দর্শন বা ফিলোসফি নিয়ে এই লেখাটা লেখবার একটা উদ্দেশ্য আছে | সেটা হলো লোককে জানানো যে দর্শন আসলে কি আর তার উপযোগিতা কি ? আধুনিক কালে যেভাবে দর্শন পড়ানো হয় তাতে লোকের কানাকড়িও লাভ হয় না | দর্শন কিন্তু ফালতু বিষয় নয় | মানুষের অশেষ উপকারে সেটা আসে | তাই দর্শন কি সেটা যথাযথ বলাটা উচিত বলেই মনে করি |

প্রথমে আমরা প্রাচীন যুগের দার্শনিকদের মতামত শুনব |

ক] গ্রিক দার্শনিক

১] সক্রেটিস

ইনি বলেছিলেন : “The unexamined life is not worth living.” অর্থাৎ অপরীক্ষিত জীবন যাপন করার কোনো মূল্য নেই | তিনি জগতের সমস্ত কিছুকে পরীক্ষা করেছিলেন | সমস্ত কিছুকে অনুসন্ধান করেছিলেন | তার কাছে দর্শন হলো জীবনকে পরীক্ষা করা | এই পরীক্ষা কিভাবে করেন তিনি ? প্রশ্ন আর উত্তরের দ্বারা | অর্থাৎ প্রশ্ন করা আর উত্তর খোঁজার মধ্য দিয়েই জীবনকে পরীক্ষা করা হলো দর্শন সক্রেটিসের মতে |

২] প্লাতো

ইনি সক্রেটিসের শিষ্য | ইনি তাঁর বই রিপাবলিক-এ দর্শন তথা দার্শনিকের বিবরণ দিয়েছেন | ওই বইয়ের ষষ্ঠ ও সপ্তম খন্ডে দার্শনিক তথা দর্শনের বিবরণ আছে | ওনার মতে দার্শনিক সর্বদা বিষয়ের চিরস্থায়ী প্রকৃত স্বরূপ জানবেন, পরিবর্তনশীল ওপর চাকচিক্য দেখে ভুলবেন না | তিনি সর্বদা সত্যপ্রিয় হবেন | কখনই মিথ্যার আশ্রয় নেবেন না | দার্শনিক সর্বদা জ্ঞান ভালবাসবেন | তিনি জাগতিক বস্তুকে ভালবাসবেন না | [ এই কারণেই গ্রিক দার্শনিকদের আমরা অতি সাধারণ বেশে দেখতে পাই | ] দার্শনিক জীবন ও মৃত্যুকে ভয় পাবেন না | তিনি শিখতে ভালবাসবেন |অসাধারণ স্মৃতিশক্তি রাখবেন, জগতের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাবেন না ইত্যাদি |

৩] অ্যারিস্টট্ল

এনার মতে দর্শন হলো জ্ঞানসাধনা | দার্শনিক প্রথমে একটা দুর্বোধ্য হেয়ালির সম্মুখীন হবে | তারপর সেই হেয়ালির সমাধান করার চেষ্টা করবে দর্শন শাস্ত্রের মাধ্যমে | ওনার মেটাফিজিক্স বইতে এইরকমই সংজ্ঞা দেয়া আছে দর্শন তথা দার্শনিকের | দার্শনিক শুধু জ্ঞানের জন্য জ্ঞান চাইবে , অর্থের জন্য নয় | আর এই দার্শনিক খোঁজ কিভাবে হবে ? প্রথমে খোঁজার পথে যেসব বস্তু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সেগুলিকে জানতে হবে | তাহলেই হেয়ালির সমাধান হয়ে যাবে | উনি মেটাফিজিক্সের বেটা বইতে এইরকম দার্শনিক হেয়ালির উদাহরণ ও সমাধান দুইই দেখিয়েছেন |

উনি দর্শনের কতগুলো সুত্র ওনার গামা বইতে দিয়েছেন | ল অফ আইডেন্টিটি , ল অফ নন কনট্রাডিক্সন আর ল অফ এক্সক্লুডেড মিডল | প্রথমটি বলে একই বস্তুর ব্যাপারে অনেক ভাবে অনেক কথা বলা যায় | যেমন স্বাস্থ্য | কিভাবে সুস্থ থাকবেন, কেন সুস্থ থাকবেন ইত্যাদি ওই একই স্বাস্থ্যের ব্যাপারে বলা হয়েছে | দ্বিতীয়টি বলছে স্ববিরোধ থাকবে না | তৃতীয়টি বলছে হ্যা আর না-এর মাঝামাঝি কিছু থাকবে না | এইটি ফাজি লজিকের বিরুদ্ধে যায় |

খ] রোমান দার্শনিকগণ

এপিক্টেটাস ও স্টয়িক দার্শনিকরা

এনার মতে দার্শনিকদের কাজ হলো যা কিছু অনুভব করা যায় সেই সব কিছুকে পরীক্ষা করা | এই পরীক্ষার উপযুক্ত মানদন্ড নির্মান করা | এনার মতে বিরোধ বা contradiction হলো ভুল তথা মিথ্যা | সত্য হলো অবিরোধ | আরিস্ততলের দর্শনের সাথে মিল পাওয়া যায় |

দার্শনিকরা দেখবে কোনটি আমার আয়ত্তে আছে আর কোনটি নেই | এই কথার গভীর তাত্পর্য আছে | একমাত্র এইভাবেই মানুষ বাঁচতে পারে | বলাবাহুল্য যে এইসব করতে গেলে প্রশ্ন-উত্তরের খেলা ছাড়া আর কোনো ভাবে সম্ভব নয় |

গ] ভারতীয় দার্শনিকগণ

ন্যায় দর্শন

ন্যায় দর্শনে ১৬ টা পদার্থের বিচারের মাধ্যমে শ্রেয়ঃ লাভের কথা আছে | এই পদার্থগুলি হলো : প্রমান, প্রমেয়, সংশয়, প্রয়োজন, দৃষ্টান্ত, সিদ্ধান্ত, অবয়ব, তর্ক, নির্ণয়, বাদ, জল্প, বিতণ্ডা, হেত্বাভাস, ছল, জাতি, নিগ্রহস্থান | এইগুলি সবই বিচারে সাহায্য করে | কি বিচারে ? না জাগতিক পদার্থের বিচারে |

ঘ] চীনা দার্শনিকগণ

এঁদের মধ্যে কনফুসিয়াস-এর নাম উল্লেখযোগ্য | ইনি বলেছিলেন সমস্ত বিষয়ে প্রশ্ন করা উচিত |

তাহলে উপরের আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে দর্শন একটা এমন জিনিস যা মানুষকে বিচার করতে শেখায় | তা সে ভারতীয় ন্যায় দর্শনই হোক বা গ্রিক দর্শন হোক | দর্শনের বিষয় অনন্ত | পদ্ধতি একটাই | পৃথিবী জুড়ে এইরকম দর্শনই প্রাচীন যুগে প্রচলিত ছিল | দর্শন মানুষকে জগতের পদার্থগুলিকে পরীক্ষা করে হিতাহিত নির্ণয় করতে শেখায় | আর এইখানেই বিপদ |

যদি একটা লোক আজ রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজ-এর ব্যাপারে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করে আসল সত্যি জানতে চায় তাহলে শাসক শ্রেণী শোষণ করবে কি করে ? সমাজই বা অত্যাচার করবে কি করে ? অতএব দর্শনকে বাঁচতে দেয়া চলবে না | তাকে এখনি মারতে হবে | মধ্যযুগে পৃথিবী জুড়ে তাই দর্শনের মারণযজ্ঞ চলতে লাগলো |

মধ্যযুগ : দর্শনের মৃত্যুঘন্টা বেজে উঠলো

ক] ইউরোপ

খ্রীষ্টধর্ম নামে এক ধর্মের আবির্ভাব ঘটল | এই ধর্মের অধীনে দর্শনকে আনা হলো | শেষ স্বাধীন দার্শনিক ছিলেন হাইপেশিয়া | ইনি আলেকজান্দ্রিয়ার বাসিন্দা ছিলেন | এনাকে খ্রিস্টান বীরপুঙ্গবেরা নৃসংশ ভাবে হত্যা করে | মধ্যযুগে দর্শনকে ধর্মের পুল্টিশ চোখে লাগিয়ে বিচার করতে হত | প্রাচীন যুগের মত খোলামেলা বিচার ছিল না | আর কোনো ধারনাকে মাথায় গুঁজে সত্যকে খুঁজতে গেলে কখনই পাওয়া যায় না | মধ্যযুগীয় দর্শনও পেল না | দর্শনের প্রতিটা অনুসন্ধানকে বাইবেলের সাথে খাপ খাওয়াতে হত | অন্যথায় জুটত নির্মম অত্যাচার | এরই বলি হয়েছিল গ্যালিলিও, ব্রুনো, পারাসেলসাস ইত্যাদি বিজ্ঞানীরা | কোপার্নিকাস ভয়ের চোটে তার বই ছাপতে পারেন নি | দেকার্তে তার বই সব পুড়িয়ে দেবার কথা চিন্তা করেছিলেন | দার্শনিকরা হয়ে গেল চিড়িয়াখানার আজব জন্তু | মূর্খদের রমরমা হতে লাগলো |

খ] মধ্যপ্রাচ্য

ইসলামের আবির্ভাব হলো | তার হাতে দর্শন নিগৃহিত হতে লাগলো | ইসলাম সর্বপ্রকার দর্শন চর্চা নিষিদ্ধ করে | তবু আব্বাসীয় খলিফাদের আমলে কিছুটা বিজ্ঞান চর্চা হয় | পরবর্তীরা সবই বন্ধ করে | এই সময়েই আরব দার্শনিকদের এক অংশ মুতাজিলি নাম নিয়ে দর্শনের চোখ দিয়ে ঈশ্বরকে খুঁজতে থাকে | আবার সেই ধর্মের পুল্টিশ চোখে লাগিয়ে দার্শনিক বিচার | ইউরোপের সাথে কি অদ্ভুত মিল, না ?

গ] ভারত

বৌদ্ধ ধর্মের আগমনের ফলে ন্যায় দর্শনের চর্চা ব্যাহত হয় | ধীরে ধীরে ন্যায় দর্শন শুধু তর্ক আর কচকচির মধ্যে আটকে পড়ে | কার্যক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না | মুসলিম আমলে ভারতে সম্পূর্ণভাবে দর্শন চর্চা বিনষ্ট হয় | মুঘল আমলে হিন্দু দার্শনিকদের অত্যন্ত দুর্দশার মুখে পড়তে হয় |
লোকাচারের অধীনে দর্শন চলে যায় | এখানেও দার্শনিকরা চিড়িয়াখানার আজব জন্তুতে পরিনত হয় |

ঘ] চীন

বর্বর ইউআন বংশের শাসন কালে চিনের সুকুমার বৃত্তি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয় | এরপর কিছু রাজা আসেন যারা শুধু আইনের শাসনকেই বড় করে দেখেন | এঁদের আমলে কনফুসিয়াসের যুক্তিবাদী দর্শন একেবারে নষ্ট হয় |

তখনও কিছুটা দর্শন অবশিষ্ট ছিল | মানুষ ভালো মন্দ বিচার করতে পারত | কিন্তু আধুনিক যুগের সূচনার পর থেকে দর্শনের সেই অবশিষ্ট ক্ষমতাটুকুও চিরতরে বিনষ্ট হলো | এই আধুনিক যুগে দর্শন শুধুমাত্র কতগুলো মতামত পথের মধ্যেই সীমাবদ্ধ | আমি আজ ৫ বছর ধরে দর্শন পড়ে আসছি | আমি প্রতিটা বইতে দেখি শুধু ভাববাদ আর বস্তুবাদের দ্বন্দ লেখা আছে | স্কুলপাঠ্য বইতে কোন দার্শনিক কি বলেছিল এইটাই শুধু পড়ানো হয় | দর্শনের ছাত্রদের বস্তুবিচার শিখানো হয় না | কোনো বস্তুর সত্য মিথ্যা কিভাবে বুঝবে তা শিখানো হয় না | শুধু কোন দার্শনিক কি বলেছিল | এর ফলে এখন দর্শনের ছাত্ররা তুলনাপুর্বক বিচার করতে শিখছে না | তারা শুধু মুখস্ত করছে আর বমি করছে | এটাই দর্শনের কফিনে শেষ পেরেক |

সক্রেটিসের মত কোনো দার্শনিক আজ আর প্রশ্ন করে না | প্রশ্ন করাটা তো আজ বারণ | যে করে , সে মরে | মুক্তমনারা প্রশ্ন করতে গিয়ে মরেছে | দেশে দেশে , এই আধুনিক যুগে | শুদ্ধু মেনে নাও | মুখ বুজে, ভারবাহী গাধার মত মেনে নাও | মুখ খুলেছ কি মরেছ | হাতে এবং ভাতে | এই তো এখনকার দস্তুর |

আজ কয়টা দর্শনের ক্লাসে প্রশ্ন করা শেখায় | অথচ প্রশ্ন হলো দর্শনের প্রাণ | প্রশ্ন না উঠলে দার্শনিক বিচার কখনই সম্ভব নয় | কিন্তু কয়টা স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে প্রশ্ন করা শেখানো হয় ? একটাও না | টিচারকে প্রশ্ন করার মানে হলো বিদ্রোহ করা | যাই হোক |

দর্শনের এই মরাঘটা অবস্থা থেকে দর্শনকে উদ্ধার আমাদের দর্শনপ্রেমিদেরকেই করতে হবে | কাজ খুবই কঠিন | তবুও করতে হবে আমাদের স্বার্থে | আজ বিচার না করলে আমাদের বাঁচার উপায় নেই | অজ্ঞানতার অন্ধকার বাঁচার চেয়ে জ্ঞানের আলোয় মরাও ভালো |