এই আগস্টের রাতেও নরম লেপ গায়ে শুয়ে আছে শিপন । আধা আঁধারির ঘরটায় এ.সি-র এল.ই.ডি নির্দেশিকায় চোখ পড়ছে বার বার । ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস । কয়েকবার খুঁজেও রিমোটটা না পাওয়ায় শেষমেশ লেপের তলে । এই কাজ সে আগেও করেছে । গরমে এসি ছেড়ে ঘরে কৃত্রিম শীত বানিয়ে পাতলা চাদর বা কাঁথা গায়ে ঘুম দেবার মজাই আলাদা । কিন্তু এদেশে সেই নকশা করার নকশি কাঁথা কই ? তবে অনেক দিন পর আজ একটা পূর্ণাঙ্গ স্বস্তির ঘুম ঘুমাবে সদ্য প্রবাসী শিপন । অবশেষে তার স্বপ্ন সত্যি সত্যিই সত্যি হল । এখন আর কোন সন্দেহ বা দুশ্চিন্তা নেই । আলাদা কোন লাইন-ঘাট বা সিস্টেম করা ছাড়াও স্কলারশিপটা যে পেয়ে যাবে, এতদিন সে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে নি । তাই প্রথম দিন বিদেশ বিভূঁইয়ে অনাগত অজানাকে পাড়ি দেওয়ার চিন্তা ছাপিয়ে তার মনের সবটা জুড়ে এখন প্রাপ্তির প্রশান্তি । শুয়ে শুয়ে মনের কোণে উদয় হয় ফেলে আসা দেশের কথা আর পথিমধ্যে ঘটে যাওয়া বিচিত্র সব কাহিনী:
— এস্কুজ মি, হয়ার ইজ দা টয়লেট ?
প্রচণ্ড প্রাকৃতিক বেগে নাকি লাস্যময়ী বিমানবন্দর কর্মীর রূপে শিপনের মুখ দিয়ে বহুদিন পর স্বতঃস্ফূর্ত ইংরেজি বেরিয়ে এলো ।
— সরি, পারডন ?
কর্মীর এক মুখ কৌতূহল মাখা পেশাদারী হাসি । কিছুই বোঝে নি সে । শিপন এবার বেপরোয়া:
— আই মিন, হয়ার ইজ দা বাথরুম ?
“যথেষ্ট” ইংরেজি জানায় এখানে চাকরি পাওয়া কৌতূহলী মুখটায় এবার ইংরেজি কথা বুঝতে না পারার লজ্জা ।
— আই এ্যাম সরি ।
মহাবিপদের গন্ধ পায় শিপন । সেই বাসা থেকে বেরুনোর আগে একবার টয়লেট করা । তারপর বিমানে পুরোটা পথ একরকম চেপে বসে ছিল । কি যেন এক অজানা অনুভূতির বশে প্লেনের ছোট ঘরে যেতে পারে নি সে । বারবারই তার মনে ভর করেছে ছোট বেলার এক স্মৃতি । একবার খরার ছুটিতে দেশের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে জাগা চরে ডাংগুলি খেলছিল খুব । এমন সময় ব্রিজ পার হচ্ছিলো শান্তাহার এক্সপ্রেস । তার ঠিক নিচে দাঁড়িয়ে সে হা করে দেখছিল প্রচণ্ড শব্দ তোলা রেলগাড়ি । কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই হঠাৎ তার চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে । নাক মুখ লেপ্টে থকথকে দুর্গন্ধযুক্ত কিছু একটার শিকার হয় শিপন । সাথে সাথে বন্ধুদের টিটকারি মাখা অট্টহাসির রোল । অতি পরিচিত এই ঘেন্নার বস্তু থেকে নিষ্কৃতি পেতে সে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সেদিন মৃতপ্রায় নদীর মরূদ্যান-সম ছোট্ট “ডোবায়” ডুব দেয় । এর অনেক পরে তার ট্রেনে চড়া এবং ট্রেনে পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারনা লাভের সুযোগ হয় । আজ প্লেন নিয়ে তার একইরকম ভুল ধারনা বশত সে কোন বিদেশি বালকের মুখ “পোড়াতে” বা অপাত্রে বিষ্ঠা ত্যাগ করতে চায় নি । কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে এই বেটি তার কথা না বুঝলে আর বিষ্ঠা ত্যাগের বেস্ট জায়গাটা সময়মত খুঁজে না পেলে তার নতুন কেনা জিন্সের প্যান্টটাকেই হয়ত পাত্র বানাতে হবে । দুহাত পেছনে নিয়ে পশ্চাদদেশ ঢেকে পেট পিঠ মুচড়ানো শরীরী ভাষা যোগে তার শেষ চেষ্টা:
— প্লিজ টেল মি, হয়ার ক্যান আই শিট ?
রূপসী কর্মী আর কিছু না বুঝলেও শিপনের মোচড়ানো দেহ ভঙ্গি আর “প্লিজ” এবং “শিট” কথা দুটো বোধ হয় বুঝতে পারলো । আর তাতে তার পেশাদারী হাসিটা মুহূর্তে উবে গিয়ে চোখে মুখে জেগে উঠল অজানা সন্দেহ । শিপনের ততক্ষণে মরি মরি অবস্থা । অতি সেনসিটিভ চীনা কানে উপমহাদেশীয় ইংরেজির টান যে সহজে ব্যাটে বলে হবার নয়, তা তক্ষণ শিপন বুঝবে কি করে ? তবু শেষমেশ রূপসীর এক সহকর্মী তাকে আঙ্গুল দিয়ে একটা দিক নির্দেশ করা মাত্রই সে পড়ি মরি করে সেদিকে ছুটে চলল । সামনে ইংরেজিতে লেখা, “টয়লেট” । ভোঁ দৌড়ের পথে মাথা ঘুরিয়ে স্কার্ট পরা রূপসীকে আরেকবার দেখে নিলো সে । জোস, হলদেটে ফর্সা লম্বা পা জোড়া যা সুন্দর না ! বাহ, এখানকার শৌচাগারও তো খুব সুন্দর । ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে চেপে রাখা মল ত্যাগের সুখে তার কাছে সবকিছুই ঝলমলে মনে হতে লাগলো । কমোডে বসে এতক্ষণে চোখ পড়ল দরজায় । চীনা ভাষায় কিছু একটা লেখা । নিচে ইংরেজি অনুবাদ ছিল কিন্তু কেউ একজন সেখানে মার্কার পেন দিয়ে একটা তীর চিহ্ন আঁকায় তা অনেকটা অস্পষ্ট । ভাষা না বুঝলেও পাবলিক টয়লেটে তীর চিহ্নের কাহিনী আঁচ করতে তার মোটেও বেগ পেতে হল না । সামনের দরজায় লেখা থাকবে, “ ডাইনে দেখ”; ডাইনের দেয়ালে লেখা থাকবে “বায়ে দেখ”; বায়ের দেয়ালে, “পেছনে দেখ”। আর পেছনে মাথা ঘুরালে দেখা যাবে “উপরে দেখ” । কৌতূহলে যন্ত্র-মুগ্ধ মাথা উপরে তুললে দেখা যাবে ছাদে লেখা আছে, “হাগতে আইসা এত এদিক ওদিক তাকাতাকি কিসে? তাড়াতাড়ি মাল খালাস কইরা বাড়িত যা” টাইপ কথাবার্তা । দেশে থাকতে শিপন অনেকবার ভেবেছে এই মহত আইডিয়াটা ঠিক কার উর্বর মস্তিষ্কের ফসল কিংবা হাগতে এসে কোন উদ্যমী টয়লেটের চাতালে উঠে কথাগুলো লিখে রেখে যায়? একবার তাদের সাথে দেখা হয়ে গেলে অটোগ্রাফ রেখে দিত !

যাহোক, এখানেও সেরকম মহাত্মা থাকতে পারে ভেবে মনের অজান্তেই সে কমোডে বসে ডানে বায়ে তাকাতে লাগলো । দেয়াল গুলোর নিচে বিঘত খানেক ফাঁকা । পাশের খোপে বসা পাবলিকের জুতা আর জুতার উপর খুলে ফেলে রাখা বেল্ট পরা প্যান্ট দেখা যায় । কিন্তু দেয়াল পরিষ্কার, তেমন কিছু লেখা নেই । এই ডানে বায়ে তাকাতে তাকাতে শিপন হঠাৎ একটা জিনিস আবিষ্কার করল, টয়লেটে কোন বদনা নেই! এমনকি কোন পানিও নেই । কী ভয়ানক ব্যাপার! দেশে থাকতে অনেকের কাছে সে শুনেছে, এদেশিরা নাকি ছোঁচে না, মোছে । কিন্তু এখানে মোছামুছি করারও তো তেমন কিছু চোখে পড়ছে না তার । তাহলে উপায় ? প্লেনে বিদেশি খাবার পেটে পড়ায় বৃহদান্ত্রের ফাইনাল প্রোডাক্ট আজ একটু অন্যরকম, আঠালো; সাথে দুর্গন্ধময় বাই-প্রোডাক্ট । ভালোমতো পয় পরিষ্কার না হয়ে বেরুলে সঙ্গী সাথীদের মাঝে বসবে কোন মুখে? ওদিকে ট্রানজিসন প্লেনেরও সময় হয়ে যাচ্ছে । এ তো মহাবিপদ । হঠাৎ পকেট হাতড়ে সে পেয়ে গেল লান্স বক্সের সাথে পাওয়া একটা শুকনো আর একটা ভেজা টিস্যু পেপার । একেই বুঝি বলে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া, তাও আবার একটা নয়, দুই দুটো টুকরো । জল খরচ করায় অভ্যস্ত হাত প্রথমেই বেছে নিলো ভেজা ভেজা চাঁদ । আর কাঁপা কাঁপা অদক্ষ সন্দিহান বাঁ হাতে চাঁদের গায়ে লেপে দিতে লাগলো হলুদ, কালো “কলঙ্ক” । আজ তার কলঙ্কটা একটু বেশি বেশি যা মুছতে তার চাই জল । শেষ সম্বল শুকনা টিস্যুতে ভরসা হচ্ছিল না শিপনের । সেটাকে সমান চার ভাগে ভাগ করে ছিঁড়ে নিয়ে একটা একটা করে কাজে লাগাবে । কিন্তু জল কই ? হুমায়ুন আহমেদের “আমার আছে জল” বইটার কথা অযথাই মনে পড়ে গেল তার । পাইছি! জল তো আছেই । বিটিভিতে হারপিকের সেই বিজ্ঞাপনের কথা, “ব্রাশ করে ফ্ল্যাশ করুন”। এ যেন বুদ্ধির বলিহারি । কমোড ফ্ল্যাশের বোতামে চাপ দিলে মল-পাত্রের উপর থেকে ক্ষিপ্র গতিতে বেরিয়ে এলো স্রোতধারা । আর তাতেই সিক্ত হয়ে চার ফালি চন্দ্র-পত্র পর্যায়ক্রমে যথাসম্ভব মুছে দিলো শিপনের গোপন কলঙ্ক ।

রাতে হোস্টেলে এসেই দু দু বার সে ভালোমতো গোসল সেরেছে । হ্যান্ড সাওয়ার দিয়ে অনেক জল খরচও করেছে । কক্ষ-লগ্ন স্নানের এই ঘরটা অনেকটা যাদুঘরে রাখা বিশাল বয়ামের মত, আগাগোড়া কাঁচে ঘেরা । ভেতরে ঝরনার হাতল বাঁদিকে ঘোরালে ঠাণ্ডা পানি আর ডান দিকে ঘোরালে গরম পানি । বাহ, কি মজা ! কিন্তু এই মজায় একটুর জন্য তার পশ্চাৎ-দেশের চামড়া পুড়তে বসেছিল । কাপড় খুলে ঝরনার মুখ নিচ থেকে ওপরে তাক করেই হাতল পুরোপুরি ডানে টান । আর যায় কোথায় । গরমের শক খেয়ে ঝরনা ফেলে পড়ি মরি করে বাঁচাবাঁচ । এরপর এ নিয়ে একটু গবেষণা করতেই সব দিনের আলোর মত ফকফকা । সারাদিনের ক্লান্তি শেষে হট-কুল স্নান আর লেপের উপর দিয়ে শীতল আর্দ্র বাতাস, প্রশান্ত মনে এলোপাথাড়ি স্মৃতি রোমন্থন । রাত ১১ টার দিকে শিপন প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিলো । এমন সময় হঠাৎ বাইরে থেকে দরজার তালা খোলার শব্দ । সাথে সাথে হুড়মুড় করে কেউ একজন ঢুকল । না, ভিতরে না ঢুকে দরজাটা আধা খোলা রেখে সে ওখানে দাঁড়িয়েই বিড়বিড় ফিসফাস করতে লাগল । শিপন রেজিস্ট্রেশন করার সময় নাম তালিকায় দেখেছিলো তার কক্ষ সঙ্গী একজন, এক রাশিয়ান ছেলে । কিন্তু বিশাল লম্বা এই ছেলেটার সাথে দরজায় দাঁড়িয়ে ফিসফাসে তাল দিচ্ছে আরও একটা মিষ্টি মেয়ে কণ্ঠ । মাঝে মাঝে মৃদু মন্দ খিলখিলানি হাসি । মদ-তাড়ি কিংবা পারফিউম, হয়তবা দুটোরই সম্মিলিত গন্ধ ভেসে এলো নাকে । শিপন দরজার দিকে মুখ করেই শুয়ে ছিল । কিন্তু অন্ধকারে ভেজানো দরজার ওপাশে কি হচ্ছিলো তা পরিষ্কার ঠাউরে উঠতে পারছিল না । একসময় হাসি আর ফিসফাস কিছুটা থেমে গেল বোধহয় । কিন্তু মিষ্টি ঘ্রাণটা রয়েই গেছে । কৌতূহলের সপ্তমে চড়া শিপন আরও ভালো ভাবে কিন্তু সাবধানে লীলা খেলা দেখতে শোয়া অবস্থাতেই মাথাটা সামনের দিকে উঁচিয়ে লেপ মুড়ি দেয়ার ভান করে কান পেতে থাকে । ওদিকে অনেকক্ষণ নীরবতা । শিপনের টানটান ঘাড় ধরে আসতে লাগলো । হঠাৎ দ্বৈত-স্বরে একটা শব্দ শোনা গেল—পাকা, পাকা । মেয়েটা গটগটিয়ে চলে গেল । দুম করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল রাশান । সাথে সাথে লুকিয়ে দেখা ধরা পড়ার ভয়ে শিপন তড়িঘড়ি করে যেই না মাথা শোয়াতে যাবে অমনি খাটের মাথার লোহার রডে ঠাস করে এক বাড়ি খেয়ে তার অস্ফুট কোৎ আর্তনাদ বেরিয়ে এলো । এমন সময় রাশান ঘরের বাতি জ্বালিয়ে কথা বলে উঠল,
— হাই, হাও আর ইউ? আই এ্যম সারগেই ।
মাথায় শক্ত বাড়ি খাওয়া গোবেচারা শিপন ঐ মুহূর্তে যে কেমন থাকে তা সে ছাড়া আর কে জানবে ? তবুও খানিক ভদ্রতা করে গদ বাধা স্পোকেন ইংলিশের মহড়া দিল:
— আই এ্যাম ফাইন । মাই নেম ইজ শিপন । আই এ্যাম ফ্রম বাংলাদেশ ।
— ও, আই সি । গুড কানট্রি । ডোন্ট ইউ ফিল ভেরি কোল্ড ইন দিস রুম ?
বলেই ছেলেটা রিমোটের তোয়াক্কা না করে লম্বা হাতে এ.সি-র পাওয়ার প্লাগটা সকেট থেকে হ্যাঁচকা টানে খুলে সব ল্যাটা চুকিয়ে দিল । হা করে তাকিয়ে থাকা শিপন লেপ থেকে বেরিয়ে আসতেই এবার রাশানটার হা হবার পালা । সে তাকিয়ে আছে শিপনের রংবেরঙ্গা লুঙ্গির দিকে । এত কাছ থেকে লুঙ্গি জিনিসটা সে আগে কখনও দেখেনি ।
— ইটস ভেরি ইন্টারেস্টিং স্কার্ট । আই লাইক ইট ।
কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না শিপন । তার মাথায় ঠাটা খাওয়া জায়গায় ফুলে আলু হয়ে গেছে । ওদিকে রাশানও উত্তরের অপেক্ষা না করে বাতি নিভিয়ে জামাকাপড় না পাল্টেই বিছানায় সটান হল । শিপনের এখন দরকার ঘুম । কাল সকালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ভাই নবাগত বাংলাদেশীদের নিয়ে সব জায়গা পরিচয় করিয়ে দেবেন । এখানে র‍্যাগিং হয় কিনা কে জানে । যাহোক, কড়া ঘুমে আচ্ছন্ন হল শিপন, শুধু স্বপ্নে দেখল দেশে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচের সেই ঘটনাটা ।
পরদিন কাক ডাকা ভোরে শোনা যায়নি কাকের ডাক । দূর থেকে ভেসে আসছে নানা কিসিমের নানা ভাষার বুলি । নিরবচ্ছিন্ন নিটোল নিদ্রা থেকে উঠে বসলো শিপন । পাশের বিছানায় বাবু মেরে বসে আছে রাশান বাবু । কোলে একটা বেঢপ বোতল । তাতে লেখা, “ভদকা”। গতকাল রাতে লুঙ্গি নিয়ে তার টিটকিরির জবাব দিতে গেল শিপন :
— ভেরি নাইস বটল, আই লাইক ইট ।
— রিয়েলি ? ওয়ানা টেইস্ট এ লিটল ?
— ও নো নো, আই ডোন্ট ড্রিংক ।
— ও কে, আই উইল গিভ ইউ দা বটল আফটার আই ফিনিশ ড্রিংকিং । নো প্রবলেম । হা হা ।
রাশানটা ভারি সেয়ানা রসিক তো । কথা দিয়ে দমাতে গিয়ে নিজেই কিছুটা দাবা খেলো শিপন । যাহোক, তাকে একটু পরে বেরোতে হবে । ঘটক ভাই নাকি কি ভাই আছেন এখানে একজন । উনার ওখানে নবাগত বংগ পুঙ্গবদের সবার দাওয়াত । খাই দাই, ঘোরাঘুরি সবই হবে তার নেতৃত্বে । রেডি হয়ে দালানের নিচে নামতেই কয়েকজন বাঙ্গালির দেখা পেল সে । তাদেরকে পেয়েই মনটা খুশিতে ভরে গেল তার । বাংলায় দুটো মনের কথা কওয়া যাবে । আশেপাশে অসংখ্য বিদেশী ছাত্র ছাত্রীর মুখরিত কলরব, ব্যস্ত আনাগোনা । কিছুক্ষণ পর একদম ঘড়ির কাটায় কাটায় কথা অনুযায়ী ঘটক ভাই হাজির । শ্রুতি আছে তিনি বিদেশেও অনেক অঘটন-ঘটন পটীয়সী । সর্বত্র তার খ্যাতি, বিশেষ করে নারীকুলে । লম্বা, ফর্সা, স্বাস্থ্যবান, একাধিক ভাষায় পণ্ডিত ঘটক ভায়া আমাদের সাথে একে একে পরিচিত হলেন । একমুখ দর্শনীয় হাসি হেসে বললেন:
— চল আগে ক্যাম্পাসটায় একটা টুর দেওয়া যাক ।
একে একে তিনি ক্যান্টিন, শিক্ষাভবন, ছাত্রাবাস, উদ্যান, খেলার মাঠ, গ্রন্থাগার সব বর্ণনা ও ইতিহাস সহ পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলেন । ব্যাপারটাকে কেন জানি শিপনের কাছে মনে হল অনেকটা পল্লীকবি জসিম উদ্দিনের “কবর” কবিতার মতো । “এই খানে তোর দাদীর কবর, ডালিম গাছের তলে । তিরিশটি বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে” — এর পরিবর্তে ঘটক ভাই বলছেন, “এই খানে সেই আড্ডা ক্যাফে, ডিসকো বারের পাশে । বিশটি বছর মাতিয়ে রেখেছি সখি পাবার আশে ।।” যাহোক, একথা সেকথা, দেশী বিদেশী নানা পাবলিক সম্পর্কে নানা টিপস দেয়ার পর তিনি আরও বললেন, এখানে নিজেদের মধ্যে বাংলায় কথা বলাই সবচেয়ে নিরাপদ । কারণ হাতে গোনা কয়েক জন বাঙ্গালি ছাড়া আমাদের কথা আর কেউই বুঝবে না । কাউকে যদি বাংলায় কসে গালও দাও কোন চিন্তা নেই । ওরা মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝবে না ।
— ঐ যে দেখ সাদা চামড়ার ছেলে গুলো । ওরা এখানে খুব জনপ্রিয় । ওদেরকে আমরা ডাকি সাদা ভাই বলে । আর সাদা মাইয়াগুলো হল সাদা বোইন । জাপানীদের বলি সূর্যওঠা । চীনাদের লোকাল ,আফ্রিকার বা অন্যদেশের কালা ছেলেরা কালা ভাই আর কালা মেয়েরা কালা বোইন । এভাবে নিক নেম ব্যাবহারে ওদের সামনেই ওদেরকে নিয়ে বাংলায় কিছু বলাবলি করলেও ওরা মাইন্ড করা তো দূরে থাক, প্যাঁচালের কিছুই বুঝতে পারবে না । এভাবে স্বাধীন ভাবে কথা বলার মজাই আলাদা, তাই না ? শুধু আমরা আমরাই বুঝব আর মজা করব । হাহাহা ।
ঘটক ভাই লোকটাকে শিপনের খুব একটা খারাপ লাগে নি । লোকটা বেশ রসিক এবং খোলামেলা বটে । তার মধ্যে অন্য জাতি, বর্ণ নিয়ে আদতে কোন হিংসা বিদ্বেষ নাই, শুধু নিজেরা নিজেরা একটু মজা করতে পছন্দ করে, এই যা । অনেক জায়গা ঘুরে ওরা ছাত্রাবাসের লিফটে চড়লো ঘটক ভাইয়ের রুমে খাবারের উদ্দেশ্যে । ওদের সাথে বাকি যারা একসাথে লিফটে ছিল তারা সব কালা ভাই । এদেরকে একসঙ্গে দেখে ঘটক ভাইয়ের চাপা কণ্ঠ:
— ইস সিরে, পুরো লিফটাই অন্ধকার করে দিলো গো ।
শিপনদের সাথে করিম ভাই নামে একজন ঘটকের এহেন কথা বার্তা একটু চেপে যেতে পরামর্শ দিলেন । তবে ঘটক ভাইয়ের আত্মবিশ্বাসী আশ্বাস বাণী:
— আরে না না, এরা কি বুঝবে নাকি আমরা কি বলছি , হা হা হা । তবে, কালা ভাইদের থেকে একটু দূরে দূরে থাকাই উত্তম; এদের গায়ে যা গন্ধ না, মাইরি! তা আর কি বলব ।
ওদেরকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল ৪ জন কালা ভাই । শিপনের ঠিক গা ঘেঁসে পেছনে দাঁড়িয়ে লম্বা চওড়া একজন । হঠাৎ ওদিক থেকে ভেসে এলো এক অপরিচিত কণ্ঠ:
— হুম, আপনারা কি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন ?
বাঙ্গালিরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল । তাদের কারো মুখ থেকে এ রকম ভাঙ্গা ভাঙ্গা কিন্তু যথেষ্ট পরিষ্কার বাংলায় একথা বের হয় নি তো । তবে ব্যাপার কী! শিপন মাথা উঁচিয়ে পেছনে তাকিয়ে টের পেল লম্বা কালা ভাইটা বাংলায় কথা বলছে:
— আমি ৬ বছর ঢাকায় ছিলাম, বাংলায় পড়াশুনা করেছি । বাংলাদেশ খুব ভালো জায়গা । আপনারা কি এখানে নতুন এসেছেন ?
আচমকা সবাই আকাশ থেকে পড়ে যেন লজ্জায় এতটুকু হয়ে গেল । বেশ কিছুক্ষণ অস্বস্তিকর নীরবতা । বিদেশিদের দিকে তাকাবারও মুখ নেই তাদের । কালা ভাইটা ঐ কথার প্রসঙ্গ না তুলে যেন আরও জোরালো গলায় ঘটকদের সাবধান করে গেল । সেদিন লিফটে আয়না ছিল না । যদি থাকত, শিপনরা দেখতে পেত বাংলা জানা কালো বিদেশি বন্ধুটার কথা ও ব্যবহার যে লজ্জা তাদের দিয়েছিল, তাতে তাদের মুখ শুকিয়ে যেন ওদের চেয়েও বেশি কালো ঠেকছিলো ।
এরপর কেটে গেছে বহুদিন । ঐ ঘটনার পর থেকে শিপন ওদের কাছ থেকে প্রায় আড়ালে আড়ালেই থেকেছে । তবে প্রবাস জীবনে এতদিন নানা দেশের নানা বর্ণের মানুষের সাথে মিশতে হয়েছে । তাদের সাথে একসাথে ওঠা-বসা, লেখাপড়া, কাজকর্ম আনন্দ ফুর্তি করেছে । তাতে করে একটা উপলব্ধি তার মাঝে দিন দিন গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে । আর তা হল মানুষে মানুষে অনেক পার্থক্যই থাকতে পারে; ভাষা, সংস্কৃতি, আচার-অভ্যাস, বর্ণ, যোগ্যতা, মতাদর্শ নানা কিছুতে । কিন্তু প্রায় সবার ভেতরের মানবিক অনুভূতিগুলো প্রায় এক । সবাই সুখে হাসে, দুঃখে কাঁদে । নানা মাধ্যমে নানা কায়দায় সবাই ই সুখে শান্তিতে মান মর্যাদা নিয়ে দীর্ঘজীবী হতে চায় । এই অভিন্ন চাওয়া পাওয়া আর অনুভূতিগুলোই জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে আমাদেরকে একীভূত করেছে এক মানব জাতিতে । বাংলার কবি অনেক কাল আগেই যেন সেটাই সংক্ষেপে বলে গেছেন:

কালো আর ধলো বাহিরে কেবল,
ভেতরে সবার সমান রাঙ্গা ।