দুই দিন আগে ঢাকায় ‘ওয়ার অন টেরর ফর পিস’ বা ‘শান্তির জন্য জঙ্গিবিরোধী লড়াই’ নামের একটা আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। অনুষ্ঠানে মন্ত্রী-সাংসদ-শিক্ষক-বিরোধীদলের নেতা অনেকেই অনেক কিছু বললেন। সেসবের বেশীরভাগ বক্তব্যই বাস্তব এবং বাস্তবতা বিবর্জিত। কিন্তু সেখানে না হয় নাইবা গেলাম। তবে নর্থ সাউথের এক শিক্ষকের একটা কথা শুনে চমকাইলাম। কারণ, তিনি কইলেন, “আগে তরুণদের মধ্যে যে প্রবণতা দেখিনি এখন তা দেখা যাচ্ছে। এনএসইউর স্টুডেন্টরা আগে খোদা হাফেজ বললেও এখন সুন্দর করে আল্লাহ হাফেজ বলেছে। ফেইসবুকে যেভাবে ধর্মের প্রচারে পোস্ট দিচ্ছে প্রগতিশীলতা ও মুক্তচিন্তার পক্ষে সেভাবে লিখছে না।”

পুরাই ‘চোররে কয় চুরি কর,গিরস্তরে কয় ধর ধর’র মত অবস্থা! মনে হইলো চিৎকার করে বলি, খাড়ান ভাই খাড়ান, এক মিনিট সময় দেন, আমার দ্রুতগতিতে উর্দ্ধগামী রক্তচাপটাকে নিম্নগামী কইরা নেই। ভাই আপনাদের স্মৃতিভ্রমের অসুখ হলো নাকি মাথায় চার চারটা চাপাতির কোপ খেয়ে আমারই স্মৃতিভ্রম হয়ে গেল? এম্নেসিয়া কি তাহলে আমার একার হয় নাই? ‘প্রগতিশীলতা ও মুক্তচিন্তার পক্ষে সেভাবে লিখছে না’ কথাটার মানে কী, ভাই? গতবছরের কথা সব ভুলে গেলেন? একদিকে মুমিন ভাইদের চাপাতির কোপ আর আরেকদিকে মন্ত্রী-নেত্রী-সান্ত্রিদের জারিকৃত ৫৭ ধারার কোপে যে আমরা বিদিশা হয়ে ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে গেলাম সেটা ভুলে গেলেন? তারপরে কী আর ‘সেভাবে’ লেখা সম্ভব ভাইজান?

এই প্রশ্নের ধাক্কায় সেই শিক্ষক হয়ত হুশে আসবেন, তার মনে পড়বে, ‘সেভাবে’ লিখতে গিয়ে কত লোকের প্রাণ গেছে। কিন্তু সেই মনে হওয়াটুকু যথেষ্ট না, কারণ তা আবার তার ও তাদের স্মৃতি থেকে গায়েব হতে পারে। তাই বিষয়টা বিস্তারিত বলার তাগিদ বোধ করছি। ‘সেভাবে’ তো লিখতে শিখেই গেছিলাম আমরা, আমরা ভাবসিলাম মুক্তচিন্তা মুক্তভাবেই করতে হয়, করা যায়। কিন্তু আমাদের মুমিন ভাইয়েরা কইল মুক্তচিন্তা করলে নাকি ওনারা সেরকম মুক্তভাবেই কুপাবেন। আর মন্ত্রী-নেত্রী-সান্ত্রিদের নেতা আইজি সাহেবরা বললেলেন, ইয়ে মানে, ব্লগার কোপানো খুউব খারাপ; কিন্তুউ ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করাও নাকি ঠিক না।

মুক্তচিন্তা ভাল কিন্তু এই নাস্তিক ব্লগারদের মুক্তচিন্তা নাকি ভালোনা। মুক্তভাবে মুক্তচিন্তা করলে চাপাতির কোপ খাইবা, আমরা বাবা সেটার বিচার করতে পারবো না, আমরা চুপটি করে থাকবো, দেখেও না দেখার ভান করবো। যুক্তিটা অনেকটা ‘ ধর্ষনের পিছনে দোষটা আসলে মেয়েটারই’ মতন । আপনারা বললেন, তোমরা দেশের নাগরিক হইসো তো কী হইসে? এরকম মুক্ত হয়ে মুক্তচিন্তা না করলেই তো আর মরতা না, হাবা নাস্তিকেরা তো নিজেরাই নিজেদের মারে!
জঙ্গি? জঙ্গি আবার কী কথা? আমাদের বানানো সোনার বাংলায় জঙ্গিফঙ্গি নাই। আমাদের কত কষ্ট করে বুদ্ধি খাটায়া ক্ষমতায় টিকে থাকা লাগে, তোমরা কি আমাদের বোকা পাইসো? এইসব নাস্তিক-ফাস্তিক রিস্কি বিজিনেস, হুহু, জঙ্গি ধরার ফান্দে আমরা পা দিমুনা।

আমরা আসলে বুঝতে পারি নাই যে মুক্তচিন্তা তো দুরের কথা, ফেসবুকে মুক্ত প্রশ্ন করলেই আপনেরা আমাদের ৫৭ ধারার কোপে ফালায় দিবেন কিন্তু হাজার হাজার জঙ্গি ফেসবুক পেজগুলার দিকে তাকায়াও দেখবেন না। আমরা বুঝি নাই যে বদ্ধচিন্তা মুক্তভাবে করলে কুন দোষ নাই। আবার মুক্তচিন্তা বদ্ধঘরে করলেও নাকি অসুবিধা নাই। কিন্তু বাট মুক্তচিন্তা মুক্তভাবে করলেই আপনাদের মনে ব্যথা লাগে!

কিন্তু আপনেরা আসলে বুঝেন নাই যে দুই চারটা নাস্তিক মাইরাই আপনাদের জঙ্গি ভাইয়েরা চুপ থাকবে না। ভাবসিলেন, বাহ মারুকনা, এইডার বিচার আবার করা লাগবে কেন? তার চেয়ে বরং নাস্তিক আইলো নাস্তিক আইলো বইলা ধর্মের কার্ডটাই খেলি, তাতেই তো রাজনৈতিক ক্যাপিটালটা বহুগুণে বাড়ানো যাবে। গুলশানে জঙ্গি হামলার মত কিছু করে আপনাদের মানসম্মান ইজ্জত যে ওরা এভাবে ধুলিস্মাৎ করে দিবে সেটা তো আপনারা তখন বুঝেন নাই। এরা যে আপনাদের সাথে এরকম বেইমানী করে নাস্তিকের মধ্যে সুঁচ হয়ে ঢুকে আলিশান গুলশানের মধ্যে দিয়ে ফাল হয়ে বের হবে- এইটা তো আপনারা বুঝেন নাই! মায়াই লাগে আপনাদের জন্য!

unnamed (1)

যাক, ওইগুলা পুরানা কথা, এবার তাইলে নতুন কথায় আসি। এই রিপোর্ট পড়ে মনে হোল আপনারা গতবছরের কথাগুলা ভুলেই গেসেন, আমরা যে একদিন ‘সেভাবেই’ মুক্তচিন্তা করতাম এবং কেন এখন আর ‘সেভাবে’ মুক্তচিন্তা করতে পারছিনা সেটাও ভুলে গেছেন। আমাদের ক্ষতিটা অনেক বড় বলে এখনো আমাদের গিলতে একটু সময় লাগতেসে এই আর কী! দেখেন, আপনেরা ইচ্ছা করলে আপঝাপ যা ইচ্ছা তাই বলতে পারেন। কিন্তু দীপন তো ইচ্ছা করলেও অবিশ্বাসের দর্শনের মত একটা বই পাব্লিশ করতে পারবে না, কিংবা অভিজিৎ শূন্য থেকে মহাবিশ্বের মত একটা বই লিখতে পারবে না।

কষ্টগুলা গিলে ফেলে নতুন কয়টা কথাই কই আপনাদের। আসলে বদ্ধ মুক্ত চিন্তা বা রয়েসয়ে মুক্তচিন্তা কিংবা না-বাড়াবাড়ি করা মুক্তচিন্তা বলে কিছু নেই। মুক্ত মানে তো মুক্তই, তাই না? এক্কেবারে ফকফকা মুক্ত। দেশে রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি নিয়ে মুক্তচিন্তার বিকাশ হোক এটা আপনারা কি আসলেই চান? এখনো সময় আছে, ঠিক কইরা, কন। এখন কি বুঝতে পারতেছেন যে দেশের তরুণদের চাপাতি ট্রেনিং দেওয়ার চাইতে মুক্তচিন্তায় আগ্রহী করে তোলাটাই বেশী লাভজনক? যদি সত্যিই বুঝে থাকেন, তাইলে ভাইজান কতগুলা কাজ করেন:

# ৫৭ ধারা উঠায়া নেন; সবাইরে মুক্তমত মুক্তভাবে প্রকাশ করতে দেন।

# যে ব্লগার-লেখকরা এতদিন ধরে একদিকে আন্সারুল্লা-জেএমবির চাপাতি আর আরেকদিকে পুলিশের রেইড থেকে বাঁচার জন্য দেশের ভিতরে বা বাইরে পালায়া থেকে অমানবিক জীবনযাপন করতেসে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দেশে ফিরায়া নেয়ার ঘোষণা দেন।

এই পর্যায়ে, দেশের তথাকথিত ‘আলোকিত’ আরেক দলের কথা কিছু কইয়া যাই। তারা মনে করেন সাম্রাজ্যবাদকে রুখতে গেলে মৌলবাদের লেজ ধরে গান গাইতে হবে। তাদেরকে বলি, ভাইয়েরা, আমরা এত দুর্বল নই যে একটা অন্যায্যতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আমাদের মধ্যযুগীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার তাবেদারী করতে হবে। বরং শোনেন, আমাদের একসাথে দুটোকেই রোধ করতে হবে। দুই শত্রুর বিরুদ্ধে ররুখে দাঁড়ানোই এখন মানবতার দাবী। সাম্রাজ্যবাদ আর মৌলবাদ আপাতদৃষ্টিতে যতটা বিপরীতধর্মী বলে মনে হয়, আসলে কিন্তু এরা তা না; এরা  সিন্দাবাদের ভুতের মত একটা আরেকটার কান্ধে চইড়া  পুলসেরাত পার হওয়ার চেষ্টা করতেসে। এইডা বুঝার জন্য খুব বেশী কষ্ট করার দরকার পড়েনা।

পরিশেষে সবাইকে বলি, চিলে কান নিছে শুইনাই চোখ বন্ধ করে দৌড়টা না দিয়ে আসেন কানগুলা কারা নিচ্ছে সেটা বের করার চেষ্টা করি। কারণ কান যে কেউ নিসে এটা আর লুকিয়ে রাখার উপায় নাই। আসেন আমরা আলোচনা করি, তর্কবিতর্ক করি, প্রয়োজনে আন্দোলন করি। চাপাতি এবং ৫৭ ধারা ছাড়াই যে সেটা করা সম্ভব সেটা প্রমাণ করে দেখাই। কোপের ভয়ে হিটকায়া পইড়া থাকা তো কোনো কাজের কথা না। আসেন কাজের কাজটা করি। চলেন আরেকবার নির্ভয়ে সামনে আগানোর চেষ্টা করি।