লেখকঃ জুমন হোসেন

ভিলিংগিলি দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের তুলনা হয় না। সেই দ্বীপের অভিজাত রিসোর্ট সাংরিলাতে গত ২৬ কার্তিক (১০ নভেম্বর) সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের এক ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে আশার বাণী শুনছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কাছ থেকে। তিনি কি তখন জানতেন, তিস্তা চুক্তি স্থগিত করার পর বাংলাদেশকে আশাহত করার মতো আরো একটি ঘটনা ঘটিয়েছে ভারত? তিনি কি জানতেন না, ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের জন্য বিনিয়োগ চুক্তি করে বসে আছে? যদি তিনি না জেনে থাকেন, তা হলে সেই দায় কার? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের? নাকি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের? নাকি কোনো উপদেষ্টার? এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা কখনই পাব না। সংসদীয় গণতন্ত্রে রাজনৈতিক জবাবদিহিতার যে ঐতিহ্য গড়ে ওঠার কথা, গড়ে তোলার কথা, আমাদের রাজনীতিকরা সে ব্যাপারে কখনই মনোযোগী হননি। কোনোদিন হবেন বলে মনেও হয় না। তাই ভারত কেন এভাবে বাংলাদেশকে কোনো কিছু না জানিয়েই হঠাৎ বিনিয়োগ চুক্তি করে বসল, সরকারের কোনো প্রতিনিধি তার ব্যাখ্যা দেবেন বলে আমাদের মনে হয় না।
বরাক নদের ওপর দিয়ে টিপাইমুখ বাঁধ ও একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্যে দিল্লীতে যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি হয়েছে গত ৭ কার্তিক (২২ অক্টোবর)। বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা না করে টিপাইমুখে বাঁধের ব্যাপারে ভারত কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না, এ রকম আশ্বাস পেয়ে আমাদের সরকার-প্রতিনিধিরা ২০১০ সাল থেকে বগল বাজিয়ে আসছেন। সরকারের সেই বগলসংগীত এতই শ্রুতিমধুর ছিল যে, বাঁধ প্রতিরোধের জন্য যেসব রাজনীতিক ও সুশীল ভাইয়েরা নানা কিসিমের কমিটি গড়ে তুলেছিলেন, তারাও ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। গত ৫ অগ্রহায়ণ (১৯ নভেম্বর) মিডিয়া আমাদের সবার ঘুম ভাঙিয়েছে। ঘুমভাঙা চোখে আমরা জানতে পেরেছি, তিস্তার পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে সরকার যেমন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, বরাক নদীতে দেশের স্বার্থ সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ব্যর্থতার পরিচয় রেখেছে।
এই নিয়ে কি আমাদের মতো আমজনতার বেশি কিছু বলা বা লেখা উচিত হবে? শেখ হাসিনা গত ৫ অগ্রহায়ণ (১৯ নভেম্বর) রাতে তার শ্রুতিমধুর কণ্ঠে আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর বদলে বিদ্যুতের ভর্তুকি বৃদ্ধি নিয়ে সমালোচনা করায় প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ তিনি; তাই বিদ্যুৎ বিভাগে তিনি আদেশ দিয়ে রেখেছেন, এরপর থেকে কেউ সমালোচনা করে কোনো কিছু লিখলে সঙ্গে সঙ্গে তার বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দিতে। ‘বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শত গুণ’- প্রধানমন্ত্রীর এ আদেশ কার্যকর হতে যে খুব বেশি সময় লাগবে না বলাই বাহুল্য। এ রকম একজন সমালোচনাক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকার কি আর সংসদে জানাবে, কেন টিপাইমুখ নিয়ে দূতিয়ালিতে সরকারের বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এত বড় ব্যর্থতার পরিচয় দিল? কী দায় সরকারের এ খোঁজ করার, গত ১ অগ্রহায়ণ (১৫ নভেম্বর) জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনকে দাওয়াত দিয়ে টেবিলে বসিয়ে রেখে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি যে ‘স্যরি’ বলে ভারতের দিকে উড়াল দিলেন (মানবজমিন, ৪ অগ্রহায়ণ) এবং মমতার সঙ্গে তিস্তা নিয়ে দেনদরবার করলেন, তখনও কি কেউ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কানে টিপাইমুখের ওই সংবাদটি পৌঁছায়নি?
বস্তুত সংসদে কিংবা জনগণের কাছে যে এসব নিয়ে জবাবদিহিতার কোনো দরকার নেই, সংসদীয় জবাবদিহিতা যে কথার কথা, তা আমাদের সংসদ সদস্য আর রাজনীতিকরা ভালো করেই জানেন। তাদের জবাবদিহিতা শুধু প্রধানমন্ত্রীর কাছে, দলের নেত্রীর কাছে। তাই প্রধানমন্ত্রী যদি সংসদে যান, তা হলেই কেবল মন্ত্রী-সাংসদরা শেভ করে পায়জামা-পাঞ্জাবি আর মুজিবকোট পরে হুড়োহুড়ি করে ছুটতে থাকেন সংসদ ভবনের দিকে। সংসদীয় গণতন্ত্রে রাজনীতিচর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে জাতীয় সংসদ; সরকারি দল তাই সুযোগ পেলেই বিরোধী দলকে ছবক দিয়ে থাকে অধিবেশন বর্জন না করে সংসদকে কার্যকর করার। কিন্তু কীভাবে কার্যকর হবে সেই জাতীয় সংসদ, যেখানে সরকারি দলের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরাই চায় না পা মাড়াতে? প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ঘোষণা দিয়ে অধিবেশনের পর অধিবেশন বর্জন করে চলেছে, অন্যদিকে অধিবেশনের পর অধিবেশনে অঘোষিতভাবে অনুপস্থিত থাকছে সরকারি দল। এই বর্জন আর অনুপস্থিতির মধ্যে পার্থক্য কতটুকু, বর্জনকারী বিরোধী দল আর অনুপস্থিত সরকারি দল- কার পাপ কতটুকু, কে বলবে? কে ঝুঁকি নেবে বিদ্যুৎ সরবরাহহীন বাসায় বসবাস করার?
মাসখানেক আগে, অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে ১১ কার্তিক (২৬ অক্টোবর) প্রধানমন্ত্রী সংসদে উপস্থিত ছিলেন, তাই মন্ত্রীরাও সেখানে হাজিরা দিয়েছিলেন। তারপর প্রধানমন্ত্রী কমনওয়েলথ দেশভুক্ত সরকারপ্রধানদের সম্মেলনে অস্ট্রেলিয়া গেলেন, সেই সুযোগে সংসদের ‘অমল ধবল পালে মন্দ মধুর হাওয়া’ লাগল। ১২ কার্তিকের (২৭ অক্টোবরের) সংসদ অধিবেশন শুরু হলো ১৫ মিনিট পরে, আওযামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে, কিন্তু অধিবেশনে ওই সময় উপস্থিত ছিলেন মাত্র ৬২ জন সাংসদ- যার মধ্যে ২৬ জন নারী সাংসদ। স্পিকার আবদুল হামিদ ছিলেন না, তিনি গিয়েছিলেন সৌদি আরব। ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী ছিলেন না, তিনি গিয়েছিলেন তার নির্বাচনী এলাকা নড়িয়াতে। অনুপস্থিত ছিলেন সংসদের উপনেতা সাজেদা চৌধুরী। ৪০ জন মন্ত্রী অনুপস্থিত ছিলেন, উপস্থিত ছিলেন মাত্র ছয়জন। সামনের সারিতে উপস্থিত ছিলেন মাত্র দুজন মন্ত্রী। এদের একজন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। অন্যজন বহুল আলোচিত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, যিনি কথা বললে নাকি তার নিজের কথা অনুযায়ীই, ধস নামে শেয়ারবাজারে এবং তার ওই কথার সূত্র ধরেই আমরা ধরে নিতে পারি, তিনি উপস্থিত ছিলেন বলেই হয়তো সেদিন অনুপস্থিতির ধস নেমেছিল মন্ত্রী সাম্রাজ্যে।
পয়েন্ট অব অর্ডারে সেদিন খুব আক্ষেপ করেছিলেন তোফায়েল আহমেদ, ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন আবদুল মতিন খসরু, সরব হয়েছিলেন শেখ ফজলুল করিম। তোফায়েল আহমেদ ‘ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য হওয়ায়’ সব কথা বলতে পারেননি। শুধু এটুকু বলেছেন, ‘বাতিল নোটিশের বক্তৃতা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে শুনতে হয়। কিন্তু কেউ নেই। কে শুনবেন কার কথা।’ স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার না থাকায় অধিবেশনে সভাপতির দায়িত্ব নিতে হয়েছিল আবদুল মতিন খসরুকে। আক্ষেপ করে তিনি বলেছেন, ‘অধিবেশনকক্ষে মন্ত্রীদের ফাঁকা চেয়ার ফ্যাল ফ্যাল করে হাসছে।’ আর শেখ সেলিম বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বুধবারে সংসদে ছিলেন। ওইদিন মন্ত্রীরা সবাই সেজেগুজে সংসদে এসে বসে ছিলেন। আজ প্রধানমন্ত্রী সংসদে নেই, কোনো মন্ত্রীও নেই।’
এই যখন অবস্থা, তখন সরকারি দলের কী কোনো নৈতিক অধিকার আছে বিরোধী দলের প্রতি সংসদে এসে কথা বলার আহ্বান জানাবার? তারা নিজেরাই তো সংসদে আসেন না ঠিকমতো! এ যাত্রায় তাও রক্ষা পেয়েছেন, কোরাম পূর্ণ হওয়ায় অধিবেশন শুরু করতে পেরেছিলেন, কিন্তু এমন অধিবেশনও গেছে যখন কোরাম পূর্ণ করতেও হিমশিম খেতে হয়েছে তাদের। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন তারা, কিন্তু সংসদে অবধারিতভাবে উপস্থিত থাকেন কেবল প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত থাকলে- কেননা তিক্ত সত্য হলো, তারা মনেই করেন না যে, জনগণের কাছে তারা দায়বদ্ধ; তারা জানেন, তাদের হাতপা বাঁধা প্রধানমন্ত্রীর কাছে। আর প্রধানমন্ত্রী এ রকম সব মন্ত্রী বানানোর জন্য, সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন দেওয়ার জন্য অনুসরণ করেন বিভিন্ন পদ্ধতি। যার মধ্যে একটি পদ্ধতি হলো দৌড় পদ্ধতি। এসব আমাদের বানানো কথা নয়। সরকারি দলের সংসদ সদস্যই এসব জানিয়েছেন- দৌড় প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে মন্ত্রিত্ব বাগিয়ে নিয়েছেন যোগাযোগমন্ত্রী। এই নিয়ে তোলপাড় হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নাকি সেই সংসদ সদস্যকে ‘মীরজাফর’ বলেছেন, অন্যদিকে সেই সংসদ সদস্যের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী তাকে কয়েকটি ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন- যেমন এই দৌড় প্রতিযোগিতা আসলে অন্য একটি স্থানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল; আর দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রধান হয়েছিলেন সাবের হোসেন চৌধুরী।
কিন্তু কে ‘মীরজাফর’ কিংবা প্রধানমন্ত্রী আসলে কী কী ‘ভুল’ ধরিয়ে দিয়েছেন, সেসব আমাদের বিবেচ্য নয়- আমরা যা দেখছি, সরকারি দল আওয়ামী লীগ সমন্বয়ের অভাবে ভুগছে, আওয়ামী লীগে প্রায় সবাই এখন যার যার মতো করে আওয়ামী লীগের মুখপাত্র হয়ে উঠেছে। কেবল নিশ্চুপ সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম- যিনি নাকি, খবর এসেছে, পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছিলেন। বিভিন্ন মন্ত্রী ও নেতার দায়বদ্ধতা, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার ধরণও রীতিমতো ভীতিকর আমাদের মতো আমজনতার কাছে। শেয়ারবাজারের কথাই ধরুন, অর্থমন্ত্রী যখন বলেন, তিনি কাগজপত্র না দেখেই স্বাক্ষর করেছেন বলে শীর্ষ পর্যায়ের একটি কমিটির প্রধান নির্বাহী হিসাবে তার নাম এসেছে- তখন সেই বক্তব্যে সততা থাকতে পারে, কিন্তু মন্ত্রীসুলভ দায়বদ্ধতা, জবাবদিহিতা কিংবা স্বচ্ছতার কোনোটিই থাকে না। এ রকম মন্ত্রী বহাল রাখার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার নিজের ক্ষমতার বহির্প্রকাশ ঘটাতেই পারেন, কিন্তু তাতে কেবল ক্ষমতাই দেখানো হয়, অন্য কিছুই নয়।
এবং লেখাই বাহুল্য, একইভাবে, টিপাইমুখের ব্যাপারেও কতিপয় কথার বাঘের কে কত গলাবাজি করতে পারেন তারই প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে। প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে সরকারি দল আর বিরোধী দলের নেতাদের মধ্যে। সরকারি দলের নেতারা বলছেন, বিরোধী দল এ ইস্যুকে কেন্দ্র করে নাকি ধূম্রজাল সৃষ্টি করার পায়তারা করছে। আর বিরোধী দলের নেতারা বলছেন, নতজানু পররাষ্ট্র নীতির কথা। তারা এমন ভাব দেখাচ্ছেন যে, বিএনপি ক্ষমতায় এলেই পররাষ্ট্র নীতির শিরদাঁড়া একেবারে সোজা হয়ে যাবে। ভবিষ্যতে যাই ঘটুক, বিএনপির এখন পোয়াবারো, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে চুক্তির খবরটি এসেছে টায়ে টায়ে একেবারে তারেক রহমানের জন্মদিনের সময়।
বিএনপি নামক কাননটির একমাত্র কুসুমকলি এখন এই তারেক রহমান। বিএনপির বয়োজ্যেষ্ঠ নেতারাও ব্যতিব্যস্ত এই কুসুমকলির বন্দনায়- তারেকবন্দনায়। তাদের এ বন্দনার প্রথম পঙ্‌ক্তিই হলো, তারেক রহমানই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রনায়ক। তিনি কোনো দুর্নীতি করতে পারেন, তা বিএনপির কোনো নেতাকর্মী বা সমর্থকের কাছে অবিশ্বাস্য ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ঘটনা। তারা তাই মনে করেন, এই যে কয়েক দিন আগে এফবিআই-এর একজন কর্মকর্তা তারেক-মামুনের বিরুদ্ধে মুদ্রাপাচার মামলায় সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন, তাকে আনা হয়েছে ভাড়া করে। এর আগে বিদেশি সাংবাদিক লরেল লিফৎসুলজ একটি মামলায় সাক্ষ্য দিতে এলেও বিএনপি নেতাদের একই ভাষায় কথা বলতে দেখা গেছে। বিএনপি’র নেতারা লিফৎসুলজকে বলেছিলেন ‘ভাড়াটে সাংবাদিক’। বিএনপির পক্ষ থেকে অহরহই বলা হচ্ছে, তারেকই ভবিষ্যতের রাষ্ট্র্রনেতা। বলা হচ্ছে, তরুণ নেতৃত্বের হাতে আগামী সরকার গঠনের দায়িত্ব অর্পণ করা হবে। কয়েক সপ্তাহ আগে ময়মনসিংহের জনসভায় খালেদা জিয়াকেও বলতে শোনা গেছে, ‘আমরা প্রবীণ, আমরা পরামর্শ দেব। তোমাদেরই ভবিষ্যতে দায়িত্ব পেয়ে দেশকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে হবে (কালের কণ্ঠ, ১৩ কার্তিক, ২৮ অক্টোবর)।’
বিএনপির এই তরুণ নেতৃত্ব কেমন হতে পারে, তার ‘সামান্য’ বিভিন্ন উদাহরণ আমরা বিগত চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলেই দেখতে পেয়েছি। উইকিলিকস থেকেও ধারণা পাওয়া গেছে এই তরুণ নেতৃত্ব সম্পর্কে। গত ৩০ আগস্ট, উইকিলিকস-এর ফাঁস করা তথ্যবার্তা থেকে জানা গেছে, ২০০৫ সালের ১১ মে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে হ্যারি কে টমাস তার পাঠানো তারবার্তায় জানান, জোট সরকারের অভ্যন্তরে রয়েছে আরেক ‘ছায়া সরকার’- যেটি পরিচালনা করছেন তারেক রহমান এবং বিএনপি ও জোটের কয়েকজন উচ্চ পর্যায়ের নেতা। হাওয়া ভবন ছিল এই ছায়া সরকারের কার্যালয়। ২০০৮ সালের ৩ নভেম্বর বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি এক তারবার্তায় তারেক রহমানকে ‘ভয়ঙ্কর রাজনীতিক ও দুর্নীতি এবং চুরির মানসিকতাসম্পন্ন’ বলে উলেস্নখ করেন। মরিয়ার্টি এই তারবার্তায় তারেক রহমানকে প্রেসিডেন্সিয়াল ঘোষণা ৭৭৫০-এর অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেন। উল্লেখ্য, এই ধারাবলে যুক্তরাষ্ট্রে যে কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ করা যায়।
যাদের অত ‘দূর অতীতের’ কথা মনে নেই, তাদের জন্য রয়েছে খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিকতম রোডমার্চেরই একটি উদাহরণ। বিএনপির তরুণ নেতৃত্ব রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নকে কোন পর্যায়ে নিয়ে গেছে, তার খানিকটা ধারণা পাওয়া যায় ওই ঘটনা থেকে। বিএনপির তরুণ নেতা, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি, সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের সঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে যিনি পুরো বাংলাদেশেই পরিচিত, সেই ইলিয়াস আলী সিলেটে বিএনপির জনসভার আগে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দ মকবুল হোসেনকে প্রতিশ্রুতি দেন জনসভার মঞ্চে তুলে বক্তব্য রাখার সুযোগ করে দেওয়ার। বিনিময়ে তিনি সাবেক সংসদ সদস্যের কাছে দাবি করেন ২০ লাখ টাকা। বেচারা সৈয়দ মকবুল হোসেনের কোনো উপায় ছিল না- বিএনপিতে তরুণ তুর্কিদের রাজত্ব চলছে, জানা আছে তার। তবে নেত্রী আসবেন, অথচ তার সামনে বক্তব্য রাখার সুযোগ পাওয়া যাবে না- তাও তো সহ্য করা যায় না। বক্তব্য না শুনলে ম্যাডাম তার কৃপাদৃষ্টি ফেলবেন কীভাবে? অতএব তিনি ইলিয়াস আলীকে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দেন। কিন্তু জনসভার দিন তিনি কোনোমতে মঞ্চে ঠাঁই পেলেও বঞ্চিত হন বক্তব্য রাখার সুযোগ থেকে। এ ঘটনায় সৈয়দ মকবুল ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং ইলিয়াস আলীর বিরুদ্ধে ‘মঞ্চ-বাণিজ্য’র অভিযোগ আনেন (প্রথম আলো, ১ কার্তিক, ১৬ অক্টোবর)।
এই হলো বিএনপির তরুণ নেতৃত্ব- এদের হাতেই আগামী সরকার গঠনের দায়িত্ব তুলে দিতে চান খালেদা জিয়া! তা হলে সেই সরকারের সেই জাতীয় সংসদটিও কেমন হবে? তারাও কি পারবেন জাতীয় সংসদকে অর্থময় করে তুলতে? টিপাইমুখ বাঁচানোর জন্য এখন বিএনপি ধনুকভাঙা পণ করেছে বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু সত্যিই কি তারা আন্তরিক এ ব্যাপারে? কিংবা বিএনপির কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যত সরকারও কি পারবে টিপাইমুখের ব্যাপারে কোনো ইতিবাচক কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে? নাকি ইস্যুটিকে নেহাৎ-ই বাঁচিয়ে রাখবে রাজনীতির স্বার্থে, যেমন তারা বাঁচিয়ে রেখেছিল দীর্ঘ দু’যুগ ‘বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তিটিকে? বিএনপির জন্য এর চেয়ে চরম দুঃখের ব্যাপার আর কী হতে পারে। ১৯৯৬ সালে সম্পাদিত গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তিই এখন টিপাইমুখের ব্যাপারে বাংলাদেশের সঠিক অংশীদারিত্ব প্রয়োগের ক্ষেত্রে একমাত্র আন্তর্জাতিক আইন হিসাবে কাজ করবে! কেননা গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি অনুসারে, অভিন্ন নদীর ওপর এককভাবে কোনো প্রকল্প গ্রহণের বৈধতা ভারতের নেই।
টিপাইমুখে ভারত ফারাক্কার মতো নতুন যে মরণফাঁদ বানাতে চলেছে, তা প্রতিরোধ করতে হলে কেবল স্থানিকভাবে নয়, বরং আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে আন্তর্জাতিকভাবে- যে আন্দোলন-সংগঠনে কেবল বাংলাদেশেরই নয়, থাকবে ভারতসহ সারা বিশ্বের পরিবেশবাদী ও পরিবেশসচেতন নাগরিকগণ। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে কেবল বাংলাদেশের মানুষ নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ভারতের আসাম ও মণিপুরের মানুষেরাও। এটি তাই যে কোনো অর্থেই কেবল একটি দেশের সমস্যা নয়। কেবল একটি দেশের বিশেষজ্ঞনির্ভর বিষয় নয়। এটি এমন একটি পরিবেশবাদী রাজনৈতিক আন্দোলনের ইঙ্গিত বহন করছে, যা বাংলাদেশ ও ভারতের আশঙ্কিত মানুষদের পরস্পরের নৈকট্যে নিয়ে আসবে।
কিন্তু দুদেশের মুখচেনা রাজনৈতিক দলগুলোর কেউই বোধকরি চাইবে না, একটি পরিবেশবাদী রাজনৈতিক আন্দোলনের এজেন্ডা নিয়ে দুদেশের মানুষ একই মঞ্চে উঠুক, একই ভাষায় কথা বলুক, ঐক্যবদ্ধভাবে দুটি সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করুক। রাজনৈতিক দলগুলোকেও তাই দেখা যাচ্ছে, খণ্ডিত প্রতিরোধের ইঙ্গিত দিতে, মুখবাঁচানো কর্মসূচি ঘোষণা করতে- কিন্তু বাংলাদেশের শক্তিশালী রাজনৈতিক দলগুলোর কোনোটাই দুদেশের আশঙ্কিত মানুষদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসছে না। রাজনৈতিক শক্তিই যদি রাজনৈতিক ব্যর্থতার পরিচয় দিতে থাকে, তাহলে জনগণ আর কতটুকুই বা করতে পারে? জনগণের পক্ষে কি বেশিদূর এগুনো সম্ভব রাজনৈতিক নেতৃত্ববিহীন অবস্থায়?