১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১। আমি তখন ১২ বছরের কিশোর। বাসায় ডিশ সংযোগ ছিলনা, আর বিটিভির রাত ৮টার বাংলা সংবাদ বা ১০টার ইংরেজি সংবাদ কোনোটাই দেখা হত না। অনেকের নিশ্চয়ই মনে আছে, রাত সাড়ে ১১টায় মিনিট পাঁচেক এর বাংলা সংবাদ আর এরপরপরেই সেই দৈর্ঘ্যেরই ইংরেজি সংবাদ প্রচারিত হত। রাতে বেশ তাড়াতাড়িই ঘুমানো হত। কিন্তু ঠিক কী কারণে সেই রাতে ঢুলুঢুলু চোখে রাত সাড়ে ১১টার খবর দেখছিলাম, আজ এতদিন পর তা আর মনে পড়ছেনা। সেই আধো ঘুম চোখেই দেখেছিলাম টুইন টাওয়ার-এ বিমানের আছড়ে পড়ার ভয়াবহ দৃশ্য। সকালে ঘুম থেকে উঠার পরেও বিশ্বাস হচ্ছিলো না, মনে হচ্ছিলো গত রাতে ঘুমের ভেতর দুঃস্বপ্ন দেখেছি।

স্কুলে গেলাম। আমাদের ইংরেজি পড়াতেন বেশ প্রবীণ এক স্যার, আবুল কাশেম। এখনো সেই দৃশ্যের কথা মনে আছে। স্যার তার চিরাচরিত স্টাইলে পান খেতে খেতে ঢুকলেন, আর ডান হাতের তর্জনী দিয়ে মুখের ভেতর লেপ্টে থাকা পানের অংশবিশেষ বের করে টেনে এনে আবার মুখে পুরলেন। অন্যদিন গুলো থেকে সেই দিন স্যারকে বড্ড বেশি খুশি খুশি মনে হচ্ছিলো। একটু পরেই বোঝা গেল কারণ। এই করতে করতেই যে তিনি প্রফুল্ল চিত্তে গতরাতে আমেরিকায় ঘটে যাওয়া হামলার ‘মজার’ বিবরণ দিতে লাগলেন। আমরা সবাই যেন হা করে শুনছি। আহ! সে কী অসাধারণ বীভৎস বিবরণ। প্রতিদিনের সাধারণ মানুষটা ঐ দিনের মত ‘অচেনা’ হননি তার আগে কখনো, এমনকি তার পরেও না।

অনেক মানুষকেই সেই ঘৃণ্য টুইন টাওয়ার হামলায় কষ্ট পেতে দেখেছি। কিন্তু অস্বীকার করবো না, সেই হামলার পর মুখে টানা অনেক দিন হাসি দেখেছি এমন মানুষের সংখ্যাও কম না। কেউ কেউ তো আগ বাড়িয়ে গর্বই করতো। বড্ড বাজে লাগায় হয়তো স্যারের ঘটনাটাই এখনো স্মৃতিতে বেঁচে আছে।

আমার চরম বিশ্বাসী মনেও বেশ বড় একটা ধাক্কা হয়ে এসেছিলো এই টুইন টাওয়ার হামলা। এতজন সাধারণ মানুষের মৃত্যু কীভাবে একজন বিশ্বাসী মানুষ সমর্থন করতে পারে, অনেক খুঁজেও তার উত্তর পাচ্ছিলাম না। ধীরে ধীরে এই হামলা নিয়ে কত কী যে ডালপালা মেললো। অনেক ডালপালার মাঝে যেটা বেশি সময় টিকে রইলো সেটা হল “ইসরায়েলের এই হামলার পিছে ইন্ধন আছে, আর তাই ঐদিন টুইন টাওয়ারে কোন ইহুদী ছিল না।” আমার নিজেরও অনেকদিন এটার ওপর ক্ষীণ সন্দেহ ছিল, অন্তত টুইন টাওয়ারের হামলায় নিহত অনেক ইহুদীর নাম না দেখা পর্যন্ত। এখনো অনেকে আছে যারা “আল-কায়েদা এই হামলা করে মার্কিনিদের টাইট দিয়েছে” ভেবে মানসিক শান্তি পায়, আবার আরেক দল মানুষ “এটাতে ইহুদী কেউ মারা যায়নি, এটা ইসরায়েলের ষড়যন্ত্র” ভেবে মানসিক শান্তি পায়।

কিন্তু ৯-১১ এর এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়কে যুক্তরাষ্ট্র পরে কীভাবে ব্যবহার করলো? একে একে আফগানিস্তান, ইরাকে হামলা চালিয়ে তারা যে পরিমাণ সাধারণ মানুষ মেরেছে তা তুলনাতীত। এই ।যুগেও আমরা যেন ফিরে গেলাম সেই সাম্রাজ্যবাদী সময়ে।

যতই দিন যাচ্ছে পৃথিবীর একদল মানুষ পৃথিবীকে আরো বাসযোগ্য, আরো সুন্দর করার চেষ্টায় শ্রম দিয়ে যাচ্ছে আর আরেকদল মানুষ তার বিপরীত আদর্শ বা মতের মানুষকে বিনাশের চেষ্টায় দিনরাত এক করছে। দুঃখের বিষয় কেন জানি পরের দলটাই বেশি ভারী হচ্ছে দিন কে দিন। মানুষ যে স্ববিনাশী প্রজাতি সেটা আজকের কথা না। মানুষের সমাজব্যবস্থার বিবর্তন নিয়ে লেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ বই রাহুল সাংকৃত্যায়নের “ভোলগা থেকে গঙ্গা” পড়তে পড়তে হারিয়ে যাই সেই সুদূর অতীতে। সেই গোত্র ভিত্তিক সমাজব্যবস্থার সময়েও নদী তীরবর্তী এলাকা নিজেদের দখলে রাখতে কীভাবে এক গোত্র অন্য গোত্রের সব মানুষ মেরে ফেলে, কীভাবে অন্য গোত্রের ছোট শিশুদেরও রেহাই দেয়না, ধরে আছড়ে আছড়ে মারে। যে সময়ের কথা বলছি সেটা আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগের। কিন্তু এই এত বছরেও আসলে আমাদের কতটা পরিবর্তন এসেছে?

টুইন টাওয়ারে হামলা করে নানা দেশের, নানা ধর্মের হাজারো মানুষ মেরে আজো অনেকে উল্লসিত হয়। আফগানিস্তানে, ইরাকে হাজারো, লাখো মানুষ মেরে সেই এলাকা আর সম্পদ নিজেদের কব্জায় আনতে পারলেই অনেকে উল্লসিত হয়। বিপরীত ধর্মের অথবা একই ধর্মের বিপরীত মতাদর্শের মানুষের কাটা মুণ্ডু হাতে নিয়ে ছবি তুলে অনেকে উল্লাসে ফেটে পড়ে। শ’খানেক নারীকে অপহরণ করে তুলে নিয়ে গিয়ে উল্লসিত হয়। কেউ ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষদের নির্বিচারে মেরে নিজেদের নিরাপদ করে, আবার কেউ সেইসব সাধারণ মানুষকে ঢাল বানিয়ে হাজারো মৃত্যুর বিপরীতে ইসরায়েল-এর একটা মৃত্যুকেই নিজেদের জয় মনে করে। ঘুরে ফিরে এরা সবাইই তো মানুষ, অন্তত জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিতে। তাহলে কি বলবো, সাড়ে পাঁচ হাজার বছর ধরে মানুষের মনোজগতের কোন পরিবর্তন হয়নি?

হয়েছে, আবার হয়নি। সেই সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগেও মানুষ সৌন্দর্য বুঝতো, ভালবাসা বুঝতো, সুর বুঝতো, আর নিশ্চয়ই তাদের কেউ কেউ দার্শনিক ছিলো, কেউ ছিল গবেষক। সেই ভাবুক দার্শনিকদেরই কেউ হয়তো পেটের খিদেয় পশুর গলায় পাথরের ছুরি মারার আগে সেই পশুর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়ার রীতি তৈরি করেছিলো। সেই গবেষকদের কেউ হয়তো পাথরের ছুরির পেছনে লম্বা দণ্ড লাগিয়ে বানিয়েছিলো বল্লম, আবার হাতের জোরের বিকল্প ভাবতে গিয়ে কেউ বানিয়েছিলো তীর।

তাহলে? অনন্তকাল ধরে মানুষ কি এভাবেই থেকে যাবে? ধ্বংসোন্মুখ?

এর পেছনে দায়ী কে? দায়ী মানুষের সবচেয়ে কার্যক্ষম অঙ্গ, মস্তিষ্ক। এ এমনই এক অদ্ভুত যন্ত্র যেটায় একবার কোন কিছু প্রবেশ করলেই তা অনবরত চেইন রি-একশনের মত চলতেই থাকে। ডালপালা মেলতেই থাকে। একটুখানি বিদ্বেষ ঢুকাতে পারলে তা বাড়তে বাড়তে মুহুর্তেই মানুষ পরিণত হয় বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রে। অন্য গোত্রের সম্বন্ধে বিষোদাগার ভালভাবে করতে পারলেই একটু আগেও গাছের ডাল দিয়ে বাঁশি বানাতে ব্যস্ত মানুষটা মুহুর্তেই প্ল্যান পরিবর্তন করে সেই একই ডাল দিয়ে বল্লম বানাতে বসে যায়। কবিতা লিখতে থাকা মানুষটিকে দিয়েও লেখানো যায় মৃত্যুর পরোয়ানা।

তাহলে এর থেকে পরিত্রাণের উপায়? হ্যা, সেটাও সেই একই অঙ্গ, মস্তিষ্ক। পৃথিবী জুড়ে চলতে থাকা এই নৃশংসতা, এই হত্যার নেশা বন্ধের ব্যাপারে অনেকের অনেক থিওরি অনেক পরামর্শ থাকলেও আমি শুধু একটা বিষয়কেই প্রধান মনে করি। না, পুরো বিশ্বের মানুষ অবিশ্বাসী হয়ে গেলেই এর সমাধান হবে না (রাতারাতি এটা সম্ভবও না, আর অবিশ্বাসী মানুষ মানেই ভাল মানুষ তাও কিন্তু না)। পুরো বিশ্বের মানুষ চরম বিশ্বাসী হয়ে গেলেও এটার সমাধান হবে না (সাম্প্রতিক সময়ের চরম বিশ্বাসী মানুষদের মাদকতা নিয়ে তো আর নতুন করে কিছু বলার নেই)। কেউ বলেন, পুরো পৃথিবী এক রাষ্ট্র হয়ে গেলে এর সমাধান হবে। আমি এটাও মনে করিনা। কারণ, তাহলে সেই রাষ্ট্রের উন্নয়নকাজের বন্টনের অসমতাও একই অবস্থা সৃষ্টি করবে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই এটা আছে, আছে ভারতে, আছে এই ছোট্ট বাংলাদেশেও, গুটি কয়েক জেলায় যে উন্নয়ন কর্মসূচি নেয়া হয় তা অন্যসব জেলার সম্মিলিত সমষ্টির চেয়েও অনেকগুণ বেশি।

একটা বিষয়ই পারে মানুষের ভেতরকার বিধ্বংসী মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে সৃজনশীল মানুষকে জাগিয়ে তুলতে। মানুষের বিচার বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা। মানুষের বারংবার নিজেকে প্রশ্ন করার ক্ষমতা। যেকোন কাজের আগে সেই কাজটা আসলেই কতটা সঠিক হচ্ছে সেই ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে নেয়া। অন্ধের মত কোন কাজে ঝাঁপিয়ে না পড়ে, একেবারে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ নেয়া।

আমি নিশ্চিত, টুইন টাওয়ার হামলায় আত্মঘাতী সেইসব জঙ্গিদের দেহে আবার প্রাণ ফিরিয়ে দিয়ে যদি এই হামলার জের ধরে ইরাকে আর আফগানিস্তানে হওয়া হামলায় মারা যাওয়া অসংখ্য মানুষকে দেখানো যেত, যদি সেই টুইন টাওয়ারের প্রতিটা ফ্লোরে থাকা সাধারণ সেইসব মানুষের ব্যক্তিজীবন দেখানো যেত, যদি দেখানো যেত একটু আগেই ছোট্ট মেয়েটার সাথে কথা বলা কোন মা অথবা বৃদ্ধ বাবার সাথে কথা বলা কোন তরতাজা তরুণ ছেলেটাই তাদের হামলায় কীভাবে নিমিষেই পৃথিবী থেকে বিদেয় নিয়েছে, তাহলে কি তাদের চোখ দিয়ে অশ্রু পড়তোনা? তাদের পাথর হয়ে পড়া বিবেক একটু হলেও আর্দ্র হত না? আমি নিশ্চিত, সেটাই হত। এমনকি তাদের টাইম মেশিনে চড়িয়ে অতীতের ঠিক ঐ মুহুর্তে নিতে পারলে তারা বিমানের লক্ষ্য পরিবর্তন করে কোন বিমানবন্দরে নিয়ে যেত।

ইরাকে সরাসরি হামলা করে, তাদের ভিতর বিভেদ সৃষ্টি করে নিজ দেশে অবাধে তেল নেয়ার সুযোগ খোঁজা শাসককে যদি সেই সময়েই দেখানো যেত তাদের পোষ্যরাই এখনকার মাথাব্যথা ধরিয়ে দেয়া জঘন্য আইএস হয়ে উঠবে, তাহলে কি এর আগে সে একটুও ভিন্ন চিন্তা করতো না?

আইএসের সমর্থক এক ভারতীয়ের শেয়ার করা এক ছবিতে দেখেছিলাম, আইএসের যোদ্ধারা নাকি এতটাই ভাল যে আশ্রয়হীন এক বিড়ালকেও চরম মমতায় আদর করছে, দুধ খাওয়াচ্ছে। ধরে নিচ্ছি এটা সত্য। তাহলে এইসব আইএস যোদ্ধাদেরও যদি নিজেদের ভিতরকার প্রশ্নের ক্ষমতা জাগিয়ে তোলা যেত, তারা আসলে কী করছে সেটা তাদের সামনে নিয়ে আসা যেত, তাহলে কে জানে হয়তো আজকের এই আইএস যোদ্ধারাই হত ডব্লিউডব্লিউএফ (ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড ফান্ড) এর এক একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী, হয়তো তাদের সারাটাদিন চলে যেত অভয়ারণ্যের পশুপাখিদের দেখভাল করতে করতে।

দুইশ নারীকে তুলে নিয়ে যাওয়া বোকো হারামকে যদি জিজ্ঞেস করা হত আজ তাদের ঘর থেকে তাদের মা,বোন বা স্ত্রীকে কোন শক্তিধর দেশের মানুষেরা এভাবে তুলে নিয়ে গেলে তাদের কেমন লাগতো? আর কেনইবা অপহরণ, সাদা চোখে কীই বা এই নারীদের অপরাধ? কে জানে হয়তো এই প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে পরিবর্তিত বোকো হারাম সদস্যদের এরপর দেখা যেত সাধারণ নারীদের আত্মরক্ষায় মার্শাল আর্ট শেখাচ্ছে।

আবু গারিব কারাগারে জঘন্য আর অকথ্য নির্যাতন চালানো সেইসব মার্কিন সেনাদের যদি প্রশ্ন করা যেত, তাদের বাবা-মা বা ভাই-বোন না শুধু পোষা কুকুরটার ওপর যদি কেউ এই ধরনের অত্যাচার করতো তাহলে তার কী অনুভূতি হত?

ইসরায়েলের নাগরিকদের যদি বোঝানো যেত রাতে পুরো বাড়ির সবাই একসাথে ঘুমানোর পর সকালে ঘুম থেকে উঠে পুরো বাড়িটাই নাই হয়ে যাওয়া, বাড়ির প্রায় সব সদস্যের রক্তাক্ত শরীর দেখার কী অনুভূতি…

ইসরায়েলি কোন মানুষকে হাতের নাগালে পেলেই তাকে আধামরা করে তার আধা জীবন্ত লাশ মোটর সাইকেলের সাথে বেঁধে পুরো শহর ঘোরানো যে কতটা পৈশাচিক সেটা যদি একবার মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া যেত ফিলিস্তিনের সেই তরুণকে…

আমার এইসব চিন্তাভাবনাকে বড্ড অসম্ভব আর এলোমেলো মনে হচ্ছে? না, আমি অন্তত এটা মনে করিনা। মানুষ নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করতে পারলে, নিজের কাঠগড়ায় নিজেই দাঁড়াতে পারলে, তার যে কতটা মানসিক বিবর্তন ঘটতে পারে – আমি নিজেই যে এর অনেক বড় উদাহরণ।

আমি অনেক অনেক ছোটবেলা থেকেই চরম বিশ্বাসী একজন মানুষ ছিলাম। কতটা? আমার পরিবারের সবাই জানে, আর আমার নিজেরও এখনো মনে আছে, সেই নার্সারি বা ১ম শ্রেণীতে থাকতে আমাদের এক আত্মীয় চাকুরী করা এক মেয়েকে বিয়ে করেছে শুনে আমি নগদে ফতোয়া জারি করে দিলাম। “ছিঃ! মেয়ে চাকরি করে!! এইসব তো ঠিক না!!!” আমার এই অবস্থা দেখে আমার পরিবারের পরিণত মানুষদের তো মাথা খারাপ (সেটাই স্বাভাবিক)। তাঁরা আমাকে অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। তাঁদের সেই দিনের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে না শুনে এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দিয়েছিলাম। কিন্তু সেইদিনের সেই ১ম শ্রেণীর আমি নিজেই নিজেকে বারবার ভাঙতে ভাঙতে আর পুনরায় গড়তে গড়তে, বিবর্তিত হয়ে এমন অবস্থায় চলে আসি যে ৯ম বা ১০ম শ্রেণীতে যখন “দ্য গার্ল নেক্সট ডোর” হলিউডি ফিল্মটা দেখছি তখন নিজেই নিজেকে বলি, “আমার ভালবাসার মানুষ যদি একজন পর্নস্টার, একজন দেহপসারিণীও হয় তাহলেও সেটা কোন বড় বিষয় না। বিষয় হল, সে আমাকে আসলেই ভালবাসে কিনা। একমাত্র দুর্নীতি আর মিথ্যার সাথে না থাকলে তার যেকোন পেশাকেই আমি সম্মান জানাবো, এমনকি সেটা পর্নস্টার হলেও।” (হাস্যকর আর বেমানান হলেও, আমি তখনো একজন পুরোদমে বিশ্বাসী মানুষ)। নিজেই নিজেকে বারবার তৈরি করেছি আর ভেঙেছি। আর এর পেছনে ছিল অসংখ্য বই, অনেক গান, অনেক মুভি, অনেক চিন্তা আর অনেক অনেক প্রশ্ন। সেইসবের ফসল আজকের আমি।

সেই শিশু শ্রেণীতে আমাকে দেখা মানুষেরা ১০ম শ্রেণীর আমাকে দেখলে হয়তো চোখ কপালে তুলতো। আর এখনকার আমাকে দেখলে তো নিঃসন্দেহে হার্ট এটাক হবে।
নিজের ভেতরকার প্রশ্নের বিস্ফোরণ, সবসময় সত্য জানতে চাওয়ার অনুসন্ধিৎসু মন, যেকোন বিষয়কেই নিরপেক্ষভাবে দেখার বা চিন্তা করার শক্তিই পারে যেকোন মানুষকে বদলে দিতে। এরজন্য কোন আইন, কোন শাস্তির প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন শুধু একটিবারের জন্যে হলেও তার মস্তিষ্কে চিন্তার ঝড় তুলে দেয়া, প্রশ্নের সাইক্লোন তৈরি করা, তাকে দেখিয়ে দেয়া সে কী করছে আর কী করতে পারতো।

আমি অনেকদিন মনে করেছি মানুষকে এগিয়ে নিতে “বিজ্ঞান”-ই যথেষ্ট, আর কিছুই লাগবে না। কিন্তু এখন বুঝতে পারি, “বিজ্ঞান” এর পাশাপাশি “অর্থব্যবস্থা”, “দর্শন” –এরও সমান প্রয়োজন এই মানবসভ্যতার। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিতে এত উন্নত হওয়ার পরেও মানুষের এই মানসিক দীনতা, এই দারিদ্র্য, এই ভয়াবহ দুর্দশা কিন্তু লুকিয়ে বিজ্ঞানের উন্নতি যে গতিতে হয়েছে সে গতিতে মানুষের আদর্শ আর দর্শনের উন্নতি না হওয়ায়। মানুষ তথাকথিত “শিক্ষা”-র গন্ধে আমোদিত না থেকে চিন্তা করতে শিখুক, আসল “শিক্ষা” কাকে বলে বুঝতে শিখুক।

“আইফোন ৬” বা “গ্যালাক্সি এস ৫” এর মত যত উন্নত প্রযুক্তিই একজন মানুষের হাতে থাকুক না কেন, তথাকথিত “প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা”-র মানদণ্ডে সে যতই “শিক্ষিত” হোক না কেন, চিন্তাভাবনায় বদ্ধ, অনুন্নত, জরাগ্রস্ত একজন মানুষ আসলে সেই “অনুন্নত”-ই।

আজ থেকে অনেক আগে মার্টিন লুথার কিং বলে গেছেন-
“বৈজ্ঞানিক ক্ষমতা আমাদের আত্মিক ক্ষমতাকে ছাড়িয়ে গেছে। এখন আমাদের আছে নিয়ন্ত্রিত মিসাইল আর অনিয়ন্ত্রিত মানুষ।”
এটা এখনো অনেক বড় সত্য।

আমি মনে করিনা শাস্তি আর আক্রমণই পৃথিবীর বিপথে যাওয়া মানুষদের পথে আনতে পারে। শাস্তি আর আক্রমণ বিপথে যাওয়া মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে, কিন্তু তাদের পথে আনতে পারে না। শুনতে খারাপ লাগলেও সত্য, বর্তমান পৃথিবীতে শাস্তি বা আক্রমণের প্রয়োজনীয়তা এখনো ফুরোয়নি। তাই একেবারে অতি প্রয়োজন পড়লেই শুধু সেটার ব্যবহার করা হোক। আর সবটা সময় পৃথিবীর মানুষদের মুক্তভাবে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করা হোক। এটাই বড় বড় অপরাধী বা জঙ্গীদেরও পরিবর্তিত শুদ্ধ মানুষে রূপান্তরিত করবে। আর সাধারণ মানুষদের অপরাধী হওয়াটাও হ্রাস করবে। শিশু অবস্থা থেকেই মুক্তচিন্তা করতে শেখা একজন মানুষ কখনোই অন্ধভাবে কোন কিছু সমর্থন করবে না, কোন কাজ করবে না।

মানুষের প্রশ্ন করার শক্তি সম্বন্ধে আবার মানুষকে জানিয়ে দেয়া হোক। এক প্রশ্ন থেকে জন্ম নেবে আরো হাজারো প্রশ্ন। নানা প্রশ্নের ডালপালা মেলে বেড়ে ওঠা বিশাল মহীরুহের এক ডাল থেকে আরেক ডালে লাফিয়ে এক প্রশ্ন থেকে আরেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে মানুষ চলে যাবে সেই উচ্চতায় যেই উচ্চতায় উঠার ইচ্ছে নিয়েই মানুষের এই অভিযাত্রা। সেই উচ্চতা থেকে পেছন ফিরে তাকালে মানুষ দেখতে পাবে নিচে ফেলে আসা আলেক্সান্দ্রিয়া লাইব্রেরী ধ্বংসের দৃশ্য, টুইন টাওয়ারের ভেঙে পড়ার দৃশ্য, স্বজাতির কেটে ফেলা মাথা হাতে পৈশাচিক হাসির দৃশ্য, হয়তো দুই চোখ বেয়ে একটু অশ্রু নেমে আসবে, কিন্তু মুখে হাসিটাও ফুটবে, কারণ সেসব কিছু পেছনে ফেলেই তো আজ তারা এই উচ্চতায়।