লিখেছেনঃ রুশো আলম

মাওলানা আবুল মোকছেদের প্রসন্নবোধ বারান্দায় চৌকিতে বসে সুরেলা গলায় কোরান তিলাওয়াত করছেন মাওলানা আবুল মোকছেদ। সুরা হাশর শেষ করেছেন, এখন সুরা রাহমান ধরবেন। প্রতিদিন সকালে ফজরের নামাযের পর তিনি ঘন্টা খানেক কোরান তিলাওয়াত করেন। বছর বিশেকের পুরোনা অভ্যাস। বয়স হয়েছে, ইদানীং চোখে একটু ঝাপসা দেখেন বলে আগের মত দ্রুত গতিতে তিলাওয়াত করতে পারেন না। আল্লাহ পাক হয়তো তার চোখের দৃষ্টিকে ঝাপসা করে দিয়ে ঈমানের পরীক্ষা নিতে চাইছে ভেবে ইদানীং তিনি তিলাওয়াতের মাত্রা খানিকটা বাড়িয়েই দিয়েছেন।

আগে দিনে এক ঘন্টা পড়তেন, এখন পড়েন দেড় থেকে দুই ঘন্টা। একটানা তিলাওয়াত করতে করতে গলা খানিকটা শুকিয়ে যায় তার। তিলাওয়াত থেকে একটু বিরতি নিয়ে তিনি খানিক ক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন, তারপর বলে উঠেন

-কই মা হাজেরা, এক গ্লাস পানি দে তো।

-খাড়াও, আনতাছি।

মাওলানার ডাক শুনে রান্নাঘর থেকে উত্তর দেয় ১৬ বছর বয়সী কিশোরী মেয়ে উম্মে হাজেরা। উঠানে ঝুলতে থাকা দড়ির উপর দুটো দাঁড়কাককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন মাওলানা আবুল মোকছেদ। সেই দাঁড়কাকগুলোর দিকে তাকিয়ে আল্লাহপাকের বিস্ময়কর কীর্তিকে অনুধাবন করে আরো একবার মুগ্ধ হন তিনি। আল্লাহপাকের কি অশেষ কারবার! মানুষ, পশু পক্ষী সবকিছুর জোড়া থাকে! জোড়াবিহীন একটা প্রাণীও নাই এই দুনিয়ায়! কি আচানক ব্যাপার স্যাপার!

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই মেয়ে হাজেরা এক গ্লাস পানি আর একটা কাঁচের পিরিচে দুটো টোষ্ট বিস্কিট মাওলানা আবুল মোকছেদের সামনে রেখে যায়। মাওলানা মেয়ের প্রত্যুতপন্নতা দেখে মুগ্ধ হন। তিনি বিস্কিট চান নি তবুও মেয়েটা বুদ্ধি করে পানির সাথে বিস্কিট নিয়ে এসেছে। তবূও মুখে একটু কপট বিরক্তির চিহ্ন এঁকে তিনি বলেন

-খালি তো পানি চাইছি।

-খালি পেটে পানি খাইবা ক্যান? মুহূর্তেই উত্তর দেয় হাজেরা।

মাওলানা জানেন তার এই মেয়েটা বুদ্ধিমতী, দারুল উলম মাদ্রাসার নবম শ্রেণীর ছাত্রী সে, রোল নম্বর এক। শুধু পড়াশোনায় নয় সাংসারিক জ্ঞানেও যে মেয়েটা গাঁয়ের সেরা তা নিয়ে মাওলানা আবুল মোকছেদের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। পর্দার ব্যাপারেও একেবারে খাঁটি ষোল আনা, এলাকার কেউ একটা খারাপ কথা বলতে পারবে না। মাওলানা খাশ দিলে আল্লাহপাকের কাছে দোয়া করতে থাকেন তার এই মেয়েটার যেন একটা ভাল বিবাহ হয়, এর ভবিষ্যৎ যেন সুখের হয়। ভাল একটা বিবাহের চেয়ে অধিক কাম্য আর কি আছে মেয়েদের জীবনে? অবশ্য হাজেরাই তার একমাত্র মেয়ে নয়।

হাজেরার বড় আরো একটি মেয়ে আছে তার, উম্মে আয়েশা। সেও প্রায় বছর তিনেক ধরে এই বাড়িতে পাকাপাকিভাবে বসবাস করছে। বড় মেয়েটার কথা ভাবলে মুহূর্তে চোখে জল চলে আসে মাওলানা আবুল মোকছেদের। কত স্বপ্ন ছিল তার এই মেয়েটাকে নিয়ে। আলিম পাশ করার পর অনেক ধুম ধাম করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। ছেলে উপজেলার জমিয়াতুল উলম মাদ্রাসার আরবী বিভাগের শিক্ষক। আচার ব্যবহার মাশাল্লাহ অতি ভাল। এমন উচ্চ শিক্ষিত, ভদ্র জামাই পেয়ে মাওলানা খুশিই ছিলেন। কিন্ত কি আর কপাল, মেয়ের কপালে সুখ বেশি দিন সইলো না। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মাওলানা সাইদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর তাদের এলাকায় যে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়েছিল সেই মিছিলের নেতৃত্বে ছিল জামাতা সাইদুল। মিছিলের এক পর্যায়ে পুলিশের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ বাঁধে। সেই সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিল সাইদুল। সাইদুলের লাশ যখন বাড়িতে আসে তখন আয়েশার বুক ফাটা আর্তনাদ দেখে চোখের জল ফেলেনি এমন কেউ ছিল না এই তল্লাটে। মেয়ের চিৎকার আর কান্না দেখে বুকটা ফেটে গিয়েছিল মাওলানা মোকছেদের। তবুও তিনি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে স্বান্তনা দিয়েছিলেন এই বলে যে -তোমার স্বামী আল্লাহর রাস্তায়, আল্লামা সাইদী সাহেবের রাস্তায় শহীদ হয়েছে। এই মৃত্যু সম্মানের, এই মৃত্যু গৌরবের, সবার ভাগ্যে এই মৃত্যু জোটে না। তুমি এক জন শহীদের স্ত্রী। আল্লাহপাক তোমার স্বামীর শাহাদতকে কবুল করুক, বল আমিন।

স্বামীর মৃত্যুর পর আয়েশা কিছুদিন শ্বশুড়বাড়িতে ছিল কিন্ত শ্বাশুড়ীর আচার ব্যবহারে বেশিদিন টিকতে পারেনি। অতঃপর এক বছরের পুত্র হাবিলকে নিয়ে একদিন পাকাপাকিভাবে তার বাড়িতে চলে আসে। মাওলানা গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তার মৃত্যুর পর মেয়েটির কি হাল হবে ভাবতেই গা শিউরে উঠে তার। আয়েশার পুত্র হাবিলের বয়স এখন সাড়ে চার, আগামী বছর থেকে স্কুলে যাবে এমনই পরিকল্পনা। বয়স যত বাড়ছে, এর দুষ্টামির পরিমাণও যেন দিনকে দিন বাড়ছে। মাওলানা আবুল মোকছেদ বলতে গেলে প্রায় সারাক্ষণই হাবিলের দুষ্টামিতে অতিষ্ঠ থাকেন। নামাজরত অবস্থায় জায়নামাজের সামনে যেয়ে ঝিম মেরে বসে থাকে হাবিল। অনেকবার মানা করেছেন, জাহান্নামের ভয় দেখিয়েছেন তবুও কোন কাজ হয় না। মাঝে মধ্যে তার লম্বা দাড়ি ধরে টানতে টানতে বলে- নানা নানা তোমার দাঁড়ি এত লম্বা ক্যান? মাওলানার ইচ্ছা করে হাবিলের গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দিতে কিন্ত অনেক কষ্টে তিনি নিজেকে সংযত করেন। মন যা চায় সবসময় তা করা যায় না। শিশুদের স্নেহ করা নবীর সুন্নত, স্বয়ং রাসুল্লাহ(স) শিশুদের স্নেহ করার নির্দেশ দিয়েছেন।

২)
দুপুরে জোহরের আজানের আগে মাওলানা আবুল মোকছেদ ঘন্টা খানেক ধনঞ্জয়ের চায়ের দোকানে সামনে বসে পত্রিকা পড়েন। কালাম মাষ্টার, হাবিব ব্যাপারী, ঝন্টু শেখ সহ আরো কিছু লোক চা খেতে আসে সেখানে, দেশের রাজনীতি ও সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে জমজমাট আড্ডা হয়। মাওলানা আবুল মোকছেদ সেই সব আলোচনা মন দিয়ে শুনেন তবে রাজনৈতিক কোন বিষয় নিয়ে তিনি সচরাচর তার নিজের কোন মতামত প্রকাশ করেন না। এই বিষয়টা তিনি সতর্কতার সঙ্গেই অনুসরন করেন। তিনি মসজিদের ইমাম, কোন একটি বিশেষ দলের প্রতি তার আনুগত্যের কথা প্রকাশ্যে বললে সেটা লোকজনের মধ্যে বিরুপ প্রভাব ফেলতে পারে। এমনিতে পুলিশের গুলিতে জামাই মরার পর অনেকে তার রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে নানান কথা বলে। তিন বিঘা জমি দিয়ে সংসারটা ঠিকমত না চলায় মসজিদের ইমামের চাকরীটা তার জন্য এখন অতি দরকারী। এই চাকরীর প্রতি কোন রকমের হুমকিকে গ্রহণ করার মত অবস্থা তার এই মুহূর্তে নেই।

মাওলানা আবুল মোকছেদকে দোকানের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে চেয়ার এগিয়ে দেয় দোকানী ধনঞ্জয়। বলে

-বসেন মাওলানা সাব। কি চা খাইবেন রং না দুধ?

-দেও একখান দুধ চাই দাও। কি ব্যাপার আজকা এইহানে লোকজন নাই ?

-লোকজনতো সব খালেক উদ্দীনের বাড়িত গ্যাছে।

-কেন কি হইছে খালেক উদ্দীনের?

-আপনি জানেন না?

-নাতো। কি হইছে?

-খালেক উদ্দীনের ছোট মাইয়া সুইটি তো ভাইগা গেছে। তিন দিন পরে বিয়া!

-বল কি? কবে ঘটলো এই ঘটনা?

-আজ সকালে। খালেক উদ্দীন মাইয়ার বিয়ার জন্য জমি বেইচা খরচাপাতি করছে, কাইলকা হাট থেকে গরু কিনছে, এখন যার বিয়া হেই নাই। উঠানে বইসা হাউমাউ কইরা কানতাছে।

-বল কি!!

মাওলানা আবুল মোকছেদ মসজিদে আসা যাওয়ার পথে প্রায়ই খালেকউদ্দীনের ছোটমেয়েটাকে দেখতেন রাস্তার পাশে এক গাছে হেলান দিয়ে মোবাইলে কথা বলতে। মেয়েটার আদব কায়দাও তো ভাল ছিল। তাকে দেখলে সালাম দিত। সেই মেয়ে যে এই কাজ করতে পারে কে ভেবেছিল? তবে এই জাতীয় ঘটনা যে ঘটতে পারে সেটা মাওলানা আবুল মোকছেদ আগেই কিছুটা অনুমান করেছিলেন। তাই তিনি প্রায়ই জুমার খুতবায় মোবাইল, ফেসবুক, বোলগের (কি সব যে আইছে দুনিয়ায়) ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে দীর্ঘ বয়ান করতেন। এই তথাকথিত প্রগতি যে সমাজের জন্য দুর্গতি ছাড়া আর কিছু বয়ে আনবে না সেটাও ব্যাখা করে বুঝিয়েছিলেন কিন্ত কেউ কানে লাগায়নি। কথাগুলো আজ অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাওয়ায় তিনি খানিকটা প্রীত অনুভব করেন। আজ লোকজন তার কথার মর্ম বুঝবে। তিনি খালেক উদ্দীনের উদ্দেশ্যে মনে মনে বলেন-মাইয়ারে মোবাইল কিইনা দিছস ক্যান হারামজাদা, এবার বুঝ ঠ্যালা। কথাটা বলার পরপরেই তিনি উপলব্ধি করেন যে অন্যের দুঃখে খুশি হওয়া মোটেও কোন ভাল মানুষের কাজ হতে পারেনা। তাই তিনি কয়েকবার আন্তাগফিরুল্লাহ বলে তওবা করে নেন। তিনি এই ভেবে খুশি বোধ করেন যে ভাগ্যিস মনের কথা মনেই থাকে, কেউ শুনতে পায় না। শুনতে পেলে সেটা একটা মহা কেলেঙ্কারির ব্যাপার হয়ে যেত।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মাওলানা মোকছেদ আজকের পত্রিকার দিকে চোখ বুলান। প্রথমে শুধু শিরোনামগুলো পড়েন, এরপর বিস্তারিত পড়েন। দেশের খবর, বিদেশের খবর, সম্পাদকীয় কিছুই বাদ দেন না। পত্রিকা উল্টাতে উল্টাতে এক সময় বিনোদন পাতা্র দিকে নজর চলে যায় তার। সেখানে বিশাল বক্ষা এক নারীর হাস্যজ্জল ছবি, নিচে শিরোনাম- আসছে সানি লিওনের নুতুন ছবি ওয়ান নাইট ষ্ট্যান্ড। ছবি দেখেই নাউযুবিল্লাহ মেন যালেক বলে পত্রিকা গুটিয়ে ফেলেন মাওলানা আবুল মোকছেদ। বিড় বিড় করে বলেন- কি এক দিন যে আইলো, রোজ কেয়ামত আইতে মনে হয় আর বেশি দিন বাকি নাই। আজ সকালে যে কার মুখ দেইখ্যা ঘুম থেইকা উঠছি। একটার পর একটা পাপ কাম করতাছি। কিছুক্ষণ পর কালাম মাষ্টারকে ধনঞ্জয়ের দোকানের দিকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়।

কালাম মাষ্টার এক কালে মাস্টারি করতো, এখন করে রাজনীতি। আবুল কালাম মাষ্টারি ছাড়লেও নামের শেষে মাষ্টার লেখা ছাড়ে নাই। টানা বিশ বছর ধরে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার। লোকে বলে কালাম মাষ্টাররে হারানোর ক্ষমতা নাকি কারো নাই। শোনা যাচ্ছে এবার নাকি মেম্বারি ছাইড়া চেয়ারম্যানের ইলেকশনে খাড়াইবো। গ্রামের একমাত্র এই একটি লোককেই সমীহ করে চলেন মাওলানা আবুল মোকছেদ। অবশ্য সমীহ না করে উপায় নেই। কালাম মাষ্টার গ্রামের মসজিদ কমিটির সভাপতি। মাওলানাকে দেখে দূর থেকেই দরাজ কন্ঠে লম্বা সালাম দেন কালাম মাষ্টার

-আস সালামু আলাইকুম ইয়া রহমতুল্লাহ মাওলানা সাব।

-ওয়ালাইকুম আস সালাম।

-তারপর আছেন কেমন?

-এই তো আল্লাহ রাখছে আর কি?আপনি কেমন আছেন?

-মাশাল্লাহ ভাল। তারপর আজকে দেশের খবর কি?

-আর দেশের খবর? নদনদীতে পানি নাই, জিনিসপত্রের দাম বাড়তাছে। লোকজন ভাল নাই।

-তয় আপনে যাই কন মাওলানা সাব আমাগো পার্টি পাওয়ারে আসার পর থাইকা জিনিসপত্রের দাম কিন্ত কমই আছে। -তা অবশ্য আপনি ঠিকই বলেছেন মেম্বার সাব।

-এদিকে দেশে তো আবার জঙ্গী উপদ্রব দেখা দিছে। হাসিনার তো জঙ্গী ঠেকাইতে অবস্থা খারাপ।

-জঙ্গী বইলা কিছু নাই মেম্বার সাব, এগুলান সব ইহুদি নাসারাদের ষড়যন্ত্র। ইসলাম এই সব সমর্থন করে না।

-সেটাই, কি এক দিন আইলো কন দেখি? আমরা সারাজীবন চোর ডাকাত খুনী দেখছি। এখন দেখতাছি জঙ্গী, হেরা নাকি বেহেশতের আশায় এই কাম করতাছে। আমারতো মাথায় তো কিছুই ঢোকে না।

-এগুলান সব কাফেরদের চক্রান্ত। মুসলমানদের ঐক্য বিনষ্ট করতে কাফের ইহুদী নাসারাই এইসব তৈরী করছে। তয় আল্লাহর রহমতে ওগো সব চক্রান্ত একদিন ব্যর্থ হইয়া যাবে ইনশাল্লাহ। একদিন ইসলামের বিজয় কাফেলা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে ইনশাল্লাহ।

-আমিন,সুম্মা আমিন। কালাম মাষ্টারের নজর এবার চলে যায় দোকানী ধনঞ্জয়ের দিকে। তাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন- কিরে ধনঞ্জয় তোর খবর কি? -এই তো ভগবানের কৃপায় আছি কোন রকম।

-সামনে ভোট আইতাছে। এলাকার খোঁজ খবর কিছু রাখিস? -জ্বি মেম্বার সাব রাখি।

-শোন এইবার আর মেম্বারের ইলেকশন করুম না , ডাইরেক্ট চেয়ারম্যানের ইলেকশন করুম। পার্টির খাতিরে সাদেক আলীর পিছনে মেলা ইলেকশন করছি, এবার ওরেই টেক্কা দিমু।

-ভাল একটা সিদ্ধান্ত লইছেন। সাদেক আলী চেয়ারম্যান কোন কাম করে নাই, আমাগো মন্দিরের সামনে রাস্তায় একটু মাটি ফেলতে নারায়ণ কাকা যে কতবার গেছে হের ওর কাছে তবুও কামটা কইরা দিল না।

-তোগো মালাউনগো উপকার কইরা আসলে ইহকাল পরকাল কোনকালেই ফায়দা নাই। তারপরও আমি চেয়ারম্যান হইলে তোগো মন্দিরের সামনের রাস্তা পাকা কইরা দিমু যা, তয় ভোট কিন্ত আমারে দিবি? একটা ভোটও যদি অন্য দিকে পড়ে তয় আল্লার কসম তোগো গোষ্ঠী শুদ্ধা ইন্ডিয়ায় পাঠামু।

-না না মেম্বার সাব একটা ভোটও অন্য দিকে পড়বো না।

-না পড়লে তো ভাল। মেম্বার সাব কইতাছস ক্যান? এখন থেইকা কবি চেয়ারম্যান সাব। -ভুল হইয়া গেছে চেয়ারম্যান সাব। মাফ দেন।

-গত দুর্গা পুজায় তোগো দশহাজার টাকা দিলাম। কেমন করলি পুজা?
-জ্বি হইছে ভালই।

-পুজার প্রসাদ তো কিছু খাওয়াইলি না।

-খাড়ান এখনি আনতাছি।

পাঁচ মিনিটের মধ্যেই একটা বাটিতে করে কিছু নারিকেলের নাড়ু নিয়ে এসে কালাম মাষ্টারের সামনে রাখে ধনঞ্জয়। কালাম মাষ্টারে একটা নাড়ু নিয়ে নাড়ুর বাটিটা মাওলানা মোকছেদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন

-নেন মাওলানা সাব একখান নাড়ু নেন।

এতক্ষণ পত্রিকা পড়ায় মগ্ন থাকলেও তাদের আলাপ আলোচনা সবই শুনছিলেন মাওলানা মোকছেদ। যে ব্যক্তি হিন্দুদের মন্দিরে দান খয়রাত করে তাকে আর যেই হোক তিনি যে ভোট দিবেন না সেটাও মনস্থির করেছেন। তিনি শুনেছেন যে এই নাড়ুগুলো দুর্গা পুজার প্রসাদ। এগুলো খাওয়া যে মোটেও শরীয়ত সম্মত নয় সেটাও তিনি বিলক্ষণ জানেন। তবুও বিনীত কন্ঠে তিনি বলে উঠেন

-না না মেম্বার সাব, আপনেই খান। আমার পেটে সমস্যা।

-আরে খান খান, একটা খাইলে কিছু হয় না। নাড়ুটার টেষ্ট আছে। এই হিন্দুগুলান নাড়ু ভাল বানায়।

-না না আপনেই খান।

-আরে খান একটা সমস্যা নেই।

মাওলানা আবুল মোকছেদ মারাত্নক দোটানায় পড়েন। এক দিকে কালাম মাষ্টারের মত প্রভাব শালীর অনুরোধ আবার আরেক দিকে শরীয়তের বিধান। শেষমেষ দোটানায় ভুগতে ভুগতে একটা নাড়ুর সামান্য অংশ মুখে ঢুকান কিন্ত পুরোপুরি গলাধঃকরন করেন না। নাড়ু্র টুকরাটি মুখে ঢুকিয়েই তিনি বলেন

-মেম্বার সাব জোহরের আযানের সময় হয়ে গেছে, আমি আজ উঠি।

-আচ্ছা ঠিক আছে।

অগ্যতা সোজা বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন মাওলানা আবুল মকছেদ। একটু সামনে ফাঁকা জায়গায় আসতেই থু থু করে মুখ থেকে নাড়ুর অংশগুলো ফেলে দেন তিনি। পাশের একটি বাড়িতে ঢুকে গৃহকর্তীকে জিজ্ঞেস করেন- তোমাদের বাসার কলপাড়টা কোন দিকে? গৃহকর্তী কলপাড়টা দেখিয়ে দেয়। মাওলানা আবুল মোকছেদ কলপাড়ে বসে মুখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে বমি করার চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্ত কি এক কপাল তার, অনেক চেষ্টার পরও আজ আর কোন বমি বের হয় না। মাওলানা আবুল মোকছেদ তবু চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। তার উকাউকির শব্দ নজর কাড়ে পাশেই খেলারত দুই কিশোরের। একজন বলে
-দেখ দেখ ইমাম সাব বমি করতাছে।

-মনে হয় পোয়াতি হইছে। অপর জন উত্তর দেয়।

দুই কিশোরই একসঙ্গে হাসতে থাকে। তাদের হাসির শব্দ মাওলানার কানে আসে না। তার সকল মনযোগ আবদ্ধ হয় বমি করার প্রতি। এক পর্যায়ে অনেক চেষ্টার পর সামান্য কিছু বমি বের হয়। বমিগুলো বের হওয়ার পর পরম শান্তি অনুভব করেন মাওলানা আবুল মোকছেদ। বমি করে আর কখনো এমন শান্তি পেয়েছেন বলে মনে পড়ে না তার। আজ সারাদিনের সবপাপ যেন বমি হয়ে বের হয়ে গেছে, এমনটাই মনে হতে থাকে। পাপ মোচনের আনন্দ যে পুণ্য অর্জনের আনন্দের চেয়ে কোন অংশেই কম নয় আজ তা যেন আবার নুতুন করে অনুভব করেন মাওলানা আবুল মোকছেদ। পাপ মোচনের এই বিমলান্দ তার হৃদয়ে একটা নির্মল প্রসন্নবোধের জন্ম দেয়, প্রখর মাদকতাময় একটা প্রগাঢ প্রসন্নবোধ…