avijit-roy-blogger-bangladesh-against-muslims
হ্যাঁ তার সাথে আমার দেখা হয় নি। কথাও হয় নি। সেই সৌভাগ্য বা সুযোগ আমি পাই নি। কিম্বা আমার বা আমার মত আরো অনেকের কাছ থেকেই তা কেড়ে নেয়া হয়েছে। এখন শুধু তার বই আর নানা মাধ্যমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লেখাগুলোই আমাদের সামনে রয়েছে। হ্যাঁ আমি অভিজিৎ দার কথাই বলছি। অভিজিৎদার কথা মনে আসলেই এক অব্যক্ত ক্রোধের সৃষ্টি হয়। তৈরি হয় এক শূন্যতার। তখন সবেমাত্র বিদেশে এসেছি। ফেসবুকে কখনোই খুব বেশি নিয়মিত ছিলাম না। দেশ ছাড়বার পর আগের থেকে একটু বেশিই ফেসবুকে ঢুঁ মারতাম। মুক্তমনাই ছিল অনলাইনে আমার প্রধান গন্তব্য। তখন পর্যন্ত কালেভদ্রে দু একটা মন্তব্য করাই আমার দৌড়। আসলে তখন মুক্তমনায় যেসব দুর্ধর্ষ ব্লগাররা ছিলেন সেখানে মন্তব্য করাও একটা বিরাট ব্যাপার ছিল। অভিজিৎদার পোস্টগুলো আসা মাত্র অনেকটা গোগ্রাসে গিলতাম। আর ভাবতাম মুক্তমনার সাথে পরিচয় এত দেরী করে হল কেন?
এখন একটু পেছনে ফিরে যাব।এই শতকের প্রথম দশকটি আমার কেটেছে বাংলাদেশের এক গ্রামীণ মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা ও শিক্ষকতার সুবাদে। পুরো এলাকাতেই সম্ভবত আমিই ছিলাম একমাত্র নাস্তিকতার অনুসারী। যার ফলে চিন্তা ও মননশীলতার জগতে এক ভয়ানক একাকীত্ব ছিল আমার নিত্যসঙ্গী। যদিও বন্ধুবান্ধবের খুব কমতি ছিল না। তবে সেটা শুধু বন্ধুহীনভাবে বেঁচে থাকার অভিশাপ থেকে দূরে থাকার জন্যই। যদিও তখনো জনমানসে ধর্মীয় প্রদর্শনের এত চুড়ান্ত হয়নি। ভাবলেই অবাক লাগে আমাদের ক্লাসে একজনও হিজাবধারী ছিল না। এমনকি শিক্ষকদের মধ্যেও নয়। তাবলিগের ছেলেরাও বেশিরভাগই প্যান্ট শার্ট পড়ত। পোলাপান নামাজ রোজা করলেও তা নিয়ে খুব বাড়াবাড়ি ছিল না। এমনকি নাস্তিকতা বা ধর্মহীনতা নিয়ে টুকটাক কথাও বলা যেত। যদিও প্রায় সবাই একধরণের দূরত্ব বজায় রাখত।
এখন অবশ্য পরিস্থিতি একদম উলটো। ছাত্রীদের প্রায় সত্তর থেকে আশিভাগই এখন হিজাব পড়ে। নারী শিক্ষকরা প্রায় শতভাগই। নামাজ রোজা না করা প্রায় অপরাধ। আর বাংলাদেশে ডাক্তারদের মধ্যে ধর্মের প্রভাব নিয়ে ত নতুন করে কিছু বলার নেই। আমার ধারণা বাংলাদেশে যত পেশা আছে তার ভেতরে চিকিৎসকরাই ধর্ম নিয়ে সবচেয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করেন। সেরকম অবস্থায় মাঝে মাঝে খুব অসহায় বোধ করতাম। তবে এত কিছু সত্ত্বেও তখনো আমি মনে করতাম ধর্ম নিয়ে সরাসরি কোন সমালোচনা করা উচিৎ নয়। বোধহয় সেই পরিবেশ আর ধর্ম নিয়ে চারদিকে মারাত্মক স্পর্শকাতরতা দেখে আমার মধ্যেও অনুভূতির ভূত ভর করেছিল।
সেই আমি যখন এই দশকের প্রথম দিকে ঢাকায় আসলাম তখন আমার ছোট ভাইয়ের কাছে প্রথম মুক্তমনার নাম শুনলাম। অথচ মুক্তমনার বয়স তখন দশ পেরিয়ে গেছে। তারপর একদিন মুক্তমনা সাইটটিতে ঢুঁ মারলাম। আর ঢুকেই চোখ ছানাবড়া। এভাবেও ধর্মের কাছাধরে টান দেওয়া সম্ভব? এভাবেও চিন্তা করা, নিজেকে প্রকাশ করা যায়? আবার এরকম একটা দেশে বসেই তাতে অংশগ্রহণও করা যায়। যেখানে আমরা কবি দাউদ হায়দার, তসলিমা নাসরিনকে দেশ থেকে তাড়িয়েছি। হূমায়ুন আজাদকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছি। তখনো অবশ্য সামনের ভয়ংকর দিনগুলোর কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। আর মুক্তমনায় শুধু একজনই নন। অনেকেই দ্বিধাহীনভাবে লেখে যাচ্ছেন। আমি যা সবসময় কল্পনা করে এসেছি আর স্বপ্ন দেখে এসেছি। আর এসবের মধ্যমণি বা মূল চালিকাশক্তিই হলেন অভিজিৎ রায়। দাদার একেকটি লেখা যেন চাবুকের মত অভিঘাত তৈরি করত। প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস,সংস্কার,কূপমন্ডূকতা আর অন্ধবিশ্বাসের খোলনলচে ধরে যেন টান দিত। শুধু মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়ে যেতাম, যেহেতু লেখার সামর্থ্য ছিল না। এখনো সেই সামর্থ্য অর্জন করতে পারিনি। তবে দাদার পর একটা প্রকট শূন্যতা তৈরি হল। পাশাপাশি মুক্তমনার ভেতর থেকেই কারো কারো অন্তর্ঘাতী তৎপরতায় অনেক পুরনো ব্লগারই মুক্তমনা থেকে সরে গেলেন। সেই কারণেই আমার মত চুঁনোপুটিও হয়ত মাঝেমাঝে একটু লেখার চেষ্টা করে। আর রক্তঋণ ত আছেই। দাদা তার রক্ত দিয়ে আমাদের দায়ী করে গেছেন। সেই ঋণ ত আমরা কোনদিনই শোধ করতে পারব না শুধু চেষ্টা করে যেতে পারি।
দাদার হত্যার খবরটা যখন পাই, তখন সবে ঘুম থেকে উঠেছি। আমাদের এখানে তখন সকাল। অভ্যেসমত ফেসবুকে একটু উঁকি দিতে গিয়েই কারো পোস্টে খবরটা পেলাম। মনে আছে সংগেসংগে চিৎকার দিয়ে উঠেছিলাম। এর আগের দিনও মুক্তমনায় দাদার লেখা পড়েছি। তখনো পারভেজ আলমের সাথে দাদার ঐতিহাসিক বিতর্কের রেশ কাটেনি। যেভাবে পারভেজ আলমকে উনি ধরাশায়ী করেছিলেন তা প্রায় ক্লাসিক হিসেবে ধরা যায়। কয়েকদিন ধরেই ভাবছিলাম উনাকে ফেসবুকে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাব। ঠিক সেইসময়েই এই ঘটানাটা ঘটে গেল। মনে হল আমাদের কাছ থেকে যেন কি একটা ছিনিয়ে নেয়া হল। আমি আরজ আলী মাতব্বর,শওকত ওসমান,আহমদ শরীফ, হুমায়ূন আজাদ সহ আরো কিংবদন্তী প্রথাবিরোধী অবিশ্বাসী যারা ছিলেন তাদের কারো সাথেই সরাসরি পরিচিত হবার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারিনি। সেখানে অভিদার সাথে সরাসরি যোগাযোগ হবার সবরকম সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তা করতে পারলাম না। আমি বেঁচে ছিলাম অভিজিৎ রায়ের সময়ে এই গর্ব সবসময় অনুভব করলেও তার সঙ্গে দেখা না হবার, কথা না বলবার দু:খ ত আর কখনো যাবে না।
আসলে অভিজিৎ দা সহ অকালে প্রাণ বিসর্জন দেয়া অন্যরা কি জানতেন তারা অনেকটা মহাভারতে বর্ণিত পৌরাণিক সংশপ্তক যোদ্ধাদের মতই ছিলেন। নইলে বাংলাদেশ বসে ধর্ম নিয়ে বিশেষ কিরে ইসলামের সমালোচনা করা ত মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই যুদ্ধে যাবার মত। পুরো বিশ্বেই ইসলাম নিয়ে লেখলেখি করা ভীষণ বিপদজনক। অনেক ইসলাম ধর্মাম্বলম্বীই এ ব্যাপারে দারুন অসহিষ্ণু। অবশ্য মডারেটরা প্রায়ই লেজূড় জুড়ে দেন তারাই সবচেয়ে শান্তিকামী আরা সহনশীল তবে ধর্ম নিয়ে এভাবে না বললেই ত চলে। এই একটা লাইনের মধ্যেই যে সব অসহিষ্ণুতা লুকিয়ে আছে তা তারা যেন বুঝেও না বোঝার ভান করেন। সেখানে অভিদা যে মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে অবিশ্বাস ও নাস্তিকতার ভিত্তি জোরদার করে প্রবল আলোড়ন তৈরি করেছিলেন সেখানে তিনি যে প্রাইম টার্গেট হবেন তা বলাই বাহুল্য ছিল। তারপরও তিনি সরল বিশ্বাসে দেশে গিয়েছিলেন। এমনকি সন্দেহজনক চরিত্র ও আচরণের লোকদের সাথে দীর্ঘসময় অবস্থান করেছেন। আসলে সব মানবতাবাদী মানুষদের মতই তারা মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ মনে করতেন। বিশ্বাসের ভাইরাস বইয়ের লেখক হয়েও তিনি এই ভুল করেছিলেন। এই ভাইরাসে আক্রান্তরা যে আসলে পুরোপুরি মানুষ নন খন্ডিত মানুষ এটা যার বোঝার কথা সবচেয়ে বেশি তিনিই তা বুঝলেন না। বাংলার কল্পিত হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য আর তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অগাধ আস্থাই তার কাল হল।
একটা কথা আমার সবসময়ই মনে হয় যে শিক্ষাদীক্ষা,অর্থনীতি সহ আরো নানাবিধ বৈষয়িক ব্যাপারে একটি মুসলমান দেশ যতই উন্নতি লাভ করুক তার সাথে অসাম্প্রদায়িক চরিত্র বা রাষ্ট্র বিনির্মাণ করার কোনোই সম্পর্ক নেই। ইসলাম ধর্মের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য বা কাঠামোগত বিশ্বাসের জন্যই তা মোটামুটি অসম্ভব। এখন অবশ্য অনেকেই মনে করেন বিজ্ঞানশিক্ষার প্রসারের সাথে সাথে সব গোঁড়ামি,অন্ধকার দূর হয়ে যাবে। অন্যদেশগুলোর কথা জানি না, মুসলমান অধ্যুষিত দেশে যে এটা এত সহজ নয় তা জোর দিয়েই বলতে পারি।
কিন্তু অভিদার মত যারা আলো হাতে অন্ধকারের যাত্রী তারা যতই প্রতিকূলতার সম্মুখীন হোন না কেন,নিরাশার অন্ধকারে চারদিক যতই নিমজ্জিত থাকুক তারা স্বপ্ন বিলিয়েই যাবেন। কোন মৃত্যুভয়কেই তারা পরোয়া করতেন না। অভিদা ত তার জীবন দিয়েই তার প্রমাণ দিয়ে গেলেন। নাহলে এতবার এতজন না করা সত্ত্বেও তিনি দেশে আসতেন না। যাই হোক সেই আলোর মশাল যদি আমরা এখন সব দ্বিধা,ছদ্মবেশ,সংকীর্ণতা ত্যাগ করে বহন করতে পারি; তাহলে হয়ত আমাদের জীবদ্দশায় না হলেও ভবিষ্যতে কোন একদিন মানবতাবাদী,ধর্মীয় বিভেদহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা হতে পারে। অভিদার স্বপ্ন তার জীবন দান একমাত্র তখনোই স্বার্থক হতে পারে।