সরকারী অথর্ব মন্ত্রী-আমলারা স্বীকার করুক বা না করুক-ধর্ম নিরপেক্ষতার চেতনা নিয়ে নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ, ক্রমে জঙ্গীবাদীদের-তথা ইসলামী জঙ্গীবাদের লীলাক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে । জঙ্গীবাদীদের প্রথম শিকার মুক্তমনা, বিজ্ঞানমনস্ক লেখক, অত:পর ক্রমান্বয়ে সংস্কৃতিবান শিক্ষক, ভিন্নমতাবলম্বী ব্যক্তি, ভিন্ন ধর্মীয় পুরোহিত, সর্বেশেষে স্বধর্মীয় ভিন্ন মতাবলম্বী মোল্লা মৌলবি ।

প্রথম প্রথম যখন জঙ্গীবাদীরা কেবল মুক্তমনা ব্লগার, লেখক-প্রকাশকদের হত্যা করা শুরু করে, তখন সরকারকেও তেমন উদ্বিগ্ন হতে দেখা যায় নি । অধিকন্তু সরকার ও সরকারী মন্ত্রীরা মুক্তমনা লেখক ও ব্লগারদের তাদের লেখা সম্পর্কে সচেতন হওয়ার নসিহত করতে থাকেন । তাই অসম্ভব সম্ভাবনাময় বিজ্ঞান লেখক ড. অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডে সরকারী কর্তাব্যক্তিদের এতটুকু উদ্বেগ ও সহানুভূতি দেখাতেও দেখা যায় নি । এ সুযোগে জঙ্গীবাদীরা একে একে অনেক ব্লগার ও লেখক-প্রকাশককে হত্যা করে পার পেয়ে যায় । কিন্তু জঙ্গীবাদীরা যখন ক্রমান্বয়ে তাদের থাবা আরো বিস্তৃত করতে থাকে, তখন সরকারী মহল একটু নড়াচড়া শুরু করে। কিন্তু ইতোমধ্যে প্রায় শতাধিক ব্যক্তি জঙ্গী হামলার শিকার হলেও একটি হত্যাকাণ্ডের বিচারও সরকার করতে পারে নি। যার নিষ্করুণ পরিণতিতে জীবন দিল পুলিশ সুপারের নিরিহ স্ত্রী।

সর্বসম্প্রতি জঙ্গী দমনের অজুহাতে সরকার যে পুলিশী অভিযান শুরু করেছে-তাতে হাজার হাজার লোক ইতোমধ্যে কারবন্ধী হয়ে চরম নিগ্রহের শিকার হচ্ছে । সে হাজার হাজার গ্রেপ্তারকৃত ব্যাক্তিদের মধ্যে পুলিশী ভাষ্য মোতাবেক সন্দেহভাজন জঙ্গীর সংখ্যা হাতেগুণা-কয়েক শ’ মাত্র । দু:খজনক ব্যাপার হল-পুলিশী অভিযানের মধ্যে জঙ্গীরা তাদের কিলিং মিশন চালু রাখে । বলাবাহুল্য, জঙ্গীদের রণকৌশলের কাছে আমাদের পুলিশ বাহিনী অসহায়। তাই সেদিন আমাদের পুলিশ বাহিনী জঙ্গীদমনের নতুন ও অভিনব কৌশল হিসাবে সাধারণ মানুষের হাতে বাঁশের লাঠি ও বাঁশি ধরিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হল-লাঠি-বাঁশি-বন্দুক-রাইফেল-র‌্যাব-পুলিশ দিয় কি জঙ্গীবাদের উত্থান ঠেকানো যাবে?

মৌলবাদ থেকেই জঙ্গীবাদের উদ্ভব
এ কথা আমাদের মানতেই হবে, ধর্ম থেকেই ধর্মীয় মৌলবাদের জন্ম। বিশ্বে ধর্মের সংখ্যা সহস্রাধিক । কোন ধর্মই তার শ্রেষ্ঠত্বের দাবী পরিহার করে নি। প্রত্যেক ধর্মানুসারীদের দাবী হল-তাদের ধর্মই একমাত্র সহিহ ধর্ম এবং শ্রেষ্ঠ ধর্ম । এ বোধের একটি বাস্তব কারণও আছে বৈকি । কারণ অন্য ধর্মের সঠিকত্ব স্বীকার করে নিলে নিজের ধর্মের প্রয়োজনীয়তা নি:শেষ হয়ে যায়।

প্রত্যেক ধর্মই শান্তির কথা বলে, ন্যায্য কথা বলে,উদানৈতিক ধার্মিকেরা ইত্যাদি দাবী করলেও মজার ব্যাপার হল-যে সকল ধর্ম ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, আর যে সকল ধর্ম ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না-তারা সকলেই প্রা্য় পরস্পর বিরোধী । ইসলাম ধর্মেতো ইহুদী-নাসেরাদের সাথে বন্ধুত্ব করতেও কঠোর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে । সে কারণে একজন সত্যিকার ধার্মিকের পক্ষে অন্য ধর্মকে শ্রদ্ধা করা প্রায় অসম্ভর ব্যাপার । ধর্ম সাম্প্রদায়িকতার জন্মও কিন্ত এখানেই।

তাহলে মৌবাদের উৎস কোথায়?
প্রায় প্রত্যেক ধর্মের একটি মৌলিক আদি গ্রন্থ আছে । ইসলাম ধর্মের এ মৌলিক গ্রন্থ আলকুরআন এবং প্রত্যেক মুসলিম বিশ্বাস করে, কুরআন হল আল্লাহের প্রেরিত গ্রন্থ-যা আল্লাহ তার প্রেরিত পুরুষ হযরত মোহাম্মদ(স:) এর মাধ্যমে মানবজাতির জন্য প্রেরণ করেছেন । ঈশ্বর বিশ্বাসী সকল ধর্মের অনুসারীদের একই বিশ্বাস-তাদের ধর্মগ্রন্থ ঈশ্বর প্রেরিত। যেহেতেু ঐ ধর্মগ্রন্থ ঈশ্বর প্রেরিত, সেহেতু এ গ্রন্থ অভ্রান্ত এবং কোন অবস্থাতেই সে সকল গ্রন্থের কোন পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংশোধন, সংযোজন করা মনুষ্য কর্তৃক সম্ভব নয়। ধর্ম মানলে ঐ সকল ঐশী গ্রন্থে যাই লেখা আছে-তাই মানতে হবে। যুক্তির বিবেচনায় দাবীটা সঠিক বৈকি । অর্থাৎ যখনি আবির্ভুত হউক না কেন, জন্মকালীন ধর্মীয় বিশ্বাস, রীতিনীতির বিন্দু-বিসর্গও পরিবর্তনের কোন অবকাশ নেই। পরিবর্তন করা হলে তা আর ঐশী বাণী থাকে না । এ ধারণা বা বিশ্বাসই মৌলবাদের উৎস-ভূমি।

কিন্তু সমস্যা হল বিশ্বে বর্তমানে বিদ্যমান ধর্মগুলোর আবির্ভাব ঘটেছে আজ থেকে হাজার হাজার বৎসর পূর্বে । এ হাজার হাজার বৎসরে মানুষের সমাজ ও সভ্যতার পিলে চমকানো বিকাশ ঘটেছে। যার ফলে আজ থেকে হাজার হাজার বছর পূর্বে মানুষের চিন্তা-চেতনা ও জীবনাচরণের অভাবিত পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু ধর্মীয় গ্রন্থ এবং সে সকল গ্রন্থ নির্দেশিত জীবনাচরণ ও বিশ্বাস রয়ে গেছে অপরিবর্তিত । মধ্যযুগীয় ধর্মীয় দর্শনের সাথে আধুনিক দর্শনের বিরোধ এখানেই। এ ক্ষেত্রে সমঝোতার কোন অবকাশ নেই। যে কোন একটি অবস্থান আমাদের মেনে নিতে হবে। এক্ষেত্রে ধর্মীয় আদি বিশ্বাস ও আচরণকে যারা দুর্লঙ্ঘনীয় মনে করেন, তারা কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে আদৌ কুণ্ঠিত হন না । বিজ্ঞানের প্রযুক্তিগুলোকে অবাধে গ্রহণ করলেও কেবল বিজ্ঞানের দর্শনকে মেনে নিতে তাদের যত আপত্তি । কারণ তাতে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এখানেই হল ধর্মীয় মৌলবাদীদে স্ববিরোধীতা ।

মৌলবাদ থেকে কিভাবে জঙ্গীবাদের জন্ম
প্রত্যেক ধর্মের মৌলবাদীদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো-তারা তাদের ধর্মের মৌলিক বিধি-বিধানকে সমাজ ও রাষ্ট্রে অবিকল ভাবে প্রয়োগ করতে চায়। তারা রাষ্ট্রের ও সমাজের সকল দিগনির্দেশনার জন্য ধর্মের আদিম ধারণা বা বিধি-বিধানকে অনুসরণ করে। মুসলিম মৌলবাদীরা সমাজ ও রাষ্ট্রের তাবৎ সমস্যা সমাধানের জন্য তাদের পবিত্র ধর্ম-গ্রন্থ কুরআন ও সুন্নাহের উপর নির্ভর করতে চায় । কুরআন যেহেতু ঐশী গ্রন্থ এবং হযরত মুহাম্মদ(দঃ)আল্লাহের প্রেরিত পুরুষ, সেহেতু কুরআন ও সুন্নাহের (নবীর জীবনাচরণ) বাহিরে কোন দিগনির্দেশনা মুসলমানেরা মানতে নারাজ ।

ইহুদী মৌলবাদীরা তোরাহ্ এর আক্ষরিক ব্যাখ্যার বাইরে বিন্দু-বিসর্গ যেতে প্রস্তুত নয়। খৃষ্টান মৌলবাদীরা প্রায় সকল প্রশ্নে বাইবেলের শিক্ষা অভ্রান্ত বলে দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করে। সাধারণভাবে সকল ধর্মের মৌলবাদীরা, প্রাণীজগত ও পৃথিবী সৃষ্টি-রহস্য নিয়ে তাদের স্ব স্ব ধর্মের ব্যাখ্যাকে অভ্রান্ত মনে করে-যদিও এসব ব্যাপারে ধর্মগ্রন্থগুলোর ব্যাখ্যা পরস্পর বিরোধী।
মৌলবাদীদের এ ধারণা যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণ করা হয়, তখন রাষ্ট্র পরিচালনায় সাধারণ জনগণের মতামত গ্রহণ-এমনকি বৈজ্ঞানিক-যুক্তিনির্ভর কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণেরও কোন সুযোগ থাকে না। সবকিছু যেহেতু ধর্মের আদি নির্দেশ অনুসারে করতে হবে, সেহেতু এখানে কেবলমাত্র ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রাহ্য করা যেতে পারে। তাই ধর্মভিত্তিক বৃহৎ রাজনৈতিক দল “জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ” এর জন্মদাতা মওলানা মওদুদী পশ্চিমা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছেন। ইরানী বিপ্লবের নেতা আয়তুল্লাহ খোমেনি ইসলামী ব্যবস্থাকে পশ্চিমা গণতন্ত্রের বিপরীত প্রত্যয় (Anti-thesis) বলে উল্লেখ করেছেন ।

গণতন্ত্রের বদলে স্বেচ্ছাচার, মত প্রকাশের স্বাধীনতার বদলে বাক স্বাধীনতার কঠোর নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে নাগরিক অংশ গ্রহণের বদলে সে সুযোগের সংকোচন-এ সবই মৌলবাদী প্রশাসনের অন্তর্গত। প্রতিটি ক্ষেত্রেই যেহেতু শুধুমাত্র ধর্ম-নির্দেশিত অনুশাসন প্রবর্তন করতে হবে, সেহেতু এসব নিয়ে বিতর্ক বা ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগও সেখানে থাকে না । আইন বা নৈতিক প্রশ্নে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার/যোগ্যতা শুধুমাত্র ধর্মশাস্ত্রে পণ্ডিত ব্যক্তিরাই রাখেন, ফলে অন্য কারো মত গ্রহণের প্রশ্নই ওঠে না। খোমেনি তার “কাসাফ আসরার” গ্রন্থে ধর্মশাস্ত্রের গুঢ়ার্থ উদ্ধারের চেষ্টার বিরুদ্ধে সাবধান করে বলেছেন-একমাত্র তারাই এর অর্থ বুঝতে পারবে, যারা আরবী ভাষায় বিজ্ঞ, বার ঈমামের শিক্ষার সাথে সুপরিচিত ও ধর্ম শাস্ত্র অধ্যয়নে সুদীর্ঘ সময় ব্যয় করেছেন।

তাহলে ধর্মের যতই উদারনৈতিক ব্যাখ্যা দেওয়া হউক না কেন, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র কখনো (আধুনিক) গণতান্ত্রিক হতে পারে না । তাই যারা ধর্ম-ভিত্তিক রাষ্ট্রের কথা বলেন, আবার জোটবদ্ধ নির্বাচন করে পশ্চিমা গণতন্ত্রের সিঁড়ি বেয়ে ক্ষমতার অংশীদার হয়েছেন এবং হতে চান, তাদের চরিত্রের স্ববিরোধীতা অত্যন্ত প্রকট । পৃথিবীতে অনেক রাষ্ট্র আছে, যাদের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ হল মুসলমান । সে অর্থে তারা মুসলিম রাষ্ট্র। তাদের মধ্য থেকে কোন রাষ্ট্রকে ইসলামী রাষ্ট্রের মডেল হিসাবে ধরতে গেলে সৌদি আরবকেই সর্বাগ্রে বিবেচনায় নিতে হয়। মাটির নীচে অগাধ (তবে অফুরন্ত নয়) তেল সম্পদের কারণে সে দেশ আজ একটি ধনী দেশ হলেও তার আর্থ-সামাজিক কাঠামোটি কেমন? যুগ যুগ ধরে সে দেশে শরিয়া আইনের নামে চলছে বাদশা শেখ আব্দুল আজিজ এর একটি গোষ্ঠীতান্ত্রিক পারিবারিক শাসন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাঠামোর সর্বত্রই একটি পরিবারের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ। রাষ্ট্র পরিচালনায় দেশের জনগণের বিন্দুমাত্র অংশগ্রহণ নেই। সে দেশের অগাধ তেল সম্পদ লুঠেপুটে খাচ্ছে তারা। আর তাদের তখ্ত-তাউসকে নিরাপদ রাখার জন্য তারা পদলেহন করছে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের-বিনিময়ে যারা লুঠে নিচ্ছে তাদের তেল সম্পদ।

চুরি করলে প্রকাশ্যে হাত কেটে ফেলা, বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্কের জন্য কোমর-সমান মাটিতে পুঁতে প্রকাশ্যে পাথর ছুঁড়ে মারা সহ একটি মধ্যযুগীয় বিচার ব্যবস্থা সে দেশে প্রচলিত-যেখানে আধুনিক বিচার পদ্ধতি অনুপস্থিত। মানুষের বাক-স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, ইত্যাকার মৌলিক মানবাধিকারের বালাই নেই। পরিহাসের বিষয় হলো, আরবী শেখরা পেট্রোডলারের বদৌলতে আধুনিক প্রযুক্তির সকল সুফল নিংড়ে নিয়ে অত্যন্ত বিলাসবহুল জীবন যাপন করলেও সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে আকঁড়ে রেখেছে মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারনা ও মূল্যবোধকে-কেবল আপামর জনগণকে শোষণ ও অবদমনের জন্য।

আজ সর্বাপেক্ষা নিগৃহীত সে দেশের নারী সমাজ-যারা বস্তুতঃ এখনো অবরোধবাসিনী-মোঠা অঙ্কের যৌতুক না পেলে যাদের পাত্রস্থ পর্যন্ত করা হয় না । তবুও প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত অঢেল তেল সম্পদ তাদের জনগণকে দারিদ্র্য থেকে রক্ষা করেছে। অপরাপর আরব দেশগুলোর অবস্থা ও তদ্রুপ।

বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে আফগানিস্তানের তালেবান রাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা আরো লোমহর্ষক-ভয়াবহ-বীভৎস।
কিন্তু মৌলবাদীরা যখন দেখে দেশে প্রচলিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতারোহণ করে তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করতে পারবে না, তখন তারা মনে করে জোর প্রয়োগ করে বা তথাকথিক জিহাদের মাধ্যমে তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করকত হবে এবং তা করার ব্যর্থ প্রয়াসে বিকল্প হিসাবে তারা জঙ্গীবাদের আশ্রয় গ্রহণ করে। কিংবা তারা মনে করে মুসলমানদের সমাজে যারা মুক্তমনা, আধুনিক চিন্তার মানুষ, ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে-তাদের ধরে ধরে খুন করলে সমাজে ইসলামী শাসন প্রয়োগ সহজ হবে।

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের সূচনা
মৌলবাদ বাংলাদেশে জঙ্গিরূপ ধারণ করেছে-বিগত ১৭ই আগস্ট, ২০০৫ ইং সালে একই সাথে ৬৩টি জেলায় বোমাবাজি-ধারণাটিকে তর্কাতীত করে তুলেছিল। পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মঘাতী বোমা হামলার মাধ্যমে দু’জন বিচারকসহ বেশ কয়েকজন আইনজীবি ও নিরীহ মানুষ মারা গেছেন । ইতিপূর্বে মৌলবাদী রাজনৈতিক দলের সাথে গাঁটছড়া-বাঁধা ৪ দলীয় জোট সরকার দৃঢ়তার সাথে দেশে মৌলবাদী শক্তির অস্থিত্বই অস্বীকার করেছেন । জঙ্গি তৎপরতার সংবাদ পরিবেশনের জন্য উল্টা সংবাদ মাধ্যমকে দায়ী করেছেন-দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার অপপ্রয়াসের অভিযোগ তুলে। কয়েকজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার ও বিদেশী সাংবাদিককে বহিস্কার করেছেন। “বাঙলা ভাই-’ইংরেজী ভাই” নামে কেউ নেই বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বারংবার তার ‘বাংলিশ’ ভাষায় গলাবাজি করেছেন।

পরিতাপের বিষয়-জঙ্গীবাদীদের অস্থিত্ব স্বীকারের প্রশ্নে বর্তমান সরকারের অবস্থানও একই রকম। এদের কাছেও সবচেয়ে মূল্যবান তাদের ভাবমূর্তি । তাই একের পর এক চাপাতীর কোপে মুক্তমনা, প্রগিতশীল, বিজ্ঞানমনষ্ক এমনকি ভিন্ন মতাবলম্বী ধর্মীয় মোল্লা-পুরোহিত খুন হলেও তারা স্বীকার করতে নারাজ, দেশে জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটছে। কিন্তু আজ মৌলবাদ যখন জঙ্গীরূপে আবির্ভূত হয়ে জাতীয় নিরাপত্তাকেই হুমকীর মুখোমুখী করেছে, তখন কর্তাব্যক্তিরা বোল পাল্টিয়ে বলতে শুরু করেছেন-এটা একটা গ্লোবাল সমস্যা।

মৌলবাদের উত্থানকে অস্বীকার করে-প্রকারান্তরে তাকে প্রশ্রয় দিয়ে-যে অন্যায় বিগত ৪ দলীয় জোট সরকার করেছেন, তার চেয়ে গুরুতর অন্যায় তারা করেছেন অপরাধীদের না ধরে-বিরোধী দলের দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করে-শূণ্যে তরবারি ঘুরিয়ে-জনগণের জীবনকে নিরাপত্তাহীন করে দিয়ে । একই ঘটনার পুণরাবৃত্তি করছেন বর্তমান সরকারও ।
ফলশ্রুতিতে আজকের বীভৎস বাস্তবতা হল-আমাদের রক্তমূল্যে কেনা প্রিয় স্বদেশভূমি আজ উগ্র-পশ্চাদপদ-মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারনায় বিশ্বাসী কতিপয় গোঁড়া ইসলাম-ধর্মীয় মৌলবাদীদের হাতে আক্রান্ত । বলা বাহুল্য, তাদের প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে পৃষ্ঠপোষকতা করছে একাত্তুরের সে পরাজিত জামাত-শিবির চক্র।

সর্বাপেক্ষা বিস্ময়কর বেদনাক্নিষ্ট প্রশ্ন হল-ইতিহাসের নজিরবিহীন আত্মত্যাগের মাধ্যমে একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের জঠর ছিঁড়ে নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া একটি রাষ্ট্রে মৌলবাদের এ বিপজ্জনক উত্থান কিভাবে সম্ভব হল? বাঙালি জাতির সমকালীন ইতিহাসের এটাই বোধ হয় সর্বাপেক্ষা নির্মম পরিহাস-দুর্বোধ্য স্ববিরোধীতা (A historical paradox)। এ স্ববিরোধীতার ব্যাখ্যার মধ্যেই নিহিত আছে একে রোখার সঠিক পথ ও পন্থার সন্ধান।

বাঙলাদেশে মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটঃ
ধর্মীয় জাতীয়তার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্রের জাতিগত শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এর ফলশ্রুতি আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ। সঙ্গত কারণেই ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র আমাদের ৪ রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসাবে সংবিধানে গৃহীত হয়। একটি স্বল্প-শিক্ষিত, দারিদ্রক্লিষ্ট জনগোষ্ঠির এ অর্জন-রাষ্ট্র পরিচালনায় উপরোক্ত আদর্শগুলোকে নীতিমালা হিসাবে গ্রহণ-ছিল বাস্তবিকই অভাবনীয়-যা পশ্চিমা বিশ্ব জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেক অগ্রগতির পর অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে একটি স্বল্প-শিক্ষিত ও পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠীর এ অর্জনের তাৎপর্য আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না । তাই আমরা অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করি, স্বাধীনতার অব্যবহিত পর বঙ্গবন্ধু সরকার মাদ্রাসা শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া শুরু করেন। অথচ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে-রাজাকার-আলবদর বাহিনী সৃষ্টির মাধ্যমে-তাদের নব্বই শতাংশের উপরে ছিল মাদ্রসার ছাত্র ও শিক্ষক। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষকদের একাধিক সভা-সমাবেশে দুঃখের সাথে কথাটি উল্লেখ করলেও তার সরকার ইসলামী ফাউণ্ডেশন সৃষ্টি করলেন । ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সে ইসলামী ফাউন্ডেশন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মৌলবাদীদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল । তারপরও ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষতা অন্যতম রাষ্ট্রীয় নীতিমালা হিসাবে বহাল ছিল-ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ ছিল এবং ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ অবারিত ছিল না।

কিন্তু ১৯৭৫ সালের আগষ্ট মাসে এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতাচ্যূত করে যারা ক্ষমতাসীন হল, তারা সর্বাগ্রে তাদের এ অপকর্মের বৈধতা দিতে জনগণের সামনে আবির্ভূত হল ধর্মের আলখাল্লা পড়ে । এতবড় একটা জঘন্য হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে মাথায় কালটুপি ও মুখে আল্লাহ-রসুলের নাম নিয়ে মঞ্চে আবির্ভূত হল খুনী মোস্তাক-প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতিভূ হিসাবে । ক্ষমতাসীন হয়েই মোশতাক তার পরিহিত কাল টুপিকে জাতীয় টুপি ঘোষণা করেছিল । এ প্রতিবিপ্লবের সুবিধাভোগী হিসাবে ক্ষমতাসীন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান দেশের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র মুছে দিলেন। নৃতাত্ত্বিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্থলে নিয়ে আসলেন বাঙলাদেশী জাতীয়তাবাদ । অর্থনৈতিক নীতিমালার ক্ষেত্রে অধনবাদী বিকাশের পথ-যা সমকালীন উন্নয়নশীল দেশগুলেতে সঠিক উন্নয়ন কৌশল হিসাবে খুবই জনপ্রিয় ছিল-পরিহার করে ধনবাদী বিকাশের পথ গ্রহণ করলেন। বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমার পরও সুনির্দিষ্ট অভিযোগে একাত্তুরের যে সকল যুদ্ধাপরাধী বিচারের অপেক্ষায় ছিল তাদেরও ক্ষমা করে দিলেন । জামাতে ইসলামী সহ ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোকে ধর্মের নামে রাজনীতি করার লাইসেন্স ফিরিয়ে দিলেন। জামাতের আমীর যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমকে দেশে এনে রাজনীতিতে পূনর্বাসিত করলেন। কতিপয় মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশ-বিশেষভাবে সৌদী আরবের আর্থিক সাহায্য নিয়ে জামায়াতে ইসলামী তাদের রাজনৈতিক প্রচারণা তীব্রতর করল-যার মূল লক্ষ্য ছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ভুল প্রমাণ করা এবং বাংলাদেশকে তথাকথিত ইসলামী প্রজাতন্ত্রে রূপান্তর করা।

পচাঁত্তরের পট পরিবর্তনের পর ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজেদের রাজনৈতিক বৈধতা আদায় ও আমজনগণের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবার জন্য ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করা শুরু করল পূর্ণোদ্যমে। মেজর জিয়া তার সকল বক্তব্য শুরু করার আগে প্রকাশ্যে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” বলা শুরু করলেন।
জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ডের পর ক্ষমতাসীন খলনায়ক, তুলনাহীন দুশ্চরিত্র হোসেন মোঃ এরশাদ রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের মাত্রাটা আরো বাড়িয়ে দিলেন একই লক্ষ্যে-তার সব অপকর্মকে বৈধতা দেওয়া। তিনি সংবিধান সংশোধন করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে দেশটাকে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের দিকে এক ধাপ এগিয়ে দিলেন ।

ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহারের সাথে এরশাদ রাজনীতিতে পীরতন্ত্রের প্রবর্তন করে নতুন মাত্রা যোগ করলেন । তিনি প্রকাশ্যে রাষ্ট্রীয় হেলিকপ্টার ব্যবহার করে বিভিন্ন পীরের কাছে যেতে শুরু করলেন এবং এসব গণ্ডমুর্খ ও ভণ্ড পীরের উপদেশ প্রকাশ্যে সাংবাদিক সম্মেলন করে প্রচার করতে ভালবাসতেন । রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারকে এরশাদ এমন এক হাস্যকর পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন যে, যখন তার বিরুদ্ধে গণআন্দোলন তীব্র হয়ে উঠল, তখন তিনি প্রতি শুক্রবারে কোন না কোন মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতে যেতেন। মসজিদে গিয়ে তিনি পূর্বরাত্রে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে সেই মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে এসেছেন বলে ডাহা মিথ্যা অবলিলায় বলে যেতেন । অথচ মানুষ জানত, এরশাদ আসবেন বলে দু’ তিন দিন পূর্ব থেকেই সরকারী লোকেরা ঐ মসজিদ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা ও নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত ছিল।

এরশাদের পতনের পর প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী দল নির্বাচনী কৌশল হিসাবে নগ্নভাবে ধর্ম ও ভারত বিরোধীতাকে কাজে লাগাল। ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহারে তারা এতটুকু গেল যে, আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে ধর্ম চলে যাবে, মসজিদে মসজিদে আজানের পরিবর্তে উলুধ্বনি হবে-দেশ ভারতের অঙ্গ রাজ্যে পরিণত হবে-ইত্যাকার কথা জোরেশোরে বলে বেড়াতে লাগল । বলাবাহুল্য তারা এ অপকৌশলে সফল হয়ে নির্বাচনে জিতেছিল এবং ক্ষমতাসীন হয়ে তারাও রাজনীতিতে-রাষ্ট্রীয় আচারানুষ্ঠানে-ধর্মের ব্যবহার বাড়িয়ে দিল।

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ-ভোটের রাজনীতির বিবেচনায় এবং বিরোধী প্রচারণার জবাবে-তাদের রাজনৈতিক আচার-আচরণেও ধার্মিকতা প্রদর্শণের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হল। জয় বাঙলা শ্লোগানের সাথে তারা ও “লা-ইলাহা ইল্লালাহু-নৌকার মালিক তুই আল্লাহ-প্রভৃতি শ্লোগান উচ্চারণ করতে লাগল।

বিএনপি ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় বিভিন্ন উপনির্বাচনে বিএনপির সীমাহীন কারচুপি একটি দলীয় সরকারের অধীনে যে কোন নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলল। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানকে স্থায়ীরূপ দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ আন্দোলন শুরু করল। সে আন্দোলন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ যুগপৎ কর্মসূচী গ্রহণ করল জামায়াতে ইসলামীর সাথে। আন্দোলনের মুখে প্রথমে বিএনপি একতরফা একটি নির্বাচন-অতঃপর সে নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন পাশ এবং সে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি সরকারের সর্বাত্মক ব্যর্থতার পটভূমিতে আবারো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পটপরিবর্তন হল।

সুদীর্ঘদিন পর এবার ক্ষমতায় এল মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ। কিন্তু বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে তত্ত্ববধায়ক সরকারের আন্দোলন করতে গিয়ে জামায়াতের সাথে অঘোষিত ঐক্য করে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির কী ক্ষতিটা আওয়ামী লীগ করেছে, সে উপলব্ধি আওয়ামী নেতৃত্বের এখনো হয়েছে কিনা জানি না। শুধু তা নয়, আওয়ামী লীগ ও তার রাজনৈতিক আচরণে এমন কিছু পরিবর্তন আনল, যা প্রকারান্তরে ধর্মীয় রাজনীতিকেই উৎসাহিত করল। দীর্ঘদিন পর ক্ষমতাসীন হয়ে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পূনর্বাসনের তেমন কোন কার্যকর উদ্যোগত গ্রহণ করলই না, বরং তাদের দলীয় কর্মসূচী এবং রাষ্ট্রীয় কর্মসুচীতে তারা ধর্মীয় আচার-আচরণ অনুসরণ করতে শুরু করল পূর্ণোদ্যমে। সংসদে প্রত্যেক সাংসদদের মাথায় টুপি পরে বসা এবং যে কোন বক্তব্যের শুরুতেই জোর গলায় “বিসমিল্লাহীর রাহমানির রাহিম” বলা, কোন কিছুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে গিয়ে মোনাজাত করা, যে কোন অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কুরআন থেকে তেলোয়াত করা, নেতা-নেত্রীর ফি বছর হজ্জ করা ইত্যাদির মাধ্যমে ধর্মীয় আচরণের সাথে রাজনৈতিক আচরণকে গুলিয়ে ফেলে অপরাপর ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণের সাথে আওয়ামী লীগের আচরণের পার্থক্য নির্ণয় করা দুরূহ হয়ে পড়েছিল-যা বস্তুতঃ ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকেই বৈধতা প্রদান করছিল।

মজার ব্যাপার হলো, ক্ষমতাসীন হয়ে বিএনপিতো নয়ই, আওয়ামী লীগও এরশাদ প্রণীত রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করার কথা চিন্তাও করল না। কিন্তু এত কিছু করেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেমন থাকতে পারল না, তেমনি যে সকল ধর্মীয় গোষ্ঠীর মন জয় করার জন্য আওয়ামী লীগ এতকিছু করল-তাদের মন থেকেও আওয়ামী লীগ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা মুছে ফেলতে সক্ষম হল না। বরং জাতীয়তাবাদী দল আরো এক ধাপ এগিয়ে জামাতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট নামক দলের সাথে জোট বেঁধে নির্বাচন করে পুণর্বার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসল।

ক্ষমতাসীন হয়ে ৪ দলীয় জোট সরকার ধর্মপালনের দায়িত্ব রাষ্ট্রের কাঁধে তুলে দিল। ক্ষমতান্ধ হয়ে এ সামান্য বোধটুকু আমাদের জাতীয়তাবাদী নেতারা হারিয়ে ফেলল যে, রাষ্ট্র একটি সামাজিক সংগঠন-কোন সংগঠনের কোন ধর্ম থাকে না । ধর্ম, তথা উপসনা-ধর্ম (worship religion) থাকে মানুষের-কোন বস্তু বা সংগঠনের নয়। বস্তু বা সংগঠনের ইহকাল পরকাল নেই। তারা স্বর্গ-নরকে যাবে না। তাই তাদের ধর্মের প্রয়োজনও নেই। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্ম পালনের ফলে প্রকারান্তরে বৈধতা পেল ধর্ম নিয়ে রাজনীতি ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। এভাবে সেক্যুলার রাজনীতির শিকড় কাটা হতে লাগল একে একে।

অত:পর ৪ দলীয় জোট সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি, অপশাসন, যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রীত্বের আসনে বসানো ইত্যাকার কার্য়ক্রমের ফলে জনগণ বিএপি এর নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট এর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট কে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করল । উল্লেখ্য যে, নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ যু্দ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার প্রদান করেছিল।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে, পাকিস্তানী রাজনীতিবিদরা যেভাবে ক্ষমতার স্বার্থে তিলে তিলে ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করে পাকিস্তানকে একটি ধর্মভিত্তিক সামরিক-আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন, র্ঠিক সে পথেই আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা দেশকে নিয়ে যাচ্ছেন এবং তারই ফলশ্রুতিতে আজ জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটছে।

মৌলবাদ-জঙ্গীবাদ রুখতে চাই শিকড়-নাড়া সাংস্কৃতিক লড়াই
মৌলবাদী শক্তিকে কেবল রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করে-ঊনিশ শ’ একাত্তুরে যেমনটি আমরা করেছিলাম-রোখা যাবে না। চুড়ান্তভাবে ঠেকাতে হলে তাকে রুখতে হবে আদর্শিকভাবে। সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে ওঠা মাদ্রাশাগুলোতে শিক্ষার নামে যা ছড়ানো হচ্ছে, তা মূলত: ধর্মাশ্রয়ী কুপমণ্ডুকতা ও অজ্ঞতা। অথচ মৌলবাদের প্রধান আশ্রয় হল অজ্ঞতা। বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ও নারী শিক্ষার বিস্তার সে অজ্ঞানতা রোধে প্রধান ভূমিকা নিতে পারে। বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিক শিক্ষা অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনার প্রসার ঘটাবে ও তার লালন মৌলবাদী অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে বর্ম হিসাবে কাজ করবে। এ লক্ষ্য অর্জনের প্রধান শর্ত হচ্ছে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে বিযুক্ত করা। মৌলবাদীদের সন্তুষ্ট করার জন্য সরকার যদি একের পর এক ধর্ম পালনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়, তাতে মৌলবাদের ভিত্তি কেবল শক্তই হবে। তাই বৈজ্ঞানিক যুক্তি বিস্তারের মাধ্যমে সর্বাগ্রে আমাদের মৌলবাদী মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণার অসারতা, অপ্রাঙ্গিকতা-পশ্চাদপদতা ও গণবিমুখতা তুলে ধরতে হবে আম জনগণের কাছে-বিশেষভাবে বর্তমান প্রজন্মের কাছে। সেজন্য একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া কোন বিকল্প নেই।

মৌলবাদের মূল উৎস যেহেতু ধর্মীয় গোঁড়ামী এবং এ গোঁড়ামীর উর্বরক্ষেত্র যেহেতু অশিক্ষা-কুশিক্ষা, সেহেতু তাকে রুখতে হলে আমাদের সর্বাগ্রে শিক্ষা, বিশেষভাবে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে শিক্ষা ব্যবস্থার মূল স্রোতে সামিল করতে হবে। ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করতে হবে এবং ধর্ম নিয়ে রাজনীতি এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।

একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক কাঠামো, বেকারত্ব দূরীকরণ ও দারিদ্র্য বিমোচন, আইনের শাসন কায়েম,সুশাসন প্রতিষ্ঠা, গ্রাম ও শহরের বৈষম্য দূরীকরণ-বিশেষভাবে গ্রামীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি আশু পদক্ষেপ মৌলবাদ উত্থানের বিরুদ্ধে বর্ম হিসাবে কাজ করবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, স্রোতস্বিনী নদীতে যেমন কোন শেওলা-শৈবাল জন্মাতে পারে না, তেমনি একটি আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক, গণতান্ত্রিক ও উন্নত আর্থ-সামাজিক কাঠামোতে মৌলবাদসহ কোন প্রকার কুসংস্কারের আগাছা শিকড় গাড়তে পারবে না। এভাবে মৌলবাদী দর্শনকে পরাভূত করতে পারলে জঙ্গীবাদ রুখে যাবে।