২০০৪-৫ এ যখন মুক্তমনাতে লেখা শুরু করি, তখন মাঝে সাঝে একটা কি দুটো বড় সন্ত্রাসবাদি হামলা ঘটত। এই জুন মাস লক্ষ্য করুন। ফ্লোরিডা, তুরস্ক এবং বাংলাদেশ। পৃথিবীর সব প্রান্তেই মেগা আইসিস হামলা। এরা আবার স্বঘোষিত আইসিসি জঙ্গী। খুব সম্ভবত নেটওয়ার্ক নেই। হিরোইন মরফিনে আচ্ছন্ন হয়ে যেমন ড্রাগএডিক্টরা মানুষ খুন করতে পারে, এরা ধর্ম এডিক্ট। ধর্মের আফিঙে আচ্ছন্ন হয়ে, বেহস্তের অনন্ত বেশ্যাসুখ উপভোগ করতে, এরা আজ ফিদাইন জঙ্গী। নশ্বর জীবনের মায়ার বাধনের উর্ধে। এরাই আজ আধুনিক বিশ্বের জীবন্ত মানব বোমা। রেস্টুরেন্ট, মল, স্কুল কলেজ, সিনেমা হল সর্বত্র ফাটতে পারে।

তবে এর জন্য শুধু ইসলাম ধর্মকে দোষ দেওয়াটাও বালখিল্যতা, আবার ইসলামের দোষ না দেখাটাও মূর্খামো। মূল ব্যপার হচ্ছে শুধু অতিধার্মিকে সন্ত্রাসী তৈরী হয় না। তার জন্য টাকা, অস্ত্র, রাজনৈতিক সাপোর্ট লাগে। বাংলাদেশে গুলশানের রেস্টুরেন্টে আইসিস হামলাতে কোত্থেকে এল টাকা আর অস্ত্র? বেয়াইনি অস্ত্র না হয় বাংলাদেশে প্রচুর-কিন্ত এই হামলাকারিদের ট্রেনিং ইত্যাদি দিতে যা টাকা লাগবে, তার সাপ্লাই দিল কে?

অভিজিত হত্যাকান্ড বাংলাদেশে অধুনা জঙ্গী উত্থানের টার্নিং পয়েন্ট। দুটো ব্যপার লক্ষ্য করুন। প্রথমত, অভিজিত যেহেতু আমেরিকান সিটিজেন, ওকে মেরে বাংলাদেশের জঙ্গীরা একটু আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করে। দ্বিতীয় হচ্ছে বাংলাদেশ সরকার এই হত্যাকান্ডের কোন নিন্দা করে নি। অধিকাংশ বাংলাদেশীরাও করে নি। ভাবটা ছিল ইসলামের শত্রু মরেছে বেশ হয়েছে। অভিজিতের মৃত্যু সংক্রান্ত নিউজগুলোতে ফেসবুকে বাংলাদেশীরা কি লেখালেখি করেছে, দেখলেই সেটা টের পাবেন।

উলটে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ব্লগারদের ইসলাম বিরোধিতা বন্ধ করতে হবে। এই বাংলাদেশ সরকার সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমানদের ধর্মানুভুতিকে এত ভয় পায়, একবার ও পরিস্কার করে বলতে পারে নি ব্লগারদের বিরুদ্ধে যারা নিরন্তর হুমকি দিচ্ছে ফেসবুকে, তাদের আইনের আওতাই আনতে হবে। অভিজিত, অনন্ত, বাবু, নিলাদ্রী-আস্তে আস্তে সব দেউটিই নিভেছে। তাদেরকে বলে বলে হুমকি দিয়ে প্রকাশ্যে খুন করা হয়েছে। ইসলামের শত্রু নিধন হচ্ছে, এতেব এদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিলে, জনপ্রিয়তা হাস পাবে-সুতরাং প্রতিটা ব্লগার হত্যার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম বুলি ছিল-ব্লগাররা ইসলামের বিরুদ্ধে লেখে কেন? শেখ হাসিনা ত পরিস্কার করেই বলেই দিয়েছিলেন, ইসলামের বিরুদ্ধে লেখালেখি চালু রাখলে তাদের প্রানের দায় বাংলাদেশ সরকার নিতে পারবে না।

অর্থাৎ খুব পরিস্কার ভাবেই বহুদিন ধরেই জঙ্গীদের উস্কানি দিয়ে চলেছে বাংলাদেশ সরকার। হালে পুলিশের ফ্যামিলির গায়ে হাত দেওয়াতে, জঙ্গী দমনের নামে বিরোধি গ্রেফতার অভিযান চালিয়েছে।

কিন্ত ঘুরে ফিরে যে প্রশ্ন ফিরে আসে এই ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মের ভূমিকা কি? যেহেতু এই জঙ্গীদের একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক, ধর্মীয় অবস্থান আছে এবং সেটা ওয়াহাবি ইসলাম-ইসলাম ধর্মের ভূমিকা আসবেই। এবং বাংলাদেশ সরকার যে এই জঙ্গিদের বিটিম-যথা জামাতি, ওলামা লীগ এবং হেফাজতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ, তার মূলেও ইসলামের ভাতৃত্ববোধের রাজনীতি।

কিন্ত এখানেই একটু গভীর ভাবে ভাবা দরকার। আর্থ সামাজিক বিশ্লেষন ফালতুই হবে। কারন আমেরিকাতে যেসব ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ ঘটেছে, তার পেছনে শ্রেনী তত্ত্ব, বঞ্চনা এসব চলে না। খুব পরিস্কার ভাবে যেটা ঘটছে-এইসব জঙ্গীদের বাবা-মা ধর্মভীরু মুসলিম। সুতরাং ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাগুলোর মধ্যে ভয় ঢোকানো হচ্ছে-আল্লার গজবের ভয়। বাচ্চাদের বা মানুষের সে সুস্থ স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, বুদ্ধিবৃত্তি আছে-সেগুলোর ওপরে চাপানো হচ্ছে ধর্মকে। পরিস্কার কথায় সব জঙ্গীদের মধ্যে একটাই কমন থ্রেড। ধর্মভীরু মুসলমান পরিবারে জন্মে, ছোটবেলা থেকেই এদের ব্রেইন অসুস্থ-ড্যামেজড। বোস্টন ম্যারাথন বম্বিং এর জারনাভ ভাইরা বা অর্লান্ডোর ওমর মতীন-অথবা অভিজিত অনন্তের খুনীরা-এদের সাধারন বৈশিষ্ট পরিস্কার। জিহাদি ভাইদের পরিবার উগ্রমুসলমান। এবং খুব ছোটবেলা থেকেই ধর্মশিক্ষার নামে এদের ব্রেইন ড্যামেজ করা হয়েছে।

ব্যাপারটা সিম্পল। আপনাকে প্রথমে আফিঙের নেশা ধরানো হল ছোটবেলা থেকে। এবার সেই নেশা কেটে সুস্থ জীবনে ফেরা মুশকিল। বরং অনেক উগ্র সংগঠন আরো কড়াপাকের আফিং খাইয়ে তাদের ইন্তেকালের, এই মর্ত্যভূমের অস্তিত্বই বিলোপ করাচ্ছে। আমি আপনি-এদের কাছে ইহকালের লোক। সুতরাং কেউনা। আফিঙের নেশাতে ওরা আলরেডি পরকালের বাসিন্দা। ফলে আমাদের মানবিক, মর্ত্যধামের লজিকে ওদের কিছু যায় আসে না। যেমন নেশাগ্রস্থ মানুষ যখন নেশার জন্য চুরি ডাকাতি করে, তারা বোঝেও না এটা চুরি। এই বোধ টাই লোপ পায় তাদের। ইসলামিক জঙ্গীদেরও একই অবস্থা।

মুশকিলটা কিন্ত ইসলামি জঙ্গীদের নিয়ে না। আসল নাটের গুরু এদের যারা ব্যবহার করছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। আমেরিকাতে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে যারা চুরি চামারি করে, তাদের ৮০% ই করে নেশার ঘোরে নেশার টাকা জোগার করতে। জঙ্গীদের ব্যপারটা আলাদা কিছু না-এরাও ইসলাম আফিঙের নেশার ঘোরে ইসলামের হেফাজত করছে বলে নিজেরা মনে করে।

কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে ড্রাগপেডলারদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিতে পারে অথচ যেসব উগ্র ইমাম এইসব জঙ্গীবাদ ছড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ কেন, ভারত , আমেরিকাও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বেগতিক অবস্থা বুঝে ফ্রান্স, বেলজিয়াম আর হল্যান্ড নতুন আইন আনছে ইমামদের বিরুদ্ধে। কিন্ত শুধু ইমামদেরই বা দোষ দেব কেন? ধর্মভীরু বাড়ীতেই ত ছেলেটির মাথা বিগড়ে দেওয়া হচ্ছে। এর পরে ইমাম বাবাজি যা করছেন, তা হচ্ছে আগুনে ঘৃতদান।

ধর্মের সাথে বিশেষত ইসলামকে ড্রাগের সাথে তুলনা করা কি যুক্তিসঙ্গত? আমি অবশ্য কমিউনিজমকেও ড্রাগ বলেই মনে করি। সব ধর্মই এক ধরনের ড্রাগের নেশা। তবে কেউ হেরোইন, কেউ মরফিন, কেউবা আফিঙ। কেখন কোন মুসলমান বলতেই পারেন ইসলাম দ্বীনের ধর্ম-এই ধর্মে জাকাত, রমজান সহ অনেক ধারনাই গরীব মানুষের প্রতি মমতাময়ী সহানুভূতি নিতে তৈরী। তাতে কেউ মজলে ক্ষতি কি? কমিনিউস্টরাও তাই। তাদের ড্রাইভিং ফোর্সত সেই গরীব অত্যাচারিত শ্রেনীর প্রতি সহানুভুতি। তাহলের গরীবের প্রতি ভালোবাসা কি আফিং এর নেশা?

এখানেই একটা ক্লিয়ারকাট ডিসটিংশন টানা দরকার। গরীবের প্রতি ভালোবাসা নিশ্চয় নেশা নয়। নেশাটা হচ্ছে এই পৃথিবীর বাস্তবতা বহুধ। ধনী দরিদ্রের বৈষম্য যেমন এর একটা দিক-অন্যদিকটা হচ্ছে পৃথিবীর এই যে জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতি-তার ভিত্তি মার্কেট । যার অনেক কিছুই ধর্মীর উচ্চ আদর্শের বিরোধি। সুতরাং কেউ যদি শুধু ধর্মের আদর্শবাদে মজে থাকে, কিন্ত তাকে বাস করতে হয় একবিংশ শতাব্দির পৃথিবীতে-যা চালাচ্ছে বাজার-সেই ছেলেটি বিরাট দ্বিধার এবং ভ্রান্তি নিয়ে বড় হবে। যা হয়েহে জারনাভ ভাতৃদ্বয় এবং ওমর মতীনের ক্ষেত্রে। এসব ক্ষেত্রে ছেলেটি সন্ত্রাসবাদি হওয়াটাই স্বাভাবিক-এবং তার কাছে আইসিসের বানী লাগবে অমৃতবানী যা অধার্মিক পৃথিবীকে ছেঁটে ফেলার প্রতিশ্রুতি দেয়। সেই জন্য ওমর মতীন নিজেই ছিল সমকামী-সমকামী ক্লাবেই যেত-আবার সেই কারনে নিজেকে ঘৃণাও করত। ফলে নশ্বর জীবনের মায়া ত্যাগ করতে তার সময় লাগে নি। কারন সে নিজেকেই ভালবাসতে শেখে নি-ঘৃণা করতে শিখেছে। ফলে এমন ছেলেদের জঙ্গী না হওয়াটাই অস্বাভাবিক।

এ এক আজব পৃথিবী। যেখানে পরম সত্য বলে কিছু নেই। নিজেকে বেশী ভালবাসলে তৈরি হয় স্বার্থপর দানব। আর নিজেকে ঘৃণা করতে শিখলে আমরা পাব ইসলামিক সন্ত্রাসী। দরকার মানবিক এবং ক্রিটিক্যাল দৃষ্টিভংগী। ধর্ম মানবিকতা শেখায় কিন্ত ক্রিটিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গী ধ্বংস করে।

ক্রিটিক্যাল বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী ছাড়া মানবিকতায় মজে থাকাটাই ড্রাগ এডিকশন-যেখানে যীশুর প্রেম শেখাতে কোটি কোটি লোক হত্যা করতে হয়। দ্বীনের ধর্মের, শান্তির ধর্মের মহান শিক্ষা দিতে, জিহাদিরা খুন করাটাকেই পন্থা বলে মনে করে!