(১)
মমতা ব্যানার্জির হাতে গোহারা হেরে, বামেরা স্বভাবতই এখন গভীর মনোকষ্টে, কেউ কেউ কোমায়। মধু কবির ভাষায় —

“কি পাপ দেখিয়া মোর, রে দারুন বিধি,
হরিলি এ ধন তুই? হায়রে কেমনে
সহি এ যাতনা আমি ? কে আর রাখিবে
এবিপুল কুলমান, একাল সমরে ! ”

বামেদের মূল যন্ত্রনা, অপূর্ন অভিলাশের শুরু এই “বাম” শব্দটির ন্যারেটিভ থেকে। এটা অনেকটা মদ্যপানের মতন- কিছু কিছু মানুষ নিজেকে বাম, হিন্দু, মুসলমান, বাঙালী এলিট এইসব পরিচিতির মাদকে “হাই” ফিল করে ! এই ধরনের আইডেন্টিটি-তাদের নিজেদের কাছে গর্বের বিষয়। কারন এরা মনে করে তারা এক মহান চিন্তাধারা, মহান আদর্শের ধারক এবং বাহক। যদিও এই মনে করার পেছেন আছে অজস্র মিথ বা রূপকথার গল্প-যা ঐতিহাসিক সত্য না। তাতে সমস্যা নেই। সমস্যার শুরু যখন তারা বিশ্বপৃথিবী এবং তার চলমান ঘটনাগুলিকে কেবল মাত্র-তাদের দৃষ্টিকোন দিয়েই দেখবে। অন্য ন্যারেটিভ, কাউন্টার ন্যারেটিভ এবং ফ্যাক্টস-রামধেনু রঙে পৃথিবীটাকে দেখতে ব্যর্থ হওয়াটাই আদর্শবাদিদের পতনের মূল কারন।

এই নির্বাচনে শুধু সিপিএম না । সুসি, সিপিয়াইএম এল সহ সব বামপন্থীরাই শুয়ে গেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে পশ্চিম বঙ্গে বামপন্থার ভবিষ্যত কি? গোটা বিশ্বেই বা বামপন্থার কি ভবিষ্যত?

সিপিএমের কোন ভবিষ্যত নেই-এটা নিয়ে কোন সন্দেহই নেই। সিপিএমকে আদৌ বামপন্থী পার্টি বলা যায় না বলেই আমার বিশ্বাস এবং বিচার।

কিন্ত তার মানে কি সামগ্রিক ভাবে পশ্চিম বঙ্গে বা ভারতে বা বিশ্বে বামপন্থার ভবিষ্যত নেই?

(২)

তার আগে “বামপন্থা” ন্যারেটিভটি আসলে কি ধরনের কাঁঠালের আমসত্ত্ব, তা নির্ধারন করা দরকার। আমি আমেরিকা এবং পশ্চিম বঙ্গ-দুদিক দিয়েই উদাহরণ টানছি।

এবার আমেরিকান নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং বার্নি স্যান্ডার্সের উত্থান বিরাট বড় ঘটনা। বার্নির পজিশন, সিপিএমের থেকেও অনেক বামে। প্রায় সিপিয়াই এম এলের কাছাকাছি। আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল প্রাইমারীতে ডেমোক্রাটিক পার্টির নমিনেশন না পেলেও ( বা পাওয়ার চান্স প্রায় নেই), নিরেপেক্ষ ভোটারদের মধ্যে বার্নি, তার প্রতিদ্বন্দী হিলারীর থেকেও বেশী জনপ্রিয়। কিন্ত ডেমোক্রাটিক পার্টি সাপোর্টারদের কাছে, তার গ্রহণযোগ্যতা খুব কম-ফলে তিনি হারছেন।

এই তথাকথিত বামপন্থি বার্নির জনপ্রিয়তা সাধারন নিরেপেক্ষ ভোটারদের কাছে-তা কি এই “ডান” “বাম” ন্যারেটিভে ব্যখ্যা করা সম্ভব??

একদমই না।

কারন দুটোঃ

ক) নিরেপেক্ষ ভোটারদের পলিটিক্যাল এফিলিয়েশন নেই। এরা ডান বাম নিয়ে ভাবেন না। যেমন বার্নির সমর্থকদের ৪০% প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে ট্রাম্পকে ভোট দেবে বলছে ( যেহেতু বার্নি নমিনেশন পাচ্ছেন না ) -ট্রাম্প সাংঘাতিক ভাবে নরেন্দ্রমোদির থেকেও অনেক বেশী দক্ষিনপন্থী। তাহলে বার্নির বেস ডান না বাম?

খ) আরেকটা ঘটনা বলি। মেরীল্যান্ড এবং ভার্জিনিয়া পাশাপাশি দুটো রাজ্য। এর মধ্যে মেরীল্যান্ডে লেফট-সেন্টার পার্টি ডেমোক্রাটদের বেস প্রায় ৭০% ( ওবামা এখান থেকে ৭৮% লিড নিয়েছিলেন)। কিন্ত গত বছর মেরিল্যান্ডের লোকেরা কিন্ত দক্ষিনপন্থী রিপাবলিকান গর্ভনর হোগানকে জিতিয়েছে। যদিও মেরীল্যান্ডের দুটী আইন সভা এখনো ডেমোক্রাটদেরই দখলে। ভার্জিনিয়াতে হয়েছে উলটো। ওখানে আইন সভা রিপাবলিকানদের। কিন্ত গর্ভনর নির্বাচনে জিতেছে ডেমোক্রাটরা।

বাম-ডান ন্যারেটিভ দিয়ে বার্নির উত্থান ব্যখ্যা করা যায় না। ব্যাখ্যা করা যায় না মমতার উত্থান ও। মমতা সিপিএমের থেকেও অনেক বেশী প্রমানিত বামপন্থী-যদি বামপন্থী ন্যারেটিভটার কোন ভ্যালু থাকে।

সোজা কথা পৃথিবী যেদিকে এগোচ্ছে-তাতে এইসব ন্যারেটিভের কোন মূল্য থাকছে না। মোদ্দা কথা জনগনের দুর্দশা বাড়ছে নানান কারনে-যারা এইসব দুর্দশার কিছুটা লাঘব করার প্রতিশ্রুতি দেবেন বা সেগুলো নিয়ে কাজ করবেন-জনগণ তাকেই ভোট দেবে।

(৩)

আমি আমেরিকা, ভারত বা পশ্চিম বঙ্গের রাজনীতিতে খুব বেশী পার্থক্য দেখছি না। সব জায়গাতেই মূল সমস্যাগুলো একধরনের –

ক) লোকজনের আয়ের বিভেদ- মাত্র ১% লোকের হাতে ৯০% সম্পদের মালিকানা চলে যাচ্ছে। গরীব, মধ্যবিত্ত আরো গরীব হচ্ছে। ধনী এবং উচ্চবিত্ত-তাদের সম্পদ আরো বাড়াচ্ছে।

খ) অটোমেশনের জন্য যন্ত্র বনাম মানুষের প্রশ্ন বারে বারে আসছে। অটোমেশনের দৌলতে অসংখ্য লোক কাজ হারাচ্ছে-তাদের পুনঃবাসন হচ্ছে না ঠিক ঠাক। ১% লোকেরা হাতে অধিক সম্পদ জমা হওয়ার কারন ও এই অটোমেশন।

গ) পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে। কোলকাতায় লোকজন অসম্ভব রকমের অসুস্থ। কারন বাতাস আর জলে এত দূষন । জল সম্পদ সম্পূর্ন ভাবে ধ্বংস হচ্ছে। ফলে লোকজনের জীবিকা, বেঁচে থাকাটাই আজ প্রশ্নের সম্মুখীন

ঘ) চিকিৎসা ব্যবস্থা সাংঘাতি ব্যয়বহুল। চিকিৎসা করতে গিয়ে পরিবারের পর পরিবার দেউলিয়া হচ্ছে-কি আমেরিকা-কি ভারতে । আজকের দিনে ডাকাত এবং ডাক্তার শব্দদুটীর মধ্যে লক্ষনরেখা প্রায় বিলুপ্ত।

ঙ) শিক্ষাও সাংঘাতিক ব্যায়বহুল। আমেরিকাতে শিক্ষা ঋন মেটাতে একজনের লাগে প্রায় কুড়ি বছর । ফলে তাদের বিয়ে সন্তানগ্রহণ সব পিছিয়ে যাচ্ছে-অধিকাংশ ছেলেমেরা চল্লিশের আগে সন্তান নিতে পারছে না। এটা রাষ্ট্রের জন্য ও ভাল না।

মুশকিল হচ্ছে বামেরা যে ভুল করেন-বার্নিও সেই ফাঁদে পা দিয়েছেন। অর্থাৎ সব কিছুর জন্য-ক্যাপিটালিম এবং মার্কেট দায়ী!! ক্যাপিটালিজম ধ্বংস করার রাজনৈতিক বিপ্লবের স্লোগান প্রথমে কিছুদিন চললেও আস্তে আস্তে বার্নির আপিলের অসারতা প্রায় প্রমানিত।

এই সমস্যাগুলোর জন্য ক্যাপিটালিজম দায়ী-সেটা নিয়ে বিতর্ক নেই।

মূল বিতর্ক এখানেই — এর সমাধান তাহলে কি?

ক্যাপিটালিজমের ধ্বংস না উন্নততর মানবিক ক্যাপিটালিজম?

বামেরা প্রায় সবাই মনে করেন ক্যাপিটালিজমের ধ্বংসই একমাত্র পথ। সেখানেই সব থেকে বড় ভুল। এই গ্লোবালাইজড অর্থনীতিতে “সমাজতান্ত্রিক দ্বীপ” তৈরী করে কেউ বাঁচতে পারবে না। এস ই জেড যদি আমি পশ্চিম বংগের জন্য আটকে দিলাম-অথচ হরিয়ানা, উত্তরাখন্ড, মহারাষ্ট্র রেখে দিল-তাহলে এস ই জেড বিরোধি বঙ্গবিপ্লবের ফল কি হইবে? সব কারখানা,চাকরি হরিয়ানা, উত্তরাখন্ডে চলে যাবে। গেছেও। গ্রীসের বামপার্টি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ানের বিরুদ্ধে এত হুমকি দিয়ে কি করল? পর্বতের মূষিক প্রসব। কারন গ্রীসের ক্ষমতা নেই একা একা একটা সমাজতান্ত্রিক দ্বীপ হয়ে বাঁচার।

মুশকিল হচ্ছে বামেদের এইভুলগুলো করা উচিত না। মার্ক্স এগুলো অনেক দিন আগেই লিখে গেছেন। স্যোশালিজিম ইন ওয়ান কান্ট্রি-সম্ভব না। সমাজতন্ত্র আসার প্রাথমিক শর্ত আন্তর্জাতিকতা-এবং দেশের সার্বভৌম আইনের বিলুপ্তি। কারনটা সহজ। ভারতকে আমি সমাজতান্ত্রিক আইন দিয়ে সাজালাম। অন্যদিকে বাংলাদেশ, ভিয়েতনামে ধনতান্ত্রিক আইন চালু রইল। ভারতের ব্যবসায়ীরাই বাংলাদেশে গিয়ে ফাক্টরী খুলবে সেক্ষেত্রে।

তবে এসব বলে কোন লাভ নেই। কোন বাঙালী বামপন্থীই মার্ক্স ভাল করে পড়ে নি। বাঙালী বামপন্থা-স্যোশাল প্রগ্রেসিভ আন্দোলনের ককটেল। বাঙালি বামপন্থা-কোন মতেই মার্ক্সবাদি না। ইন ফ্যাক্ট যারা মার্ক্স ভাল করে পড়েছেন, তারা বিলক্ষন অবগত থাকবেন, মার্ক্সকে সারাজীবন এই স্যোশাল প্রগ্রেসিভ সেকশনের বিরুদ্ধেই লিখে যেতে হয়েছিল।

(৪)

বামেরা ঐক্যবদ্ধ হতে চাইলে-প্রথমে তাদের নিজেদের ভুলগুলো বুঝতে হবে। স্বীকার করতে হবে।

এবং তারপরে বুঝতে হবে, মানুষ বামপন্থী বা ডানপন্থী হতে নারাজ। তারা বাঁচতে চাইছে। ন্যারেটিভে তাদের উৎসাহ নেই। সুতরাং ন্যারেটিভ বর্জন করে – ইস্যুর ভিত্তিকে একজোট হওয়া ছাড়া উপায় নেই। আমি যে ইস্যুগুলো লিখলাম- চিকিৎসা, চাকরি, শিক্ষা-এগুলোতে দ্বিমত করার কিছু আছে কি?

কিন্ত দ্বিমত হবে-যখন লোকে সমাধানের পথ খুঁজবে। এখন ধনের বৈষম্য আছে বলে যদি আমি হুটহাট করে কর্পরেট ট্যাক্স বাড়িয়ে দিলাম । জঙ্গী ট্রেড ইউনিয়ান চালালাম। কি হবে? ব্যবসা বানিজ্য-এবং তার সাথে সক্ষম জনগন রাজ্য ছেড়ে চলে যাবে। যা পশ্চিম বঙ্গে হয়েছে। ফেসবুকের বামেরা প্রায় কর্পরেট ট্যাক্স বা ছাড়ের বিরুদ্ধে হুংকার ছাড়েন-যেগুলো তাদের অজ্ঞানপ্রসূত বালখিল্যতার পরিচয়।

সুতরাং বামেদের বিকল্প খুঁজতে হবে। কোয়াপরেটিভ একটি ভাল বিকল্প। ধরুন চা বাগান বন্ধ হচ্ছে। এখানে শ্রমিক আন্দোলন, রাজনীতি বৃথা। বাগানগুলো শ্রমিক কোয়াপরেটিভের হাতে তুলে দেওয়া হৌক। মাইনিং এর ক্ষেত্রেও আমি একই কথা লিখব। যেখানেই শ্রমিক শোষন বেশী-সেখানেই তা শ্রমিকদের কোয়াপরেটিভের হাতে দেওয়াই ভাল। ্ট্রেড ইউনিয়ান শ্রমিক সমস্যার কোন সমাধান না। তা হচ্ছে ঘাঁতে খুঁচিয়ে পুঁজ বার করা। এটাই ঐতিহাসিক সত্য।

সোভিয়েতের পতনের ঠিক আগে, খনিগুলির উৎপাদন এত কমে যায়-রাষ্ট্র বাধ্য হয় শ্রমিকদের কোয়াপরেটিভ করে-সেগুলো শ্রমিকদের হাতে দিয়ে দিতে। কারন এক্ষেত্রে উৎপাদন কমলে শ্রমিকদের নিজেদের মাইনে কমবে। এই উদ্যোগের ফলে সোভিয়েত মাইনিং সেক্টরে আবার উৎপাদন ফিরে আসে।

মোদ্দা কথা ব্যক্তিমালিকানা অস্বীকার করা যেতে পারে-কিন্ত মার্কেটকে অস্বীকার করলে, মার্কেট মহাদেব ভষ্ম করবেন। এটাই রূঢ় বাস্তব। সুতরাং কোয়াপরেটিভ আন্দোলনের মাধ্যমে বামেরা আবার জমি ফিরে পেতে পারে। কিন্ত তাদের একদম প্রথম থেকে শুরু করতে হবে।

হাসপাতাল এবং শিক্ষাকেও কমিউনিটির ভিত্তিতে ভাবতে হবে। প্রাইভেট স্কুল, প্রাইভেট হাসপাতালের চেয়ে খোদ আমেরিকাতেই কমিনিউটি স্কুল এবং হাসপাতাল অনেক ভাল চলে। এগুলোই আসল আন্দোলন। সেসব বাদ দিয়ে হাঁসপাতালে কোয়ার্ডিনেশন কমিটি আর স্কুলে এবিটিয়ে করাটা আসলেই একটা অতিক্ষুদ্র শ্রেনীর স্বার্থ রক্ষা করা। সেগুলো যদি বামপন্থা হয়, বা বামপন্থার মূল উদ্দেশ্য হয়, পশ্চিম বঙ্গ বামমুক্ত হওয়াটাই শ্রেয়।

মোদ্দা কথা আদ্দিকালে চিন্তাধারা থেকে না বেড়োতে পারলে, বঙ্গের বিধি “নো ভাম”।