সেবার ঢাকায় যাওয়াটা বেশ উত্তেজনায় পূর্ন ছিল। প্রথমবার কোন অনলাইন বন্ধুর সাথে দেখা হতে যাচ্ছে। ভাবতেই শিহরিত হয়ে উঠছিলাম। একে তো অনলাইনের বন্ধু, তার উপর সে মুক্তমনা-নাস্তিক। বেশ অনেকদিন ধরে তার সাথে চ্যাট করছি, দেশ, ধর্ম, দর্শন নিয়ে। এবার সরাসরি দেখা হবে, আড্ডা হবে।
Niloy-neel-FB

বিকেলে দেখা করার কথা টিএসসিতে, আমি দুপুরের পরই বের হয়েছি। প্রতিবারের অভ্যাসমত নীলক্ষেত থেকে কিছু পুরনো বই কিনলাম। বইয়ের ভারে পিঠ কুজো হয়ে যাচ্ছে। তারপরও বইগুলো নিয়েই টিএসসিতে গিয়ে তাকে ফোন দিলাম, দেখা হলো, পরিচয় হলো নীলয় নীলের সাথে। অনলাইনের একজন বন্ধুকে সামনা সামনি আবিষ্কার করা মফস্বলের কোন ছেলের জন্য যারপর নাই শিহরন জাগানোর মত। বুক মেলানোর পর বইয়ের ব্যাগটা সে জোর করে নিয়ে নিল। আমরা ভেতরে টিএসসির মাঠে গেলাম। সেখানে পরিচয় হলো আরেকজনের সাথে; রঞ্জন বর্মন। এরপর রঞ্জন দা আর নীল কথা বলতে শুরু করল। আমি নির্বাক শ্রোতার মত তাদের কথা শুনছি। ওরা নিজেদের মধ্যে এতই মগ্ন হয়ে গেল যে, এখানে যে নতুন একটি ছেলে এসেছে তাদের সাথে কথা বলার জন্য, তা তারা বেমালুম ভুলেই গেল। এই হলো নীল। একটা মানুশ কথা পেলে, আলোচনা পেলে তার সদ্য পরিচিত বন্ধুর অস্তিত্ব দিব্যি ভুলে যেতে পারে তা তাকে না দেখলে আমি কখনোই জানতে পারতাম না।

এরপর যতবারই ঢাকা গিয়েছি, প্রায় প্রতিবারই তার সাথে দেখা হয়েছে, তার হাত ধরে আরও অনেকের সাথে সম্পর্ক তৈরী হয়েছে। ঢাকায় যাবার আগে আর কাউকে জানাতাম বা না জানাতাম, নীলকে নক করেই তবে ঢাকার যাত্রা নিশ্চিত করতাম। মুক্তচিন্তার জন্য, বৈজ্ঞানিক দর্শন প্রচারের জন্য কিছু একটা করার প্রয়াস পেয়েছিলাম নীলের হাত ধরে। ধীরে ধীরে আমরা একটা সংগঠন পর্যন্ত দাঁড় করিয়ে ফেলেছিলাম। হালের বেশ কজন রথী-মহারথীও সে সংগঠনের সদস্য ছিল, ছিল কর্মীর মত। বলতে দ্বিধা নেই, আজও আমাদের সেই সংগঠন টিকে আছে, কাজ করে যাচ্ছে নীলকে, নীলের চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ থেকেই।

সেবার ঢাকায় রাতে উঠেছিলাম নীলের বাসায়। বাসা বলতে একখানি খাট-টেবিল আর কিছু হাড়ি পাতিল রাখার জায়গা আছে, জানলা নেই, বদ্ধ একখানা কামরা। তবু দিব্যি আমরা দুজনে রাত কাটিয়ে দিয়েছিলাম গল্পে গল্পে, কথামালায়। মুক্তিচিন্তকদের সাধারণত নানান বিষয়ে তর্ক হয়, এক জনের সাথে অন্য আরেক জনের মতের মিল পাওয়া খুবই দুষ্কর। আশ্চর্যজনকভাবে রাজনীতি, সমাজ, ব্যক্তিজীবন, ধর্ম-দর্শন সবকিছুতেই তার সাথে আমার চিন্তাগুলো একদম মিলে যেত। রাত ভোর হয়ে গেছিল কখন টেরই পাইনি।

নীলয় নীল; আমার দেখা সত্যিকারের একজন মুক্তমনা। মুক্তমনা কি বা কে এ নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক আছে। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে, আমার কল্পনায় একজন মুক্তমনার যে ছবি আঁকতাম, তার প্রকৃত প্রতিচ্ছবি ছিল নীলয় নীল। একজন দর্শনের ছাত্র হিসেবে দর্শনকে যেভাবে ধারন করতে হয়, যেভাবে দর্শন নিয়ে ভাবতে হয়, তা করতে পেরেছিল নীলয় নীল। তার দৃষ্টিতে মানুষের একমাত্র পরিচয় শুধুই মানুষ। আমি কিংবা আমার মত অনেক নাস্তিকই ধার্মিকদের থেকে দুরত্ব বজায় রেখে চলি। এ ব্যাপারে তার কথা ছিল, “ এভাবে চলতে থাকলে তো তুমি নিজেই মানুষের থেকে, সমাজের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে তুমি কিভাবে সমাজকে বদল করবে?

কিভাবে চিন্তা করতে পারলে একটা মানুশ সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠতে পারে, তা নীলের কাছ থেকে শেখা যায় অনায়াসেই। খুন, হত্যা যে কোন সমাধান হতে পারে না, তা যে কোন মানবিক কাজ নয় তা নীলয় নীলের কথাতেই স্পষ্ট হয়ে উঠে; আমি বাজার থেকে মুরগি আনলে সব সময় কেটে আনি, আর কাটার সময় মুরগি কাঁটা দেখি না। তবে কিছুদিন আগে দেশি জ্যান্ত মুরগি এনে ভাবছিলাম, এটার কল্লাটা আমি কিভাবে কাটবো? অবশেষে আমার দ্বারা এই কাজ করাও সম্ভব হয়নি। আমি একটা জ্যান্ত মুরগীকে কিছুতেই কাটতে পারলাম না।
যে ছেলেটা একটা মুরগী কাটার মত কাজকে নিষ্ঠুরতা মনে করে, সে ছেলেটাকেই আমাদের ধর্মান্ধ সমাজ, ধর্মের পা চাটা রাষ্ট্র দায়ী করেছে মানবতার শত্রু হিসেবে! সত্যি সেলুকাস!!

বিয়ে, পরিবার, মানুষ মানুষীর সম্পর্ক নিয়ে তার ছিল সুন্দর এক দর্শন। সে বলত, মানুষ যেহেতু স্বাধীন, তাকে কেন সম্পর্কের বেড়াজালে আটকে রাখবে? এই যেমন তোমার সাথে আমার একটা সম্পর্ক আছে, তা যতদিন আছে ততদিনই কন্টিনিউ করো। যখন মিলবে না, তখন যার যার মত হয়ে যাও। তোমার কিংবা আমার জায়গায় কোন বিপরীত লিঙ্গ হলেও একইভাবে কল্পনা করো। প্রতিটা মানুষ স্বাধীন, প্রতিটা মানুষ আলাদা। কেন কিছু কমিটম্যান্টের কারনে বন্দীত্বের বেড়াজালে আটকে রাখা? তার মতে পাখীকে উড়তে দাও, তাকে যে কোন ডালে বসতে দাও। যতক্ষণ ভাল লাগে বসুক, তারপর উড়ে যাক, এ নিয়ে এত মাথা ব্যাথা কেন বাপু?

নীলের জীবন দর্শন ছিল অনেকটাই কামুর মত। সে লিখেছিল, আমার জীবন অর্থহীন, এই গাড়ি, বাড়ি, সুন্দর নারী, টাকা-কড়ি সবকিছুই অর্থহীন। কারণ, সবকিছু মৃত্যুতেই পরিসমাপ্তি ঘটবে, তারপরও আমি সেগুলোর পেছনে দৌড়াই। মৃত্যু চরম বাস্তবতা হলেও উদ্ভব ও বিকাশের শ্রেষ্ঠ প্রাণী হিসেবে আমরা মানুষেরা কখনোই তা মানতে চাই না। উতকর্ষতা কল্পনা শক্তিকে বাড়া, তাই অর্থহীন এ জীবনকে অর্থপূর্ণ করার জন্য আমরা কল্পনা করি স্বর্গ, নরক, ঈশ্বর, আত্মা প্রভৃতি।

হ্যাঁ, নীলয় নীল নাস্তিক ছিল, কট্টর নাস্তিক। নাস্তিকতা কী আদৌ কোন অপরাধ? সংখ্যাগুরু মুসলমানদের দেশে নাস্তিকতা কিংবা ইসলাম নিয়ে লিখালিখি করাটা যদিও তর্কের খাতিরে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়, তাতেও তো নীলকে এ কলঙ্কের কালিমায় লেপ্টে দেয়া যায় না। তার ধর্ম বিষয়ক আলোচনা ছিল তুলনামূলক। আমার জানামতে, শুধু ইসলাম নয়, অপরাপর সকল ধর্ম নিয়েই তার লিখালিখি ছিল, ছিল অগাধ পড়াশোনা, জানাশোনা। সে যেমন ইসলাম ধর্ম নিয়ে লিখতো, তেমনই লিখত হিন্দু ধর্ম নিয়ে, বৌদ্ধ কিংবা খ্রীস্টান ধর্ম নিয়ে। নারী অধিকার নিয়ে লিখতে গিয়ে সে শুধু ইসলামকেই দোষারোপ করেনি, করেছে হিন্দু ধর্মকে, বৌদ্ধ ধর্মকে। হিন্দু ধর্মে নারীর অবস্থান নিয়ে তার লিখা একটা ইবুক ছিল ” সনাতনী কামিনী” নামে। বৌদ্ধ ধর্মে নারীর মূল্যায়ন নিয়ে একটা সিরিজ শুরু করেছিল। নাম ছিল, “বৌদ্ধ শাস্ত্রে পুরুষতন্ত্রঃ নারীরা হলো উন্মুক্ত মলের মতো দুর্গন্ধযুক্ত”।

নীলয় নীলের লিখাগুলো দেখলে এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই সে ধর্মীয় সমালোচনায় ছিল একপেশে একচোখা। কোন ধর্মের প্রতিই তার আলাদা কোন টান বা দূর্বলতা ছিল না, পক্ষপাতিত্ব তো কল্পনার অতীত। সকল ধর্মকেই সে সমালোচনা করে গেছে নির্মোহভাবে, তুলে ধরেছে আধুনিক ও সভ্য সমাজে ধর্মের অসাড়তাকে। কিন্তু, হায়! তাকে প্রান দিতে হলো শুধু ইসলাম ধর্মের কারণে। ইসলামের বীর সেনানীরা কল্পনার বেহেস্তে হুর পাবার লোভে নীলের মত একজন নির্মোহ মানুষকে হত্যা করে ফেলল!! হায় ইসলাম, হায় শান্তি!!

আজ ৭ আগস্ট। ঠিক এক বছর আগের এই দিনে হারিয়েছিলাম আমার প্রিয় বন্ধু, যার সাথে অনলাইনে পরিচয়ের সূত্র ধরে প্রথম দেখা হয়েছিল, শুরু হয়েছিল দেশের জন্য, মুক্তচিন্তার জন্য কিছু করার উদ্যোগ। সাধারনত কোন মৃত্যু আমাকে নাড়া দেয় না, কাঁদাতে পারে না। কিন্তু, তার মৃত্যুর সংবাদ শুনে কত সময় যে বেহুঁশ ছিলাম, তা এখনও মনে করতে পারি না! আজ নীলের মৃত্যুর এক বছর পূর্ণ হয়ে গেল। এই এক বছরে প্রাণ খুলে হাসি কি জিনিস সেটা ভুলেই গেছি। অথচ, এদিকে আমাদের সরকার, প্রশাসন খুনিদের আইনের আওতায় আনা দূরে থাক, হত্যা রহস্যের কিনারা পর্যন্ত করতে পারেনি অথবা করেনি।

নীলের সাথে স্বপ্ন দেখতাম, একদিন আমরা দেশটাকে বদলে দেব, সমাজে ছড়িয়ে দেব বৈজ্ঞানিক দর্শন। আমি বলতাম, বছর পাঁচেকের মধ্যেই আমরা সফল হয়ে যাব। সে বলত, না, অনেক সময় লাগবে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিশ্বাসের ভাইরাস যেভাবে বাসা করেছে, তা দূর করতে গেলে এত কম সময়ে হবে না, বছর তিরিশেকের সংগ্রাম করতেই হবে ধরে নাও। বছর তিরিশ কেন, পাঁচটি বছরই পার হলো না, নিদারুন আশাবাদি, প্রানবন্ত ছেলেটাকে বিশ্বাসের ভাইরাসে আক্রান্ত পিশাচেরা পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দিল!

হ্যাঁ, আজ নীল আমাদের মাঝে সশরীরে হয়ত নেই। কিন্তু, সে যা দিয়ে গেছে; মৃত্যু ভয়কে তুচ্ছ করে সত্য বলা, সত্যের জন্য, অন্ধকার দূর করণের জন্য আলো জ্বালার যে শক্তির প্রদর্শন করে গেছে, তা-ই আমাদের মুক্তি চিন্তার আন্দোলনকে আরও গতিময় করবেই করবে। এ যে সজন হারানো রক্তের দায়। এ দায় থেকে মুক্ত হবার আগ পর্যন্ত কি আমাদের চিত্ত শান্ত হবে!