images-1
সুন্দরবন একটি ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট আমরা সবাই জানি। এটি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ তাও আমরা জানি। শুধু আমার নয় হয়ত আরো অনেকের দৃষ্টিতেই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ও শৌর্যেবীর্যে অসামান্য প্রাণী রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসভূমি যে সুন্দরবন তা ত আমরা জানিই। আরো অনেক অসাধারণ প্রাণী এবং লতা,গুল্ম,বৃক্ষ দ্বারা পরিপূর্ণ একটি অদ্বিতীয় ও অতুলনীয় বন হচ্ছে সুন্দরবন। আরো একটি কারণ যা সুন্দরবনকে আলাদা করেছে তা হল বাঙালীর ইতিহাসে এই প্রথম কোনো বনরক্ষার জন্য আন্দোলন গড়ে উঠেছে। বাঙালীর বন বা পরিবেশ,প্রকৃতি রক্ষা বা সংরক্ষণের কোনো ইতিহাস বা ঐতিহ্য নেই। আরো অনেক কালিমালিপ্ত ইতিহাসের সাথে বাঙালীর ইতিহাস বন,অরণ্য ধ্বংসেরও ইতিহাস।
আমি জাতীয়তাবাদী নই। বিশেষত বাংলাদেশের যে বাঙালী জাতীয়তাবাদ তাতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহও নেই। তবে দুই বাঙলা মিলিয়ে অভিন্ন সহজিয়া,শিকড়মুখী,অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় নির্ভরতাহীন যে জাতীয়তাবাদ তাতে আমার আস্থা ছিল। বর্তমান বাংলাদেশে মুসলিম জাতীয়তাবাদের ধ্বংসাবশেষের উপর দাঁড়িয়ে তার থেকে নির্যাস নিয়ে যে জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি তার কাছে আমার কিছু আশা করার নেই। তাই আমি জাতীয়তাবাদের কাছ থেকে ছুটি নিয়েছি। ধান ভানতে শিবের গীতের মত এই কথাগুলো বলার মানে কেউ যেন আমার কাছ থেকে দেশপ্রেমের আদিখ্যেতা বা বাঙালী জাতিসত্ত্বার প্রতি দূর্বলতা আশা না করেন।
একটু আগে বলেছিলাম বাঙালী জাতির ইতিহাস বনধ্বংসের ইতিহাস। অবশ্য খুঁজলে পৃথিবীর আদিবাসী জাতিসমূহ ছাড়া আর প্রায় সব জাতির সাম্প্রতিক ইতিহাসেই এর নজীর পাওয়া যাবে। কিন্তু যেহেতু আমি বাংলাদেশী ও বাঙালী তাই এই দেশের সীমানাতেই আমার আলোচনা সীমাবদ্ধ। কিন্তু এই ইতিহাসটা কি? ভারত যখন ভাগ হয় ১৯৪৭ সনে তখনো এই ভূখন্ডে বনাঞ্চলের পরিমাণ চল্লিশ শতাংশের উপরে। এমনকি দেশ স্বাধীন হবার সময়েও দেশে বনের পরিমাণ তিরিশ শতাংশের কাছাকাছি ছিল। এখন তা খুব বেশি হলে সাত ভাগ হবে। বনাঞ্চল ধ্বংসের হার যদি বিবেচনা করি তাহলে সম্ভবত আমরা পৃথিবীতে শীর্ষস্থানে থাকব।
images-2
এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমাদের দেশে যে শত বাধাবিপত্তি,হুমকী,নির্যাতন সহ্য করে হলেও সুন্দরবনের জন্য একটি আন্দোলন গড়ে উঠছে সেটাকে আমার কাছে পরিবেশ রক্ষার সংগ্রামে একটি টার্নিংপয়েন্ট বলেই মনে হয়। তবে সব বিষয়ে সিলেকটিভ আচরণের মত এই বিষয়েও বাঙালী কিছুটা সিলেকটিভ। নাহলে গত চল্লিশ বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার ও পাক আর্মির ঐতিহ্য বহনকারী বাংলাদেশ আর্মির ছত্রছায়ায় ক্রমাগত আদিবাসী সমাজ, সংস্কৃতি ধংস ও উচ্ছেদের ধারাবাহিকতায় বন ধ্বংসের নীরব ও বিশাল কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে এ বিষয়ে তেমন কোন জাতীয় আন্দোলন চোখে পড়েনি। মাঝেমাঝে ফেসবুকে কিছু স্ট্যাটাস বা পত্রিকায় কিছু বিবৃতিই চোখে পড়ে। এর বেশি কিছু নয়।
যাক সুন্দরবন এ ফিরে আসি এবার। যখন সুন্দরবন নিয়ে একটি প্রতিবাদ ধীরে ধীরে দানা বেঁধে উঠছে তখনি কিন্তু সরকার বিভ্রান্তি ছড়াবার জন্য বিভিন্ন মিডিয়ায় তার ভাড়াখাঁটা ‘বুদ্ধিজীবীদের’ মাঠে নামিয়ে দিয়েছে। এই ক্ষেত্রে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার যে ভীষণ পাকা খেলোয়াড় তা বলাই বাহুল্য। এমনকী অন্তর্জালে বিরাজমান উল্লেখযোগ্য প্রগতিশীল,মুক্তচিন্তক ঘরানার ব্যক্তিকেও তারা বিভ্রান্ত করেছে। অবশ্য এদের উল্লেখযোগ্য অংশই ইতোমধ্যে প্রগতিশীলতার আওয়ামী ভার্সনে কমবেশি আসক্ত। স্বাধীনতার পর থেকে আদর্শগত দিক থেকে আওয়ামী লীগের ভন্ডামির সীমা না থাকলেও তারা বাংলাদেশে প্রগতিশীলতার শেষ বাতিঘর হিসেবে আওয়ামী লীগকেই আঁকড়ে ধরেন।
কিন্তু সোজাসাপটা যে কথাটি সরকার গায়ের জোরে অস্বীকার করে যাচ্ছে তা হল কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র কোনোভাবেই উন্নয়নের দোহাই হতে পারেনা। এটা বর্তমানে সারাবিশ্বেই সর্বজনস্বীকৃত। আমাদের দেশের মত একটি ঘনবসতিপূর্ণ ভূখন্ডে শুধু সুন্দরবন কেন কোনো জায়গাতেই কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা উচিৎ নয়। বিশ্বের কোন সভ্য রাষ্ট্রেই এখন কয়লাকে জ্বালানী হিসেবে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় না। কানাডার অন্টারিও সরকার গর্বের সাথে প্রায় প্রতিদিন প্রচার করে থাকে তাদের একশভাগ বিদ্যুৎ ধোঁয়াহীনভাবে উৎপাদিত হয়। মানে কয়লাবিহীনভাবে। প্রসঙ্গত অন্টারিও প্রদেশে সুন্দরবনের মত প্রাকৃতিকভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল কোন বন ত নেইই আর জনসংখ্যাও বাংলাদেশের দশভাগের একভাগ। ইউরোপের অনেক দেশ থেকেই জ্বালানী হিসেবে কয়লার ব্যবহার উঠে গেছে। এমনকি বিশ্বে পরিবেশ ধ্বংস করে উন্নয়নের নয়া রেকর্ড যারা সৃষ্টি করেছে সেই চীনও ধাপে ধাপে তার সমস্ত কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ভারতেও বিভিন্ন জায়গায় তীব্র প্রতিবাদ এর মুখে সরকার কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ থেকে পিছিয়ে এসেছে। আর কোন বনের ধারেকাছেও যে ও কাজটি করা যাবে না সে ব্যাপারে ত আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশ আছে। তাহলে বিদ্যুতের কি প্রয়োজন নেই? অবশ্যই আছে। এই বিষয়েও কিন্তু এই আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় যারা তারা তাদের মতামত দিয়েছেন। বর্তমানে দেশে যে বৃহৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গুলো রয়েছে তাদের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও আধুনিকায়ন করলেই বিদ্যুতের উৎপাদন কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব। শুধু দরকার এই খাতে বিরাজমান পুকুরচুরি রোধ। দেশের প্রতি সামান্য দায়বদ্ধতাই এর জন্য যথেষ্ট।
fprd8613777
প্রশ্ন হচ্ছে এতসবকিছু জানা সত্ত্বেও সরকার কেন গোয়ার্তুমি করে যাচ্ছে? একটি কারণ হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত নানা আনুষঙ্গিক কাজ থেকে কমিশন ও টুপাইস কামানোর সুবর্ণ সুযোগ। যা সরকারদলীয় লোকজন কোনোভাবেই হারাতে রাজী নয়। পাশাপাশি সুন্দরবন ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে এর মাধ্যমে লুটপাট ও ভূমিদখলের যে নতুন ক্ষেত্র তৈরি হবে তা হারানোও কোন বুদ্ধিমানের কাজ নয়। যা ইতিমধ্যেই আমরা ভাওয়াল গড়,মধুপুর বন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এ দেখেছি। আর একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে এই কেন্দ্র স্থাপন করার মাধ্যমে ভারত সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতাপ্রকাশ। যা আওয়ামী লীগের জন্য অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। কারণ যে ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ধরে রাখল এর পেছনে ভারত সরকারের সমর্থন অনস্বীকার্য। এখানে এসে অনেক আওয়ামী সমর্থক মুক্তচিন্তার মানুষেরা বিভ্রান্তিতে পড়ে যান। কারণ যদি সবদল মানে বিএনপি জামাতের অংশগ্রহণে একটি ফেয়ার নির্বাচন হত তাহলে হয়ত তারাই ক্ষমতায় আসত। তাহলে হয়ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও হত না। আমার কথা হল যদি আগুনে পুড়ে মরে ছাই হয়েও দেশের মানুষ তাদেরকেই ক্ষমতায় আনত তাহলে সেই দেশের মানুষের কাছে অত আশা করতে যাওয়া কেন? হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য নিয়ে অত কথার খই ফোটানো কেন? অবশ্য আদর্শগতভাবে বা আচরণগতভাবে বর্তমান আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কোন পার্থক্যই নেই। শুধু একদল আওয়ামী প্রগতিশীলতার ধ্বজাধারী ব্যক্তি একটি পার্থক্য তৈরি করবার আপ্রাণ প্রয়াস চালান মাত্র।
download
তাই বর্তমান সরকার কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে সুন্দরবন ধ্বংস হল কি হল না সেই বিষয়ে খুব বেশি ভাবিত নয়। তারা তাদের স্বার্থই দেখছে। অবশ্য বাংলাদেশের কোন সরকারইবা নিজের স্বার্থের আগে দেশ ও দেশের মানুষকে স্থান দিয়েছে। আর ক্রমাগত ধর্মীয় আফিম,জাতীয়তাবাদ ও সংকীর্ণতাবাদের ঘোল খাওয়ায় ব্যস্ত থাকা জনগণ তাদের পেছনেই জড়ো হয়েছে।
images
কিন্তু আমি ও আমার মত আরো অনেকেই যারা মনে করেন আমাজন বন,বিষুবীয় চিরহরিৎ বৃষ্টিবহুল বনাঞ্চলের মত সুন্দরবনও সমগ্র পৃথিবীর মানবজাতির অভিন্ন সম্পদ; তারা কখনোই বিনা প্রতিবাদে এই অসামান্য সম্পদকে ধ্বংস হতে দেবেন না। হয়ত সাময়িকভাবে একটি ক্ষুদ্র স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করবে কিন্তু ইতিহাসের কাছে তারা অপরাধী হিসেবেই সাব্যস্ত হবে। প্রকৃতি আমাদের জন্মলগ্ন থেকে উজাড় করে শুধু বিলিয়েই গেছে আজ কিছুটা হলেও সেই ঋণ শোধ করার সময় এসেছে। এই সুযোগ কি আমাদের হেলায় হারানো উচিৎ?