ইসলাম কী জংগিবাদকে সমর্থন করে? এই বিতর্কে গত পর্বে (ইসলাম অর্থ শান্তি, আসলেই কি?) লিখেছিলাম ইসলাম শব্দের অর্থ শান্তি বিষয়ে কোরানের বক্তব্য কী তা নিয়ে। আজকের পর্বে ইসলাম ধর্মের উপর জংগিবাদের অপবাদের ভিত্তি কী এবং এ বিষয়ে মডারেটগনের দাবীর পেছনে কোরানের বক্তব্য অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হবে। যেহেতু হাদীসের সত্যতা নিয়ে অনেকের সন্দেহমূলক বক্তব্য পাওয়া যায়, তাই হাদীসকে এ আলোচনার বাইরে রাখার চেষ্টা করা হবে। তবে হাদীস ছাড়াও কোরানের শানে নুযূল সম্পূর্নভাবে বোঝা সম্ভব নয়, তাই এর স্বার্থে যতটুকু হাদীস আলোচনায় না আসলেই নয় ততটুকু ব্যবহার করা হবে। আশা করি, কোরানের বক্তব্য অনুসন্ধান করলেই আমরা ইসলামে জংগিবাদের অবস্থান কী সে সম্পর্কে একটা ধারনা লাভ করতে পারবো।

প্রথমেই শুরু করবো, মডারেটগনের সেই দাবী নিয়ে যা তারা সর্বাধিকবার ব্যবহার করেন। তারা দাবী করেন, ইসলাম ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছে। কোরানের ২ নং সূরা বাকারা ২৫৬ নং আয়াতের বাংলা অর্থ মূলত এটি।
২:২৫৬ – দ্বীনের ব্যাপারে কোন জোর-জবরদস্তি নেই।
এই আয়াতের অর্থটি খুবই সুন্দর। সত্যিকার অর্থেই যদি ইসলামকে এই আয়াতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যেতো, তাহলে পৃথিবীতে ইসলাম একটি আতংকের ধর্মে পরিণত হতো না। মুসলমানদেরকে দাবী করতে হতো না, “আমি মুসলমান কিন্তু সন্ত্রাসী নই”। যেহেতু মুসলমাগণকে এখন আধুনিক বিশ্ব ভয় করে সেহেতু ধরে নেয়া যায়, ইসলাম এই আয়াতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তাহলে, প্রশ্ন এসে যায় কেন মুসলমানগণ এই আয়াতের বাইরে চলে গেছেন? এর কারণ কী? ইসলাম যদি শান্তির ধর্ম নাই হতো, তাহলে এমন আয়াত কেন কোরানে থাকবে? এ আলোচনায় প্রবেশের আগে আমাদেরকে জানতে হবে কোরানের মাক্কি সূরা ও মাদানী সূরা সম্পর্কে। এতে করে কোরানের সূরা কিংবা আয়াত নাজিলের কারণ স্পষ্ট হবে। এবং কোন পরিস্থিতিতে মুসলমানদেরকে কোন আয়াত ফলো করতে হবে অর্থাৎ সূরা বাকারার এমন সুন্দর একটি আয়াত থাকার পরও কেন মুসলমানরা সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যা পাচ্ছে, কেন এই আয়াতের নির্দেশ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।

হ্যা, আমরা কম বেশি সকলেই জানি কোরানের সূরাগুলোকে নাজিলের সময়ভেদে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ১. মাক্কী ও ২. মাদানী। মোহাম্মদের মদীনায় হিজরতের আগে পর্যন্ত নাজিলকৃত সূরাগুলোকে মাক্কী ও এর পরের সূরাগুলোকে মাদানী নামে অভিহিত করা হয়েছে। সকল তাফসীরকারকই এই সূরাগুলোর কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করেছেন। আসুন এক নজরে দেখে নিই বৈশিষ্ট্যগুলো কী কীঃ

মাক্কী সূরার বৈশিষ্ট্যঃ
১. মাক্কী সূরায় তাওহীদ এবং রিসালাতের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে।
২. মৃত্যুর পর পুনরুত্থান ,জীবনের কৃতকর্মের হিসাব – নিকাশ ,কিয়ামতের বিভীষিকা এবং জান্নাতের অনুপম শান্তি ও জাহান্নামের কঠোর শাস্তির বর্ণনা এতে প্রাধান্য লাভ করেছে।
৩. এতে শরীআতের সাধারণ নীতিমালা এবং উত্তম চরিত্র ও বৈশিষ্টের বর্ণনা রয়েছে।
৪. এতে পূর্ববর্তী নবীগণ এবং তাঁদের অবাধ্য উম্মাতের করুণ পরিণতির কাহিনী বিবৃত হয়েছে।
৫. মাক্কী সূরা আকারে ছোট ,কিন্তু অতীব ভাবগম্ভীর। এর শক্তিশালী শব্দমালা কর্ণে ঝংকার এবং অন্তরে প্রকম্পন সৃষ্টি করে।
৬. এতে প্রসিদ্ধ বস্তুসমূহের শপথের মাধ্যমে উপস্থাপিত বিষয়ের প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে।

মাদানী সূরার বৈশিষ্ট্যঃ
১. মাদানী সূরায় ইবাদাত, সামাজিক আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি, পরস্পরের লেনদেন, হালাল-হারাম, উত্তরাধিকার আইন, জিহাদের ফযীলত, ব্যবসা-বাণিজ্য, পররাষ্ট্র নীতি, বিচার ব্যবস্থা, দন্ডবিধি, পারিবারিক, আর্থ সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও সমষ্টিগত জীবনের যাবতীয় সমাধানের উল্লেখ্য রয়েছে।
২. মাদানী সূরায় বিশেষভাবে আহলে কিতাব তথা ইহূদী ও খ্রিস্টানদের প্রতি ইসলাম গ্রহণের জন্য আহবান জানান হয়েছে।
৩. এতে আহলে কিতাবদের সত্যবিমুখতার কথা এবং তাদের কিতাব বিকৃতি সাধনের কথা বর্ণনা করা হয়েছে।
৪. এতে মুনাফিকদের কপট আচরণের কথা বর্ণনা করা হয়েছে এবং ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র উদঘাটন করা হয়েছে।
৫. মাদানী আয়াত ও সূরা দীর্ঘ। এতে শরীআতের বিধি-বিধানকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

লক্ষ্য করলে সহজেই বোঝা যায়, মাক্কী সূরাগুলো মুসলমানদের জন্য নির্দেশমালা সম্বলিত নয়। এগুলো কাফিরদেরকে ইসলামে আহবান করার জন্য নাজিল করা হয়েছে। কাফিররা যেনো আখিরাত তথা জাহান্নামের ভয় এবং বেহেস্তের লোভে ইসলাম গ্রহন করে, সে জন্য জান্নাত জাহান্নামের বর্ননা করা হয়েছে। এ সুরাগুলোতে শরীয়তের অর্থাৎ ইসলামী আইনের সামান্য কিছু বিষয় ছাড়া একজন মুসলমান হিসেবে করনীয় তেমন কোন নির্দেশনা পাওয়া যায় না। অন্যদিকে মাদানী সূরাগুলো মুসলমানদের জন্য করনীয় নির্দেশনায় পরিপূর্ন। অর্থাৎ, একজন ব্যক্তি ইসলাম গ্রহনের পর তার বা মুসলমান হিসেব একজন ব্যক্তির করনীয় বিষয় নিয়ে মাদানী সূরায় দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে মোহাম্মদ মাক্কী জীবনে তার দাওয়াতী কার্যক্রমের মাধ্যমে বেশি সংখ্যক মুসলমান তৈরী করতে পারেনি, তাই ওই সময়কার সূরাগুলো মুসলমানদের দলভারী করার স্বার্থে মুশরিকদের প্রতি আহবানে পূর্ণ। মোদ্দাকথা, তখন তেমন সংখ্যক মুসলমানই ছিলো না যে তাদেরকে জীবন বিধান দেয়ার ততটা প্রয়োজন পড়েছিল। কিন্তু, মদীনায় মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াতে তাদেরকে ইসলামের অন্তর্ভূক্ত রাখা ও তাদের জন্য আলাদা জীবন প্রনালী অর্থাৎ তাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপ কী হবে, তাদের দায়িত্ব কী হবে তার প্রয়োজন পড়ে যায়। তাই মাদানী সূরাগুলোতে মুসলমানদের করনীয় বিষয়, ও ইসলামের ইবাদাত, সামাজিক আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি, পরস্পরের লেনদেন, হালাল-হারাম, উত্তরাধিকার আইন, জিহাদের ফযীলত, ব্যবসা-বাণিজ্য, পররাষ্ট্র নীতি, বিচার ব্যবস্থা, দন্ডবিধি, পারিবারিক, আর্থ সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও সমষ্টিগত জীবনের যাবতীয় সমাধানের উল্লেখ্য রয়েছে।

এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে, প্রতিটা সূরা নাজিলের কারণ বা শানে নুযূল অর্থাৎ একটা প্রেক্ষাপট বা প্রেক্ষিত রয়েছে। ইসলামকে প্রতিষ্ঠা ও মুসলমানদেরকে পরিচালনার স্বার্থে মোহাম্মদ তার নিজ জীবদ্দশায় যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, সে সকল সমস্যা সমাধান কল্পে কোরানের সূরাগুলোর অবতারনা হয়েছে। এমনকি, মোহাম্মদের ব্যক্তিগত বিষয়ের সমস্যা সমাধানেও কোরানের আয়াত নাজিলের প্রমান পাওয়া যায়। তাই, এটা স্পষ্ট যে কোন আয়াতের মূল নির্দেশ সম্পর্কে জানতে বা বুঝতে হলে শানে নুযুলের বিকল্প নাই।

যাই হোক, আবার ফিরে যাই সূরা বাকারার ২৫৬ নং আয়াতের শানে নুযুলে। এই আয়াত নাযিল হওয়ার কারণ সম্পর্কে অধিকাংশ তাফসীরে পাওয়া যায় যে, আনসারদের কিছু যুবক ছেলেরা ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টান হয়ে গিয়েছিল। পরে যখন আনসাররা ইসলাম গ্রহণ করল, তখন তারা তাদের ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টান হয়ে যাওয়া সন্তানদেরকে ইসলাম গ্রহণের জন্য বাধ্য করতে চাইলে এই আয়াত অবতীর্ণ হল। আয়াত নাযিল হওয়ার কারণের দিকে লক্ষ্য করে কোন কোন মুফাসসির এটাকে আহলে-কিতাবদের জন্য নির্দিষ্ট মনে করেন। অর্থাৎ, মুসলিম দেশে বসবাসকারী ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানরা (মূর্তি পূজারীরা এর বাইরে) যদি জিযিয়া-কর আদায় করে, তাহলে তাদেরকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা যাবে না। এখানেও মূর্তি পূজারী আর জিজিয়া কর প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। এই আয়াতের নির্দেশনার সাথে ইসলাম নিয়ে গ্রহণ বর্জনের বিষয় কতটুকু উদার নৈতিকতা প্রদর্শনের সুযোগ রয়েছে তা কী প্রশ্ন স্বাপেক্ষ নয়!

(কথা হবে আগামী পর্বে। )