লিখেছেনঃ কে এইচ রুধির
u

“আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী।
তুমি থাক সিন্ধু পারে ওগো বিদেশিনী।।
তোমায় দেখেছি শারদপ্রাতে, তোমায় দেখেছি মাধবী রাতে,
তোমায় দেখেছি হৃদি-মাঝারে ওগো বিদেশিনী।
আমি আকাশে পাতিয়া কান শুনেছি শুনেছি তোমারি গান,
আমি তোমারে সঁপেছি প্রাণ ওগো বিদেশিনী।”
রবীন্দ্রনাথের এই গানের বিদেশিনী কে? কেউ কেউ ধারনা করেন যে, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ই এই গানে উল্লেখিত বিদেশিনী। কিন্তু গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে এই বিদেশিনী, রবি-বিদেশিনী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো নয়। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো’র সাথে দেখা হওয়ার অনেক আগেই রচিত হয়েছিল এই গানটি। “মূল গানটি কবি রচনা করেছিলেন শিলাইদহে বহুদিন আগে – সেই ১৮৯৫ সালে”। আর ওকাম্পোর সাথে কবির দেখা হয়েছিল ১৯২৪ সালের অক্টোবর কিংবা নভেম্বর এর দিকে। রবীন্দ্রনাথ কবে মিরালরিওর বাসাটায় উঠেছিলেন সেটার সঠিক তারিখ নিয়েও বিভ্রান্তি আছে। কিন্তু “এ বিখ্যাত গানটির ইংরেজি অনুবাদ ওকাম্পোর হাতে তুলে দিয়েছিলেন রবিঠাকুর, আর্জেন্টিনা আসার কয়েক দিনের মধ্যেই”। “গানটি রচনা করার ত্রিশ বছর পরে রবীন্দ্রনাথ হয়তো ওকাম্পোর মধ্যেই আবিষ্কার করেছিলেন তাঁর পরম আরাধ্য সত্যিকার ‘বিদেশিনী’ কে”। সেই ১৯২৪ সালে দানা মেলা রবি-ওকাম্পো’র “অশ্রুত অনেক গুঞ্জনকেই” বিভিন্ন আঙ্গিকে ব্যবচ্ছেদ করেছেন অভিজিৎ রায় ২০১৫ সালে এসে, তাঁর “ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোঃ এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে” বইটিতে।

Untitled

‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোঃ এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে’ বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন আবু তৈয়ব আজাদ রানা

গবেষণাধর্মী বই লেখা অনেকটা কঠিন বলতে হয়। সঠিক তথ্য আর তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা না থাকলে সেই গবেষণার কুঁড়ি দেখার আশা ছেড়ে দিতে হয়। আর সেটা যদি আজ থেকে ৬০/৭০ বছরেরও আগেকার কোন মানব-মানবীর মধ্যেকার রহস্যময় সম্পর্কের হয় যার খুবই নির্ভরযোগ্য এবং নিরপেক্ষ তথ্যের ভান্ডারটা যথেষ্ট নয় তাহলে ব্যাপারটা আরো একটু বেশি কষ্টসাধ্য এবং গোলমেলে হয়ে যায়। এই অসীম ধৈর্য্য ও পরিশ্রমের কজটিই বেছে নিয়েছিলেন অভিজিৎ রায় যার সুফল হিসেবে আমরা পেয়েছি “ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোঃ এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে” বইটি। বইটির লেখা সম্পর্কে প্রথমেই কিছু বলার লোভ সামলাতে পারছি না। এই বইটিতেও অভিজিৎ রায়ের লেখার ধরণ বরাবরের মত প্রাঞ্জল ও সাবলিল। যে জায়গায় যে তথ্যটা দরকার সেই জায়গায় ঠিক সেই তথ্যটি ব্যবহার করেছেন। মাঝে মাঝে প্রয়োজনের তুলনায় অধিক তথ্য দিয়েছেন যা তথ্যের সত্যতাকে অনেকাংশে নির্ভরযোগ্যতা দিয়েছে। অভিজিৎ রায় অসাধারণ মাপের বিজ্ঞানমনস্ক লেখক তো বটেই সাথে একজন পরিপক্ব সাহিত্যিকও বটে। বিজ্ঞান ও সাহিত্য উনার হাতে সমানভাবেই প্রসূত হয়। একটার আধিক্যে অপরটার সংশয়ে পড়তে হয় না।

এখন আসা যাক বইটির মূল প্রস্তাবনায়। বইটি মূলত পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত-
১। প্রথম অধ্যায়ঃ বিজয়ার করকমলে
২। দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ পূরবীঃ কিছু অশ্রুত গুঞ্জন
৩। তৃতীয় অধ্যায়ঃ চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ
৪। চতুর্থ অধ্যায়ঃ রবীন্দ্রনাথের নারীভাবনা এবং ওকাম্পো-প্রভাব
৫। পঞ্চম অধ্যায়ঃ রবীন্দ্র-জীবনে নারীঃ একটি বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীয় অনুসন্ধান

বিজয়ার করকমলে অংশে ওকাম্পো আর রবীন্দ্রনাথের পরিচয়ের সূত্রপাত। “১৯২৪ সালে পেরুর স্বাধীনতা সংগ্রামের শত বছর বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যাবার জন্য জাহাজে উঠলেও মাঝপথে অসুস্থ হয়ে আর্জেন্টিনায় অবস্থান করতে হয় তাঁকে” এবং তখনই পরিচয় হয় ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সাথে। পরে পেরু ভ্রমণ বাদ দিয়ে তিনি প্রায় দুই মাসের মত বুয়েনোস আইরেস থেকে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে সান ইসিদ্রোতে মিরালরিওর একটি বাসায় আশ্রয় গ্রহণ করেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর নিবিড় পরিচর্যায় এবং পর্যবেক্ষণে। যে বাসাটিতে উনি ছিলেন “এক ইউরোপনিবাসী দম্পতির ব্যক্তিগত বাড়ি হিসেবেই এটি পরিচিত এখন”। তবে মিরালরিও নামের এ বাড়িটির কয়েক ব্লক পরেই একটি বাড়ি আছে, সেটাই আজ পরিচিত ‘ওকাম্পোর বাড়ি’ হিসেবে; নাম ‘ভিলা ওকাম্পো’।

অনেকেই ধারনা করেন যে “পূরবী” কাব্যগ্রন্থের সবগুলো কবিতাই ওকাম্পোকে নিয়ে রচিত কিন্তু তথ্যের বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে এখন “পূরবী” নামে যে কাব্যগ্রন্থটি পরিচিত তার অন্তর্গত ১৬টি কবিতার সময়কালঃ ১৯১৭-১৯২৩। কিন্তু এই কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত কবিতাগুলোতে ওকাম্পো প্রভাব নেই সেটা বলাও সমীচীন হবে না বরঞ্চ “পূরবী” কাব্যগ্রন্থের শেষের দিকে সংযোজিত কবিতাগুলোতে যথেষ্ট পরিমাণে ওকাম্পো প্রভাব আছে। “১৯২৪ সালের ৬ নভেম্বর প্রবেশের পর থেকে লেখা ২৬টি কবিতার সাথে আর্জেন্টিনীয় যোগসূত্র আছে বল অনুমিত হয়”। এই পূরবী কাব্যগ্রন্থেরই উৎসর্গপত্রে কবিগুরু লিখেছিলেন- “বিজয়ার করকমলে”। এই বিজয়া-ই ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। রবীন্দ্রনাথের দেয়া নাম। লেখকের মতে- “যতদিন এই প্লাতা নদীর জল বইবে, যতদিন পূরবী কাব্যগ্রন্থ টিকে থাকবে, ততদিন মর্মর সুরে বইবে রবিঠাকুর আর তাঁর প্রেয়সী ওকাম্পোর রোমান্টিক অভিসারের অশ্রুত কলকাকলি”। “পূরবীঃ কিছু অশ্রুত গুঞ্জন” অংশে লেখক “অশ্রুত গুঞ্জনগুলোকে” নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্রের সাহায্যে ব্যাখ্যা করেছেন। নিত্যপ্রিয় ঘোষ এর মতে “রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী প্রেমের কবিতাগুলো একমাত্র ওকাম্পো-অনুপ্রাণিত, সেই সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়- রবীন্দ্রনাথের পৃথিবীকে তাহলে অত্যন্ত সংকীর্ণ করে ফেলা হয়”।

Untitled1
রবীন্দ্রনাথ এবং ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো

তৃতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম- “চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ”। রবীন্দ্রনাথ শুধু কবিতা-গান-উপন্যাস-প্রবন্ধই লেখেননি চিত্রকলাতে ছিল তাঁর অসামান্য খ্যাতি। কিন্তু এই খ্যাতির পেছনে ওকাম্পোর সাহায্য এবং অনুপ্রেরনার কথা অনস্বীকার্য। রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর চিত্রকর্মের প্রদর্শনীর জন্য সহায় খোঁজে পাচ্ছিলেন না তখন ওকাম্পো এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁর সহায়তায় ১৯৩০ সালের মে মাসে প্যারিসের পিগ্যালে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্মের প্রথম সফল প্রদর্শনী হয়। তার পর “জুন মাসে বার্মিংহ্যাম, ইন্ডিয়া সোসাইটি, লন্ডনে। জুলাই মাসে বার্লিন, জেনেভায়। সেপ্টেম্বর মাসে মস্কোয়, অক্টোবরে আমেরিকার বোস্টনে এবং ডিসেম্বরে নিউইয়র্ক এবং ফিলাডেলফিয়ায়”। রবীন্দ্র গবেষকদের মতে ওকাম্পোর অনুপ্রেরণাতেই রবীন্দ্রনাথ পুরুদস্তুর ছবি আঁকতে শুরু করেছিলেন। তবে ওকাম্পোর সাথে দেখা হওয়ার আগে থেকেই রবীন্দ্র চিত্রকর্মের নথিপত্রও পাওয়া গেছে।


রবীন্দ্রনাথের আঁকা নারী অবয়বে ওকাম্পোর প্রতিচ্ছবি

অনেক গবেষকরা রবীন্দ্রনাথের আঁকা অনেক নারী অবয়বে ওকাম্পোর প্রতিচ্ছবি পেয়েছেন। তবে স্বীকার করলে ভুল হবে না যে, রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকলায় আগ্রহী করে তোলায় ওকাম্পোর বড় প্রভাব ছিল। বইটির মূল রচনা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে নিয়ে হলেও লেখক আনুষঙ্গিকভাবে টেনে এনেছেন রবীন্দ্র-চিত্রকলাকে। তেমনি রবীন্দ্রনাথের নারীভাবনাকেও টেনে এনেছেন চতুর্থ অধ্যায়ে। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে এই বিষয়ের অবতারণা অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও বিষয়টি যথেষ্ট প্রাসঙ্গিকও বটে। এই অংশে রবীন্দ্রনাথের নারীভাবনাকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দেখা গেছে, ওকাম্পোর সাথে পরিচয়ের আগের রবীন্দ্রনাথ আর পরের রবীন্দ্রনাথের নারীভাবনায় বিরাট ফারাক রয়েছে। অনেকটা বলা যায় স্রোতের অনুকূল আর প্রতিকূল।

এই বইয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও মূল্যবান অংশ হচ্ছে পঞ্চম অধ্যায় যার শিরোনাম- “রবীন্দ্র-জীবনে নারীঃ একটি বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীয় অনুসন্ধান”। এই অংশে লেখক বিবর্তন ও মনোবিজ্ঞানের ভাষা দিয়ে রবিঠাকুর আর ওকাম্পোর মধ্যেকার “প্লেটোনিক সম্পর্ক” কে (রবীন্দ্র গবেষকদের ভাষায়) খন্ডন করেছেন সুচারুভাবে। ওকাম্পোর প্রতি রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসা অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের প্রতি ওকাম্পোর ভালোবাসা যে অস্বাভাবিক কিছু নয় বরঞ্চ একে অপরের নিবিড় সাহচর্য তথা ভালোবাসা আকাঙ্ক্ষা করাটাই যে স্বাভাবিক ছিল সেটা লেখক গবেষণালব্ধ বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করেছেন। এই অংশটি এই বইয়ের এক আসামান্য সংযোজন নিঃসন্দেহে যা রবীন্দ্র-গবেষণায় এক অন্য মাত্রা যোগ করেছে।

তার বাইরেও বইটিতে আরো তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে- ভূমিকা, লেখকের জবানবন্দি আর পরিশিষ্ট।

রাজু আলাউদ্দিন এর লেখা ভূমিকাটিও চমৎকার হয়েছে। বলতে হয় অভিজিৎ রায়ের বইটির সাথে মানানসই। পরিশিষ্ট অংশ তিনটি ভাগে বিভক্ত- নারীঃ তার অধিকার ও দায়িত্বসমূহ, পত্রাবলী ও পাঠকের অভিমত। ‘নারীঃ তার অধিকার ও দায়িত্বসমূহ’ প্রবন্ধটি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো’র ‘La mujer, sus derechos y sus responsabilidades’ প্রবন্ধটির তর্জমা। পরিশিষ্টে অন্তর্ভুক্ত ‘পত্রাবলী’ অংশটি এই বইয়ের গুরুত্ব অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে। অভিজিৎ রায়ের বাংলায় তর্জমা করা রবিঠাকুর ও ওকাম্পোর মধ্যে আদানপ্রদানকৃত মোট পঞ্চাশটি চিঠি সংযোজিত হয়েছে ‘পত্রাবলী’ অংশে, যা রবিঠাকুর আর ওকাম্পোর মধ্যেকার রহস্যময় জগতের প্রবেশদ্বার অনেকখানি উন্মোচিত করেছে।