লিখেছেনঃ অরুণাভ বিলে

লেখাটি শুরু করছি সতীদাহ প্রথা দিয়ে ।

সতীদাহ প্রথা কি ?
সতীদাহ প্রথা হচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিধবা নারীদের স্বামীর চিতায় সহমরণে বা আত্মহুতি দেবার ঐতিহাসিক প্রথা । গুপ্ত সাম্রাজ্যের (খৃষ্টাব্দ ৪০০) পূর্ব হতেই এ প্রথার প্রচলন সম্পর্কে ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া যায় । গ্রিক দিগ্বিজয়ী সম্রাট আলেকজান্ডারের সাথে ভারতে এসেছিলেন ক্যাসান্ড্রিয়ার ঐতিহাসিক এরিস্টোবুলুস । তিনি টাক্সিলা (তক্ষশীলা) শহরে সতীদাহ প্রথার ঘটনা তার লেখনিতে সংরক্ষণ করেছিলেন। গ্রিক জেনারেল ইউমেনেস এর এক ভারতীয় সৈন্যের মৃত্যুতে তার দুই স্ত্রীই স্বত:প্রণোদিত হয়ে সহমরণে যায়, এ ঘটনা ঘটে খৃষ্ট পূর্বাব্দ ৩১৬ সালে ।

মূলতঃ স্বত:প্রণোদিত হয়েই পতির মৃত্যুতে স্ত্রী অগ্নিতে আত্মাহুতি দিত । পৌরাণিক কাহিনীতে এ আত্মাহুতি অতিমাত্রায় শোকের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই দেখা হত । মহাভারত অনুসারে পাণ্ডুর দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রী সহমরণে যান কারণ মাদ্রী মনে করেছিলেন পান্ডুর মৃত্যুর জন্য তিনি দায়ী যেহূতু পান্ডুকে যৌনসহবাসে মৃত্যুদন্ডের অভিশাপ দেওয়া হয়েছিল । রাজপুতানায় “জহর ব্রত” প্রচলিত যাতে কোন শহর দখল হবার পূর্বেই পুরনারীরা আত্মসম্মান রক্ষার্থে আগুনে ঝাঁপ (বা জহর বা বিষ) দিয়ে স্বেছায় মৃত্যুবরণ করতেন, যা সতীদাহের অনুরূপ । কিন্তু কালক্রমে বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে হিন্দু স্ত্রীকে সহমরণে বাধ্য করা হত । বিশেষ করে কোন ধনী লোকের মৃত্যুর পর সম্পত্তি অধিকার করার লোভে তার আত্মীয়রা তার সদ্যবিধবা স্ত্রীকে ধরে বেঁধে, ঢাক-ঢোলের শব্দ দ্বারা তার কান্নার আওয়াজকে চাপা দিয়ে তার স্বামীর সাথে চিতায় শুইয়ে পুড়িয়ে মারতো । কালের বিবর্তনের সাথে একসময় লোপ পায় সতীদাহ প্রথা । যা রাজা রাম মোহন রায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বন্ধ হয় । ১৮২৯ সালের ডিসেম্বর ৪-এ বৃটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীতে সতিদাহ প্রথাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল ঘোষণা করা হয় । এসময় বেঙ্গলের গভর্ণর ছিলেন লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক । অবশ্য এ আইনী কার্যক্রম গৃহীত হয় মূলতঃ রাজা রামমোহন রায়ের সামাজিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতেই । এই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে মামলা করা হয় । প্রিভি কাউন্সিল ১৮৩২ সালে বেঙ্গলের গভর্ণর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংকের ১৮২৯ এর আদেশ বহাল রাখেন । খুব অল্পসময়ের মধ্যে ভারতের অন্যান্য কোম্পানী অঞ্চলেও সতীদাহ প্রথাকে বাতিল ঘোষণা করা হয় । যদিও ভারতীয় বেদ ভাষ্যকারগণদের মতে বেদে সতীদাহের উল্লেখ নেই । বরং স্বামীর মৃত্যুর পর পুনর্বিবাহের ব্যাপারেই তাঁরা মত দিয়েছেন । বেদের অন্যতম ভাষ্যকার সায়নাচার্যও তাঁর তৈত্তিরীয় আরণ্যক ভাষ্যে এই মতই প্রদান করেছেন (জানা নেই ঠিক) ।

অনেকে বলেন, বিধবা মাতা ও সুন্দরী বিধবাদের প্রতি মুসলিম জায়গীর ও নবাবের কুদৃস্টি / “নজরে বেওয়ার” হাত থেকে বাঁচার জন্য হিন্দু সমাজপতিরা সতীদাহ প্রথার প্রবর্তন করেছিলেন বলেই জানা যায় । প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে সতীদাহ প্রথা নামে কোন শব্দের উপস্থিতি পাওয়া যায় না , তবে সহমরন শব্দ ও তার প্রয়োগ দেখা যায় । সহমরণ বা সতীদাহ যদিও এককথা নয় ।

সম্রাট আকবর (১৫৪২-১৬০৫) সতীদাহ আটকানোর জন্য সরকারীভাবে আদেশ জারি করেন যে, কোন নারী, প্রধান পুলিশ কর্মকর্তার সুনির্দিষ্ট অনুমতি ছাড়া সতীদাহ প্রথা পালন করতে পারবেন না । ফরাসি বণিক এবং ভ্রমণকারী তাভেনিয়ের লেখা থেকে জানা যায় যে, সম্রাট শাহ জাহানের রাজত্বে সঙ্গে শিশু আছে এমন বিধবাদেরকে কোনমতেই পুড়িয়ে মারতে দেওয়া হত না এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে, গভর্নররা তড়িঘড়ি সতীদাহের অনুমতি দিতেন না, কিন্তু ঘুষ দিয়ে করান যেত এইখানে পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে কেন জানি ধোঁয়াশা । তথ্যটি পেয়েছি উইকিপেডিয়া থেকে । আমি আসলে জানি না যে মুঘল আমলে পুলিশ ছিল কিনা !! তবে ইতিহাস যেটুক জানি তাতে মনে পরে না ঐ আমলে কোথাও পুলিশের কথা বলা ছিল । যাইহোক, সে অন্য আলোচনার বিষয় ।

বিধবা বিবাহ –
ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর উনিশ শতকে অবিভক্ত বাংলায় শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন । তিনি হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহ প্রথা চালু করেন । তার প্রচেষ্টায় ২৬ জুলাই ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ আইন পাস হয় । নিজের ছেলের সঙ্গে এক বিধবা কন্যার বিয়ে দিয়েছিলেন । যাতে অন্যান্য হিন্দুরাও উৎসাহ বোধ করে । বিদ্যাসাগরের এ আইনের ফলে বঙ্গ-ভারতের কোটি কোটি বিধবাদের স্বামীর ঘরে আশ্রয় হয়েছিল । লর্ড ডালহৌসী বিধবা বিবাহ আইন চালু করেন । ১৮৫৫ সালে ঈশর চন্দ্র বিদ্যা সাগর ‘বিধবা বিবাহ’ আইনসম্মত করতে ভারতে নিযুক্ত ব্রিটিশ সরকারের নিকট বহুসাক্ষর সম্বলিত এক আবেদনপত্রও পাঠান । ২৭ ডিসেম্বর আরেকটি আবেদনপত্র পাঠান বহু বিবাহ নিবারণ বিধির জন্য ।১৬ জুলাই বিধবা বিবাহ আইনসম্মত হয় । এরই পরিপেক্ষিতে লর্ড ডালহৌসী বিধবা বিবাহ আইন চালু করেন ।

বিধবা মেয়েদের সমাজের চরম পীড়ন থেকে রক্ষা করার জন্য প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইনটি হল ১৮২৭ সালের সতীদাহ নিবারণ আইন । এই আইনে সতীদাহকে বে-আইনী বলে ঘোষণা করা হয় এবং তারজন্য শাস্তির বিধান দেওয়া হয় । এই আইন হিন্দুদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে অবমাননা করছে বলে সেযুগের নামীদামী অনেকেই (বলা বাহুল্য সবাই পুরুষ) ঘোরতর আপত্তি তুলেছিলেন । কিন্তু রামমোহন রায় ও অন্যান্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির প্রচেষ্টায় তাঁদের আপত্তি টেকে নি । এদের এবং পরবর্তী কালে বহুলোকের আন্তরিক চেষ্টায় সতীদাহ সম্পর্কে সচেতনতা ভারতবর্ষে এতদিনে কিছুটা এসেছে এবং সংবাদপত্রের প্রচারে ও আইনের ভয়ে এই প্রথা প্রায় লুপ্ত ।

১৮৫৬ সালে গৃহীত বিধবাবিবাহ আইনটি বিধবাদের স্বার্থ-রক্ষার জন্য আরেকটি বড় পদক্ষেপ । এ ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের একটা বড় ভূমিকা ছিল । বিধবাবিবাহ অবশ্য এই আইনের আগেও হয়েছে। ইংলিশম্যান পত্রিকায় ১৮৫৪ সালে কৃষ্ণনগরে একটি পনেরো বছর বয়স্কা বিধবার পুনর্বিবাহের খবর প্রকাশিত হয় । ঐ সময়ের কিছু আগের থেকেই সমাজের কিছু প্রগতিশীল লোক পণ্ডিতদের সাহায্যে প্রমাণ করার চেষ্টা করছিলেন যে, বিধবা-বিবাহ শাস্ত্রসন্মত । তবে বিদ্যাসাগর বুঝতে পেরেছিলেন, এটি শুধু শাস্ত্রসন্মত প্রমাণ করলেই সমাজ তা মানবে না, এটির জন্য আইনের সমর্থন প্রয়োজন । বিদ্যাসাগর, বর্ধমানের মহারাজা, কৃষ্ণনগরের মহারাজা ও আরও কিছু ব্যক্তির বিশেষ প্রচেষ্টায় বিধবাবিবাহ আন্দোলন জোরদার হয় এবং বিধবাবিবাহ আইনটি প্রণয়ন করা হয় ।

বিধবাবিবাহ আইন গৃহীত হয় ২৬শে জুলাই, তার চার মাস বাদে ৭ই ডিসেম্বর বিদ্যাসাগর ঘটা করে একটি বিধবার বিবাহ দেন । কিন্তু সাধারণভাবে সেই সময়কার হিন্দুসমাজ বিধবাবিবাহকে স্বীকৃতি দেয় নি । যাঁরা এর সঙ্গে যুক্ত তাঁদের সবাইকেই সমাজের কাছে অল্পবিস্তর বিড়ম্বিত হতে হয়েছে । দুঃখের বিষয় আজ দেড়শো বছর বাদেও বিধবাবিবাহকে হিন্দুসমাজ সুনজরে দেখে না। বিধবাদের পুনর্বিবাহ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সংখ্যায় সেগুলি নগণ্য । এখনের হিসেব জানা নেই, কিন্তু ১৯৭৭ সালে, যেখানে বিধবাবিবাহ আন্দোলনের সূত্রপাত, সেই পশ্চিমবঙ্গে মাত্র ৫৪ টি বিধবাবিবাহ হয়েছে বলে প্রকাশিত একটি খবর থেকে জানা যায় ।

হিন্দু বিধবাদের নিরামিষ ভোজনরীতি –
এককালে স্বামীর মৃত্যুর পর কমবয়সী বিধবাদের তাঁদের বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হত । পতিগৃহে সাধারণভাবে তাঁদের স্থান ছিল না । সিঁথির সিঁদুর মুছে, দেহের সব অলঙ্কার খুলে ফেলে, চুল কেটে, সাদা থান পরে, এক বেলা নিরামিষ খেয়ে অনশন-ক্লিষ্ট অবস্থায় তাঁদের বৈধব্য পালন করতে হত । কারণ ছিল বিধবা নারীর যৌবন, দীর্ঘ কেশ ও রঙিন শাড়ী-গয়নায় পুরুষরা আকৃষ্ট হয় – তাই এই ব্যবস্থা । বিধবা নারীর নিজের মধ্যেও যেন কামনার উদ্রেক না হয়, তার জন্য শুধু আমিষ বর্জন নয়, অনেক জায়গাতে মুসুর ডাল, পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি খাওয়ার ব্যাপারেও বাধানিষেধ ছিল, কারণ এগুলি এবং আমিষকে মনে করা হত কামোত্তেজক খাদ্য! বাপের বাড়িতে ভাইদের সংসারেও বিধবাদের স্থান উচ্চে ছিল না । বাড়ির সব কাজ তাঁদের দিয়েই করানো হত । বিধবাদের পুনর্বিবাহ কল্পনা করাও ছিল পাপ । বিধবারা সংসারের কাজ করে শুদ্ধমনে পবিত্র জীবনযাপন করবে এইটেই ছিল সমাজের দাবী । বহু বিধবাকে জোর করে তীর্থক্ষেত্রে রেখে আসা হত । চোখের আড়ালে কাশী, বৃন্দাবন ইত্যাদি জায়গায় তাঁরা কীভাবে জীবন-যাপন করছে – সে খবরও কেউ রাখতো না ।

বিধবাদের নিয়ে পরিসংখ্যান –
এতোক্ষন আলোচনা করলাম ইতিহাস নিয়ে । এখন আমরা আধুনিক কালের বিধবাদের জীবনযাপন ও কঠিন কিছু বাস্তবতার চিত্র দেখে নি আগে ।

বহু বিধবা নারীই জানেন না যে, বাসস্থান বা সম্পত্তির ব্যাপারে আইন তাঁকে বঞ্চিত করে নি । নতুন আইনেতো বটেই ১৯৩৭ সালে রচিত হিন্দু নারীর সম্পত্তি অধিকার আইনেও (Hindu Women’s Right to Property Act, 1937) মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে বিধবার অধিকার ছিল । অধিকারটা অবশ্য নিরঙ্কুশ ছিল না – দেওয়া হয়েছিল বিধবার জীবদ্দশা পর্যন্ত । তবে শর্ত ছিল যে, পুনর্বিবাহ করলে সেই অধিকার থেকে বিধবা বঞ্চিত হবেন । ১৯৫৬ সালের হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে নারীর সম্পত্তি সংক্রান্ত অধিকারকে পূর্ণ অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় । আজকে যদি কোনো হিন্দু বিধবা ১৯৫৬ হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তির উপর অধিকার পান, তাহলে পুনর্বিবাহ করলেও সেই সম্পত্তি তিনি হারাবেন না । তবে পতিগৃহে মৃতস্বামীর স্বজনদের উপর বা নিজের বাড়িতে ভাইদের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে বলে, হিন্দু বিধবারা অনেক সময়েই তাঁদের প্রাপ্য সম্পত্তি দাবী করতে চান না । পিতার মৃতু্যর পর বহু বিধবা নারীই নিজের দাবী প্রত্যাহার করে ভাইরা যাতে তাঁর ভাগ পান – সেইমত এফিডেভিট দাখিল করেন । অনেক সময়ে তাঁর নিজের সাবালক পুত্রকে সম্পত্তি দিয়ে দেন । সব সময়েই এই আশায় যে, এঁরা তাঁদের ভরণপোষণ করবেন । স্বামীর সম্পত্তির ক্ষেত্রে যে বিধবার শিশুসন্তান আছে তাঁর দাবী সমাজ মেনে নিলেও, অপুত্রক বিধবার দাবী অনেকেই সুনজরে দেখেন না । সমাজের ভয়ে সম্পত্তিতে পূর্ণ অধিকার আছে জেনেও অনেক বিধবা তাঁদের দাবী প্রতিষ্ঠা করতে সাহস পান না ।

তবে যেটা আশার কথা, সেটা হল বিধবাদের সমস্যা নিয়ে কিছু ভাবনাচিন্তা এখনও চলছে । বেশ কিছু এন.জি.ও তাদের সীমিত ক্ষমতার মধ্যে বিধবাদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করছেন; বিধবাদের পুনর্বিবাহের সপক্ষে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন । কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় সেগুলি অতি অল্পই । যেসব বিধবাদের কাশী-বৃন্দাবনে পাঠিয়ে দিয়ে আত্মীয়স্বজনরা তাঁদের দায় সেরেছেন, সেইসব বিধবাদের অবর্ণনীয় অবস্থার নিয়ে এইসব এন.জি.ও চিন্তিত । ১৯৯২ সালে ন্যাশেনাল কমিশন ফর উইমেন একটা সমীক্ষা করে দেখেন যে বৃন্দাবন ও মথুরাতে যেসব বিধবা রয়েছেন তাঁদের অধিকাংশই নিদারুণ দারিদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করছেন । ফলে নারীদেহ-ব্যবসা সেখানে রমরমিয়ে চলছে । স্থানীয় প্রশাসন বা রাজনৈতিক দলগুলি যে সে খবর জানেন না – সেটা বিশ্বাস করা কঠিন । মোট ২৯১০ জন মহিলাকে এই সমীক্ষায় প্রশ্ন করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে ২১১৩ জন এসেছেন পশ্চিম বঙ্গ থেকে ২৯৭ জন বাংলাদেশ থেকে । এঁদের মধ্যে ৫০০ জনের বেশির বয়স ৩০ বছরের কম । এঁদের শতকরা ৫০ জন নির্ভর করেন ভজনাশ্রমের দেওয়া খাবার আর ভিক্ষে করে যা পাওয়া যায় তার ওপর । সবার তাও জোটে না । দেহ ব্যবসায় ছাড়া জীবনধারণের অন্য কোনো উপায় প্রায় নেই । অনেকেই ভুগছেন যক্ষ্মা, পেটের ব্যধি ও নানা যৌন-সংক্রামক ব্যাধিতে । এই অমানুষিক অবস্থাতে জীবনকাটানো সত্বেও মাত্র ৪৩৬ জন বিধবা নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন । বৃন্দাবনে বা মথুরাতে নিজের সমাজের অন্যান্য যন্ত্রণা থেকে অন্তত তিনি মুক্ত!

এই সমীক্ষার ৯ বছর বাদে ২০০১ সালেও অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয় নি । ঐ বছরই ন্যাশেনাল হিউম্যান রাইটস কমিশনের (NHRC) একটি মিটিং-এ বিচারক জে.এস ভার্মা খেদোক্তি করে বলেছেন, এখন প্রয়োজন এঁদের (বিধবাদের) বৃন্দাবনে আসা বন্ধ করা এবং একইসঙ্গে এঁদের পুনর্বাসনের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া যাতে এঁদের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয় । NHRC’র একজন সদস্য মন্তব্য করেছেন যে, এইসব পরিত্যাক্ত মহিলাদের জন্য পরিচ্ছন্ন থাকার জায়গা, অর্থ সাহায্য এবং চিকিত্সার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করাটাই হবে প্রথম কাজ । কাজটি সুবৃহৎ সন্দেহ নেই ।

নিজস্ব কিছু কথা –
আমার দাদু মানে মায়ের বাবা যখন মারা যান তখন আমার বয়স আড়াই বছরের মত । এরপর বড় হবার পর দেখি আমার দিদিমা মানে মায়ের মা তিনি আলাদা খান । এমনকি তার রান্নাটাও আলাদা করা হয় । রান্না করার জন্য তার গুরুত্ব সবার আগে !!! রান্না শুরুর আগে দিদিমার জন্য মামী আলাদা রান্না করত, মা থাকলে মাকেও দেখেছি রান্না করতে । আমার শৈশবের প্রায় সময়টা কেটেছে দিদিমার কোলে । আমি তাকে ছাড়া কিছু বুঝতাম না । দুপুরে যখন ভাত খাব তখনও তার সাথেই খাব এমন বায়না ছিল । কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব !!! উনি খাচ্ছেন নিরামিষ, ঘরের একমাত্র সদস্য যে প্রতিদিন নিরামিষ খাচ্ছে । আর সবাই মাছ, মাংস খাচ্ছে । আরো অবাক করা ব্যাপার ছিল সামান্য পিঁয়াজ পর্যন্ত তার খাবারের আশে পাশে যাচ্ছে না । তো যদি আমি দিদিমার সাথে খেতে চাই তবে আমাকে নিরামিষ খেতে হবে কিন্তু আমি নিরামিষ খাব না । কিন্তু তার সাথে বসে মাছ, মাংসও খাওয়া যাবে না । মনে আছে একদিন মাছের থালা নিয়ে গিয়ে দিদিমার পাশে বসে গেছিলাম, সেদিন মা আমাকে ধোলাই দিছিল । তখন আমি ছোট । এরপর আমি একদিন মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, মা দিদিমা কেন মাছ মাংস খায় না ?? মা বলেছিলেন, তোমার দাদু মারা গেছে তো তাই তার মাছ, মাংস খাওয়া নিষেধ । মেয়েদের স্বামী মারা গেলে তারা মাছ মাংস খেতে পারে না । এটাই নিয়ম । উলটো প্রশ্ন করলাম, বাবা মারা গেলে কি তুমিও আর খেতে পারবে না ?? আমার দিকে ক্রুর ভাবে তাকিয়ে মা বলল না । এরপর যখন আরো বড় হলাম কিছু কিছু বুঝতে শিখলাম তখন আবার একদিন এইসব প্রশ্ন মা কে করেছিলাম । তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেন নি । শুধু বলেছিলেন এটা ধর্মের নিয়ম, যারা ধর্ম মানে তাদের এসব মানতে হয় । সমাজে মেয়েদের অনেক কিছু সহ্য করতে হয় ওসব তুই বুঝবি না । খাওয়া নিষেধ তাই খায় না ব্যাস ।

২০১২ সালের দিকে দিদিমা অনেক অসুস্থ । তার বয়স তখন ৭৫+ । বিছানায় পড়ে থাকেন । গত ৩৫ বছর থেকে তিনি ডায়বেটিসের রোগী । ভীষণ অসুস্থ, অপারেশন করতে হবে কি যেন একটা । তো ডাক্তার বলল, নিরামিষে কাজ হবে না উনাকে সুস্থ করতে হলে আমিষের দরকার । যাইহোক, দাদু মারা যাওয়ার দীর্ঘ ১৬ বছর পর আবার তিনি আমিষ খাওয়া শুরু করলেন । ২০১৩ সালে মারা যাবার আগ পর্যন্ত খেয়েছেন । তখন মাকে একদিন প্রশ্ন করেছিলাম, ধর্মের নিয়ম কেন ভাঙ্গা হল এবার ? এতদিন যিনি নিরামিষ খেলেন তার তো আমিষ খাওয়ার কথাই না । এটা তো ঘোরতর পাপ । মৃত্যুপথযাত্রীকে দিয়ে তোমরা কেন এই পাপ করালে !!! সেদিনও কোন সদুত্তর পাই নি । শুধু বলেছিল, বাঁচিয়ে রাখার জন্য যেটুক দরকার ছিল করেছি ।

এই সমাজ আমাদের বিভিন্ন নিয়ম আর বিধিনিষেধের জালে আটকে রেখেছে । আরো স্পস্টভাবে লক্ষ্য করলে মেয়েদের তো খুব বেশি । এইসব নিয়ম কানুন, আচার ব্যাবহারের উৎপত্তি হয়েছে বিভিন্ন ধর্ম থেকে । নারী আর পুরুষের মাঝে লিঙ্গ বৈষম্য করেছে । এই সমাজ আমাদের নারী আর পুরুষ করে গড়ে তুলেছে হাজার শতাব্দী ধরে । অথচ কথা ছিল মানুষ করার । আমরা মানুষ বিচার না, কে ছেলে কে মেয়ে তা বিচার করি, কে হিন্দু, কে মুসলমান বা বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান দিয়ে জাতিভেদ করি । এই লেখাটি লিখতে গিয়ে অনেক ঘাটাঘাটি করলাম, কোন কোন ব্লগ পোষ্টে দেখলাম দুই পক্ষের কমেন্ট যুদ্ধ । এক পক্ষ বলছে, সতীদাহ প্রথা রোধ করেছিলেন রাজা রাম মোহন রায় যদি ইতিহাস তাই বলে । আরেক পক্ষ বলছে মুঘল আমলে সম্রাটরা এটা রোধ করেছিলেন কিন্তু ইতিহাস বদলে তাদের নাম মুছে দেয়া হয়েছে । এখানেও সেই জাতিগত বিভাজন ।
এই ব্যাপারগুলো সমাজে এখনও আছে । আমাদের বাংলাদেশে এখন তেমন হিন্দু নেই, এরপরেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনও এইসব কুসংস্কার এখনও অনেকেই মানে ।

আধুনিকায়নের সাথে সাথে নগরায়নের প্রভাব বেড়েছে । মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমিয়েছে, জমাচ্ছে । শিক্ষিত হচ্ছে, কুসংস্কার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, অনেকেই অনেক রীতিনীতি ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে । সতীদাহ প্রথা দেড় শতাব্দীকাল আগেই রোধ হয়েছে, বিধবা বিবাহের প্রচলনও হয়েছে । এরপরেও অনেক ধর্মীয় রীতিনীতি, কুসংস্কার এসব থেকে মানুষ এখনও বের হতে পারে নি । অন্তত ধর্ম যতদিন আছে এসব থেকে বের হওয়া সম্ভব না । এর মানে দাঁড়ায়, এইসব কুসংস্কার খুব সহজে সমাজ থেকে দূর হবে না । আমাদের দেশের মানুষরা ধর্ম যে খুব মনে প্রাণে মানে তাও না । যতোটা না ভালোবাসে তার থেকে বেশি ভয় করে । কিসের ভয় !! ধর্মে আমাদের নরকের ভয় দেখানো হয়েছে । এইসব নিয়ম না মানলে নরকে গমন । এই প্রসঙ্গে ভারতীয় চলচ্চিত্র পিকে এর একটি লাইন উদ্বৃত করা যেতে পারে, সেখানে অতিরিক্ত ধার্মিকদের নিয়ে বলা হয়েছিল, “They are not God lover, they are god fear people.”

হাজার হাজার বছর ধরে আবহমান এইসব নিয়ম কানুন, শৃঙ্খল এই একবিংশ শতাব্দিতে এসে একবারেই ভাঙ্গা সম্ভব না । তারপরেও যারা স্রোতের বিপরীতে গিয়েছে, প্রচলিত ধর্ম, সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কার, নিয়মরীতি অস্বীকার করার সাহস দেখিয়েছে তাদেরকেই নাস্তিক বলা হয়েছে । ২১ শতকে এসে তো জীবন পর্যন্ত দিতে হয়েছে অনেককেই । প্রথাবিরোধী হাবার জন্য বাঙলা সাহিত্যের বা বাংলাদেশের সাহিত্যের শক্তিমান প্রথাবিরোধী লেখক, কবি, সাহিত্যিক হুয়ায়ুন আজাদকে প্রাণ দিতে হয়েছে । এরপরে ডঃ অভিজিৎ রায় সহ সামাজিক মাধ্যমে প্রথাবিরোধী লেখালিখির জন্যও অনেককে প্রাণ দিতে হয়েছে । সামাজিক সংস্কার করতে গিয়ে রাজা রাম মোহন রায়, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর এদেরকেও হয়ত অনেক অনেক ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়েছিল কিন্তু জীবন দিতে হয় নি । কথা ছিল সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে মানুষের চিন্তা চেতনার বিকাশ ঘটবে । উল্টো দেখা যাচ্ছে মানুষ দিন দিন বর্বর হচ্ছে । জ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্য, সঙ্গীত, দর্শন চর্চার মাধ্যমে নিজেদের আরো উন্নতি করার বদলে তারা বেছে নিচ্ছে আত্মহুতির পথ ।

তবে শেষমেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এই সমাজ ??? কালের বিবর্তনে সমাজের পরিবর্তন হতে থাকবে । এটাই চলমান প্রক্রিয়া ।

শেষ করার আগে প্রিয় নচিকেতার একটা গানের কয়েক লাইন দিয়েই শেষ করি –
“একদিন ঝড় থেমে যাবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে । বসতি আবার উঠবে গড়ে, আকাশ আলোয় আবার উঠবে ভরে, জীর্ণ মতবাদ সব ইতিহাস হবে । পৃথিবী আবার শান্ত হবে ।”

তথ্যসুত্রঃ উইকিপেডিয়া, গুগল, বিভিন্ন ব্লগ পোস্ট ।

অরুণাভ বিলে
ফেসবুক লিংকঃ https://web.facebook.com/arunav.belayy