(১)
৮ই অক্টবর ২০০৮, আইসল্যান্ড। হ্যা যেভাবে গ্রীষ্মের প্রবল দাবাদহে সেকেন্ডের মধ্যেই বরফ গলে জল হয়, ২০০৮ সালের সামারে পৃথিবীব্যাপী ফ্যাইন্যান্সিয়াল মেল্টডাউনে, গলে জল আইসল্যান্ডের অর্থনীতি। ওইদিনই আইসল্যান্ডের ন্যাশানাল ব্যাঙ্ক, সেন্ট্রাল ব্যঙ্ক অব আইসল্যান্ড জানিয়ে দেয়, তাদের পক্ষে সম্ভব না, আইসল্যান্ডের ব্যাঙ্কগুলো উদ্ধার করা-কারন তারা আইসল্যান্ডের জিডিপির প্রায় এগারোগুন ধার দিয়ে বসে আছে! সম্পূর্ন রেকলেস ফাইনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট। ভাবুন সারদা কেলেঙ্কারিতে আপনাদের শুধু কারু কারুর এক দুলাখ টাকা গেছে। ৮ ই অক্টবর ২০০৮ ছিল এমন একটা দিন, যেদিন আইসল্যান্ডের সবাই জানল, তাদের সব ব্যাঙ্ক উল্টেছে, সেভিংস বলতে আর কিছু নেই।

আটই অক্টবরে সব ব্যাঙ্কের যেদিন গণেশ উল্টালো, ওইদিন শুধু একটা ছোট ফ্যানান্সিয়াল সার্ভিস -আডুর ক্যাপিটাল কিন্ত টিকে যায় । আডুর ক্যাপিটালের মালকিন দুই মহিলা- হাল্লা তোমাসদোতির এবং ক্রিস্তিন প্রেদুসদোতির। এই ভদ্রমহিলা রিস্ক ইনভেস্টমেন্ট করে নি, গ্রাহকদের বরং বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন, রেকলেস ফাইনান্সিল গেইন মানেই ভরাডুবি। ফলে ওই টর্নেডোর মধ্যেও টিকে যায় তাদের সার্ভিস।

পরবর্তীকালে হাল্লা একটা খুব ইম্পটার্ন্ট কথা বলেছিলেন। উনার মতে, ২০০৮ সালের ফাইনান্সিয়াল ক্রাইসিসের জন্য দায়ী পুরুষ নেতৃত্ব। হাল্লা দেখিয়েছিলেন, ফাইন্যান্সিয়াল ইন্সটিউটগুলোর টপ ম্যানেজমেন্টের ৯৫% ই পুরুষ। ফলে এইসব ইন্সটিউটশনগুলি সাংঘাতিক ভাবেই প্রচুর লাভের প্রত্যাশাই আইন ভাঙে এবং সাংঘাতিক রিস্ক নিয়ে থাকে। জৈব বিবর্তনের কারনেই পুরুষ অনেক বেশী এগ্রেসিভ এবং রিক্স নিতে ভালবাসে। পুরুশ একাধারে যোদ্ধা এবং জুয়ারী। ফলে পুরুষের সিদ্ধান্ত অনেকক্ষেত্রেই বেশী এগ্রেসিভ, ঝুঁকিপূর্ন এবং আইনের বর্ডার লাইনে খেলা করা। এর তুলনায় নারীর মানসিকতা অনেক বেশী রক্ষণশীল-কারন বহুদিন ধরে সংসার চালানোর দায়ভার নারীরই।

(২)

অবশ্য আইসল্যান্ড পর্যন্ত যেতে হবে না-পশ্চিম বঙ্গের দিকে তাকালেও পরিস্কার হবে মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বের ক্যারিশমায় পশ্চিম বঙ্গের রাজনীতি আজ বিরোধিশুন্য। মুর্শিদাবাদের শাহেনশাহ অধীর খোদ মুর্শিদাবাদেই জমি হারাতে চলেছেন যা সিপিএম আমলেও ছিল অকল্পনীয়। কালকেই অমিত শাহ দিল্লী থেকে নিদান দিয়েছেন বিজেপি মমতার বিরুদ্ধে আন্দোলনে যাবে না-যার নীটফল ফেসবুকের বিজেপি ধর্নুর্ধররা অস্ত্র মাটিতে শুইয়ে রেখে বাণপ্রস্থের যাবার পাবলিক পোস্টিং দিচ্ছেন সর্বত্র। সিপিএমত বহুদিন আগেই ধ্বংস। আপনারাই বিচার করুন-মমতা ব্যানার্জির রিয়াল পলিটিক্সের সামনে প্রকাশ কারাত, সীতারাম ইয়েচুরি, সূর্যকান্ত মিশ্র, বিমান বসু-সম্পূর্ন নাবালক। মমতা যেভাবে জনগণের পালস বোঝেন-রাজনীতি বোঝেন তার ধারে কাছেও নেই কোন সিপিএম নেতৃত্ব। শুধু তাই না-গোটা পশ্চিম বঙ্গ জুরে মমতা যেভাবে কাজ আদায় করে নিতে পারেন আমলাদের কাছ থেকে-সিপিএম আমলে কোওর্ডিনেশন কমিটির তাবেদারি ছাড়া- রাজ্য প্রশাসন ছিল সম্পূর্ন ধ্বংস। মোদ্দা কথা, রাজনীতিবিদ এবং প্রশাসক হিসাবে মমতাকে ৮০/১০০ দিলে সিপিএমের নেতাদের ১০/১০০ দেবারও কারন নেই।

ইন্দিরা গান্ধীর আমলেও বিরোধি পুরুষনেতাদের দুরাবস্থা অধীরের থেকে ভাল কিছু ছিল না । যদ্দিন ইন্দিরা বেঁচে ছিলেন –না কংগ্রেসের মধ্যে, না বিরোধিদের মধ্যে এমনকোন নেতা ছিল-যিনি ইন্দিরার পলিটিক্যাল ক্যারিশমার কাছাকাছি আসতে সক্ষম। ইন্দিরাও মমতার মতন বিরোধিশুন্য করে ছেড়েছিলেন সম্পূর্ন নিজের পলিটিক্যাল ক্যারিশমার জোরে।

এবার শেখ হাসিনা এবং বেনজির ভুট্টোর দিকে তাকানো যাক। ১৯৯১ এর পরে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ সম্পূর্ন নারী নেতৃত্বের আওতাই। মাঝের ২০০৭-২০০৯ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ দিয়ে। বাংলাদেশের জিডিপি থেকে হিউম্যান ডেভেলেপমেন্ট ইন্ডেক্সের সব থেকে বেশী প্রগতি কিন্ত হাসিনার আমলেই হয়েছে। বাংলাদেশীরা নারী নেতৃত্ব শুনলেই তেলে বেগুনো জ্বলে ওঠেন। স্বাভাবিক আন্টি ইনকাম্বেন্সি। কিন্ত বাস্তব এটাই বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বঙ্গে পুরুষ রাজনীতিবিদ সেই মাপের নেই।

বেনজিরকে খুন না করলে পাকিস্তানের আজকের এই দূরাবস্থা হয় না। আমি পাকিস্তানের নিউক্লিয়ার বোমের জনক আব্দুল কাদের খানের ইন্টারভিঊ শুনছিলাম। উনি বেনজিরকে খুব গালাগাল দিচ্ছিলেন। কারন বেনজির ভুট্টো পাকিস্তানের নিউক্লিয়ার বোম প্রোগ্রাম প্রায় বন্ধ করে দিতে চাইছিলেন। এই কারনেই চাইছিলেন যে নিউক্লিয়ার বোমার জন্য পাকিস্তানের ওপরে সব ধরনের নিশেধাজ্ঞা-এবং যার দরুন পাকিস্তানের অর্থনীতির জীর্ন দশা। পাকিস্তান এমন এক দেশ, যার বাজেটের মোটে ১% খরচ হয় জনগনের শিক্ষা এবং চিকিৎসার জন্য। ৫৬% যায় মিলিটারীর পেছনে!
এই দেশ কি টিকতে পারে? বেনজির এসবের পরিবর্তন চেয়েছিলেন-ফলে পাকি মিলিটারী তাকে খুন করে দিল!

(৩)

আমেরিকাতেও দেখুন হিলারী ক্লিনটনের প্রেসিডেন্ট হওয়ার কথা বিল ক্লিনটনের আগে। কি ছাত্র হিসাবে, কি ছাত্র নেতা হিসাবে কি পেশাদার আইনজীবি হিসাবে হিলারি ক্লিনটন বিল ক্লিনটনের থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন। কিন্ত আমেরিকা নারী নেতৃত্ব খুব একটা বেশী মানতে অপারগ। ফলে রাজনীতিবিদ হিসাবে এগিয়ে গেলেন বিল ক্লিনটন। আর অনেক বেশী সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও, ফার্স্ট লেডি হিসাবেই কাটাতে হল হিলারীকে। যদিও ২০০৮ সালেই প্রেসিডেন্ট হওয়ার কথা হিলারীর। কিন্ত সেই বছরই উত্থান ওবামার-যিনি সম্ভবত শতাব্দির সেরা রাজনীতিবিদ বলেই আমি মনে করি।

অন্যদিকে পুরুষ রাজনীতিবিদ হিসাবে ট্রাম্পের ভূমিকা দেখুন। সম্পূর্ন ঘৃণার চাষবাস করে ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টা। শুধু ট্রাম্প কেন-বাকী সব রিপাবলিকান পুরুষরাজনীতিবিদরাই মনে করে
আর্বশন বন্ধ করা উচিত। অদ্ভুত সব দাবী এই রিপাবলিকান পুরুষ রাজনীতিবিদদের!

কি ট্রাম্প, কি সীতারাম ইয়েচুরি। পুরুষ রাজনীতিবিদ মানেই বাস্তব বর্জিত বস্তাপচা আদর্শবাদ, মানুষের মনে সুরসুড়ি দিয়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা। সেখানে মমতা বা হিলারীর রাজনীতির মধ্যে আছে নারীত্বের ছোঁয়া-যা মাটির খুব কাছাকাছি-এবং যা মেয়েরা শেখে একদম বাস্তব ভাবে বাঁচার জন্য, সংসারকে বাঁচানোর জন্য। এই বাস্তববাদিতা পুরুষদের রাজনীতিতে অনুপস্থিত।

সুতরাং পৃথিবীকে ক্ষমতা এবং লোভ থেকে বাঁচানোর জন্য রাজনীতি , ফাইনান্স এবং কর্পরেটে মহিলা নেতৃত্ব আরো অনেক বেশী করে দরকার। পুরুষ আসলে জন্মলগ্ন থেকে শিকারি। ফলে সে স্বভাব জুয়ারী। তাকে দিকে শিকার হবে-কিন্ত ম্যানেজমেন্ট এবং নেতৃত্বের ক্ষেত্রে মেয়েদের ক্ষমতা স্বভাবজাত।

সিপিএম এবং কংগ্রেসকে টেনে তুলতে গেলে একটাই পথ-মহিলা নেতৃত্বকে ক্ষমতা দিতে হবে বেশী। কিন্ত সিপিএমের ক্ষেত্রে তা প্রায় অসম্ভব। তারা গোটা পার্টিতেই মেয়েদের ক্ষমতার ল্যাডারে উঠতে দেয় নি। ফলে আজকে পার্টির ভরাডুবি।