বাংলা প্রবাদ হলো পোড় খাওয়া জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্জাত বাণী।যে বাণীগুলির চিরন্তন আবেদন এখনও আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে জ্ঞাতে অজ্ঞাতে বহন করে চলেছি।বাংলাভাষায় প্রচলিত সকল প্রবাদ প্রবচন যদি এক ব্যক্তির রচনা হতো তবে নিঃসন্দেহে তিনি শুধু বাংলাদেশের নয় পুরো বিশ্বে একজন শীর্ষ দার্শনিকের সম্মান পেতেন।কিন্তু প্রবচনগুলি এক ব্যক্তির বা কোনো বিশেষ সময়ের রচনা নয়।এগুলি যুগে যুগে রচিত হয়েছে আর এগুলির রচয়িতা উচ্চমার্গীয় পন্ডিত থেকে শুরু করে গ্রামের অশিক্ষিত সাধারণ মানুষ।এই প্রবাদ প্রবচনগুলির ভেতর লোকিয়ে আছে বাংলার লোকায়ত জীবনের হাজার বছরের সমাজ চিত্র।এগুলি বিশ্লেষণ করেই বাংলার প্রাচীন সমাজ জীবনের অনেক অজানা তথ্য আবিষ্কার করা সম্ভব কিন্তু এ লেখার উদ্দেশ্য প্রাচীন সমাজ চিত্র নয় বরং একেবারে সাম্প্রতিক রাজনীতি ও তার আশপাশের জগতকে প্রবাদ প্রবচনের আলোকে বিশ্লেষণ করা। চলুন দেখা যাক আমাদের রাজনীতি ও রাজনীতি সংশ্লিষ্ট বিচিত্র প্রেক্ষাপট নিয়ে আমাদের বাস্তবদর্শী মহাজনেরা কতটুকু আগাম বলে যেতে পেরেছেন।

আমাদের দেশের স্বাধীনতার বয়স সাড়ম্বরে চার দশক পেড়িয়ে গেলেও সত্যিকারের প্রজ্ঞাবান দেশপ্রেমিক শাসক আমরা ক’জন পেয়েছি তা গবেষণা সাপেক্ষ।কিন্তু শুধু চল্লিশ বছর বলি কেন বাঙ্গালীর গণবান্ধব বা জনবান্ধব শাসকের হাহাকার বোধহয় সুদীর্ঘ কালের আর এই হতাশা থেকেই বাঙ্গালী জেনেছে ‘যে যায় লংকায় সেই হয় রাক্ষস’ এই সত্যটি।বাংলার মসনদটিকেই বাঙ্গালী লংকা বলে ধারণা করেছে সুতরাং লংকা যেখানে সেখানেই রাক্ষস এটাই সহজ সমীকরণ।অবশ্য রাবন আর তার গুষ্টি কুটুম্ব কেমন রাক্ষস ছিল সেটা ঐতিহাসিক বিতর্কের বিষয় তবে আমাদের দেশের গদ্দিনাসীন রাক্ষসদের যে ‘দেশ গিলে খাওয়া’ রাক্ষস হিসেবেই কল্পনা করা হয়েছে তা বলাই বাহুল্য।এ প্রবাদটি মনে করলে চারদিকে লুন্ঠনের মহোৎসব তথা ‘হরি লুট’ দেখেও মনে কিছুটা স্বান্তনা খুঁজে পাওয়া যায়।

‘দশ চক্রে ভগবান ভুত’ একটি সংস্কৃতজাত প্রবাদ।একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে এর সমার্থক আরেকটি প্রবাদ আছে ‘দশের মুখে সংক্রাইত’(সংক্রান্তি) প্রবাদ দুটি আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার এক মূর্তমান ছবি। বিশেষ করে মুর্খের দেশে গণতন্ত্র এই ফসলই দিচ্ছে। শিক্ষার অর্থ যদি হয় মনের দরজা জানালা খোলে বাইরের আলোকে অন্তরে ধারণ করা তবে সে অর্থে আমাদের দেশে শিক্ষার হার শ’য়ে দুতিন ভাগ হবে কি? এজন্যেই প্রতি পাঁচ বছর পর পর আমরা বিপুল উদ্যমে ভুতদের ভগবান বানাচ্ছি আর ভগবানদের ভুত। পশ্চিম বাংলার বুদ্ধদেব আর ত্রিপুরার মানিক সরকারের মতো সৎ মানুষ আমাদের দেশে কম হলেও একেবারে বিরল নয় কিন্তু এই সৎ  মানুষগুলি জামানতের টাকাটাও তুলতে পারেননা আর তাদের বিপরীতে যারা চোর বদমাশ ডাকাত বলে সমাজ স্বীকৃত কখনো আত্নস্বীকৃত তারাই লক্ষ লক্ষ দলকানা মুর্খের দুর্বিনীত রায়ে ভগবানের আসনে অভিসিক্ত হচ্ছেন।

আমাদের দুই নেত্রীর ক্ষমতার যে লড়াই চলছে তাতে ‘দুই সতীনের ঘর খোদায় রক্ষা কর’ এই প্রবাদটিকেই যেন বার বার মনে করিয়ে দেয় যদিও সম্পর্কের দিক থেকে তারা সতীন নন তবে বাংলাদেশকে যদি একটি বৃহৎ যৌথপরিবার কল্পনা করা হয় আর এই সংসারের দুই নেত্রীর ‘সাপে নেউলের’ সম্পর্কটাকে একটু বিশ্লেষণ করা হয় তবে উপরুক্ত প্রবাদেরই প্রতিধ্বণি শুনা যায়। আসলে এই দুই সতীনের দ্বৈরথে দেশটার যে কী হবে তা মহাকালই জানে। আবার এদের এই বিরতিহীন জঙ্গের সিপাহি লাঠিয়াল এদেশেরই ভূখা নাঙ্গা মুর্খ জনতা। শুধু শুধু কিছু উচ্ছিষ্টের আশায় এরা রাজপথে অকাতরে প্রাণ দেয়। হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ এলাকায় একটি প্রবাদ আছে ‘হরিপালের টাকা আর কটুপালের নাচ’। হরিপাল ছিলেন মস্ত ধনাঢ্য ব্যক্তি তার অগাধ বিত্ত বৈভব পক্ষান্তরে কটুপাল এক দরীদ্র দোকানদার ফেরী করে করে কোন রকম দিন গুজরান করা মানুষ। কিন্তু কটুপালের মনে কোনও দুঃখ ছিলনা।তার দরীদ্রক্লিষ্ট মনে সব সময় লেগে থাকতো হরিপালের বিত্তের সুখোপলব্ধি।হরিপাল যতই নতুন নতুন বিত্তের অধিকারী হতেন কটুপাল ততোই আনন্দে আত্নহারা হয়ে চিত্তসুখে নাচতেন।এ থেকেই এ প্রবাদটির জন্ম হয়। দেশের বেশীরভাগ মানুষই সম্ভবত এখন কটুপালের ভুমিকায় অবতীর্ন।দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দুই নেত্রীর অনড় অবস্থানে ‘ভাঙ্গবে তবু মচকাবেনা’ এই কথারই প্রতিফলন ঘটছে। এক্ষেত্রে ‘উবে (খাড়াভাবে) ডুবে যেতেও রাজী কিন্তু গুঁজা হয়ে ডুব না দেয়ার’ বাগধারাটিকেও স্মরণ করা যেতে পারে।

আবার এই বিপুল সংখ্যক লাঠিয়াল ছাড়াও এই দুই নেত্রীর আরেকদল উমেদার আছেন যারা শিক্ষিত সুশীল(ব্যরিস্টার নাজমুল হুদার ভাষায়’ সু-শীল=ভাল নাপিত) যাদের কেউ কলমকে লাঠি বানিয়ে কেউ গলাকে বোমা বানিয়ে নেমে গেছেন যুদ্ধে। এদের এই চিৎকার চেঁচামেচিতে সেই প্রবাদটির কথাই মনে পড়ে ‘যার মড়া সে খায় মাছে ভাতে আর কাইন্ধা মরে যোগীর সাত পুতে’। দেশে যোগীপুত্রদের সংখ্যা যত বাড়বে দেশে অনাচারও বাড়বে বুলেট ট্রেনের গতিতে।

এরশাদকে নিয়ে মানুষের হাসাহাসির শেষ নেই। তার পতনের উষালগ্নে দেশের মানুষ একযোগে তাকে বিশ্ব বেহায়ার তকমা দিয়েছিল। কিন্তু এরশাদের জন্মেরও শত শত বছর আগে বাংলা প্রবাদে এই বেহায়ার সংজ্ঞা দেয়া হয়ছিল এরকম ‘বেহায়ার এ বাড়িও আমার, ওবাড়িও আমার’। সুতরাং এরশাদের এঘর ওঘর অর্থাৎ আলীগ বি এন পি করাতে দোষের কী আছে ? দু’টিইতো তার।আবার এই বেহায়া নিয়েই আরেক প্রবাদ ‘বেহায়া মাওই আর দানা ভাঙ্গা কাঁকুই’ সমার্থক বস্তু।কাঁকুইর দাঁত ভেঙ্গে গেলে এটি যেমন আর কাঁকুই থাকেনা বর্জ হয়ে যায় তেমনি হায়া নামক বৈশিষ্টটি চরিত্র থেকে খসে পড়লে মানুষ আর স্বাভাবিক মানুষ পদবাচ্য থাকেনা।‘দুয়ার টানা’ বা দুয়ারে ধাক্কা দেওয়া বড় বড় অফিস কাচারির দরজাতেই লেখা থাকে এটা একটা বৈধ ক্রিয়া হিসেবেই চর্চিত কিন্তু গ্রামীণ বাগধারায় যখন ‘দুয়ার টানা’ বলা হয় তখন এর গূঢ়ার্থ অন্য রকম হয়ে যায়।লাম্পট্য চরিতার্থ করতে অন্যের ঘরে গমন বা হানা দেয়া বুঝাতেই এই রুপকের সৃষ্টি।এরশাদের নান্দনিক চরিত্রেও এটি ছিল এক অনন্য অনুসঙ্গ।অবশ্য তাকে কষ্ট করে কখনও দুয়ার টানায় যেতে হয়নি বরং হা-মুখ দুয়ারগুলিই তার বেডরুমে স্বয়ং হাজির হয়ে যেতো।ধর্মশাস্ত্র বলে রাজদর্শন নাকি পরম পূণ্যের কাজ এমন কি স্বপ্নযোগে রাজ-দর্শন হলেও সৌভাগ্য দুয়ারে কড়া নাড়ে। তাহলে রাজ-ধর্ষণে যে কি পরিমান পূণ্য তা নিরুপন করার দায়িত্ব নাহয় শাফি আল্লামাদের উপরই ছেড়ে দেয়া ভাল কেননা ‘কী করিলে’ কত ইউনিট সওয়াব অর্জন হয় তা নির্ধারণের বাটখাড়া তো তাদেরই হাতে। শুধু পোড় খাওয়া বাস্তববাদী মানুষ জানে একটি রাজ তথা এরশাদ-ধর্ষণে জাতীর তথা দরীদ্র জনগণের কি পরিমান অর্থ সম্পদ গচ্ছা দিতে হয়েছে।রাজ-ধর্ষনের মোহ এতই অনতিক্রম্য যে এরশাদকে যখন প্রেসিডেন্ট শাহাবুদ্দিন জেলে পুরেছিলেন তখন সংসদ এলাকার জেলেও লীলাপ্রিয় ললনাদের লাইন পড়ে গিয়েছিল।বি এন পির কজন সাংসদ তখন বেশ রসালো ভাবে সংসদে প্রশ্ন তুলেছিলেন ‘এটা জেল না বৃন্দাবন বানানো হয়েছে?আবার এরশাদকে এককভাবে কলংক তিলক দেয়ার বিরুদ্ধেও বাংলাপ্রবাদ সোচ্চার।এরশাদকৃত হেন দুষ্কর্ম নেই যা আমাদের দুই নেত্রী করেননি বা করছেননা।একমাত্র লিঙ্গনির্ভর কর্মকান্ডগুলি এরা করতে পারেননি কেবল লিঙ্গভেদের কারণে।তাহলে এরশাদকেই কেন এককভাবে সব দুষ্কর্মের দায় বহন করতে হবে?এক্ষেত্রে এরশাদ সেই প্রবাদগুলিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন যেমন ‘সব মাছে গু খায় লাইড়ার উপর বদনাম যায়’ ‘যত দোষ নন্দঘোষ’ অথবা ‘যত মরা ভাইয়া যায় পদ্মারে ছুঁইয়া যায়’ ইত্যাদি। অবশ্য এরশাদের এই আত্নপক্ষ সমর্পণকে বেরসিকরা ‘বেহায়ার মুখ জোড়া’ বলে মশকরা করতে পারেন তাতে কী, এরশাদতো আসলেই তাই।

নষ্ট রাজনীতি সমাজের সব ক্ষেত্রেই ভয়ানক ক্যান্সারের বিস্তার ঘটিয়েছে। বিচার বিভাগও সেই আগ্রাসন থেকে মুক্ত নয়।রাজনৈতিক বিবেচনায় যখন সব ক্ষেত্রে লোক নিয়োগ হয় তখন সত্যিকার যোগ্য ব্যক্তিরা বাদ পড়ে যান আর অযোগ্য আগাছারা সে স্থান দখল করে নেয়।বিচার বিভাগেও এরকম হর হামেশা ঘটছে।এক বিচারপতিকে পাওয়া গেল যার সার্টিফিকেটই ভূয়া।আরেকজনকে আবিষ্কার করা হলো মার্কশীটে ঘষা মাজা করে উত্তীর্ণ হয়েছেন।আরেকজনকে পুলিশ গ্রেফতার করলো বমাল।গাড়ীর ভেতরে ফেনিসিডিল বা ডাইলের বিপুল কালেকশন।আরেক পরম ধার্মিক বিচারক মাহমুদুর রহমানের আমার দেশ থেকে সেক্যুলার ব্লগারদের ব্যক্তিগত ব্লগের ফটোকপি করে সকল বিচারকের টেবিলে টেবিলে পৌঁছে দিয়েছিলেন।হাজার হাজার রায় হচ্ছে ‘নগদ নারায়নের’ কল্যাণে।সাদাকে কালো কালোকে সাদা করা হচ্ছে।এটাও বাঙ্গালীর নতুন অভিজ্ঞতা নয়।একেবারে যখন কাজীর বিচার সমাজে প্রচলিত ছিল তখন থেকেই।পোড় খাওয়া বাঙ্গালী তখনই তৈরি করেছিল ‘কাজীর ঘরে আঠার পুঙ্গা’(জারজ) এই প্রবাদটি।বিচার বিভাগ কি এই অবস্থা থেকে উত্তরন করতে পেরেছে ?

দুর্নীতিতে বাংলাদেশের হেট্রিক চ্যাম্পিয়নশীপের গল্প পুরনো।তবে ব্যাংকিং খাতের সাম্প্রতিক দূর্নীতিকে আমলে নিয়ে টি আই বি রিপোর্ট করলে চ্যাম্পিয়নশীপের মেডেলটা ফের ফিরে আসার সম্ভাবনা আছে।পূর্বেও সমাজে দুর্নীতি ছিল কিন্তু তার পরিসর এত ব্যাপক ছিলনা তবুও কালীক প্রেক্ষাপটে বৃহৎ বলে খ্যাত দুর্নীতিকে বলা হতো ‘পুকুর চুরি’ কিন্তু বর্তমানের আকাশ সমান উঁচু দুর্নীতিগুলিকে এই ‘পুকুর চুরি’র সংজ্ঞায় আর ফেলা যায়না তাই মাননীয় অর্থমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন পুকুর নয় সাগর চুরি হয়েছে।এই সত্য প্রকাশের জন্য তিনি ধন্যবাদ পেতেই পারেন কিন্তু তিনি বা তার মন্ত্রনালয় তথা সরকার কী করছিল ?তারা কি অথর্ব ‘স্বাক্ষী গোপালের’ভূমিকাই পালন করেনি?যে প্রতিষ্টানের যে কর্ণধার যাকে যে বিভাগ বা মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় তিনিই প্রতিষ্টানটিকে তার খাদ্যে পরিনত করেন।দূর্নীতির ‘কালোবিড়াল’ ধরার প্রত্যয় নিয়ে নিজেই যদি কালোবিড়াল হয়ে বমাল ধরা পড়ে যান তাহলে একে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করবেন?হাঁ এ অবস্থাকে প্রবচনের ভাষায় বলা হয় ‘বেড়ায় ধান খাওয়া’।বাংলাদেশের বেড়াগুলিই মোট সম্পদের বড় অংশটি খেয়ে ফেলছে।যে যেখানে যোগ্য নয় রাজনৈতিক বিবেচনায় যদি তাকেই সেখানে বসিয়ে দেয়া হয় অর্থাৎ ‘সুটকির নাওয়ে বিলাই চৌকিদার’ নিয়োগ দিলে সুটকির হেফাজত যেরকম হওয়ার কথা তাইতো হচ্ছে এতে বিষ্ময়ের কী আছে।এখানে ‘নগদ নারায়ন’এর কল্যাণে ‘বাঘের দুধ’ও মিলে।এ সমাজে ‘টাকার নাম জয়রাম টাকায় হয় সব কাম’।আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক প্লাটফরম হলো রাতারাতি ভাগ্য পাল্টানোর এক মোক্ষম মাধ্যম।প্রায় দিগম্বর অবস্থায় যদি কেউ রাজনীতিতে যোগ দেয় কিছুদিনের মাঝেই সে নেম ব্র্যান্ড ছাড়া কাপড় পড়বেনা।তার বেন্নাপাতার চাওয়া পাখীর বাসাটি ভোজবাজীর মতো রাতারাতি আলীশান দালান হয়ে যাবে।একেবারে ‘আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ’ অবস্থা।আর দলগুলিতে এই কলাগাছের সংখ্যা এখন এত বেশী যে এদেরকে বাছাই করতে গেলে ‘টগ বাছতে গা উজাড়’ বা ‘লোম বাছতে কম্বল উজাড়ে’র দশা হবে।

এবার একটু ব্যক্তি প্রসঙ্গে আসি। এসময়ের এক আলোচিত চরিত্র হলো দেলোয়ার হোসেন সাঈদী। এই লোকটি সাকা চৌধুরীর মতো উন্নতশির রাজাকার ছিলনা অথবা মীরপুরের কসাইখ্যাত কাদের মোল্লার মতো এতবড় কুখ্যাতিও তার ছিলনা।কিন্তু কালে কালে এই লোকটিই মুক্তিযুদ্ধের এক ভয়ানক প্রতিপক্ষ হয়ে উঠল। সাধারণ ডালা দোকানদার থেকে এক সাধারণ রাজাকার। তারপর লুন্ঠণ খুন। স্বাধীন বাংলাদেশে তার আবির্ভাব তার সুললিত গলা নিয়ে। ওয়াজমাহফিলে ওয়াজ করে করে একদিন সে আবিষ্কার করল মানুষ ভাল খাচ্ছে।সে গলার রেওয়াজ বাড়িয়ে দিল।ইংরেজী শক্ত শক্ত শব্দ সে ভাষণে সেঁধিয়ে দিতে শুরু করল এমনকি অনেক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব যা্র মাথামুন্ডু তার নিজের মাথাতেই ঢুকার কথা নয় ঢুকিয়ে দিতে থাকল তার বয়ানের ভাঁজে ভাঁজে। তার আকর্ষণীয় গলাটি যে নিজেরই অজান্তে তার জন্য কাল হয়ে উঠতে যাচ্ছে তা সাঈদী না বুঝলেও হাজার বছর আগের চর্যা কবি ঠিকই ধরেছিলেন ‘আপনা মাঁশে হরিণা বৈরী’ উচ্চারণের মাধ্যমে। তার গলা বেপরোয়া হয়ে ওঠে।গ্রাম্য প্রবাদে যেমন বলে ‘কঁচু কাটতে কাটতে হাত বাড়ে’ তেমনি সাঈদী, সাঈদীর সাহস গলার তুজুর্বা চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়তে থাকে। সুযোগ পেলেই সে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে টাট্টা বিদ্রুপ করত। বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে গিয়ে মুলতঃ একাত্তরে তাদের কৃত বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডকে জায়েজ করার হীন কাজটি সে বেশ সুচারু ভাবেই করছিল। তার জনপ্রিয়তা আকাশ্চুম্বি হয়ে ওঠে। খুঁদ আওয়ামীলীগেই তার অগনন ভক্ত সৃষ্টি হয়। সে নবীর পর্যায়ে চলে যা্য। ইসলামে নবুয়তিপ্রাপ্তিকে সীল গালা করে বন্ধ না করে দিলে সাঈদী নিশ্চিতভাবেই নবুয়তের দাবী করত এবং দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ তা বিশ্বাসও করতো।তার চাঁদে আরোহন পর্বটি যদি দীর্ঘায়িত হতো তবে হাজার বছরের প্রচলিত চরকা বুড়ির উপাখ্যান মুঁছে দিয়ে সেখানে চরকাবুড়ার উপাখ্যান সংযোজিত হয়ে যেতো।সাঈদী ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে এভাবেই নিজেকে রাজাকারের ‘চুনোপুটিঁ ক্যাটাগরি থেকে ‘রুই কাতলা’ ক্যাটাগরীতে উন্নীত করে ‘আটারো শিকে’র ভিতর নিদারুন কালাতিপাত করছে। গ্রামীণ প্রবাদে আছে ‘ফকির মরে মেলে আর খাটাশ মরে তেলে’ সাঈদীর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। অবশ্য খাটাশ মরে তেলে’র একটি ভিন্নপাঠও আছে যেখানে খাটাশ এর জায়গায় পাঁঠা আর তেল এর জায়গায় পাঁঠার বিশেষ একটি অঙ্গের কথা বলা হয়েছে কিন্তু তা লিখিতব্য নয় বলে ক্ষান্ত দিলাম।

দেশের হুজুরদের লম্প ঝম্প আর ক্ষমতা দখলের খোয়াব দেখে ‘গুঁজারও কি সাধ নাই সোজা হয়ে শোয়ার’ এই বাগধারাটিকে মনে করিয়ে দেয়। অবশ্য হুজুরদের নিয়ে আরেকটি চমৎকার কথা আছে যেমন ‘এরা মাইরেও ফার্স্ট দৌঁড়েও ফার্স্ট। এর প্রমান মিলেছে শাপলা কান্ডে। পুরো এলাকায় অবর্ণনীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যখন দৌড়ের পালা এলো তখন এরা উসান বোল্টকেও হার মানিয়েছে। ঘটনাটি দিনে ঘটলে এর ভিডিও চিত্র দেখে বিএনপির দৌড় সালাউদ্দিনও শিরোপা হারিয়ে নামের আগ থেকে দৌড় শব্দটিকে বাদ দেবার জন্য প্রেস কনফারেন্স করতেন।

মূখরা রমনী বশীকরণ’এর সত্যিকারের কোন মন্ত্র যদি থাকতো তবে আওয়ামীলীগ হাজার কোটি টাকা খরচ করেও তা কিনতো কারণ তাদের মূখরা নেত্রীর কথাবলা মুখ তাদেরকে বার বার বিপদের মুখে ঠেলে দেয়।আওয়ামীলীগের নীতিনির্ধারকেরা প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় যে সমস্যাকে একটি সমাধানের দিকে নিয়ে আসেন তাদের নেত্রীর এক কথাতেই তা ভন্ডুল হয়ে যায় এ যেন ‘হাজার কোপে লাঙ্গল আর এক কোপে চেলী বা লাকড়ি’ করে দেবার ঘটনা।সব ব্যাপারে শেখ হাসিনার কথা বলার একটা প্রবনতা আছে একেই প্রবাদের ভাষায় বলা হয় ‘সব পাতিলে লবন দেয়া’।মাত্রা না বুঝে সব পাতিলে লবন বিলালে খাদ্যও যে অখাদ্য হয়ে যায় তাতো আমরা সবাই জানি।গত বছর দেশী বিদেশী বিনিয়োগকারীদের এক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণের এক জায়গায় বলে বসলেন-‘কবি জীবনানন্দ বলেছেন,এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।ভীনদেশীদের মাঝে বাঙ্গালী না থাকলে কোনও কথা ছিলনা কিন্তু বিপদ হয়েছে ভারতীয় প্রতিনিধি দলে ক’জন বঙ্গালীও ছিলেন যে।কোনটা জীবনানন্দের আর কোনটা ডি এল রায়ের বচন এটা নিশ্চয় তাদের অজানা ছিলনা।বহু বছর আগে শেখ হাসিনার ‘দুই নাওয়ে পাও দেওয়া’ তত্ত্বে আওয়ামী ভোটব্যাংকে ভূমিকম্প শুরু হয়ে গিয়েছিল পরে বহু চেষ্টায় তা ফিক্স করা হয়।এজন্যই মহর্ষি কনফুসিয়াস একটি অমূল্য কথা বলে গেছেন-‘মৌনতা হলো গাছের বাকল যা গাছকে রক্ষা করে’।আর আমাদের দেশের অখ্যাত কনফুসিয়াসই কম যান কিসে প্রায় সমার্থক একটি প্রবাদই বাংলাতে আছে ‘বান্ধা ঝাঁপি লাখ টাকার মূল’।খালেদা জিয়ার ভক্তবৃন্দ অবশ্য গর্ব করে বলতে পারেন আমাদের নেত্রীর এমন বাহুল্য কথার অভ্যেস নেই কারণ ‘ফাপা কলস আওয়াজ দেয় বেশী’ আমাদের নেত্রী হলেন জ্ঞানে গরিমায় মহীয়ান কথায় বলেনা ‘ভরা কলস নড়েনা’।কিন্তু কথা কম বলারও যে ভীষণ কুফল আছে তাও বাংলা প্রবাদে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে এরকম ‘ম্যানা গরু হানা মারে গুটের গরু কানা করে’। বিভিন্ন সময়ে খালেদা জিয়ার বিভিন্ন বিতর্কিত বক্তব্য যেমন শাহবাগের জনতামঞ্চে জড়ো হওয়া লক্ষ মানুষকে নাস্তিক বলে কটুক্তি করা হেফাজতিদের পাশে দাঁড়ানো যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দেয়ার দাবী বা মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ গুটের গরুতো গরু দেশের জনগণকেই কানা করে দেবার শামিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে বিদেশী হ্যাকাররা।কিন্তু আমাদের দেশের সরকার ও সরকার প্রধানের আচরন দেখে মনে হয় এ আর কি এতো আমাদের ‘হাতের ময়লা’। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরুত্তাপ উদ্বেগ আর ফিলিপাইন জুড়ে হৈ চৈ দেখে সেই পুরনো প্রাবাদকেই যেন মনে করিয়ে দেয় ‘যার বিয়া তার দেখা নাই আর পাড়া পড়শীর ঘুম নাই’ ইত্যাদি।যারা এই সাগরচুরিতে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল বলে কানাঘুঁষা তারা দিব্যি চেয়ার আগলে বসে আছে আর দরীদ্রবান্ধব হিসেবে পরিচিত গভর্নর ভদ্রলোককে তাৎক্ষণিকভাবে পদত্যাগ করতে বাধ্য করার মাধ্যমে যেন ‘ঢাকাত চোরে চুরি করে আর আচোরা পথে মরে পড়ে’ প্রবাদেরই প্রতিফলন।চোরের আদ্যোপান্ত নিয়ে ফরাশউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্তাধীন তদন্ত কমিটীর রিপোর্ট সহ দেশে লক্ষ লক্ষ তদন্ত রিপোর্ট চির অপ্রকাশিতই থেকে যাচ্ছে।সবকিছু কি যেন একটা রাখঢাকের গ্যাঁড়াকলে আটকা পড়ে থাকে।এ অবস্থাকে বুঝাতেই বোধহয় ‘গুপ্তে গুমাংস খায় জানতে পারলে জাত যায়’ প্রবাদটির জন্ম হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিলম্বিত প্রতিক্রিয়া দেখে গ্রামবাংলার সেই প্রবাদ ‘হাই মরল হাইঞ্জাবেলা আর কাইন্ধা উঠলা পতা বেলা’(স্বামী মরলো সন্ধ্যাবেলা আর কেঁদে উঠল প্রাতবেলা)এই প্রবাদটিকেই মনে করিয়ে দেয়।বাংলাদেশ ব্যাংক বিশ্বাস নিয়ে বসে আছে হারানো টাকা তারা ফেরত পাবে কিন্তু আমাদের মনের খচখচানীতো যায়না কারণ আমরা জানি ‘পরের হাতে থুইয়া যে কয় আছে তারে খায় বোয়াল মাছে’।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আতিশয্যের মাত্রা এখন ঐতিহাসিক পর্যায়ে।পথে প্রান্তরে অলিতে গলিতে এখন শুধু পিতা পিতা বলে হাহাকার শুনা যায়।পিতার ছবিকে পাশে নিয়ে পুত্রদের কোটি কোটি পোষ্টারে বাংলাদেশ ছেয়ে যাচ্ছে।এই বিপুল পুত্র সমাহার দেখে ‘বহু পুতে বাপ নির্বংশ’ প্রবাদের আশংকাই বুকে জেগে ওঠে।কারণ এরাতো পুত্র নয় পুত্রের ভান ধরা ‘দুধের মাছি’ ‘তীর্থের কাক’ বা বসন্তের কুকিল।

সংস্কৃতে ‘ভৃত্ত নায়ক বালক নায়ক আর স্ত্রীনায়ক এই তিন নায়ককে ভয়াবহ বলে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। ইতিহাসে ভৃত্ত নায়কদের অনেক ‘তুগলকি’ কান্ড আমরা প্রত্যক্ষ করেছি আর স্ত্রীনায়কদের দুঃশাসনের অভিজ্ঞতা আমাদের চেয়ে আর কার বেশী আছে। বাকী রয়েছে বালক নায়কের শাসন দেখা।যদিও বিগত জোট শাসনামলে আমরা এর কিঞ্চিত স্বাদ পেয়েছি আংশিক পার্শ বালকনায়ক হিসেবে। আশা করি খুব শীঘ্রিই আমাদের সেই স্বাদ ‘ষোল কলায়’ পুর্ণ হবে। কেমন হবে সেই বালক শাসন ? তা নাহয় ভবিতব্যের কাছেই জমা থাক। তবে দুই যুবরাজের কিছু মুল্যায়ন আমরা করতেই পারি।অগ্রজজনদের প্রতি শব্দ প্রয়োগে তারেক আর জয়ের বেশ ভাল একটা সাযুজ্য লক্ষ্য করা যায়।এতে আগামী দিনের রাজনীতি যে বর্তমানের চেয়ে আরো প্রতিদ্বন্ধীতাপূর্ণ আরও বৈচিত্রময় হবে তা বলাই বাহুল্য।কথায় আছে না ‘সমানে সমানে দোস্থি আর সমানে সমানে কুস্থি’। দোস্থি হবেনা জোর কুস্থি হবে তা সহজেই অনুমেয় কারণ ‘ফুটিতেই চিনা যায় গুটির খবর’ অথবা আরো সহজে বলা যায় ‘মা’র মান ঝি আর গাছের মান গুটা’ অবশ্য এখানে ঝি এর লিঙ্গান্তর করে পড়তে হবে ‘পুত’ যেমন বাপকা বেটা না বলে বলতে হবে ‘মাইজিকা বেটা।দুজনেরই বয়সের তূলনায় ভারী কথা বার্তা আচার আচরনে ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়’ অথবা ‘বার হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি’ প্রবাদ দু’টিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে এই দুজনের বালসুলভ কথা বার্তাকে ‘বেদবাক্য’ প্রমাণের জন্য দু’দলের পক্ককেশী নেতা এবং দলভজা সুশীলগণ যেভাবে কসরত করে যান অথবা সাম্প্রতিক বহুল আলোচিত রামপাল ইস্যুতে একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীর তেলমর্দনজাতীয় রচনা বা কথন দেখে বা শুনে আমার মনে ‘চামচা’ শব্দটির ব্যুৎপত্তি নিয়ে প্রশ্ন জাগে।চামচা কি চামচ থেকে এসেছে যে চামচ কাপের চা চিনি দুধকে মেশানোর অথবা খাবার দাবার বেড়ে দেয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়? তাহলে এই দুই দলকে আমরা যদি অতিকায় দুই চায়ের গামলা রুপে কল্পনা করি তবে দেখতে পাই দুই গামলাই পরিপূর্ণ হয়ে আছে লক্ষ কোটি চামচে যেখানে দুধ চা চিনি নাই বললেই চলে।কথায় বলে ‘এক পাতে খেলে হাড়ি পাতিলেও টুকাটুকি হয়’ আর শূণ্য গামলায় লক্ষ চামচ থাকলে ফলাফল যা হবার তাই হচ্ছে অর্থাৎ চামচে চামচেই এখন টুকাটুকি চলছে।

এই লেখার শেষকথা হলো আমাদের এই দেশটা এ্ত ঝড়ঝাপটা অতিক্রম করেও এগিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক ভাবেও বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনার কথা বলা হয়ে থাকে। তাহলে আমরা গোটা দেশটাকে যদি পাঁকা সরিষার সাথে তূলনা করি তবে জনগণকে নিঃসন্দেহে বলা যায় বলদ আর তাদের ঘাড়ে স্থায়ী হয়ে আছে দুই বিখ্যাত কলু পরিবারের ঘানি। এজন্য ‘কলুর বলদ’ বাগধারার দৃষ্টান্ত দিতে বাংলাদেশের জনগণকে উপস্থাপিত করলেই স্কুলের বাচ্চারা সহজে এর অর্থ বুঝতে পারবে। অতএব হে ‘ভঙ্গধ্বজ’ জনগণ কাধ থেকে এই ঘানি নামাবার ক্ষমতাই যদি না থাকে তবে কি আর করা ‘যষ্মিন দেশে যদাচার,কাছা খুলে নদী পাড়’ হও, অথবা ‘যেই দেশের যেই বাও, পুঁদ উল্টাইয়া নৌকা বাও’।