লিখেছেনঃ ফাহিম আহমেদ

মানচিত্র আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অভাবনীয় প্রভাব বিস্তার করে। আমরা কখনো মানচিত্র প্রদত্ত তথ্যকে প্রশ্ন করি না, অস্বীকার করি না। মানচিত্রকে আমরা সার্বজনীন হিসেবে মেনে নেই যা আমাদের রাজনৈতিক ও ভৌগলিক চিন্তা ধারাকে প্রভাবিত করার মধ্য দিয়ে সমগ্র বিশ্বকে এক নজরে দেখতে সহায়তা করে থাকে। মানচিত্র সমগ্র বিশ্বকে অথবা এর অংশবিশেষকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করে। কিন্তু তা করা হয় নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে। মানচিত্রে আমরা পৃথিবীর উত্তরকে বলি উপরের অঞ্চল, দক্ষিণকে বলি নিচের অঞ্চল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি অনর্থক কেননা আমরা একটি গোলাকার পৃথিবীতে বসবাস করি। আধুনিক মানচিত্রে উত্তর হল উপরে, দক্ষিণ নীচে পূর্ব ডানে আর পশ্চিম বামে। কিন্তু পৃথিবী বৃত্তাকার হওয়ার দরুণ আমরা যদি বলি আমেরিকা পূর্বে অবস্থিত অথবা দক্ষিণ আফ্রিকা উত্তরে তবে উভয় সিদ্ধান্তই সঠিক হবে।

আধুনিক যুগে শক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে মানচিত্রের প্রভাব অপরিসীম। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য মানচিত্রের ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সোভিয়েত কার্টোগ্রাফি প্রশাসন এ ধরণের বিকৃতির অন্যতম উদাহরণ। ব্রাইন মইনাহান এর মতে,” সোভিয়েত কার্টোগ্রাফি প্রশাসন প্রধান একবার স্বীকার ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত সাধারণ জনগণের ব্যবহারের জন্য সকল মানচিত্রের বিকৃত সাধন করা হয়েছিল। কেজিবি’র (Committee for State Security) নির্দেশ অনযায়ী সড়ক, নদী এমনকি আবহাওয়াও গোপন করা হয়েছিল। ১৯৭০ সালের আগ পর্যন্ত আবহাওয়া প্রতিবেদন দৈনিক পত্রিকাগুলোতে প্রকাশ করা হত না।”​

কোন মানচিত্রই মিথ্যা বর্জিত নয়। সত্য চয়নের ক্ষেত্রে মানচিত্রগুলোতে থাকে পক্ষপাতিত্ব, সত্যকে বর্জন, সাধারণীকরণ ও অতিরঞ্জন। কোন মানচিত্রে মিথ্যা বেশী এবং কোনটিতে কম তা নিয়ে বির্তক করা যেতে পারে। কিন্তু মানচিত্র যখন পক্ষপাতিত্ব ও অতিরঞ্জন সাথন করে তখন তা মতবাদ প্রচারের পর্যায়ে চলে আসে। এক্ষেত্রে আপেক্ষিকতাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যেখানে “তাদের মানচিত্র মতবাদ প্রচারের জন্য গৃহীত”, “আমাদেরটি সম্পূর্ণ নির্ভূল।” এধরণের বক্তব্যের আবির্ভাব ঘটে।

জার্মান কার্টোগ্রাফি মতবাদ প্রচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। হিটলারের ক্ষমতা অধিগ্রহণের যুগে অভ্যন্তরীণ যুদ্ধচলাকালীন সময়ে মানচিত্র জার্মান জনমত গঠন ও বৈদেশিক নীতি নির্ধারণে ভূমিকা পালন করে। এর দ্বারা মূলত সাধারণ জনগণদের ভার্সাই চুক্তির নেতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে অবগত করে তোলা হয়। তাছাড়া জার্মান জাতির

জন্য একটি Lebensraum (Living Space) বা হৃদভূমির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। মানচিত্র যখন মতবাদ প্রচারে ব্যবহৃত হয় তখন এর মাঝে উপস্থাপনজনিত গলদ ও মিথ্যা স্থান পায়। ক্লস ডডস বলেন, “জার্মান ভূগোলবিদ ও কার্টগ্রাফাররা এমন মানচিত্র তৈরি করেছিল যার মাধ্যমে জার্মানীকে ১৯১৯ এর ভার্সাই চুক্তির বন্দী হিসেবে প্রতিয়মান হয়।” এ মানচিত্রগুলো তাদের প্রতীক, রং, আপেক্ষিক অবস্থান দ্বারা জার্মানীর সীমানার ওপর সাধারণদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ মানচিত্রগুলো একটি বৃহত্‍ জার্মানী গঠনের লক্ষ্যে জার্মান সাম্রাজ্যের হারানো ভূমি পূণরায় অধিগ্রহণের জন্য অস্ট্রিয়া ও চেকশ্লোভাকিয়াকেও অন্তর্ভক্ত করে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর এ মানচিত্রগুলো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও পরে তা বিভিন্ন পত্রিকা, ম্যাগাজিন, পোস্টাকার্ড এবং স্কুলের মানচিত্রে দেখা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে এ মানচিত্রগুলো নাত্‍সীবাদীদের পক্ষে জনমত গঠন ও রাজনৈতিক গতিশীলতা আনয়নে সহায়তা করে।

সীমানা অধিগ্রহণ ও তার দাবির ক্ষেত্রেও মানচিত্রের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। সাম্রাজ্যবাদী মানচিত্রগুলোতে এ ধরণের বিকৃতি সাধন করা হয়। উপনিবেশিক শাসন চলাকালিন সময়ে সাম্রাজ্যগুলো তাদের মানচিত্রে নিজ নিজ নিয়ন্ত্রিত উপনিবেশগুলকেও অন্তর্ভুক্ত করে। ক্ষমতাও কর্তৃত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত এ মানচিত্রগুলোর দ্বারা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো তাদের ক্ষমতার প্রদর্শনে সচেষ্ট হয়। উপনিবেশিক আমলে এ ধরণের বিকৃতির অন্যতম উদাহরণ হল রাশিয়ার মানচিত্রে সাইবেরিয়া, বেলজিয়ামের মানচিত্রে কঙ্গো এবং হল্যান্ডের মানচিত্রের ইস্ট ইন্ডিজের অন্তর্ভুক্তি। মানচিত্রকে রাজনৈতিক অস্র হিসেবে ব্যবহারের সর্বোত্তকৃষ্ট উদাহরণ হল উত্তর আমেরিকাতে ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের মধ্যে ভূমি দখল কেন্দ্রিক প্রতিযোগীতা যা সতের ও আঠারো শতকে বজায় ছিল।

১৬৫৬ সালে ফ্রান্সের রাজা লুই-১৩ এর ভূগোল শিক্ষক নিকোলাস স্যানসন উত্তর আমেরিকার একটি মানচিত্র তৈরি করেন যার নাম ছিল “Canada or the New France”। এ মানচিত্রে ছিল নানা অতিরঞ্জন যা সকলের নজরে এসেছিল। এ মানচিত্রের অভ্যন্তরীণ অংশ কেটে ছোট করা হয়েছিল যার ফলে লেক এরি’কে (Lake Erie) ফ্লোরিডার উত্তর অংশের অনেক কাছাকাছি মনে হচ্ছিল। এ অতিরঞ্জণের ফলে ইংল্যান্ড কর্তৃক অধিকৃত সীমানাকে ছোট এবং ফ্রান্সের সীমানাকে বড় আকারে মানচিত্রে প্রকাশ করা হয়েছিল। সেন্ট লরেন্স নদী থেকে ফ্লোরিডা পর্যন্ত সীমানা ফ্রান্স
কর্তৃক দখলকৃত হিসেবে আবর্তীত হয় যা ছিল অসত্য। এর ফলে ফ্রান্স ঐসব ভূমি দাবি করছিল যা তাদের সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল না।

ভূ-রাজনৈতিক নানা প্রয়োজনে মানচিত্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে ইউরোপ ভিত্তিক মানচিত্রগুলো পশ্চিমা বিশ্বে অনেক বেশী সমাদ্রিত হয়েছিল। এর মূল কারণ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রকৃত আয়তনকে বাড়িয়ে প্রকাশ করা। এর ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন আরো বেশী ভয়ঙ্কর রূপে উপস্থাপিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব এ মানচিত্রগুলো ব্যবহার করার পাশাপাশি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের “বড়ত্ব” প্রতিষ্ঠা ও সোভিয়েত
ইউনিয়কে নিজেদের ঘনিষ্ঠ শত্রু হিসেবে প্রদর্শন করার লক্ষ্যে একটি নতুন মানচিত্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এসকল প্রয়োজনে যে নতুন মানচিত্রটি প্রণয়ন করা হয় তা ছিল উত্তর মেরু কেন্দ্রীক। এতে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর অর্ন্তভুক্ত রাষ্ট্রগুলোকে ঘিরে সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রদর্শন করা হয়। উত্তর মেরুভিত্তিক এ মানচিত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নকে পশ্চিমের কলহপূর্ণ অঞ্চল ও নিরাপত্তার হুমকির সন্নিকটে অবস্থান করতে দেখা যায়। জন শর্ট এর
মতে,”এ নতুন মানচিত্র প্রণয়ন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ও অফিস ওফ স্রাটেজিক সার্ভিসেস (পরবর্তীতে সিআইএ) প্রধান ভূমিকা পালন করে।”

ষোল শতক থেকে পৃথিবীকে দেখার ক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রভাবিত করতে মার্কেটরের মানচিত্রের প্রভাব অপরিসীম। ফ্লেমিশ কার্টোগ্রাফার গেরারডাস মার্কেটর ১৫১২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার সবচেয়ে বড় আবিষ্কার ছিল ১৫৬৯ সালে তার তৈরি মানচিত্র। কার্লটন হেস বলেন,”মার্কেটর ইউরপীয়দেরকে গ্রীক ও রোমান কার্টোগ্রাফারদের একচ্ছত্র প্রভাব থেকে মুক্ত করেন।” মার্কেটরের মানচিত্র প্রথম খ্যাতি লাভ করে এর বিষুবরেখা ও
সমান্তরালের জন্য যা সঠিক কোণে মিলিত হত। এর ব্যবহারকারীদের জন্য অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ নির্ধারণ করার মাধ্যমে পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত নির্ণয় করা সম্ভব হয়। তাছাড়া নাবিকদের আবিষ্কারের ক্ষেত্রেও এ মানচিত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মার্কেটরের মানচিত্রের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ইউরোপকে এর কেন্দ্রে অবস্থান দেয়া।

আবিষ্কারকদের জন্য অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ সঠিকভাবে উপস্থাপন করার জন্য এ মানচিত্রে নানা বিকৃতি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ মানচিত্রে মার্কেটর ৩৮ লক্ষ বর্গমাইল আয়তনের ইউরোপকে প্রায় ৭০ লক্ষ বর্গমাইল আয়তনের দক্ষিণ আমেরিকার চেয়ে বড় আকারে প্রদর্শন করে। এ মানচিত্রে আলাস্কার চেয়ে মেক্সিকোকে ছোট আকারে প্রদর্শন করা হয় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উল্টোটাই ছিল সত্য। জন শর্টের মতে,”মার্কেটরের মানচিত্র ঊনবিংশ ও বিংশ শতকে ব্রিটিশদের প্রিয় ছিল কেননা এর মাধ্যমে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যের আয়তন অতিরঞ্জিত করে প্রকাশ করা হয়।” মার্কেটরের মানচিত্রের মাধ্যমে রাশিয়া ও গ্রীনল্যান্ডের আয়তন স্বাভাবিকের চেয়ে বড় আকারে প্রকাশ করা হলেও আফ্রিকার আয়তন কমানো হয়।​মার্কেটরের এ মানচিত্র ইতিহাসে দুটি প্রভাব বিস্তার করে। প্রথমত, এ মানচিত্রের মাধ্যমে পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের ধারণা একটি নির্দিষ্ট আকার ধারণ করার পাশাপাশি ইউরোপকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় এটি ভূমিকাপালন করে। এ মানচিত্রের মাধ্যমে ইউরোপকে এর প্রভাব আকৃতির চেয়ে অনেক বড় করে পৃথিবীর কাছে পেশ করা হয়।​ দ্বিতীয়ত, এ মানচিত্রের মাধ্যমে ইউরোপীয়রা বিশ্ব আবিষ্কারের ক্ষেত্রে বিভাজন তৈরি করে।

পৃথিবীকে সর্বপ্রথম প্রাচীন গ্রীকরা বিভিন্ন মহাদেশে ভাগ করে। গ্রীকরাই সর্বপ্রথম পৃথিবীকে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশে বিভক্ত করে। পৌরাণিক দেবী ইউরোপা’র নামানুসারে ইউরোপীয়ানরা এ মহাদেশেকে “ইউরোপ” নামকরণ করে। এ মানচিত্রের মাধ্যমে ইউরোপকে পৃথিবীর রাণী হিসেবে কল্পনা করা হয়। মার্কেটরের এ মানচিত্র দ্বারা ইউরোপীয়নদের মাঝে একটি স্বাতন্ত্র ও বড়ত্বের মানসিকতা ফুটিয়ে তোলে।

প্রতিটি মানচিত্রই আমাদের সামনে কিছু তুলে ধরে। আর এগুলো আমাদের গ্রহণ করতে হয়। এর কারণ সমগ্র পৃথিবীকে কিংবা এর কোন অংশকে একত্রে প্রত্যক্ষ করার একমাত্র মাধ্যম হল মানচিত্র। মানচিত্র পক্ষপাতিত্ব দ্বারা আমাদের বন্দী করে যা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হল সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি। যে কোন ঐতিহাসিক দলিলের মত মানচিত্রও ক্ষমতাধর মানুষদের দ্বারা তৈরি এবং সত্যকে প্রভাবিত করাই এর মূল লক্ষ্য। কিন্তু তার মানে এই নয় সকল মানচিত্র পরিবর্তন করা উচিত। এর অর্থ হল মানচিত্রের মাধ্যমে আমরা যা দেখি তাকে পৃথিবীর একটি প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখা উচিত, প্রকৃত পৃথিবী নয়। প্রতিটি মানচিত্রই কোন প্রকার প্রাকৃতিক বা সার্বজনীন সত্যের ধারক নয়। মানচিত্রগুলো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ব্যাখ্যা বা নির্দিষ্ট আলোচ্য সূচির ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত কাহিনী। এতে যেমন আছে স্পষ্টতা তেমনি আছে নিরবতা, জ্ঞান ও গোপনীয়তা, সত্য ও মিথ্যা।

তথ্যসূত্রঃ John R. Short, “The World through Maps: A History of Cartography”
Brian Moynahan, “The Russian Century: A History of the Last Hundred Years Paperback”
Klaus Dodds,”Geopolitics: A Very Short Introduction”

ফাহিম আহমেদ
শিক্ষার্থী, ৪র্থ বর্ষ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়