কাশ্মীরের ৮০% জনগণ হিন্দু হলে, সেখানে সন্ত্রাসবাদের প্রশ্ন উঠত না-মিলিটারি ইন্টারভেনশনের দরকার ও হত না। সুতরাং এক্ষেত্রে সরকারের তরফ থেকে রাজনৈতিক ইসলামকে ডাইল্যুইট করার কোন প্রচেষ্টা নেই কেন? বরং তারক বিশ্বাসের মতন যেসব নাস্তিকরা ইসলাম সম্মন্ধে স্পেডকে স্পেড বলার সাহস রাখেন তাদের জেলে ঢোকানো হচ্ছে।

সার্জিক্যাল এটাক নিয়ে যে উন্মাদনা তৈরী করা হচ্ছে, তা বুদ্ধিভ্রংশের উজ্জ্বল উদাহরন। কজন সন্ত্রাসী মারবে ভারতের সেনা বর্ডার পেরিয়ে? ১০, ১০০, ১০০০, ১০,০০০? দশ হাজার সন্ত্রাসী মরলে এক লাখ সন্ত্রাসী তৈরী হবে পরের বছর-যদ্দিন ওই ইসলামিক আদর্শ এবং শরিয়ার মোহ থেকে মুসলমান যুবকরা মুক্ত না হতে পারছে।

ভ্রান্ত রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় আদর্শের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কি দেশে সন্ত্রাসবাদ কমবে?