20160801_073410
আজ ৭ আগস্ট, নিলয় নীলের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। একটি বছর হয়ে গেল, কিন্তু হয় নি ওর খুনিদের শাস্তি বা সঠিকভাবে সনাক্ত। একেক পর এক মুক্তমনা মুক্তচিন্তার মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, কিন্তু সরকার যেন ছিল নিরবতার মূর্তি!

নিলয় নীল এর নামে পরিচিত আমার বন্ধুর নাম নিলাদ্রী চ্যাটার্জি (নান্টু)। ওকে নিয়ে লিখতে গেলে একটি বই লেখা হয়ে যাবে, কিন্তু লেখা শেষ হবে না। ও আমার জীবনে শুধু বন্ধু ছিল না, ছিল আপন ভাইয়ের মত। নীলের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল ২০১১ সালে বই মেলায়। কিন্তু এই অল্পদিনের পরিচয়ে, নীল একদিন যে আমার  সবচেয়ে আপন এবং কাছের মানুষ হবে, তখনো তা কল্পনা করতে পারি নাই। খুব অল্প দিনেই ও আমার খুব কাছের মানুষ হয়ে যায়। এর মাঝে একদিন মোবাইলে ম্যাসেজ পাই, সবাই একটি বিশেষ আলোচনায় বসবে, চারুকলা ভবনের সামনে। অনেকেই এসেছিল সেই মিটিং এ। মূলত ঐ মিটিং থেকেই আমাদের সম্পর্ক দৃঢ় হয়। নীলের আমন্ত্রণে, BSRA গঠন নিয়ে ছিল আমাদের আলোচনা। উক্ত আলোচনায় আমার দায়িত্ব আসে আমাদের নতুন সংগঠনের ফেসবুক পেজ এবং গ্রুপ খুলা। আমার বাসা ছিল পুরান ঢাকা। একই সাথে নীল তখন থাকত আমার বাসার খুব কাছেই। তার দুইদিন পর নীল আমার বাসায় এসেছিল আমাদের সংগঠন নিয়ে আলোচনায় করতে। নীলের অনুপ্রেরণায় আমি সরাসরি যুক্ত হয়ে গিয়েছিলাম নীলের করা এই সংগঠনে। আমাদের সব সদস্যদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমি আর নীল আহ্বায়ক এর দায়িত্ব নিয়েছিলাম। যা পরে আমি সাধারন সম্পাদক এবং নীল সাংগঠনিক সম্পাদক এর দায়িত্ব নিয়েছিল।ভারতের প্রবীর ঘোষের অনুপ্রেরণার বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সংগঠন (Bangladesh Science and Rationalist Association)  করা হলেও মূলত নীল হল এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। 11856452_10207417524903190_207830378466460381_o বিজ্ঞান চিন্তার প্রসার, কুসংস্কার মুক্ত সমাজ গঠন, ধর্মীয় গোঁড়ামি বিরুদ্ধে ও ধর্মীয় নির্যাতন এর বিরুদ্ধে কাজ করা, যে কোন মানবিক অধিকার পক্ষে লড়াই করা ছিল এই সংগঠনের লক্ষ্য। আমাদের সবচেয়ে সফল এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ছিল এক ভণ্ড পীরকে হাতেনাতে ধরা। ২০১২ সালের ৩ অগাস্ট  ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে আমরা সেই পীরের ভণ্ডামি প্রমাণসহ ধরি। একটি অসমাপ্ত কাজ থেকে যায় আমাদের, সেটা হল কবিরাজির নাম করে মানুষের সাথে প্রতারণা। তাছাড়া সর্বপ্রথম ৫৭ ধারার বিরুদ্ধে রাজপথে নামা, বাংলাদেশে বৌদ্ধমন্দির ভাঙার বিরুদ্ধে, সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে রাজপথে বিভিন্ন সময় আমাদের সংগঠন মানব বন্ধন করেছিল।

নীলের শুধু সাংগঠনিক যোগ্যতাই ছিল না, মানুষ হিসেবে সে ছিল অসাধারন। তেমনি ছিল খুবই ভাল মানের লেখক। বিভিন্ন ব্লগ ছাড়াও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছিল অনেক একটিভ। বাবা মার একমাত্র ছেলে সন্তান ছিল নীল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ পড়ার সময় সে তার বাড়ি থেকে সহজেই পড়ার বা থাকা খাওয়া জন্য কোন খরচ আনত না। টিউশনি করে ও ওর পড়ার খরচ চালিয়েছিল। এই স্বল্প আয় আবার ও বিভিন্ন সাহায্য অনুদানেও ব্যবহার করেছিল। নিজে না খেয়ে অন্যকে সাহায্য করার ঘটনা নীল জীবনে অসংখ্যবার ঘটেছিল। তাছাড়া বিভিন্ন সংগঠনের সাথেও নীল নিঃস্বার্থভাবে কাজ করছিল। মানুষ হিসেবে এতো আন্ত্ররিক ছেলে আমি আর কখনোই দেখি নাই। দিনে দিনে ও আমার বন্ধু থেকে পরিবারের একজন হয়ে গিয়েছিল। নীল শুরুতেই, ওর মাকে আমার ফোন নম্বর দিয়েছিল। যাতে ওর ফোন বন্ধ থাকলে, ওর খোঁজখবর আমার কাছ থেকে নিতে পারেন। সেই সুবাদে নীলের মা এবং ওর একমাত্র ছোট বোনের সাথে আমার মাঝে মধ্যেই কথা হত। নীল খুন হবার পর নীলের পরিবারের কাছে আমাকেই দিতে হয়েছিল, নীলের মৃত্যুর খবর। কারন, নীলের পরিবারের নম্বর আর কারোর কাছে তখন ছিল না। একজন মায়ের কাছে তার সন্তানের মৃত্যুর খবর দেওয়া যে কত কষ্টের, যা আমি কখনই ভুলব না। নীল মারা যাবার পর, আশামনি এবং মেরাজ ভাইয়ের ফোন পাই আমি। মেরাজ ভাই আমাকে বলেছিলেন, নীল আর নেই। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আশামনি ফোনে কি বলেছেল, কিছুই বুঝিছিলাম না। শুধু শুনেছিলাম তার বুকফাটা কান্নার শব্দ। তখনও বুঝি নাই, আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটি আর নেই! নীলের বাসায় যাবার পর, এক রুমে নীলের লাশ, অন্য রুমএ আমরা সবাই। প্রায় তিন ঘণ্টা ছিল নীলের লাশ। পুলিশ সাক্ষী রাখার জন্য নীলের রুমে আমাকে ঢুকতে বলেছিল। কিন্তু আমি পারি নি, নীলের সেই রক্ত মাখা লাশ দেখতে। যে ছেলেটি এতো হাস্য উজ্জ্বল ছিল, এতো অমায়িক আন্তরিক ছিল, এতো বেশি সাহায্যকারী ছিল, আজ তার রক্ত মাখা লাশ!

নীল মারা যাবার প্রায় দুই-তিন মাস আগে দুটি ছেলে, তাকে ফলো করেছিল। ‘সেইদিন নীল অফিস থেকে কাঁটাবন হয়ে, শাহবাগ চত্বরে যায়।সেখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে খিলগাঁও বাসার যাবার পথে দুই ছেলে তাকে ফলো করে। প্রায় বাসার কাছাকাছি যেয়ে নীল অন্য রাস্তায় ঢুকে। এরপর সে আশামনি ফোন করে, দুইজনে একসাথে বাসায় যায়। বাসায় যেয়েই প্রথমে সে আমাকে ফোন করে বিস্তারিত বলে। আমি তাকে থানায় জিডি কথা বলি। আমি আমার ব্যবসায়ী পার্টনার এবং বন্ধু দেবজ্যোতিকে বলি নীলকে সাহায্য করতে। দেবজ্যোতির বাসা নীলের বাসার কাছেই। পরদিন দুইজনে দুই থানায় যেয়েও জিডি করতে ব্যর্থ হয়। সাধারণ জিডিও পুলিশ নেয় নাই। তারা ব্যাখ্যা দেয়, যদি নীলের কিছু হয়ে যায়, তাহলে পুলিশের সমস্যা হবে। কিন্তু নীলকে কোন ধরনের নিরাপত্তা দিতে পারবে না বলে জানায়’।

আমার মনে পড়ে, ৩-৪ বছর আগে, আমরা দুইজন আড্ডা দিচ্ছিলাম জুরাইন কবরস্থানের মাঠে। এই সময় একজন ফোন করে বলে, ও পজেটিভ রক্ত লাগবে এক মসজিদের ইমামের জন্য। আমি তাকে বলেছিলাম, “অপরিচিত এবং তার উপরে মসজিদের হুজুর, সেখানে যাওয়া ঠিক হবে না”। সে আমাকে বলেছিল, “কে হুজুর আর কে মেথর, আর কে সন্ত্রাসী, সেটা আমি দেখব না। আমার দায়িত্ব, মানুষ হিসাবে একজন মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানো।” নীল মারা যাবার এক মাস আগে আমার বড় ছেলের অপারেশন হয়েছিল। আমার ছেলের অপারেশনের দিন, আমি কাউকে পাশে পাই নি শুধু নীল ছাড়া। আমার যে কোন ব্যক্তিগত কাজে আমি নীলকে সাথে পেয়েছিলাম সবসময়। সেই দিন নীল আমাকে বলেছিল “তাহসিব ভাই, আপনি তো দুইটা বাচ্চা নিয়েছেন। কিন্তু আমি এই জীবনে বাচ্চা কখনই নিব না। আমি একটা অনাথ আশ্রম দিব। লোকদেখানো অনাথ আশ্রম না। হোক অল্প বাচ্চা কিন্তু তারা যেন পায় পরিপূর্ণ শিক্ষা এবং অন্যান সুবিধা। আর নিজে পালব দুটি বাচ্চা। নিজের বাচ্চা যে, নিজের ওরসজাত হতে হবে, আমি তা মানি না। নিজের পরিচয়ে দুইজনকে মানুষ করাই হল বড় কাজ।” আমার ছেলের অপারেশন পরের দিন, ও চাকরি ছেড়ে দেয়। তাই এক সপ্তাহ পর নীল তার গ্রামের বাড়ি চলে যায়। সেখানে বেশ কিছুদিন থেকে নীল আবার ঢাকা আসতে চায়। কারন শ্রীলঙ্কা একটি কনফারেন্স ও আমন্ত্রণ পেয়েছিল। একই সাথে জার্মান এমব্যাসিতে একটি ইন্টারভিউ দেওয়ার কথা ছিল। ও মা বাঁধা দিয়েছিল সেইবার ঢাকায় না আসার জন্য। কিন্তু ও ওর মাকে বলেছিল, “ঢাকায় আমার তাহসিব ভাই আছে। আমার কিছু হলে উনি আমাকে বাঁচাবেন।” হয়তো আমার প্রতি ভালোবাসা হিসেবে, নীল তার মাকে বলেছিল, এই কথাগুলো। নীল মারা যাবার পর এই কথাগুলো নীলের মা আমাকে বলেছিলেন। অনেক আস্থা রেখে নীল এই কথাগুলো বলেছিল। কিন্তু আমি নীলের এমনই বন্ধু যে, ওর জন্য কিছুই করতে পারি নাই। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু আজ আমার সামনে নেই……………।