ডাউনলোড লিংকঃ পিডিএফ ই-পাব

জন্মেরও আগে, ভ্রূণাবস্থাতেই বইটার সাথে আমার, আমাদের পরিচয়, তাঁর অন্য একাধিক বইয়ের মতনই।

নতুন বই লেখার সিদ্ধান্ত নিলে সাধারণত তিনি ব্লগে লেখা শুরু করতেন, এবং এর আলোচনাসমালোচনার পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ার ব্লগজাগতিক সুবিধে নিয়ে তিনি সম্ভাব্য বইটির পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংশোধন করতেন। কৃতজ্ঞতাপ্রকাশে অকুণ্ঠ ছিলেন তিনি। এমনকি বইয়ের ভূমিকা থেকে আরম্ভ করে পাতায় পাতায় তিনি সহব্লগারদের অবদান, প্রভাব, এমনকি বিরোধের কথাও টেনে এনেছেন। সত্যিকার অর্থে বিনয়াবনত, নির্মোহ, নৈর্ব্যক্তিক একাডেমিক ও সত্যসন্ধানী শিল্পীর মতন তিনি তাঁর সৃজন আরো গুরুতর, আরো রূপদক্ষ, আরো সমৃদ্ধ, আরো বিশ্লেষণাত্মক, আরো অভিনিবিষ্ট করার বিন্দুমাত্র সুযোগ হাতছাড়া করতেন না। ভয়ঙ্কর সিরিয়াস উপাদানসন্ধানী হয়েও তিনি উপাদানগুলো পরিবেশনের সময় যেন যথাসম্ভব ভারমুক্ত ও রসমণ্ডিত হয়ে ওঠে, পাঠাভিজ্ঞতা হয় আনন্দময় এবং পাঠকের মস্তিষ্ক চাপমুক্ত হয়েও আকৃষ্ট হয় সম্যকভাবে, সেদিকে সুতীক্ষ্ণ নজর দিতেন। পপ সায়েন্সের বই লিখতে গিয়ে তিনি সততা, জ্ঞানবিস্তার, ও প্রশ্নোদ্রেকের দিকে দৃষ্টি দিতে যেমন ভোলেননি, তেমনই ভোলেননি ভাষা, উপস্থাপনভঙ্গি ও আকর্ষণের মূলধারা ধারণে।

তবে, বইটা নিয়ে আমার দুটো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে। বলি সেসব।

প্রথমটা ২০১১-এর।

বইটা তখনো সূর্যের আলো দেখেনি, তবে সম্ভাব্যতা বিদ্যমান। ব্লগে ধারাবাহিক লেখাও চলছে, উপভোগ করছি সেসব পুরোমাত্রায়। তবে মন্তব্য করার দক্ষতা, যোগ্যতা, কিংবা জ্ঞান না-থাকায় মনের ভেতর দুচারটে প্রশ্ন এলেও তেমন করা হয় না। তখন বিনামেঘে বজ্রপাতের মতন আমার ফেসবুকের ইনবক্সে একটা গ্রুপ মেসেজ। দিয়েছেন লেখক স্বয়ং, যুক্ত করেছেন সম্ভাব্য প্রকাশককে। এর আগেই অবশ্য তিনি আমায় জানিয়েছেন তাঁর বইটি সম্পাদনার কথা, অপারগতা জানিয়েছি আমার জ্ঞানস্বল্পতা, ও ব্যক্তিগত সমস্যাজনিত কারণে। তবে এটুকুও বলে রেখেছি, বইটির সাথে আমি যথাসম্ভব জড়িত থাকার চেষ্টা করব।

তিনি লিখছেন:

(প্রকাশকের ডাকনাম) ভাই,
আপনার এবং (আমার নাম)-এর সাথে পরিচয় এবং যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার জন্য এই ম্যাসেজ। উনি সময় এবং বিভিন্ন কারণে আমার বইয়ের পুরোপুরি প্রুফ রিড না করতে পারলেও (ম্যাসেজে তাই ঈঙ্গিত করেছেন) বানান রীতি, ভাষা ইত্যাদির উন্নয়নে সাহায্য করবেন বলেছেন। উনাকে দিয়ে প্রাথমিক ড্রাফটটা পড়িয়ে নিতে পারেন। উনার উপর আমার অনে আস্থা। সবচেয়ে বড় কথা উনি উনি নিজেও ইউনিকোডে লিখেন, ফলে কনভার্শনের ঝামেলা পোহাতে হবে না। উনি যা সাহায্য করতে পারবেন, তাতেই আমা্দের লাভ। আপনার দুজন ইমেইলে বা ফেসবুক ম্যাসেজে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে ব্যাপারটিকে চাইলে এগিয়ে নিতে পারেন।

(আমার নাম), সাহায্য করার প্রতিশ্রুতির জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

এটুকুতেই শেষ। এরপর প্রকাশক আর যোগাযোগ করেননি, দুর্ভাগ্যজনকভাবে। এবং বইটির সাথে জড়িত থাকার সুযোগ, তাঁর কোন বইয়ের সাথে জড়িত থাকার সুযোগটি নক্ষত্রের বিমুখিতায় হারিয়েছি।

আমার জীবনের একাধিক তুমুল স্বপ্নের ভেতর একটি ছিল এটি, তাঁর কোন প্রকাশিত বইয়ের সাথে আমি জড়িত থাকব, স্বপ্নে, মাংসে, অস্থিতে, সম্ভব হলে লিখনপ্রক্রিয়াতেও। যুগ্মলেখক হিসেবে না-হোক, অন্তত সম্পাদক হিসেবেও যদি পারতাম…কাছে এসেও সেই সুযোগ আমৃত্যু রয়ে গেল দূরে, আমার জীবন আর নিয়তির এমনই গোলকধাঁধালো পরিহাস!

আহ, বেদনা, দাহ, অশ্রু!

দ্বিতীয় ঘটনাটি ২০১৫-এর।

গেছি একুশের বইমেলায়। দেখা হয়েছিল তাঁর আর তাঁর সহধর্মিণীর সাথে। কথা বিশেষ হয়নি, তাই পরেরদিন তাঁদের সাথে আলাপক্রমে সকালে আরেক জায়গায় বাইরে বসে কথা বলার কথা ঠিক হল। সেইমত তাঁরা এলেন। কথা হয়েছিল অনেক বিষয় নিয়েই, ব্লগজগত, ফেসবুক, বই, জীবন, প্রকাশনা। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন আলোচ্য বইটি, যেটি তিনি ২০১২ সালেই, বেরুনোর পর, আমার হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, আমার অনুরোধেই। এবং, সেটি এই তিন বছরেও আমার হাতে আসেনি। এর আগেরদিন বইমেলায় সেটা নিয়ে দুয়েকটা কথা বলেছিলাম। বইটা তখন ছাপার বাইরে, মেলেনি। তিনি আজ সেটা হাতে করে নিয়ে এসেছেন। বেদনাদায়ক ব্যাপার, তাঁকে সেটায় কিছু লিখিয়ে নেওয়ার কথা মনে থাকেনি আর। ভুলে যাই আমি অনেক কিছুই, কিন্তু কখনো কখনো কিছু খুবই খরুচে হয়ে পড়ে।

আজ বইটা নিয়ে আলোচনা করব দুচার পংক্তিতে।

বইয়ের নাম: ভালোবাসা কারে কয়। লেখক: অভিজিৎ রায় (২০১২)।

‘মানবমনের জৈববিজ্ঞানীয় ভাবনা’এমনটাই লেখা ছিল বইয়ের শুরুতে। তবে, ব্লগপোস্টগুলো যখন লেখা হয়, তখন মূলত নরনারীর পারস্পরিক আকর্ষণের কলকব্জাগুলো বৈজ্ঞানিক মানসিকতার ও মননের আলোকে খুঁটিয়ে-দেখা ও কারণ, সূত্র, সম্পর্ক ইত্যাদি খতিয়ে-দেখাই অন্বিষ্ট ছিল বলে মনে হয়। পুস্তকাকারে প্রকাশনার সময় আরো বেশি কিছু জড়িয়ে ও যুক্ত করে মানব মানসিকতার আরো কিছু বিষয়ে আলোকপাত করা হয়। তিনি যে-বিষয়টির ওপর জোর দিতে চেয়েছিলেন, তার নাম বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান। এর আলোকে তিনি মানব চরিত্র, বৈশিষ্ট্য, ও নানান ধ্যানধারণার বিশ্লেষণ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। বস্তুত, বাংলা ভাষায় তাঁর বইটিই এব্যাপারে পথিকৃৎ আরো একাধিক বিষয়ের মতনই।

তিনি সব সময়েই চেষ্টা করে গেছেন, বাংলাভাষীদের ও পাঠকদের কাছে বিজ্ঞানের কৌতূহলোদ্দীপক প্রান্তিক বিষয়াশয় নিয়ে লেখার ও নতুন দিগন্ত তুলে-ধরার। প্রাণের উদ্ভব ও বিকাশ নিয়ে, মহাবিশ্ব ও মহাশূন্য নিয়ে, সমকামিতা নিয়ে, ঈশ্বরাবিশ্বাস নিয়ে তিনি একের পর এক বই লিখে গেছেন। কিছু কিছু বিষয়ে তো তাঁর লেখাই বাংলা ভাষায় প্রথম প্রকাশনা হয়েছে, যেমন সমকামিতা বা এই বইটির বেলায়।

বইয়ের সূচিপত্রের দিকে নজর দিলে আটটি অধ্যায়ের দেখা মিলবে, যেগুলোর নামকরণেও কাব্যিকতা ও আগ্রহজাগানোর মানসিকতার ছাপ সুস্পষ্ট। যেমন: বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান – মনের নতুন বিজ্ঞান (প্রথম অধ্যায়), ব্ল্যাঙ্ক স্লেট (দ্বিতীয় অধ্যায়), সংস্কৃতির ‘ভূত’ (তৃতীয় অধ্যায়), সখি, ভালোবাসা কারে কয়? (চতুর্থ অধ্যায়), নারী ও পুরুষ: দুই ভবনের দুই বাসিন্দা (পঞ্চম অধ্যায়), জীবন মানে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা (ষষ্ঠ অধ্যায়), বিবর্তনের দৃষ্টিতে নৈতিকতার উদ্ভব (সপ্তম অধ্যায়) ও যে প্রশ্নগুলোর উত্তর মেলেনি (অষ্টম অধ্যায়)।

ভূমিকায় তিনি বলছেন, “এতোদিন ধরে সমাজবিজ্ঞানী আর মনোবিজ্ঞানীরা বিবর্বতনতত্ত্বকে বাইরে রেখে মানবসমাজের নানা সামাজিক ব্যাখ্যা প্রতিব্যাখ্যা হাজির করে চলেছিলেন। তাদের ব্যাখ্যায় ডারউইনীয় বিশ্লেষণ অনুপস্থিত থাকায় সেগুলো থেকে গেছে অনেকাংশেই অসম্পূর্ণ নয়তো হয়ে উঠেছে বৈজ্ঞানিক দিক থেকে একেবারেই অপাংক্তেয়। সেই সমস্যাগুলো অসম্পূর্ণ সমাধানের পূর্ণতা দিতে বিবর্তন তত্ত্ব কীভাবে অগ্রসর বিশ্লেষণ হাজির করতে পারে তার বেশ কিছু নমুনা হাজির করেছি আমার এ বইয়ে।…যৌনতার নির্বাচন এই বইটির বড় অংশ অধিকার করে থাকলেও সেটাই বইয়ের একমাত্র উপজীব্য নয়। বইটির মূল লক্ষ্য ডারউইনীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জীবন, জগৎ ও সমাজকে ব্যাখ্যার প্রচেষ্টা; আর সেই সাথে এ সংক্রান্ত বিভিন্ন আধুনিক গবেষণার সাথে বাঙালি পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেয়া।”

প্রথম অধ্যায়ে তিনি বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে পরিচিত করে তুলেছেন পাঠকদের, শুরু করেছেন একটা বড়দের কৌতুক দিয়ে যা কিছুটা অনাবশ্যকভাবে দীর্ঘ, এবং কারোর কারোর কাছে কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক, তবে পরের পৃষ্ঠাগুলোয় তিনি যথারীতি তাঁর সুদৃঢ় দুর্গভিত্তি বৈজ্ঞানিক প্রসঙ্গ, তথ্য, ও প্রমাণ সহযোগে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের হৃদয়গ্রাহী বিবরণ দিয়েছেন। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান কী তা জানাতে গিয়ে তিনি বাক্সে বাঁধাই করে জানাচ্ছেন:

“বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান মূলত বিজ্ঞানের দুটো চিরায়ত শাখাকে একীভূত করেছে; একটি হচ্ছে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান (Evolutionary Biology) এবং অন্যটি বৌদ্ধিক মনোবিজ্ঞান (Cognitive Psychology)। বৌদ্ধিক মনোবিজ্ঞান থেকে আমরা জানতে পারি যে, আমাদের মানসপট নির্মাণে দীর্ঘদিনের এক জটিল পরিকল্পনার ছাপ আছে। আবার বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান বলে যে, জীবদেহের এই ‘জটিল পরিকল্পনা’ বলে যেটাকে মনে হয় সেটা আসলে ডারউউন বর্ণিত ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ এবং কিছু ক্ষেত্রে যৌনতার নির্বাচনের ফলাফল। কাজেই, এই দুই শাখার মিশ্রণে গড়ে ওঠা বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের উপসংহার হচ্ছে–আমাদের জটিল মানসপটও উদ্ভূত হয়েছে দীর্ঘদিনের বিবর্তনীয় পথ-পরিক্রমায়–প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং যৌনতার নির্বাচনকে পুঁজি করেই।”

মোদ্দা কথা, মানবপ্রকৃতি শুধু পরিবেশের ব্যাপার নয়, বরং নিজের ভেতরকার উপাদানের, তথা বংশাণুরও ব্যাপার। জানাচ্ছেন তিনি, এডওয়ার্ড ও উইলসন তাঁর সুখ্যাত ‘সামাজিক জীববিজ্ঞান (Sociobiology) (1975)’ নামের বইতেই প্রথম মতপ্রকাশ করেন যে, “মানবপ্রকৃতি বিশ্লেষণে জিন বা বংশাণুকে গোণায় ধরা উচিত।” এবং, ধারণাটি পরে তিনি আরো বিস্তৃত করেন তাঁর ‘On Human Nature (2004)’ বইতে। উইলসনের ভাষ্যমতে, আধুনিক হোমোস্যাপিয়ান্সের মানসিক ভিত্তিভূমির বিনির্মাণ ঘটে প্রাচীন শিকারী-সংগ্রাহক যুগেই যখন তারা দলবদ্ধভাবে শিকার করে আর ফলমূল কুড়িয়ে টিকে থাকত। এর সাথে সভ্যতার সাংস্কৃতিক উপাদান যুক্ত হয়ে জিন ও সাংস্কৃতিক মিশেলে গড়ে ওঠে মানবচরিত্র বা –প্রকৃতি, উইলসনের ভাষায়, ‘Gene-culture coevolution’, ড. রায়ের অনুবাদে ‘জিন-সংস্কৃতি সহবিবর্তন’।

উইলসন তোপের মুখে পড়েন সমাজবিজ্ঞানী ও জীববিজ্ঞানী দুই তরফ থেকেই।

সমাজবিজ্ঞানীরা ভুরু কোঁচকান তাঁদের এলাকায় জীববিজ্ঞানীর ‘অযাচিত’ হস্তক্ষেপে। অনেক জীববিজ্ঞানী খেপে ওঠেন সামাজিক আচরণের ওপর জৈবিকতা চাপানোর মানসিকতায়। উইলসনকে অভিযুক্ত করা হয় বর্ণবাদী আচরণ বিজ্ঞানের মোড়তকে পরিবেশনের, অভিহিত করা হয় তাঁকে নিউ-সোশাল ডারউইনিস্ট অভিধায়। বিশেষত, তদানীন্তন ‘আদর্শবাদী’ চিন্তাবাদীরা, যাঁরা মূলত বামপন্থায় বিশ্বাসী, অর্থনৈতিক দিক ছাড়া অন্য কোনোদিক দিয়ে মানবচরিত্র বিশ্লেষণ করায় আস্থাশীল ছিলেন না। Science for the people নামের একটি বাম মতাদর্শিক সংগঠনের তিন বৈজ্ঞানিক রিচার্ড লেওনটিন, স্টিফেন রোজ, ও লিওন কামিন ‘Not in our genes (1984)’ বইতে দেখানোর চেষ্টা করেন যে “বিজ্ঞান এখন জাত্যাভিমানী পশ্চিমা পুঁজিবাদি সমাজের প্রোপাগান্ডা মেশিনে পরিণত হয়েছে, আর উইলসন সেই বৈষম্যমূলক ‘পুঁজিবাদী বিজ্ঞান’কে প্রমোট করছেন। তারা উইলসনের জমজ নিয়ে পরীক্ষা, পরিগ্রহণ পরীক্ষা প্রভৃতির উপর পদ্ধতিগত আক্রমণ পরিচালনা করেন, শুধু তাই নয় তাদের মার্কসবাদী দার্শনিক বিশ্বাস থেকে প্রস্তাব করেন জীববিজ্ঞানেও মার্ক্সবাদের মতো ‘দ্বান্দ্বিক’ বা ডায়ালেক্টিকাল পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত। এ নিয়ে অধ্যাপক রিচার্ড লেওনটিন একটি বইও লেখেন সে সময়–ডায়ালেক্টিকাল বায়োলজিস্ট নামে (পৃ. ২২)।”

রিচার্ড ডকিন্স অবশ্য পরে এর প্রতিবাদ করেন, যুক্তিখণ্ডন করেন নিউ সায়েন্টিস্ট পত্রিকায় ২৪ জানুয়ারি, ১৯৮৫ সালের একটি লেখায়। এছাড়া, তাঁর “The Selfish Gene (1976)” বইটিও অনন্য একটি মাইলফলক হয়ে ছিল বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান ব্যাখ্যায়।

একটি দীর্ঘশ্বাস পড়ে এখানে।

প্রাক্তন সোভিয়েত রাশিয়ায় একইভাবে দ্বান্দ্বিকতা বিকাশে বেছে নেওয়া হয়েছিল জীববিজ্ঞানের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়, লাইসেঙ্কোবাদ। ১৯২০-এর শেষদিকে শুরু হয় এই বামপন্থী প্রোপাগান্ডার আর আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্তি ঘটে ১৯৬৪-তে । লাইসেঙ্কোবাদ নামকরণ করা হয় ‘লেনিন-অল ইউনিয়ন একাডেমি অব ন্যাচারাল সায়েন্সেস’-এর পরিচালক ত্রোফিম দানিসোভিচ লাইসেঙ্কো-এর নামে, যিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, অর্জিত গুণাবলির বংশানুক্রমিক ধারাবাহিকতার মাধ্যমে, ল্যামার্কবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, তিনি ফসলের ফলন দুর্দান্তভাবে বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন। মেন্ডেলের জিনতত্ত্ব ও ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন খারিজ করে দিয়ে তিনি প্রাকৃতিক সহযোগিতা আবিষ্কার করেছেন বলে জানানো হল। লাইসেঙ্কোবাদের প্রবক্তারা এমনটাও দাবি করলেন যে রাই থেকে গম আর গম থেকে বার্লিতে রূপান্তর সম্ভবপর হয়েছে এবং আগাছাদের ক্রমাগত পরিবর্তনের মাধ্যমে শস্যোৎপাদী প্রজাতি উৎপাদন করা যায়, যা আজও আসলে ঠিক হয়ে ওঠেনি। রাষ্ট্রনায়ক জোসেফ স্টালিনের সমর্থন পেয়ে লাইসেঙ্কো অদ্বিতীয়, অপ্রতিহত ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন। তাঁর বিরোধিতাকারী অন্তত হাজার তিনেক জীববজ্ঞানীকে শ্রমশিবিরে প্রেরণ, বন্দিশালায় অন্তরীণ, ও নানারকমের রাষ্ট্রীয় শাস্তির মুখোমুখিও হতে হয়। এমনকি সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রেও ছড়িয়ে পড়ে এই ছদ্মবৈজ্ঞানিক প্রতারণা। যদিও পরে এটা থেকে সরে আসে রাশিয়া, কিন্তু ততদিনে বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে, এবং জিনতত্ত্বের গবেষণায় রাশিয়া আর কখনোই অগ্রগামী হয়ে উঠতে পারেনি।

এই লাইসেঙ্কোবাদ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি গ্রন্থ বিরচিত হয়েছিল অনন্ত বিজয় দাশের হাতে, ‘সোভিয়েত ইউনিয়েনে বিজ্ঞান ও বিপ্লব: লিসেঙ্কো অধ্যায়’ নামে। ডানপন্থী ও বামপন্থী বৈজ্ঞানিক বিচ্যুতি, অপবৈজ্ঞানিক দাবি, ও ছদ্মবৈজ্ঞানিক প্রতারণা নিয়ে বরাবরই সোচ্চার ছিলেন এই দুজন অগ্রপথিক, অভিজিৎ রায় ও অনন্ত বিজয় দাশ। আজ ধর্মমূঢ়, উন্মত্ত মৌলবাদীদের হাতে তাঁদের নৃশংস, প্রকাশ্য, বিচারহীন খুনের অবহ ভার নিয়ে আমাদের চোখ মুছতে হয়, আর অকালে স্মৃতিতর্পণ করতে হয়। এমন প্রতিভাদের এইই পুরস্কার প্রাপ্য ছিল বৈকি।

ফিরি মূলধারায়।

বিখ্যাত নৃতাত্ত্বিক নেপোলিয়ন শ্যাগনোন তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, নৃবিজ্ঞানীরা, বিশেষ করে সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীর একরকমের ‘বায়ো-ফোবিয়া’-য় ভোগেন। মানবচরিত্রের পেছনে যে কোনো জৈবিক ভিত্তি আছে সেসব তাঁরা মোটেও হিসেবেই নিতে চান না। তাঁর ভাষ্যমতে:
“অধিকাংশ নৃবিজ্ঞানীরা ‘মানুষ কেন সামাজিক?’ এই প্রশ্নটি নিয়ে কখনোই ভাবেন না। তারা মনে করেন মানুষের সামাজিক হওয়াটা একদম ‘স্বাভাবিক’ ব্যাপার। কিন্তু প্রাণী জগতের অনেক প্রজাতিকে দেখা গেছে তারা মোটেও সামাজিক নয় বরং সন্তান উৎপাদনের জন্যই অল্প মুহূর্ত একত্রিত হয় এবং যৌন মিলনের পর আলাদা হয়ে যায়। এভাবেই, মানুষের সব থেকে বড় যে বৈশিষ্ট্য, ‘সামাজিকতা’, সেটিকে আমাদের ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে। এবং এই প্রশ্নের উত্তর সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীরা দিতে চান না কেননা মৌলিকভাবে এটি একটি জৈবিক প্রশ্ন।” (‘নৃবিজ্ঞানে শ্যাগনোন ও ইয়ানোমোমা বিতর্ক: খেরোখাতার লেখালেখি’–ফাহমিদ আল জায়িদ (২০১৫), পৃ. ৪৪)। বলতে কি, নৃতাত্ত্বিকদের ভেতর সোশিওবায়োলজি তত্ত্বের বিপরীত ধারার মানসিকতার লোকই বেশি, এবং এজন্যে অনেকেই মার্শাল শাহলিন্সের ‘Use and Abuse of Biology (1976)’ প্রভাবের কথা বলে থাকেন, যা নৃতাত্ত্বিকদের ভেতর বেশ জনপ্রিয়।

এখানেই এসে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান নামের জ্ঞানকাণ্ডের নতুনতর একটি ধারা উন্মোচিত হয়, যার আলোকে মানবচরিত্রের নানান দিক, বিশেষত জৈব আকর্ষণ বা যৌন নির্বাচনের ব্যাপারটি, যা ডারউইনবাদের একটি মূল ভিত্তিও বটে, আলোকনের প্রয়াস পেয়েছেন ড. রায় বইটিতে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের মূল ভিত্তি তৈরি যাঁরা করেন, সেই জন টুবি ও লিডা কসমাইডস দম্পতির ভেতর টুবি নিজেই নৃতত্ত্ববিদ ও লিডা একজন মনোবিজ্ঞানী। তাঁরা এর মূলনীতি হিসেবে পাঁচটি সূত্রের প্রস্তাব করেন যার ভেতর পঞ্চমটি, “আমাদের আধুনিক করোটির ভিতরে বাস করে আদিম প্রস্তরযুগের মস্তিষ্ক” সাভানা অনুকল্প হিসেবেও খ্যাত। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের আলোকে মানুষের আচরণগত বৈশিষ্ট্য দেখাতে গিয়ে মানুষ যে জীবজগতেরই অংশ সেটা মেনে নিয়ে তার মানসিকতাও যে বিবর্তনগত পরিবর্তনের ধারায় এসেছে এবং মানুষের মস্তিষ্ক যে জন্মের পরপরই ব্ল্যাঙ্ক স্লেট বা টাবুলা রাসা (Tabula rasa) হিসেবে না-থেকে জিনগত প্রচুর বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম নেয়, সেসব জেনে ও মেনে নিয়েই এই বই শুরু হয়েছে। তবে, সেইসাথে লেখক বাস্তবতা বনাম ঔচিত্যবোধের হেত্বাভাসের ঝুঁকির কথাও প্রকাশ করেছেন এবং প্রাকৃতিক হেত্বাভাস (Naturalostic fallacy) ও নৈতিক হেত্বাভাস (Moralistic fallacy) নিয়েও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। যা ঘটে, তাই যেমন সত্য নয়, তেমনি যা উচিত, তাও নয়, এটিই মনে রাখতে হবে, তাইই বারংবার বুঝিয়ে দিয়েছেন লেখক।

দ্বিতীয় অধ্যায় ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’-এ তিনি নানা সাইকোপ্যাথের উদাহরণ টেনে, যমজ সন্তানদের জীবনাচরণের কথা ও কাহিনি উল্লেখ করে, কানাডা ও আমেরিকায় একই টিভি সিরিজ চলার পরও সহিংসতায় পার্থক্যের কথা জানিয়ে, এমনকি আমেরিকায় নিজের ও্ পরিচিতজনের জীবনের ঘটনা তুলে ধরে সিদ্ধান্ত টানেন যে “বংশাণু আর পরিবেশ–আসলে আয়তক্ষেত্রের দুটি বাহুর মতো। একটি দৈর্ঘ্য, আরেকটি প্রস্থ। মানবপ্রকৃতি নির্মাণে কার ভূমিকা বেশি–জিন না পরিবেশ? এ প্রশ্ন কেউ করলে এর জবাবটিও আরেকটি প্রশ্ন করেই দেয়া যায়–আয়তক্ষেত্রে তৈরিতে কার ভূমিকা বেশি–দৈর্ঘ্য নাকি প্রস্থ? (পৃ. ৫৬)।”

এবং, “বংশাণু আর পরিবেশের দ্বন্দ্ব যুদ্ধের ফলাফল যাই হোক না কেন, মানুষের মন যে আসলে ব্ল্যাঙ্ক স্লেট হয়ে জন্মায় না তা এখন সমাজবিজ্ঞানীরাও মোটামুটিভাবে মেনে নিতে শুরু করেছেন। এর মধ্যে অনেকেই ভাবছিলেন এই ব্ল্যাঙ্ক স্লেট ব্যাপারটাকে অন্য কিছু দিয়ে পরিবর্তন করা যায় কিনা। বিজ্ঞানী জন টুবি এবং লিডা কসমাইডস একটি বিকল্প প্রস্তাব করেছেন সম্প্রতি। মানব মনকে ব্ল্যাঙ্ক স্লেট না বলে জুক বক্স হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। স্লেটের তুলনায় জুক বক্স অনেক বেশি আকর্ষণীয় এবং মিথস্ক্রিয়াময়। জুকবক্সকে যেমন কেবল ভিতরের সরঞ্জামাদি দিয়ে বিচার করা যায় না, ঠিক তেমনি যায় না কেবল বাইরের সম্ভরণ দিয়েও। যেমন, F6 বোতাম টিপলে কোনো সুরই বাজবে না, যদি না বোতামের সাথে ভিতরে কোনো রেকর্ডের সংযোগ থেকে থাকে। অর্থাৎ বোতাম টেপা এবং সেই সাথে ভেতরের রেকর্ডের উপস্থিতি আর সুগ্রন্থিত সংযোগের মাধ্যমেই আমরা সফলভাবে জুকবক্স থেকে সুরধ্বনি শুনতে পাই। পুরোপুরি না হলেও, বাংলাদেশে আমরা যে হারমোনিয়াম বাজিয়ে থাকি, সেটার ব্যাপারও অনেকটা প্রায় একই রকমের। হারমোনিয়ামের চাবি টিপে আপনি কেমন সুর তুলবেন তা হয়তো আপনার উপরেই নির্ভর করছে–
সেটা ‘খাঁচার ভিতর অচীন পাখি’র সুরই হোক, কিংবা হোক ‘না চাহিলে তারে পাওয়া যায়’ এর সুর–কিন্তু সুর তোলার মতো উপকরণগুলো হারমোনিয়ামের চাবির সাথে আগে থেকেই যুক্ত থাকতে হবে। কোন্ চাবির সাথে ‘সা’ আর কোন্ চাবির সাথে ‘রে’ আর কোন্ চাবি টিপলে ‘গা’ তা আপনাকে জানতে হবে, এবং হারমোনিয়ামের সঠিক চাবি থেকে সঠিক সুর বেরুতে হবে। অর্থাৎ পুরো ব্যাপারটি নির্ভর করছে ভিতর এবং বাইরের সুষম সমন্বয়ের উপর। আমাদের মনও কাজ করে অনেকটা সেরকম ভাবেই, ভিতরের জেনেটিক কাঠামোর সাথে বাইরের পরিবেশের এক ধরনের সুষম মিথস্ক্রিয়ায়। (পৃ. ৫৫-৫৬)”

তৃতীয় অধ্যায় সংস্কৃতির ‘ভূত’-এ তিনি সমাজবিজ্ঞানীদের সংস্কৃতিকৈবল্যবাদের সমালোচনা করেছেন মৃদু, পরিশীলিত, সরস ভঙ্গিতে। সমাজবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা এমিল ডুর্খেইমের মতে, মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য জনে জনে আলাদা হয় শুধু এবং শুধুই সাংস্কৃতিক বিভাজনের কারণে। মানবপ্রকৃতি বিষয়ক সবকিছুরই উত্তর আছে সংস্কৃতিতে। “মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা বেশি সহিংস কেন–সংস্কৃতিই এর কারণ। ছেলেরা কেন সত্তুর বছরের বুড়ির চাইতে বিশ বছরের ছুঁড়ির প্রতি বেশি লালায়িত হয়–এর উত্তর হচ্ছে সংস্কৃতি। ছেলেরা কেন মেয়েদের চাইতে বেশি পর্নোগ্রাফি দেখে, কিংবা বহুগামী–উত্তর একটাই–‘সংস্কৃতি’! ওম সংস্কৃতায়ঃ নমো! Omnia cultura ex cultura! (পৃ. ৬০)”

তিনি উদাহরণ দিয়েছেন বিশিষ্ট নৃতাত্ত্বিক গবেষক মার্গারেট মিডের ‘Coming of Age in Samoa (1928)’ নিয়ে। সামোয়ার নারীদের নিয়ে গবেষণায় তিনি দেখালেন যে, যৌনতার ব্যাপারে নারীরা সেখানে নিতান্তই স্বাধীন ও স্বতঃস্ফূর্ত। বহুগামী তারা, যখন ইচ্ছে স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে প্রিয়জনের সাথে তারা মিলিত হতে পারে। তাঁর সিদ্ধান্ত, “বংশগতি নয় বরং সংস্কৃতিই ব্যক্তিত্বকে প্রভাবিত করে।” হুমায়ুন আজাদও তাঁর ‘নারী (১৯৯২)’ বইতে মার্গারেট মিডের তিনটি বইয়ের কথা টেনে বলেন, “তিনি প্রশান্ত মহাসাগরীয় নারীপুরুষের প্রকৃতি সম্পর্কিত গবেষণায় দেখিয়েছেন নারীপুরুষের সক্রিয়তা/নিষ্ক্রিয়তা ধ্রুব/বিশ্বজনীন ব্যাপার নয় (পৃ. ৩০)।”

কাজেই বোঝা হয়ে গেল, সংস্কৃতির বিভিন্নতার কারণেই মূলত মানবসমাজে বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়। প্রমাণিত! কিউ ই ডি!

সমস্যা হল, পরবর্তীকালে ডেরেক ফ্রিম্যানসহ অনেক গবেষকের লেখায় উঠে আসে যে “মীডের অনুকল্পগুলো স্রেফ ‘উইশফুল থিংকিং’ ছাড়া আর কিছু ছিল না। গবেষকেরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, মীডের গবেষণা ছিল একেবারেই সরল এবং মীড স্যামোয়ান মেয়েদার দ্বারা নিদারুণভাবে প্রতারিত হয়েছিলেন। ফ্রিম্যানের গবেষণা থেকে বেরিয়ে এল, স্যামোয়ান জাতির মধ্যে হিংসা, বিদ্বেষ, রাগ, ঘৃণা, হত্যা, লুণ্ঠন – আর দশটা জাতির মতোই প্রবলভাবে বিদ্যমান, সরলমনা মীড সেগুলো দেখতেই পাননি। ডেরেক ফ্রিম্যানের অনুমান এবং অভিযোগের একেবারে সরাসরি সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায় মীডের গবেষণা প্রকাশের ষাট বছর পর। ১৯৮৮ সালের মে মাসে ফাপুয়া (Fa’apua’a), যখন তার বয়স ৮৬ বছর অফিশিয়ালি স্যামোয়ান সরকারের কাছে স্বীকার করে নেন যে, তিনি আর তার বন্ধু ফোফোয়া স্যামোয়ান নারীদের যৌনপ্রবৃত্তি নিয়ে যে তথ্য মীডকে ১৯২৬ সালে দিয়েছিলেন তার সবটুকুই ছিল বানোয়াট। এ কমপ্লিট হোক্স।
সেজন্যেই ম্যাট রীডলী তার ‘এজাইল জিন’ বইতে মীডের গবেষণা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলেন, ‘তার মানবপ্রকৃতির সাংস্কৃতিক ভিন্নতা খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা অনেকটা এমন কুকুর খুঁজে পাওয়ার মতোই–যে কুকুর ঘেউ ঘেউ না করে মিউ মিউ করে (পৃ. ৬০-৬১)।”

ডেরেক ফ্রিম্যান এই নিয়ে দুটো বইও লিখেছিলেন: “Margaret Mead and Samoa: The Making and Unmaking of an Anthropoligical Myth (1983)” এবং “The Fateful Hoaxing of Margaret Mead: A Historical Analysis of her Samoan Research Books (1999)”।

হুমায়ুন আজাদও, দেখা যাচ্ছে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই আবিষ্কার সম্পর্কে ওয়াকিফ ছিলেন না কিংবা হয়তো পাত্তাই দেননি, কারণ তাঁর অনুকল্পের সাথে তো এটা যায় না ঠিকঠাকমতন!

এরকম আরেকটা উদাহরণ দিয়েছেন ড. রায় এখানে। ম্যানুয়েল এলিজাল্ডে জুনিয়র ফিলিপাইনে টেসাডে নামের এক শান্তিপ্রিয় জাতি খুঁজে পেয়েছিলেন বলে রায় দিলেও কার্যত জানা যায় যে পুরো ব্যাপারটাই ভাঁওতাবাজি!

মোদ্দা কথা হল, “মানব সংস্কৃতি কোনো উদ্ভট কিংবা বিচিত্র সংস্কৃতির ভিন্ন ভিন্ন সমাবেশের জোড়াতালি দেওয়া ফসল নয়, বরং, জৈবিক পথেই উদ্ভূত একটি অভিন্ন এবং সার্বজনীন মানব উপাদানের অংশ (পৃ. ৬৫)।”

এরপরই চতুর্থ অধ্যায় ‘সখি, ভালোবাসা কারে কয়?’ অধ্যায়ে তিনি নারী-পুরুষের যৌনাকর্ষণের বিশদ বিশ্লেষণ ও কর্ষণের প্রয়াস নিলেন, যা বইটির শিরোনামের মূলধারার বিস্তৃত রূপ। এখানে তিনি সাহিত্য থেকে প্রেমের নানা সংজ্ঞার্থ ও উদাহরণ টেনে দেখাচ্ছেন যে প্রেম, হুমায়ুন আজাদের ভাষায়, “মাংসের জন্যে মাংসের সোনালি আকাঙ্ক্ষা” মূলত বংশরক্ষার তাগিদে বিবর্তনীয় যৌন নির্বাচন, তবে তার সাথে মিলিত হয়েছে নানা সাংস্কৃতিক মিম, যা সামগ্রিকভাবে কিছু মৌল সূত্র তুলে ধরে। সতর্কতা: ব্যতিক্রম বিদ্যমান, এবং এটা হয় বলেই হওয়া উচিত এমনটা কিন্তু নয়।

নারীদেহ ও মানসের প্রতিই মূলত জোর পড়েছে দেখা যাচ্ছে এখানে। ফ্রয়েড স্বীকার করেছিলেন যে, ত্রিশ বছর এ-নিয়ে গবেষণা করেও তিনি বের করতে পারেননি, নারী কী চায়! এখানে সেসবের কিছু উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। নারীশরীর কেমন হলে পুরুষ আকৃষ্ট হয় (সেই ক্লাসিক জলঘড়ি বা কোকের বোতলের মতন আকৃতি), গন্ধ কিভাবে সঙ্গী নির্বাচনে ভূমিকা রাখে (গন্ধবিচার, সুকুমার রায়ের নয়, যদিও আমি খুব একটা মিল পেলাম না বাস্তবে), চুম্বনের ভূমিকা (প্রথম চুম্বনও কতটা কাজের), অলঙ্কার বা হিরের আংটি কেন পছন্দনীয় (ফিটনেস মার্কার হিসেবে, টাকা কথা রাখে), ঈর্ষাপরায়ণতার পরিচয় ও পরিণাম (“ঈর্ষা সুমহতী, ঈর্ষা বৃহতের ধর্ম” ইত্যাদি, তবে এখানে যৌন ঈর্ষা), পুরুষাঙ্গের আকার ও আকৃতি নারীদের পছন্দে কিভাবে বিবর্তিত হল (পুরুষদের চিরাচরিত উদ্বেগ, মজার ব্যাপার হল শতকরা ৮৫ ভাগ নারী ভাবেন তাঁদের সঙ্গীদের আকার ঠিকই আছে), রাগমোচন বা অর্গ্যাজমের সাথে জড়িত বিষয়াশয় (বিবর্তনীয় উপযোগিতা এবং কিছু ভয়াবহ তথ্য) ইত্যাদি নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে এখানে। এবং এটি আমার সবচে পছন্দের অধ্যায়ও।

তবে, আত্নরতির কারণ এবং সমকামী/উভকামীদের নিয়ে কিছু বলা হলে এই অংশটি পূর্ণত্ব পেত বলে ভাবি।

পঞ্চম অধ্যায়টি সবচে বিতর্কিত হবে যার নাম ‘নারী ও পুরুষ: দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা?’।

কেন পুরুষেরা নারীদের তুলনায় বেশি করে পর্নোগ্রাফির ভক্ত, এবং মেয়েরা ছেলেদেরচে বেশি ভালবাসে ‘লাভ স্টোরি’ তার উত্তর মেলে এখানে। এমনকি, কেন মেয়েদের জন্যে ভায়াগ্রা তৈরির প্রচেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়েছে, তারও। নারী-পুরুষের মধ্যে চাহিদা, মানসিকতা ইত্যাদিতে কেন পার্থক্য, কেন Women are from Venus, Men are from Mars, সেসবও কিছুটা আলোচিত হয়েছে এখানে। অবশ্য লেখক পই পই করে জানিয়েছেন যে, এরকম হচ্ছে মানেই যে এটা ধ্রুবসত্য, কিংবা এর ওপর নির্ভর করে নারী ও পুরুষে বৈষম্য করা সম্ভব, এই ধারণা যেন করা না হয়। মৌলবাদীরা, বা পুং-আত্মগর্বীরা এসবকেই ব্যবহার করে কিনা, তাই। তাছাড়া, নারীবাদীরা বারবারই যে বলে থাকেন, নারীপুরুষ খুব বেশি আলাদা কিছু নয়, যেটা অভিজিৎ রায় নিজেও, অন্তত অধিকারের বেলায় বলে এসেছেন এতাবৎ, সেই জায়গাটার সাথে কিছুটা বিরোধ প্রকাশ করে। আমার পড়তে পড়তে কেন যেন মনে হচ্ছিল, তিনি তাঁর সহধর্মিণী বন্যা আহমেদের সাথে যে বইপ্রকাশের আগে “বহু ক্ষেত্রেই আমার লেখালেখি এমনকি নাওয়া খাওয়া সরিয়ে রেখে আর (তদেব) সাথে তর্কযুদ্ধে নামতে হয়েছে”, তার একটা মূল কারণ এখানে। মিজ বন্যা আহমেদকে কৌতূহল থেকে সবিনয়ে এটা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি উদাসভাবে উত্তর দিয়েছিলেন, ও, ওই বইটার নেচার ভার্সাস নার্চারের ব্যাপারটা আমার পছন্দের ছিল না।

এছাড়া, নারীরা কেন পুরুষের বাহ্যিক সৌন্দর্যের চাইতে টাকাকড়ি, স্ট্যাটাস, ক্ষমতা (Power is the ultimate aphrodisiac-Henry Kissinger) ইত্যাদিতে বেশি মনোযোগী, এবং পুরুষ নারীদের দৈহিক সৌন্দর্যে, সেটার কিছু কার্যকারণ বিশ্লেষণও এখানে উপস্থিত।

দুটো ঘটনা মনে পড়ে গেল। কাকতালীয়ভাবে, দুটোরই কেন্দ্রে হুমায়ূন আহমেদ।

হুমায়ূন তাঁর একটা লেখায় লিখেছিলেন, প্রকৃতি চায়, পরের প্রজন্ম সুন্দর হোক। তাই পুরুষ নারীর সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়। প্রকৃতি চায়, পরের প্রজন্ম মেধাবী হোক। তাই নারীরা মেধাবী পুরুষে আকৃষ্ট হয়।

তুলোধুনো করলেন সাম্প্রতিককালে ফেসবুকে তাঁকে একজন। প্রকৃতির কথা উল্লেখ করে হুমায়ূন মূলত পুরুষতান্ত্রিকতার আড়ালে পুরুষদের নগ্ন কামবাসনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন, শুধু দৈহিক সৌন্দর্যের দিকে কেন নজর দিতে হবে, ওতে করে নারীদের পণ্যায়ন ঘটে, মেধাবী নারীদের প্রতি পুরুষেরা কম আকৃষ্ট হয় কারণ পুরুষ (হুমায়ূন তার ভেতর সম্মুখভাগে) মূলত নারীমাংস উপভোগে বিশ্বাসী, নারীদের মেধার দিকেও পুরুষ আকৃষ্ট হয় আর পুরুষের বহিরঙ্গে নারীরাও, তিনি অতিসাধারণীকরণ করে নারীদের অবমাননা করেছেন (হয়ত পুরুষদেরও?)। মজার ব্যাপার হল, এই অধ্যায়টিতে দেখা যাচ্ছে, অন্তত পুরুষদের প্রকৃতিই যে বিবর্তনের ধারায় এমনটা হয়ে গড়ে উঠেছে, সেটা নেহাৎ মিছে নয়। বেচারা হুমায়ুন! তবে, ভদ্রলোক মেলশভিনিস্টিক যে ছিলেন, সে একেবারে ভুল নয় কিন্তু। গুলতেকিনের তোলপাড়-তোলা সাক্ষাৎকার, সত্যি হলে, তাইই তো প্রকাশ করে। অবশ্য, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টানাটানি হলে অনেকেই আটকা পড়ে যান। মানুষ আজকাল ভারি বেদ্দপ, আল্লাখোদাকেই মানে না, তো মানুষ!

আরেকটা ঘটনা। ঠিক কোন সাল খেয়াল নেই। বিশ্বকাপ ফুটবল চলছে। তসলিমা তখনও দেশে। হুমায়ূন তখনো দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ সম্ভবত করেননি। রাজাকারেরাও মন্ত্রী হয়নি তখনো। হুমায়ূন জনকণ্ঠ পত্রিকায় কলাম লেখেন মাঝেমধ্যে। সেখানটায় তিনি একবার লিখলেন, ছেলে আর মেয়েশিশুর সামনে খেলনা রাখলে ছেলেরা বন্দুক, গাড়ি, বল এসব তুলে নেয় আর মেয়েরা তুলে নেয় পুতুল, হাঁড়িকুড়ি এসব। ব্যক্তিগত এনেকডোট ব্যবহার করে কথাটা বলেছিলেন তিনি। নিঃসন্দেহে আপত্তিকর জেনেরালাইজেশন। অপছন্দ হয়েছিল তসলিমারও। এর প্রতিবাদ করে তিনি বলেছিলেন, ছেলেদের উৎসাহ দেওয়া হয় ওসব নিয়ে খেলতে, আর মেয়েদের হাতে তুলে দেওয়া হয় ‘মেয়েলি’ খেলনাগুলো, এটাই হল ব্যাখ্যা। স্বস্তি পেয়েছিলাম।

কিন্তু স্বস্তিটা উবে গেল অভিজিৎ রায়ের এই অধ্যায়টা পড়তে গিয়ে। তিনি একটা ঐতিহাসিক উদাহরণ দিয়েছেন ইসরায়েলের কিবুৎজ (Kibbutz) শহরের। নারীপুরুষের বৈষম্য মূলত সাংস্কৃতিক অবদমনের বা অধিকারগ্রস্ততার শিকার, এটা প্রমাণ করতে গিয়ে সেখানকার অধিবাসীরা ঠিক করে, যৌনতার পার্থক্যবাহী সব কিছুরই চিহ্ন সেই শহর থেকে ঝেঁটিয়ে দূর করা হবে। মেয়েদের চুল ছেলেদের মতন ছোট রাখা হল, ছেলেদের মারামারি, সহিংসতা থেকে সরিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দিকে আগ্রহী করা হল। গেছো মেয়েদের দেওয়া হল উৎসাহ, ছেলেদের শেখানো হল গেরস্থালি ‘মেয়েলি’ কাজ, মেয়েদের বাইরের কাজে তালিম দেওয়া হল যথাযথভাবে। কিন্তু পরে দেখা গেল অশৈলী কাণ্ড! অভিজিৎ রায়ের ভাষায় বাকিটা বলি:

“কিন্তু তিন প্রজন্ম পরে দেখা গেল সেই আদর্শ ‘কিবুৎজ’ শহর পরিণত হয়েছে সবচেয়ে সেক্সিস্ট বা যৌনবৈষম্যবাদী শহর হিসেবে। সেখানকার মানুষজন আদর্শবাদীদের স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে ফিরে গিয়েছিল সেই চিরন্তন গৎবাঁধা জীবনে। অভিভাবকদের আদর্শবাদী নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল পরবর্তী প্রজন্মের সন্তানেরা। ছেলেরা দেখা গেল, অভিভাবকদের দেখিয়ে দেওয়া পথ অস্বীকার করে বেশি পদার্থবিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং গণিত পড়তে শুরু করেছে, মেয়েরা বেশি যাচ্ছে মেডিকেলে। তারা নার্সিং-এ কিংবা শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছে ছেলেদের চেয়ে অনেক বেশি। ছেলেদের ঘরের কাজ করার যে ট্রেনিং দেয়া হয়েছিল, কিন্তু দেখা গেল মেয়েরাই শেষপর্যন্ত ঘরদোর গোছানোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। দায়িত্ব তুলে নেওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে তারা বলল, ‘আরে ছেলেরা ঠিকমত বাসাবাড়ি পরিষ্কার রাখতে পারে না।’ আর অন্যদিকে ছেলেরা বলল, ‘আরে যত ভালোভাবেই করি না কেন বউয়ের মর্জিমাফিক কিছুতেই হয় না।’ ব্যাপারটা অপ্রিয় হলেও সত্য যে, এধরনের বিভক্তিগুলোকে যতই অস্বীকার করে সাম্যের পথে সমাজকে ঠেলে দেয়া হয়, বিদ্যমান জৈববৈজ্ঞানিক পার্থক্যগুলো সে সমাজে ততই প্রকট হয়ে ওঠে। ইতিহাস তাই সাক্ষ্য দেয় (পৃ. ১৪৪)।”

এবং, এর পরেও, “এদিকে ছেলেরা শুধু কেন বল খেলবে আর মেয়েরা পুতুল–এই শিকল ভাঙার অভিপ্রায়ে ভিন্ন ধরনের খেলনা প্রবর্তনের চেষ্টা হয়েছিল–চলেনি। কারণ কী? কারণ হচ্ছে আমরা যত আড়াল করার চেষ্টাই করি না কেন, ছেলেমেয়েদের মানসিকতায় পার্থক্য আছে–আর সেটা দীর্ঘদিনের বিবর্তনীয় ছাপ থাকার কারণেই। এই ব্যাপারটিই প্রকাশিত হয়েছে ব্রিটিশ পত্রিকা ইন্ডিপেন্ডেন্টে এক মায়ের আর্তিতে। সেই মা পত্রিকায় (নভেম্বর ২, ১৯৯২) তার অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন–
আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে আপনার পত্রিকার বিজ্ঞ পাঠকেরা কী বলতে পারবেন কেন একই রকমভাবে বড় করা সত্ত্বেও যতই সময় গড়াচ্ছে আমার দুই যমজ বাচ্চাদের মধ্যকার নারী-পুরুষজনিত পার্থক্যগুলো প্রকট হয়ে উঠছে? কার্পেটের উপর যখন তাদের খেলনাগুলো একসাথে মিলিয়ে মিশিয়ে ছড়িয়ে রাখা হয়, তখন দেখা যায় ছেলেটা ঠিকই ট্রাক বা বাস হাতে তুলে নিচ্ছে, আর মেয়েটা পুতুল বা টেডি বিয়ার।

শুধু মানব শিশু নয়, মানুষের কাছাকাছি প্রজাতি ‘ভার্ভেট মাঙ্কি’ নিয়ে গবেষণা করেও বিজ্ঞানীরা দেখেছেন তাদের হাতে যদি খেলনা তুলে দেয়া হয়, ছেলে বানরেরা ট্রাক বাস গাড়ি ঘোড়া নিয়ে বেশি সময় কাটায় আর মেয়ে বানরেরা পুতুল কোলে নিয়ে। মানবসমাজে দেখা গেছে খুব অল্প বয়সেই ছেলে আর মেয়েদের মধ্যে খেলনা নিয়ে এক ধরনের পছন্দ তৈরি হয়ে যায়, বাবা মা’রা সেটা চাপিয়ে দিক বা না দিক। দোকানে নিয়ে গেলে ছেলেরা খেলনা-গাড়ি কিংবা বলেল দিকে হাত বাড়াতে শুরু করে, আর মেয়েরা পুতুলের প্রতি (পৃ. ১৫৩)।”

আবারও বলি, বেচারা হুমায়ূন!

তবে এটুকুতে যদি কেউ ধরে নেন যে এই বৈষম্য তিনি সমর্থন করছেন, তবে তার জন্যে এই অধ্যায়ের শেষ পরিচ্ছেদ ‘নারী পুরুষ শেষ পর্যন্ত অভিন্ন মানব সত্তারই অংশ’টুকু পড়ে নেওয়ার আহ্বান থাকল। কটি লাইন তুলে ধরি।
“কাজেই উপযুক্ত পরিবেশ পেলে এবং সঠিক প্রচেষ্টা থাকলে নারী পুরুষ সবার পক্ষেই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন সম্ভব। পাথরের গায়ে কখনোই খোদাই করে লেখা নেই–নারীরা ‘ইহা পারিবে’, আর পুরুষেরা ‘উহা’। বরং অভিন্ন মানববৈশিষ্ট্যের বহু কিছুই আমরা নারী পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের মধ্যে ধারণ করি, এবং নিজ নিজ পছন্দ, অভিরুচি এবং আগ্রহকে প্রাধান্য দিয়ে সেগুলোর পরিস্ফুটন ঘটাই (পৃ. ১৬৫)।”

এছাড়া, এই অধ্যায়ে জিহাদি জনতার যৌনবিকারগ্রস্ত মানসিকতা নিয়ে আলোচনা অংশে ওসামা বিন লাদেনের কম্পিউটারে এন্তার পর্নো পাওয়ার কাহিনি তুলে ধরে তিনি অবদমনের হাস্যকরতার প্রতি এক হাত নিয়েছেন। আমার ধারণা, এটা লিখে তিনি বেশ মজাই পেয়েছিলেন। আইসিলে যোগদানরত নারী যৌন জিহাদিদের দেখলে হয়তো সেটুকুও তিনি তাঁর বইতে তুলে আনতেন, এবং অবধারিতভাবে এর পেছনে ব্যাখ্যার যোগানদার হত তাঁর প্রিয় বাক্যবন্ধ ‘বিশ্বাসের ভাইরাস।’

ষষ্ঠ অধ্যায়ে (‘জীবন মানে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা’) বেশ কিছু বিষয়ের অবতারণা করেছেন তিনি।

প্রথম ও দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে (‘মানবিকতার ধরন’ ও ‘মিথ অব নোবেল স্যাভেজ’) তিনি মানুষের মানবিকতার ব্যাপারটি যে অতিকথন এবং সহিংসতা যে আমাদের চরিত্র, তাইই বিশদ করার চেষ্টা করেছেন।

তবে এখানে তিনি যে-ইয়ানোমোমো গোত্রের কথা বলেছেন, যারা ব্রাজিল ও ভেনেজুয়েলার সীমান্তে আমাজন বনে প্রায় ২০০ থেকে ৩০০টির মতন গ্রামে বসবাস করে, এবং নৃতাত্ত্বিক নেপোলিয়ন শ্যাগনোনের ভাষায় (অভিজিৎ রায় চ্যাংনন লিখেছেন, যা ঠিক নয়) তারা হিংস্র যুদ্ধবাজ গোত্র যারা নিজেদের ভেতরে এবং গ্রামে গ্রামে তুমুল লড়াই করে চলে, তাদের ব্যাপারটা পুরোপুরি সঠিক কিনা, সেটা নিয়েও বেশ বিতর্ক আছে। নামকরা ফরাসি নৃতাত্ত্বিক জ্যাকুয়েস লিজট ইয়ানোমোমোদের ভেতর ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বসবাস করেছেন। তিনি ইয়ানোমোমোদের নিয়ে দুটি বই লিখেছেন: The Yanomami in the Face of Ethnocide (1976)” এবং “Tales of the Yanomami: Daily Life in the Venezuelan Forest (1985)”। শ্যাগনোনের সিদ্ধান্ত নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান তিনি এবং কট্টর সমালোচক শ্যাগনোনের। এছাড়া, ২০০০ সালে সাংবাদিক প্যাট্রিক টিয়ার্নি জিনবিজ্ঞানী জেমস নিল ও নৃতাত্ত্বিক শ্যাগনোনের বিপক্ষে অভিযোগের তির ছোঁড়েন তাঁরা সাড়াজাগানিয়া বই “Darkness in El Dorado: How Scientists and Journalists Devastated the Amazon” বইতে। পরে আমেরিক্যান এ্যানথ্রোপোলজিক্যাল এসোসিয়েশন একটি টাস্কফোর্স গঠন করে বিষয়টি যাচাইবাছাই করে দেখে এবং তারা রিপোর্টে শ্যাগনোনের বিপক্ষেই বেশি কিছু অভিযোগ করে। তবে সবচে যে মারাত্মক অভিযোগটি প্যাট্রিক করেছিলেন নিল ও শ্যাগনোনের বিপক্ষে, যে তাঁরা হামরোগ ছড়িয়ে দিয়ে তাদের মহামারী আকারে মৃত্যু ঘটিয়েছেন, সেটি ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়। কিন্তু শ্যাগনোনের বিপক্ষে ইয়ানোমোমোদের বিপক্ষে ছড়ানো অনেক কিছুই অতিরঞ্জিত ও অবমাননাজনক বলে টাস্কফোর্স রিপোর্টে লেখে এবং অন্য অনেকেই এই মত সমর্থন করে গেছেন।

এছাড়া, অধ্যায়টিতে পুরুষালি সহিংসতা, সৎ সন্তানদের প্রতি নির্যাতনের কথা ও কাহিনি, পুরুষদের ভেতরে অপরাধের প্রাবল্য, ক্ষমতাশালী পুরুষদের পরকীয়াসক্তি, নারীদের পরকীয়ার জৈব-মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা, বয়েসের সাথে অপরাধের সম্পর্ক এবং প্রতিভারও, বিবাহের সাথে মানসিক অস্থিরতা কমানোর কিংবদন্তি আসলে কতটুকু সত্যি, পুরুষের বেলায় বিয়ের সাথে প্রতিভাহ্রাসের সম্পর্ক, বয়স্কদের মধ্যে স্ত্রীহত্যার হার বেশি হওয়া, এমনকি জাতিগত সহিংসতা ও সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নের জৈব-মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও রয়েছে।

সপ্তম অধ্যায়ে (‘বিবর্তনের দৃষ্টিতে নৈতিকতার উদ্ভব’) কিভাবে মানবসমাজে নৈতিকতার শুরু এবং বিস্তার সে-নিয়ে বিশদ আলোচনা আছে। স্বার্থপরতা থেকে কিভাবে সহযোগিতা এসেছে, সেটাই এখানে তুলে ধরা হয়েছে। যৌনতা ও যৌনতার নির্বাচনও কিভাবে বিবর্তনের ধারায় পরার্থপরতার জন্ম দিতে পারে, সেটা নিয়েও আলাপ করা হয়েছে।

শেষতম অধ্যায়ে (‘যে প্রশ্নগুলোর উত্তর মেলেনি’) তিনি রবার্ট রাইটসের ‘Moral Animal (1994)’ নামের বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের ওপর লেখা ধ্রুপদী বইতে স্বীকার করেছিলেন যে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান ছয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সেই স্ফিংকসের ধাঁধা সমাধানের কিছুটা প্রচেষ্টা নিয়েছেন তিনি এই অধ্যায়ে। এছাড়া, জ্ঞানকাণ্ডের এই নতুনতর শাখার নানান সমালোচনার কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন এখানে। নারীপুরুষের পার্থক্যের ব্যাপারটি টেনে এনে তিনি বারংবার সতর্ক করেছেন যে সেটি যেন নারীদের জন্যে অবমাননাকর না হয়ে দাঁড়ায়। বিবর্তনের ব্যাপারটি মানবসভ্যতার বিপক্ষেও ব্যবহৃত হয়েছে, এমনকি স্বৈরশাসকদের রাজনৈতিক চক্রান্ত হিসেবেও, এই ব্যাপারটি মাথায় রেখে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের ফলিত ব্যবহার নিয়ে তিনি সতর্কতাবাণীও উচ্চারণ করেছেন। সাথে সাথে বইয়ের ভূমিকায় স্টিভেন পিঙ্কারের How the Mind works (2009) নিজের বইটির ভূমিকায় যা বলেছেন সেটা মনে করিয়ে দিয়ে আমি আমার আলোচনার এখানেই সমাপ্তি টানছি।

“এই বইয়ের প্রতিটি ধারণা সময়ের সাথে ভুল প্রমাণিত হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সেটাই হবে আমাদের জন্যে অগ্রগতি। কারণ পুরোন ধ্যান ধারণা গুলো এতোই নিরস যে ভুল হবারও যোগ্য নয়।”

বইটার প্রচ্ছদ শিবু কুমার শীলের, খুব আকর্ষণীয় না-হলেও পছন্দ হওয়ার মতন। প্রচুর বানানবিভ্রান্তি এবং মেকাপগেটাপের কিছু দুর্বলতায় মনে পড়ে যায়, আমি হয়তো সামান্যতম অবদান রাখতে পারতাম এসবে, আহা, এইসব ভালোবাসা, ধুলো আর কাদা…

অভিজিৎ রায়ের আজ জন্মদিন।

কিন্তু তাঁর সম্পর্কে কিছু বলতে গেলেই মনে পড়ে তাঁর নিথর উপুড়-হওয়া দেহ, তাঁর রক্তলাল পাঞ্জাবি, তাঁর সহধর্মিণীর রক্তাপ্লুত জামা ও চেহারায় অসহায় সহায়তার আহ্বান নিয়ে হাতছানি। এরপর ভেসে আসে রাষ্ট্রপ্রধানের মৌলবাদের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ, একের পর এক লেখক, দলদাস, এমনকি ব্লগারদেরও নানাছলেকৌশলে খুনের দায় তাঁর ওপরেই চাপানোর আপ্রাণ সূক্ষ্ম ও স্থূল প্রচেষ্টা, উল্লসিত সাধারণ নাগরিকদের কথা তো বাদই দিলাম, একের পর এক ব্লগারখুনের মহোৎসব, সরকারপ্রধান, পুলিশপ্রধান থেকে শুরু করে দায়িত্বশীল সবারই নির্লজ্জ উদাসীনতা, বিচারের নামে কালক্ষেপণ ও ভ্রান্তিবিলাস সৃজনের প্রয়াস, জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের আস্ফালন। একমাত্র গুলশান হত্যাকাণ্ডের পরেই তেনাদের কিছুটা টনক নড়েছে, শুট এট সাইটের তাণ্ডব দেখা যাচ্ছে, এবং এও দেখা যাচ্ছে, জঙ্গিরা কতটা শক্তিশালী, কতটা বহুধাবিস্তৃত, কতটা সাংগঠনিকভাবে দৃঢ়।

রবীন্দ্রনাথকেই স্মরণ করি, অনাথের নাথ, অবলের বল, “জন্মদিন মৃত্যদিন দোঁহে/ একাসনে বসিয়াছে।”

খুব আশাবাদী নই আমি, তবে বইটার ও অভিজিৎ রায়ের আদর্শের বহুলপ্রচার কামনা করি। এই পোড়ার দেশে হয়ত কখনো আলো আসবে, আশা বা ভরসা করি না, শুধু ভাবি, অলসভাবে, অন্যমনস্ক হয়ে। এই দাহকালে তাঁর লেখার, বিশ্লেষণের, ব্যঙ্গের, শ্লেষের, সহায়তার বড্ড অভাব বোধ করি।

তাঁকে খুব মিস করি।

শুভ জন্মদিন, অভিজিৎ রায়। ভালবাসা নিরন্তর। ভালবাসা কারে কয় সামান্য হলেও আমিও জানি, হারানোরও।