আমার ছেলের (অন্যান্য আত্মীয়দেরও) ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার বয়স, ঐসময়ের অবয়ব, চোখের চাহনি, চিন্তা চেতনার স্তরের সাথে সারাদিনই পত্রিকায় দেখা মাদারীপুরের ঘটনার জন্য জনতার হাতে ধরাপড়া এক কিশোর ফাহিমের টলটলে চাহনি অবচেতনে ঘা দিচ্ছিল। ফাহিমকে নিয়ে তাই এ লেখাটি।

মাদারীপুরে শিক্ষকের উপর হামলার সময় হাতেনাতে গ্রেপ্তার গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিম রিমান্ডে থাকা অবস্থায় বন্দুক যুদ্ধে নিহত।ফাহিমের মৃত্যু। জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া — এটা বিচাব বহির্ভূত হত্যা—- উচিত বিচার ইত্যাদি ইত্যাদি।
অন্যান্য ঘাতকদের মতো আইনে গেলে বিচার দীর্ঘ হলেও এক সময় কিশোর ফাহিম হয়তো বের হয়ে আসতো। কারণ আক্রমণের শিকার শিক্ষক মরেন নি।
আগের দিন ধরলো আর পরের দিন মারলো।কেন? এ কেন শব্দটি অবশ্য জনগণের বলার অধিকার নেই। বলা যেতে পারে, জনগণ কাজ করবে আর ভাত খাবে— এতো আইনী বিষয় বুঝার চেষ্টার প্রয়োজন কেন? নিশ্চয়ই এর সাথে অনেকেই একমত। আইনী বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাবার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, আইন মন্ত্রণালয়, মাননীয় সংসদ সদস্যগণ, পুলিশ বিভাগ ও অন্যান্য দায়িত্নবশীল ব্যক্তিরা রয়েছেন।

তবে আমার মাথা ঘামাবার কারণ নিরীহ জনগণ যখন ঘতকদের শিকার। একেবারে এক মাসের ঘটনা—পাবনার পূজারী, চিটাগাং এ গৃহিণী ( পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী যদিও) আর সর্বশেষ একজন সাধারণ কলেজ শিক্ষক ঘাতকদের নিশানা। কি পাপে নিরীহ গণ মরছে? কার পাপে?
কলেজ শিক্ষক ঘাতকদের নিশানা হয়েছে মাদারীপুরে আর ঘাতক এক কিশোর গেছে ঢাকা থেকে —- যাকে রিমান্ডে থাকা অবস্থায় মরতে হয়েছে। মরতে হলো কেন? এ শিক্ষককে লক্ষ্য বস্তু বানাতে নিশ্চয়ই মাদারীপুরের স্থানীয় কেউ জড়িত! তা না হলে এ নাম লক্ষ্যে আসতো না। সে নামটি ঢাকতেই কি ফাহিমকে মরতে হলো? জানি না। অথবা ফাহিমের সহযোগীরাই ক্রস ফায়ারে মেরেছে তথ্য ফাঁস হয়ে যাবার ভয়ে।ফাহিমকে না নিয়ে কি আসামী ধরতে যেতে পারত না পুলিশ! তা ও গণ হিসেবে জানি না।
এতো এতো অঘটন ঘটলো, বাবু হত্যার আসামীরা হিজড়াদের হাতে ধরা পড়লো , কিন্তু পুলিশ তেমন তথ্য পেয়েছে বলে প্রকাশ করেনি। না করার কারণ তদন্তের স্বার্থে। কিন্তু কতদিন? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কি বলে তার কোন আগা মাথা জনগণ পায় না। জনগণ সম্ভবত বুঝেই না।

কিশোর ফাহিম কেমন ছিল এ নিয়ে তার শিক্ষক ও প্রতিবেশীরা যে চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছে তা আরও ভয়াবহ। ঘাতক চেনা কঠিন।শান্ত নিরীহ কিশোরটি এমন গ্যারাকলেকিভাবে পড়লো।আমার আপনার পরিবারের কিশোর সদস্যদের ঘাতক হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে। ফাহিমের মা বাবা কি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পেরেছিল তাদের ছেলের গতিবিধি ?

একটা ইণ্টারমিটিয়েট পড়ুয়া ছেলেকে যে বাহিনী — যে গোষ্ঠী — যারা ধর্মের নামে কাজে লাগায় তারা কি মানুষ! আর যে ধর্মের নামে কাজে লাগায় সে ধর্মের প্রকৃত ব্যাখ্যা প্রচার করা কি সে ধর্মের প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় নেতাদের দায়িত্ব নয়? স্কুলে প্রত্যেক ক্লাসে ধর্ম বিষয়টি পড়া বাধ্যতামূলক।দশ বছর শিক্ষকরা ধর্ম বিষয়ে কি পড়ান? দশ বছরের ধর্মীয় শিক্ষা কয়েকদিন আলোচনা করেই জঙ্গিরা মগজ ধোলাই করতে পারেন! ধর্ম ক্লাসে শুধুই কি বেহেশতের হুরপরী, বিশেষ খাবার আর আরাম আয়েশের বর্ণনা?
এক গবেষণায় দেখা গেছে প্রতিদিন ছয়জন কিশোর কিশোরী আত্মহত্যা করে বিভিন্ন সামাজিক কারণে। গবেষণার সময় এসেছে তথাকথিত ধর্মের নামে কতজন বিপথে যায় – তা জানা।
আই এস, আনসারুল্লাহ, হিযবুত তাহরীর এরা যে অমানুষ তা বলার অপেক্ষা রাখে না, কিন্তু তাদেরকে যারা আশ্রয় প্রশ্র্য় দিচ্ছে তারা? অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে বিষয়টি কি এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য নয়?
ছোটবেলা একটা গল্প শুনেছিলাম। গল্পটি হলো –এক ছেলে চুরি করে ধরা পড়েছে। পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটি বললো – আমাকে একটুঁ আমার মায়ের কাছে কাছে নিয়ে যান। পুলিশ তাকে মায়ের কাছে নিয়ে গেলে ছেলেটি মাকে বললো মা তোমার জিহ্বাটি দেখি। মা জিহ্বা মেলতেই ছেলেটি মায়ের জিহ্বা কাটতে গেল। পুলিশ তো রেগে আগুন। এ কি করতে যাচ্ছে। ছেলেটি উত্তর দিল, আমার মা একদিন বললো, ডাল রান্না বসিয়েছি, কিন্তু কাঁচা মরিচ নেই। আমি এক ফাঁকে পাশের বাড়ির গাছ থেকে কয়েকতি কাঁচা মরিচ এনে মাকে দিলাম । মা খুশী হলো । এরপর থেকে আমি সুযোগ পেলেই এটা ওটা এনে মাকে দিই। মা খুশী হয়। আর আমারও চুরির সাহস বেড়ে যায়। এভাবেই ধর্মীয় শিক্ষা সাহস বাড়াচ্ছে আর দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ খুশী হচ্ছে। কাঁচা মরিচ থেকে সাগর চুরিতে যাচ্ছে। শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার নালিশ থেকে চাপাতি হাতে উঠছে।
যে দেশে রাষ্ট্র শিক্ষককে প্রকাশ্যে ধর্মানুভূতির দোহাই দিয়ে শাস্তি দিবে সে দেশে ফাহিমের মতো কিশোর চাপাতি নিয়ে ঢাকা থেকে মাদারীপুর যাবে এতে অবাক হওয়ার আর কি আছে !
কাজেই ধর্মীয় শিক্ষা নিয়েও আমাদের ভাবনার সময় এসেছে।ধর্ম ক্লাসে জিহাদ নয়— নৈতিকতা শেখান। সৎ কাহিনী শোনান, সৎ কাজের পরামর্শ দিন, সৎ চিন্তা চেতনার বিকাশ ঘটাতে সহযোগিতা করুন। প্রয়োজনে পাঠ্যপুস্তক পর্যালোচনা করুন। দোজখের ভয়ে নয়, ইহকালের জীবনকে — চারপাশকে — সমাজকে সুন্দর করতে এগিয়ে আসুন।