[১৯১৬ সালে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের আবিষ্কার সংক্রান্ত বিজ্ঞানপত্রটি দুনিয়ার সামনে প্রকাশিত হয়। এই বছর সেই দুনিয়া কাঁপানো আবিষ্কারের একশ বছর পূর্তি উদযাপিত হচ্ছে বিশ্বের নানা জায়গায় নানা ভাবে। সেই উপলক্ষে আমি এখানে আপেক্ষিকতা তত্ত্বের দুই পর্ব সংক্ষেপে সকলের বোধগম্য ভাষায় তুলে ধরার চেষ্টা করছি। প্রথম পর্বে আলোচনা করা হয়েছিল বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব। এবার লক্ষ্য: সাধারণ আপেক্ষিকতা।]

প্রথম পর্বে বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে জানা গিয়েছিল, দৈর্ঘ্য সময় আর ভরকে বস্তুর কোনো শাশ্বত গুণ বা বৈশিষ্ট্য হিসাবে ভাবা যাবে না, বস্তুর গতির অবস্থার সাথে তার এই সব বৈশিষ্ট্যও সংযুক্ত এবং সেই অর্থে আপেক্ষিক বলে বুঝতে হবে। তার ফলে (শুধু বলবিদ্যার নয়) পদার্থবিজ্ঞানের সমস্ত নিয়ম পরস্পর সমবেগে চলমান নির্দেশাক্ষগুলিতে সমানভাবে খাটবে। তার জন্য নতুন (লোরেঞ্জ) পরিপাতন সম্পর্ক ব্যবহার করতে হবে। কে দেখবে, কোথা থেকে দেখবে, আদৌ কেউ দেখবার জন্য আছে কিনা—এরকম কোনো প্রশ্নই এর সঙ্গে জড়িত নয়। পদার্থবিজ্ঞানের আবিষ্কৃত নিয়ম বা সত্যগুলির গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে কোনো আপেক্ষিকতার অবকাশ নেই। এক একটা নির্দিষ্ট নির্দেশাক্ষ বরাবর কে কী দেখব তা কিন্তু দর্শক নিরপেক্ষভাবে প্রকৃতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হিসাবে নির্দিষ্ট আকারেই ঠিক হয়ে আছে।

কিন্তু আমরা অবাক হয়ে দেখি, এত বড় একটা আবিষ্কার করেও আইনস্টাইনের কিন্তু মন ভরল না। তাঁর মনে একটা প্রশ্ন তখনও খচখচ করে যেতে লাগল, কেন, শুধু সমবেগে চলমান নির্দেশাক্ষ কেন, ত্বরিত নির্দেশাক্ষগুলিতেই বা পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলি সমানভাবে সিদ্ধ হবে না কেন? তাছাড়া, পৃথিবী তো শুধু সমবেগে সূর্যের চারদিকে ঘুরছে না। ঘুরছে মানেই অনবরত দিক বদল করছে। তার মানে, ক্রমাগত বেগের পরিবর্তন হচ্ছে, ত্বরণ নিয়ে চলছে। অথচ, পৃথিবীর বুকে আমরা পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলিকে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যে ফল পাচ্ছি, তা যথেষ্ট সন্তোষজনক। তাহলে সেটা আপেক্ষিকতার নিয়মে তত্ত্বগতভাবে ধরা পড়বে না কেন? ত্বরিত গতি সমবেগে গতির থেকে কোথায় আলাদা? কোথায় তাদের মিল?

তাঁর নিজের আবিষ্কারের ভিত্তিতে আরও একটা জরুরি বিষয় চিন্তায় আলোড়ন তুলল। বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুযায়ী দেখা গেল, বস্তুর গতির ক্ষেত্রে আলোকের গতিবেগই সর্বোচ্চ; তার চেয়েও জোরে আর কিছুই ভ্রমণ করতে পারে না। তার মানে হল, যে কোনো ভৌত সঙ্কেতের এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যেতে কিছুটা সময় লাগেই। যেমন, আমরা জানি, সূর্য থেকে পৃথিবীর বুকে আলো এসে পৌঁছতে আট মিনিটের মতো সময় লাগে। কিন্তু সূর্য যে আকর্ষণ বল দিয়ে পৃথিবীকে (বা অন্য কোনো গ্রহকে) টানছে, তার এই অবধি আসতে সময় লাগে কি লাগে না? নাকি, অসীম বেগে তৎক্ষণাৎ এসে যায়? যদ্দুর মনে হয় নিউটনও এই সমস্যা নিয়ে ভেবেছিলেন, কিন্তু অনেক ভেবেও কোনো কূল-কিনারা পাননি। শেষ পর্যন্ত এটা সাবেকি বলবিদ্যায় যে কোনো দূরত্বে এক রহস্যময় তাৎক্ষণিক ক্রিয়া হিসাবেই জায়গা করে নেয়।
এই রকম অনেক প্রশ্ন তাঁর মাথায় ঘুর ঘুর করতে লাগল।

অত সহজ নয়!

পর পর অতগুলো যুগান্তকারী আবিষ্কার করে ফেললেও এই বিষয়টির সমাধানে পৌঁছতে আইনস্টাইনের কিন্তু বেশ সময় লাগল। অন্তত দশ বছর। ১৯১৬ সালে তিনি তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব বিজ্ঞান পত্রের আকারে প্রকাশ করলেন। [Einstein 1916] এবারে দেখা গেল, অঙ্কগুলো আগেকার মতো অত সহজ নয়। প্রচণ্ড জটিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম গণিতের সাহায্য নিয়ে তবে এগোনো যাচ্ছে। খুব ভালো অঙ্ক না জানলে তার ধারে কাছেও পৌঁছনো যাবে না।

প্রসঙ্গত একটা কথা মনে পড়ে গেল।
আপেক্ষিকতা তত্ত্ব সম্পর্কে লোকপ্রিয় ভাষ্য সম্বলিত বেশ কিছু ভালো বই লেখা হয়েছে। লিখেছেন পূর্বতন সোভিয়েত রাশিয়ায় লান্দাউ ও রয়মার, স্মিলগা, ইংল্যান্ডে রাসেল এবং বার্নেট, আমেরিকায় গ্যামো, প্রমুখ বিশিষ্টরা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এঁরা কেউই সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ নিয়ে খুব একটা কিছু লেখেননি। আর্থার এডিংটন এবং হেরমান হ্বাইল—এই দুজনকে বাদ দিলে বাকি সকলেই কেবল মাত্র বিশেষ আপেক্ষিকতা নিয়ে লিখে গেছেন। সম্ভবত এর কারণও একটাই। এঁদের হয়ত উদ্বেগ ছিল, সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদকে সহজ সরল করে লিখে আম পাঠকদের বোঝাতে গেলে বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি ব্যাপারে ছোট বড় নানা মাপের ভুল ধারণা চালান হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই তাঁরা খুব সচেতন ভাবেই মনে হয় এই দায়িত্ব সযত্নে এড়িয়ে গেছেন।
অতএব পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন, “হাতিঘোড়া গেল তল, মাছি মাপে কত জল”—আমার সেই দশা কিনা! দুঃসাহস দেখাচ্ছি, না, নিজের ঢাক পেটাতে চাইছি?

কোনোটাই নয়।
বলতে পারেন, অবস্থার সুযোগ নিচ্ছি। জিনিসটাকে যতটা কঠিন বলে প্রচার করা হয়েছে এত কাল ধরে, আসলে এখন আর বোধ হয় তত কঠিন নেই। আমাদের সাধারণ বোধভাষ্যির সাথে মেলাতে গেলে খুব অসুবিধা হয় বলে আমরা এর যুক্তি বা সংজ্ঞাগুলো মন থেকে সহজে মেনে নিতে পারি না। কিন্তু একটা তত্ত্বের উপলব্ধি তো আর এক জায়গায় পড়ে থাকে না। বহু লোক বহু কাল ধরে বুঝবার এবং বোঝাবার চেষ্টা করতে করতে এখন অনেক জিনিস এমনিতেই পরিষ্কার হয়ে এসেছে। সরল করে বোঝানোর ভাষাও অনেকখানি তৈরি হয়ে গেছে। অর্থাৎ, কঠিন কঠিন বলেও আমার কাজ পূর্বসূরীরা অনেকাংশে সহজ করে দিয়েছেন। আমরা আইনস্টাইনকে অনুসরণ করে একটা একটা করে সংশ্লিষ্ট সমস্যার জট খোলার কায়দাকানুন দেখতে দেখতে এগোব। তাহলেই, পুরোপুরি না হলেও, অনেকটাই সাধারণ পাঠকদের কাছে এই বিষয়টা খোলসা করে তুলে ধরতে পারব।

তফাত নেই কেন?

আইনস্টাইন প্রথম যে প্রশ্নটিতে মনঃসংযোগ করলেন তা হল, জড় ভর (inertial mass) এবং মহাকর্ষ ভর (gravitational mass) কীভাবে সমান হয়? কেন হয়?

সমস্যাটা এই রকম: আরিস্ততলের ধারণা ছিল, উপর থেকে শূন্যে (বাতাসে) ছেড়ে দিলে ভারি বস্তু হালকা বস্তুর চাইতে তাড়াতাড়ি নীচে পড়ে যায়। প্রচলিত অভিজ্ঞতার সারসঙ্কলন করেই তিনি এটা বলেছিলেন। সত্যিই তো, এক টুকরো কাগজ বা একটা পাখির পালক আর একটা পাথরের টুকরো বা ঢিল উপর থেকে নীচে ফেলে দিলে দেখা যায়, পাথরের টুকরো বা ঢিল অনেক আগেই মাটিতে পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু কাগজ বা পাখির পালকের পড়তে দেরি হচ্ছে। গ্যালিলেও এই ধারণাকেও চুনোতি জানালেন। বললেন: উপর থেকে একটা বড় পাথর আর একটা পাথরের টুকরো এক সঙ্গে ফেলে দিলেও কি দুটো আলাদা আলাদা সময়ে নীচে পড়বে? সহজ বুদ্ধিতেই বোঝা যায়, এর উত্তর কী হবে। তিনি বললেন, বায়ুর বাধার জন্য কাগজ বা পালকের পড়তে দেরি হচ্ছে। পাথরের টুকরো এই বাধা সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারে বলে তাড়াতাড়ি নীচে নেমে আসছে। আমরা যদি শূন্যস্থানে পরীক্ষা করে দেখতে পারি, দেখা যাবে, ভারি পাথর আর কাগজের টুকরো এক সাথেই নীচে পড়ছে।
গ্যালিলেও এর ভিত্তিতে পদার্থবিজ্ঞানে আর একটা মৌল সিদ্ধান্তের কথা জানালেন: বাধাহীন ভাবে উপর থেকে নীচে পতনশীল যে কোনো বস্তু সমান দ্রুততায় নেমে আসে।

এই জিনিসটা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নিউটন দেখালেন, এই দ্রুততা আর কিছু নয়, অভিকর্ষজ ত্বরণ, যাকে ‘g’ চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হয়ে থাকে। পৃথিবীর আকর্ষণ বল যে কোনো বস্তুর উপর এমনভাবে প্রযুক্ত হয় যে ভারি বা হালকা সমস্ত বস্তুই অবাধে পতনের সময়ে এই একই ত্বরণ সহ নীচে নামতে থাকে।

পদার্থবিজ্ঞানে যখন বল ও গতির সম্পর্ক নিয়ে মাথা ঘামানো হয়, তখন আমরা একটা বস্তুর জড় ভর নিয়ে কাজ করি। এই জড় ভর বলতে বোঝানো হয়, একদিকে বস্তুতে পদার্থের মোট পরিমাণ, অপর দিকে বল প্রয়োগ করে গতিবেগ পরিবর্তন করার সময় এ কী পরিমাণে বাধা দেয়। একই ত্বরণ পেতে যত বেশি ভর তত বেশি বল প্রয়োগ করতে হয়। আর, অপর দিকে, মহাকর্ষের ফলে যখন একটা বস্তু পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ে, তখন সেই বল যেন একটা ভার হিসাবে কাজ করে। ভর যত বেশি আকর্ষণ বলও তত বেশি হয়। বিপরীতভাবে যত বেশি ভরযুক্ত বস্তু তত তাকে উপরে তুলতে কষ্ট হয়। একে মহাকর্ষ ভর বললেও এ যে জড় ভরের সমান তা নিউটন বুঝেছিলেন। তাঁর সূত্রগুলির অঙ্ক থেকেই এটা বেরিয়ে আসে। এটাও তিনি বুঝেছিলেন, এই রহস্যের একটা চাবিকাঠি কোথাও নিহিত আছে, কিন্তু তা কোথায় তিনি খুঁজে পাননি।

আইনস্টাইন বিভিন্ন দিক থেকে ভাবনা চিন্তা করে এই সমস্যার সমাধান দুই ভাবে করে দেখালেন।
প্রথমত, অবাধে পতনশীল বস্তুর ক্ষেত্রে দুদিক থেকে বুঝবার চেষ্টা করা যায়: একটা হচ্ছে পৃথিবীর আকর্ষণ বল, যা বস্তুকে যেন নীচের দিকে ‘g’ ত্বরণ সহ নেমে আসার জন্য “আহ্বান” করছে, এবং যা সেই বস্তুর মহাকর্ষ ভরের সমানুপাতিক। অপর দিকে, মনে মনে পৃথিবীর কথা ভুলে গিয়ে এইভাবেও তাকে দেখা যেতে পারে যে তার উপর একটা যান্ত্রিক বল এমনভাবে কাজ করছে যে তার ফলে ‘g’ ত্বরণ উৎপন্ন হচ্ছে। বাস্তবে দুটো ছবি যেহেতু একই ঘটনাকে বোঝাচ্ছে, আইনস্টাইন বললেন, দুটো ভরের মানও সমান হওয়াই স্বাভাবিক।
দ্বিতীয়ত, দুটো ছবিকে পৃথক পৃথকভাবে এইভাবেও দেখা যায়: পতনশীল বস্তুর ক্ষেত্রে একই বলের জন্য মহাকর্ষ ভর যত বেশি, পৃথিবীর টানে সাড়া দিয়ে ত্বরণও তত যেন বাড়তে চাইছে; পক্ষান্তরে, একই বল প্রয়োগ করে যান্ত্রিক সরণের সময় জড় ভর যত বেশি, গতিতে বাধা দানের ফলে ত্বরণ যেন ততই কমে যেতে চাইছে। বাস্তবে দুটো ছবি একই ঘটনাকে তুলে ধরছে এবং ত্বরণও অবাধে পতনের পুরো সময় ধরে একই থাকছে; অতএব দুটো ভরও পরস্পর সমানই। [Einstein and Infeld 1938, 37-38]

এইভাবে বিষয়টাকে বুঝতে গিয়ে আইনস্টাইন যেন নিজের সাথে নিজে স্বগতোক্তি করে যাচ্ছিলেন। শুধু তো আর দুরকম ভরই সমান—এইটুকু মাত্র ঘটনা নয়। “বস্তুর একই বিশেষত্ব পরিস্থিতি অনুযায়ী কোথাও “জাড্য” আবার কোথাও “ওজন” (আক্ষরিক অর্থে “ভার”) হিসাবে ব্যক্ত হয়।” [Einstein 1954, 65] সত্যিই কি গতির সাধারণ চিত্রের সঙ্গে পৃথিবীর টানে বস্তুর অবাধ পতনের মৌল চরিত্রগত কোনো পার্থক্য আছে?

এর পর আবার একটা ছবির কথা তিনি ভাবলেন। এমন একটা ছোট আকারের পৃথিবীর কথা মনে মনে চিন্তা করলেন, যার উত্তর (বা দক্ষিণ) মেরুতে দাঁড়িয়ে বিষুব অঞ্চলের ঘটনাবলি দেখা যাবে। এইবার মনে করা যাক, উত্তর মেরুতে দাঁড়িয়ে একজন দর্শক উপরে একটি গোলক ছুঁড়ে দিচ্ছে এবং নীচে নামার সময় তা লুফে নিচ্ছে। তার কাছে এই ছবিটা নিউটনের মহাকর্ষের নিয়ম প্রদর্শনের একটা ভালো দৃষ্টান্ত হিসাবে প্রতিভাত হচ্ছে। গোলকটা যে অভিকর্ষজ ত্বরণ নিয়ে নামছে এই ব্যাপারে তার কোনো সন্দেহ নেই। আর সেই সময় আর এক দর্শক, যে বিষুব অঞ্চলে দাঁড়িয়ে একই কাজ করছে, তার গোলকের ভূকেন্দ্রিক পতনশীল গতি দেখে মেরুর দর্শক ভাবছে, ওখানে নিশ্চয়ই কেউ বল প্রয়োগ করে গোলকটাকে পৃথিবীর দিকে ঠেলছে (চিত্র নং-৬ দ্রষ্টব্য)। আর সেইজন্য সেটা ক্রমবর্ধমান বেগে (অর্থাৎ, ত্বরণ সহ) ভূপৃষ্ঠের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। কেন না, সে বিষুব অঞ্চলের লোকটিকে দেখতে পাচ্ছে না, শুধু গোলকটির গতিই দেখছে। ঘটনাচক্রে, উভয় ক্ষেত্রেই সে দেখছে গোলক দুটি একই ত্বরণ নিয়ে ধাবমান। মজার কথা হল, এর বিপরীত চিত্রটিও একই রকম। অর্থাৎ, বিষুবীয় দর্শক নিজের ক্ষেত্রে মনে করবে মহাকর্ষের নিয়ম কাজ করছে, আর মেরু অঞ্চলে বলের গতি দেখে ভাববে, কেউ নিশ্চয়ই গোলকটির উপর যান্ত্রিক বল প্রয়োগ করছে।

একই ধরনের দুটো সমতুল ঘটনা, দুটো আলাদা আলাদা নির্দেশতন্ত্র থেকে দেখা হচ্ছে বলে দু রকম লাগছে। তার মানে হল, সমতলে বস্তুর ত্বরিত যান্ত্রিক গতি আর মহাকর্ষ বলের টানে বস্তুর পতন আসলে একই ঘটনা। বা অন্য ভাষায়, মহাকর্ষের টানও আসলে এক রকমের ত্বরণ যুক্ত গতি। কিংবা যদি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে এক একটা বস্তুকে স্বতন্ত্রভাবে দেখা হয়, তাহলে আলাদা করে আর মহাকর্ষের টান নামক ঘটনাকে বিবেচনা করার দরকারই হয় না। কেন না, ব্রহ্মাণ্ডের বুকে উপর-নীচ ডান দিক বাঁ দিক—ইত্যাদির কোনো মানেই হয় না। সমস্ত দিকই সমতুল্য। অতএব বস্তুটির ত্বরিত গতি নিয়ে বিচার বিবেচনা করলেই চলে।
তবুও কিছু খটকা রয়েই গেল আইনস্টাইনের মনে।
সেগুলো কী কী?

দূর থেকে ক্রিয়া

এক নম্বর হচ্ছে, দূর থেকে ক্রিয়া। এর কথা আগেই উত্থাপন করে রেখেছি। এবারে আরও বিস্তারিতভাবে বুঝবার চেষ্টা করব। নিউটনীয় মহাকর্ষে আকর্ষণ বল ক্রিয়া করার জন্য দুটো বস্তু চাই। অথচ, তারা যে যে দূরত্বেই থাকুক না কেন, এই বলের ক্রিয়া ঘটতে কোনো সময়ের ব্যবধান নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না। ভারি অদ্ভুত, তাই না? অন্তত, বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের প্রস্তাবনার পর থেকে এটা মনে হওয়া আইনস্টাইনের কাছে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল।

এই যেমন সূর্যের আকর্ষণ পৃথিবী কি সঙ্গে সঙ্গেই অনুভব করতে পারে? না, সময় লাগে খানিকটা? সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতেই সময় লাগে আট মিনিট কুড়ি সেকেন্ডের মতো। মহাকর্ষীয় টান নিশ্চয়ই তার চাইতেও তাড়াতাড়ি চলে আসতে পারে না! আজ যদি হঠাৎ কোনো কারণে সূর্যের, ঠাকুর না করুন, ভালো মন্দ কিছু একটা হয়ে যায়, আমরা পৃথিবীর লোকেরা সেটা কখন টের পাব? সঙ্গে সঙ্গেই, না, কিঞ্চিত বিলম্বে?

অন্যান্য গ্রহগুলিও কি তাই? আবার তারা সকলে মিলে পৃথিবীকে যে বলের দ্বারা টানে তাও কি তৎক্ষণাৎ চলে আসে? আইনস্টাইন দেখলেন, নিউটনের সূত্রে এসব প্রশ্নের উত্তর তো দূরের কথা, উত্থাপন করার পর্যন্ত সুযোগ নেই। কেন না, তাতে দুটো বস্তুর ভর এবং তাদের মধ্যেকার দূরত্ব ছাড়া আর কিছু সেই মাধ্যাকর্ষণ বল পরিমাপ করতে লাগে না। সেখানে সময়কে কোথাও ধরাই হয়নি। এই ব্যাপারটাকে তাঁর নিতান্তই ভুতুড়ে বলে মনে হল। যতক্ষণ কাছাকাছি বিশ্ব নিয়ে কাজ হচ্ছে এতে মাথা না দিলেও হয়ত চলে যায়। অঙ্কে বা হিসাবে খুব বড় একটা ভুল হয় না। কেন না, সব রকম সঙ্কেতই আলোকের গতিবেগে প্রায় তৎক্ষণাৎ চলে আসে। সেই জন্যই হয়ত এতদিন এতে ভুল ধরা পড়েনি। কিন্তু আজ (১৯১০-২০) আমাদের জানা বিপুল বৃহত্তর যে ব্রহ্মাণ্ড, যেখানে এক একটা জ্যোতিষ্ক পরস্পর থেকে হাজার, লক্ষ, বা এমনকি কোটি আলোকবর্ষ দূরে দূরেও ছড়িয়ে আছে, তাদের বেলায়ও কি সময়কে উপেক্ষা করা যায়? যে তারা হয়ত দু চার লক্ষ বছর আগে মরে গেছে, তার কিছু সঙ্কেত পেয়ে কি বলব, সে এখনও মহাকর্ষীয় প্রভাব ফেলে চলেছে এই সংসারে?

দ্বিতীয় সমস্যা হল, যান্ত্রিক বল কাজ করে গায়ে গায়ে লেগে। বলে লাথি মেরে গোল দেওয়া বা ব্যাট দিয়ে মেরে বাউন্ডারিতে পাঠানোই হোক, কিংবা জলের বালতি তোলাই হোক, অথবা দড়ি টানাটানিই হোক, এমনকি দু জন লোকের মারামারির ঘটনাও যদি ধরি—বল প্রয়োগ কর্তাকে বল গ্রহীতার সঙ্গে সংস্পর্শে যেতেই হয়। কেউ কেউ আছেন যাঁরা দাবি করেন যে তাঁরা শুধুমাত্র ভেবে ভেবেই একটা জিনিসকে নাড়িয়ে দিতে পারেন। তার আবার একটা গালভরা নামও আছে—মানস-সঞ্চালন (psycho-kinesis)। তবে আমাদের মতো সাধারণ লোকেদের এরকম ক্ষমতা শুধু যে নেই তাই নয়, এই রকম সব ভোজবাজির ব্যাপার-স্যাপার চাক্ষুস দেখবারও সুযোগ হয়ে ওঠেনি আজ অবধি। এরকমও দেখিনি যে গরু আগে আগে জোয়াল ছাড়াই চলেছে, আর গাড়ি তার পেছনে কোনো যোগাযোগ ছাড়াই গড় গড় করে এগোচ্ছে। এই সমস্ত ক্ষেত্রে বল প্রয়োগ করে কাজ করার সময় সরাসরি ধাক্কা যে লাগছে আর তাতেই যে কাজ হচ্ছে, তা বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না। মহাকর্ষের ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। যারা পরস্পরকে টানছে, তারা কেউ কারোর গায়ে গা লাগিয়ে বসে নেই, তবুও একটা আকর্ষণ বল দিব্যি কাজ করে যাচ্ছে। আইনস্টাইনের প্রশ্ন হল, কী করে এটা সম্ভব হচ্ছে?

এরও উত্তর তিনি খুঁজতে চাইলেন। মহাকর্ষের পরিঘটনাকে এমনভাবে যান্ত্রিক ত্বরিত গতির সাথে তুলনা করে দেখাতে চাইলেন, যেখানে এই দূর থেকে ক্রিয়ার সমস্যাটি থাকবেই না।

ক্ষেত্রতত্ত্ব

তবে তার জন্য এবার তিনি তাকালেন বলবিদ্যার গণ্ডী ছাড়িয়ে ফ্যারাডে-ম্যাক্সওয়েলের তড়িচ্চুম্বক ক্ষেত্রতত্ত্বের দিকে। সর্বপ্রথম সেখান থেকেই তো তিনি আপেক্ষিকতার সমস্যা বুঝতে শুরু করেছিলেন কিনা!

ঊনবিংশ শতাব্দের প্রায় পুরো সময় ধরেই বিদ্যুৎ আর চুম্বক নিয়ে ইউরোপে গবেষণা চলেছিল। অ্যাম্পিয়র, কুলম্ব, ওয়ের্স্টেড, ফ্যারাডে, লেনৎস্‌, ম্যাক্সওয়েল, হারৎস্‌, প্রমুখ বিজ্ঞানীদের হাত ধরে ধাপে ধাপে বহু পরীক্ষানিরীক্ষা ও তাত্ত্বিক বিকাশের মধ্য দিয়ে একটু একটু জ্ঞানের ভাণ্ডার পূর্ণ হয়ে চলেছিল। তাতে দেখা গেল, দুটো চৌম্বক মেরু বা দুটো আধানের মধ্যে যে আকর্ষণ (বা বিকর্ষণ) বল কাজ করে তার পরিমাণ নির্ণায়ক সূত্রটি মহাকর্ষ সূত্রের সঙ্গে খুবই সাদৃশ্যপূর্ণ।

যেখানে F = তড়িত বা চুম্বকীয় বল, d = আহিত/চৌম্বক বস্তুদ্বয়ের মধ্যেকার দূরত্ব, q1 ও q2 যথাক্রমে দুই বস্তুর চৌম্বক শক্তি বা আধানের পরিমাণ এবং E = সংশ্লিষ্ট ধ্রুবক রাশি।

আইনস্টাইনের মনে হল, এই সাদৃশ্য কি নেহাতই উপরে-উপরে দেখা অনুরূপ গাণিতিক আকার, নাকি, এর পেছনে বাস্তবের কোনো গভীর তাৎপর্য নিহিত রয়েছে? চিন্তাটাকে তিনি কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারছিলেন না।
আচ্ছা যদি, গাণিতিক সাদৃশ্যের পেছনে বাস্তবেরও ভূমিকা থেকে থাকে, তাহলে কি কোনো সুবিধা পাওয়া যায়? উপরের অনুচ্ছেদে উল্লেখিত সমস্যাদুটির সমাধানের কি কোনো সম্ভাব্য রাস্তা চোখে পড়ে?

তা পড়ে। একদিকে তড়িচ্চুম্বকীয় বলের বিস্তারও অসীম; মহাকর্ষ বলের সঙ্গে এই জায়গায় তার খুবই মিল। অথচ, এই বলের ক্রিয়া যে কোনো দূরবর্তী অবস্থানে তৎক্ষণাৎ ছড়িয়ে পড়ে না। ধাপে ধাপে ছড়ায়। গায়ে গায়ে লেগে ছড়ায়। তড়িচ্চুম্বকীয় শক্তির ক্ষেত্রে যে আন্দোলন উৎপন্ন হয় তা তরঙ্গের আকারেই ছড়িয়ে পড়ে। অপর দিকে এই বলের ক্রিয়ার প্রভাব বিস্তৃত হয় নির্দিষ্ট ও সসীম বেগে—আলোকের গতিবেগে।
আসুন দেখে নিই আইনস্টাইন নিজে এই সমস্যা নিয়ে কী বলেছেন তাঁর অনবদ্য ভাষায়: “ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বে কোনো বস্তুগত কারক নেই। এই তত্ত্বের সমীকরণগুচ্ছ তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্র সংক্রান্ত নিয়মগুলিকেই তুলে ধরে। নিউটনের সূত্রের মতো এখানে দুটো দূর দূরান্তে সংঘটিত ঘটনাকে যুক্ত করে দেখা হয় না; ওখানে কী অবস্থা ছিল দেখিয়ে এখানে কী ঘটছে তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয় না। একটা বিশেষ বিন্দুতে এই মুহূর্তে ক্ষেত্রের চরিত্র একটু আগেকার এবং নিতান্তই আশপাশের ক্ষেত্রের অবস্থার উপর নির্ভর করে। আমরা এখন এইখানটায় কী ঘটছে জানি, সমীকরণগুচ্ছ থেকে পরবর্তী মুহূর্তে পরবর্তী জায়গায় কী ঘটবে তার পূর্বাভাস দিতে পারি। ক্ষেত্র সম্পর্কে আমরা একটু একটু করে জানতে জানতে এগোতে পারি। আবার অনেক পেছন থেকে এই রকম ছোট ছোট ধাপগুলোতে কী ঘটেছিল জেনেই আমরা এখন কী ঘটতে চলেছে তা বের করে ফেলতে পারি।” [Einstein and Infeld 1938, 152-53]

আর একটা জিনিসও লক্ষ করার প্রয়োজন আছে। তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্র দেখানোর জন্য দুটো আহিত/চৌম্বক বস্তু থাকার প্রয়োজন পড়ে না। একটি আহিত বা চৌম্বক বস্তু থাকলেই তার প্রভাব তথা শক্তি ক্ষেত্রকে অনুভবও করা যায়, গণিতের মাধ্যমে প্রকাশও করা যায়।

এই সব দেখে আইনস্টাইন ভাবতে শুরু করলেন, মহাকর্ষের পরিঘটনাকে কোনোভাবে এই রকম একটা প্রভাব ক্ষেত্র হিসাবে দেখানো যায় কিনা। এর জন্য তাঁকে দুটো জায়গায় কাজ করতে হল: একটা হল, সর্বজনীনভাবে মহাকর্ষকে ত্বরিত গতির সাথে অভিন্ন ছবি বলে দেখানোর চেষ্টা করা; দ্বিতীয়ত, মহাকর্ষকে কীভাবে প্রভাবাধীন ক্ষেত্র হিসাবে চিত্রায়িত করা যায় তার বিজ্ঞানসম্মত যোগসূত্র খুঁজে বের করা।
একে একে। আমরাও এখানে তাঁর উপলব্ধির অগ্রগতির সরণি ধরেই এগোতে থাকব।

ত্বরিত গতি বনাম মহাকর্ষ!

কাজটা কিন্তু সহজ ছিল না। কেন না, দেখাতে হবে, ত্বরিত গতির ক্ষেত্রেও যে কোনো একটি নির্দেশাক্ষে বসে কারোর পক্ষেই প্রকৃতপক্ষে সেই গতির আন্দাজ পাওয়া সম্ভব নয়। যে কাজ গ্যালিলেও বা নিউটন শুরু করলেও শেষ করে যেতে পারেননি।
সেটা সম্ভব হল আরও কয়েকটা কল্পিত পরীক্ষার আয়োজন করার দ্বারা। তবে গ্যালিলেও সমুদ্রে জাহাজ নামিয়েছিলেন; আইনস্টাইন আধুনিক কালের লিফটের সাহায্য নিলেন। [Einstein 1954, chapter XX; Einstein and Infeld 1938, 226-35; রায় ২০০৫; আমরা বর্তমান পাঠকদের কথা মনে রেখে এই পরীক্ষাকল্পনাগুলির উপস্থাপনায় সামান্য স্বাধীনতা নেব।]

প্রথম পরীক্ষা: তার জন্য প্রথমে আমাদের একটা লিফট নিয়ে মনে মনে অনেক দূরে চলে যেতে হবে। ব্রহ্মাণ্ডের এমন একটা ফাঁকা জায়গায়, যেখানে কোনো বড় জ্যোতিষ্কের আকর্ষণ কাজ করছে না। (যেতে অসুবিধা কিছুই নেই: কল্প-পরীক্ষায় “কোথাও আমাদের হারিয়ে যাবার নেই মানা”! বাস্তবে অবশ্য এরকম জায়গা খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন; আমরাও পরীক্ষা হয়ে গেলেই সে জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে আসব।) সেখানে মনে করা যাক, একটা পাহাড়ের গা বেয়ে লিফটটা ত্বরিত গতি নিয়ে উপরে উঠছে। লিফটের ভেতরে একজন ব্যক্তি বেশ আরামেই দাঁড়িয়ে আছেন, যিনি বাইরের কোনো খবর রাখেন না। ফলে লিফটের ত্বরণ সহ উপরে ওঠার খবরও তাঁর জানা নেই। ওদিকে বাইরে, পাহাড়ের কোনো একটি চূড়ায় একজন শিকারী হাতে দূর পাল্লার খুব শক্তিশালী বন্দুক নিয়ে বসেছিলেন ওঁত পেতে। লিফট তাঁর কাছাকাছি উঠে আসতেই তিনি বন্দুক বাগিয়ে লিফট ভেদ করে গুলি চালিয়ে দিলেন। গুলিটা লিফটের উপরের দিকের দেওয়াল ভেদ করে ঢুকে গেল আর এক-আধ সেকেন্ড বাদেই উলটো দিকের দেওয়াল একটু নীচ দিয়ে ভেদ করে বেরিয়ে এল। শিকারী দেখলেন, গুলি একেবারে নিউটনের এক নম্বর গতিসূত্র মেনেই দিব্যি সরলরেখায় চলেছে (৭ক চিত্র দেখুন)।

লিফটের আরোহী কী দেখবেন? তিনি হঠাৎ দুম করে একটা আওয়াজ শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখবেন, লিফটের ভেতরে উপর দিক দিয়ে একটা গুলি ঢুকেছে যেটা চলতে চলতে ক্রমাগত নীচে পড়ে যাচ্ছে। যেমনটা পৃথিবীর বুকে চলন্ত বস্তুর উপর মাধ্যাকর্ষণের টানে হয়ে থাকে আর কি! গুলিটা একটা অধিবৃত্তাকার পথ ধরে গড়িয়ে পড়ছে (চিত্র নং ৭খ দেখুন)। তিনি আবার নিউটনের গতিসূত্র, তথা মহাকর্ষ নিয়ম—সমস্ত ব্যাপারেই নিশ্চিত বোধ করবেন। সব কুছ ঠিক হ্যায়।

এইভাবে দুজনে যদি দুরকম দেখেন, তাহলে প্রকৃত সত্যটা কী?

সত্য ঘটনাটা হল, যাহা এক দর্শকের কাছে সরলরেখায় (প্রায়) সমবেগে গতিশীলতা, তাহাই আর এক দর্শকের কাছে মহাকর্ষ জনিত অধিবৃত্তাকার গতি। নির্দেশাক্ষ অনুযায়ী কে কী আপেক্ষিক গতি দেখবে তা ঠিক হচ্ছে। ঘটনা একটাই। সেই রেল গাড়িতে ভ্রমণের সময় মাঠঘাটের পিছিয়ে যাওয়ার মতন ব্যাপার!

দ্বিতীয় পরীক্ষা: এদিকে হল কি, লিফটের যাত্রীর হাতে ছিল একটা ক্রিকেট বল। কথা নেই বার্তা নেই, বন্দুকের শব্দে চমকে ওঠায় তাঁর হাত ফস্কে আকস্মিকভাবে বলটা বেরিয়ে গেল। এইবার শুরু হল আর এক মজার কাণ্ড। আবার উপরোক্ত দুই দর্শক দু রকম জিনিস দেখতে পেলেন।
লিফটের আরোহী দেখলেন, বলটা তাঁর হাত ফস্কে গলে গিয়ে নীচে পড়ে গেল। লিফটের মেঝেয় গিয়ে ধুপ্‌ শব্দ করে ধাক্কাও খেল। ঠিক যেমনটা পৃথিবীর উপরে এরকম ঘটনায় হয়ে থাকে, হুবহু সেরকমই ঘটল ব্যাপারটা। আবার তিনি নিশ্চিত বোধ করলেন, নিউটনের মহাকর্ষ নিয়ম যথা পূর্বং কাজ করে চলেছে (চিত্র নং ৮ক দেখুন)। সাবেকি বলবিদ্যার প্রতি তাঁর বিশ্বাস অটুট রইল এই ঘটনায়।

ওদিকে, বাইরে যে শিকারী বসেছিলেন, তিনি দেখলেন একেবারে অন্য রকম ঘটনা। লিফটও উপরে উঠছে, বলও উপর দিকে যাচ্ছে। কিন্তু লিফটের ত্বরণ থাকায় সেটার গতিবেগ ক্রমশ বাড়ছে। আর বলটা যখন আরোহীর হাত থেকে গলে গেল, তখন তার (লিফটের সঙ্গে একসাথে চলার দরুন) যা বেগ ছিল সেই বেগেই সে গতিজাড্য নিয়ে উপরে উঠছে। নিউটনের প্রথম সূত্র অনুযায়ী। তার ফলে লিফটের মেঝে এক সময় তাকে ধরে ফেলে এবং টকাস করে শব্দ করে বলটাকে কোলে নিয়ে নেয় (চিত্র নং ৮খ দেখুন)। নিউটনের দ্বিতীয় গতিসূত্রের সঙ্গে সঙ্গতি বজায় রেখেই ব্যাপারটা ঘটে।

অর্থাৎ, একজনের কাছে যেটা ত্বরিত গতির সাপেক্ষে আপেক্ষিক সম বেগে চলন, আর একজনের কাছে সেটাই আবার মহাকর্ষীয় আকর্ষণের ব্যাপার বলে প্রতিভাত হচ্ছে।

তৃতীয় পরীক্ষা: এইবার আমাদের লিফটটাকে নিয়ে মনে মনে যেতে হবে ব্রহ্মাণ্ডের এমন জায়গায় যেখানে কোনো একটা খুব বড় নক্ষত্রের শক্তিশালী মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্র কাজ করছে। বাস্তবে এরকম পরীক্ষা করা খুবই বিপজ্জনক; আমরাও এই শেষ মনোপরীক্ষাটা হয়ে গেলেই বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটার আগেই লিফট থেকে বের করে ভদ্রলোককে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে চলে আসব। আপাতত লিফট সেই মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রে অবাধে পতনের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তরতর করে সেটা নীচে নামছে। ভেতরের আরোহী অবশ্য এসব কিছুই জানেন না। তিনি হাত থেকে একটা রুমাল ছেড়ে দিলেন; সেটা তাঁর হাতের পাশেই ভেসে রইল। বলটা ছেড়ে দিয়ে দেখলেন, সেও একই ভাবেই ভাসমান। আরোহীর যদি পৃথিবীর অভিজ্ঞতা স্মৃতিতে থেকে থাকে তিনি এই সব ঘটনাকে দেখে ভাববেন, তিনি পৃথিবীর একটা “মিনি” বা “পকেট সংস্করণ”-এর মধ্যেই আছেন। [Einstein and Infeld 1938, 228] গ্যালিলেওর সেই জাহাজের যাত্রীর মতোই তিনি যেভাবেই পরীক্ষা করুন না কেন, লিফটের গতি সম্পর্কে তিনি বিন্দুমাত্র আভাস পাবেন না—সেটা এক জায়গায় স্থির হয়ে থেমে আছে, না সমবেগে চলছে, নাকি ত্বরণ সহ চলমান। এমনকি লিফটটা অনুভূমিক দিকে চলছে না মহাকর্ষের টানে উপর থেকে নীচে পড়ছে—তাও তিনি টের পাবেন না। ভূপৃষ্ঠে বসে আমরা যেমন প্রতিদিনকার ছোটখাটো সাধারণ অভিজ্ঞতায় আকাশ না দেখে পৃথিবীর আহ্নিক বা বার্ষিক কোনো গতিরই হদিশ পাই না, সেই অর্থে, তার ত্বরণেরও কোনো সংবাদ পাই না, সেই লিফট যাত্রীর অবস্থাও সেই রকম। তিনিও তাঁর যানের প্রকৃত গতি কী প্রকারের তা বুঝতে সক্ষম হবেন না।

মজা হল, বাইরের সেই শিকারী যদি সেখানেও কাছাকাছি গিয়ে কোথাও এক জায়গায় বসে লক্ষ করেন, তিনি বলবেন, “না, না; কিছুই থেমে নেই। লিফট, লিফটের আরোহী, তাঁর রুমাল বা বল—সমস্ত কিছুই লিফটের সঙ্গে একই ত্বরিত বেগ নিয়ে এক নক্ষত্রের আকর্ষণে নীচের দিকে ধাবমান। আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি।” অর্থাৎ, আবার সেই নির্দেশাক্ষ অনুযায়ী গতি। লিফটের সাপেক্ষে ভেতরের সব কিছুই আপেক্ষিকভাবে স্থির বা সমবেগে চলমান। আবার বাইরের সেই শিকারীর নির্দেশাক্ষ অনুযায়ী লিফট এবং তার ভেতরের সব কিছুই এক মহাকর্ষজ ত্বরণ সহ নীচে অবাধে পতনশীল। এখানেও মহাকর্ষ আর যান্ত্রিক গতির মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য দেখা যাচ্ছে না। পদার্থবিজ্ঞানের সমস্ত নিয়মগুলি উভয় ক্ষেত্রে একই ভাবে কার্যকর। অর্থাৎ, শুধু সমবেগে গতিশীল নয়, মহাকর্ষ সাপেক্ষে ত্বরিত বেগে গতিশীল নির্দেশাক্ষগুলির ক্ষেত্রেও সেই নিয়মগুলির কোনো ব্যতিক্রম হয় না।

এরকম তিনটি কাল্পনিক পরীক্ষার মাধ্যমে আইনস্টাইন আমাদের বোঝালেন যে মহাকর্ষ আসলে এক রকমের ত্বরিত গতি ছাড়া আর কিছুই নয়। শুধু এই ত্বরণের মান নির্দিষ্ট বস্তুস্থিতির উপর নির্ভর করে।


জ্যামিতির পাঠ

পাঠকদের অনেকেই হয়ত ভাবছেন, বাঃ বেশ সহজেই ব্যাপারটার সমাধান হয়ে গিয়েছিল তো! তাহলে আর এর অঙ্ক অত জটিল হতে গেল কেন? হ্যাঁ, যা বলেছেন! শুনুন মশাই, ধৈর্য, ধৈর্য চাই অফুরন্ত। এই অবধি এসে অনেকগুলো সমস্যার সমাধান হয়ে গেল ঠিকই। কিন্তু এক নতুন উপদ্রব এসে হাজির হল—সেটা খেয়াল করেছেন কী?

নিশ্চয়ই করেননি। আমাদের মতো আম আদমির আদৌ ধরতে পারার কথাই নয়। সেকালেও এমনকি বেশিরভাগ বিজ্ঞানীই পারেননি। নইলে তো আরও অনেকেই আইনস্টাইনের জায়গাটা নিতে পারতেন।

সমস্যাটা হল: এই ত্বরণ কীভাবে সৃষ্টি হয়? বল কে প্রয়োগ করছে? সূর্য যদি পৃথিবীকে দূর থেকে টান দিয়ে না থাকে, পৃথিবী তার দিকে হেলে যায় কেন? নিউটনের হাতে তো একজন ঈশ্বর ছিলেন রামধাক্কা দেবার জন্য। আইনস্টাইন আবার অতটা ঈশ্বরভক্ত নন। তিনিও এক ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখতেন। কিন্তু সে এক নিষ্ক্রিয় জগত-কার্যনিস্পৃহ নিয়মভক্ত জ্ঞানপ্রিয় অলস কিছুই না-করা না-দেখা ঈশ্বর। অনেকটা যেন শার্লক হোম্‌সের সেই দ্বিগুণ-বুদ্ধি দাদা, মাইক্রফট হোম্‌স—আর্থার কোনান ডয়েলের লেখা The Adventure of the Greek Interpreter, সেই গল্পের নতুন নায়কের কথা মনে পড়ছে তো আপনাদের?—তাঁর মতো। বিপুল বুদ্ধি, কিন্তু নড়েচড়ে কিছু করার একেবারেই ইচ্ছা নেই। ওরকম ঈশ্বরকে এত বড় দায়িত্ব দেওয়া যায় না! অতএব এই মহাকর্ষীয় ত্বরণের জন্য কিছু ভৌত উৎস চাই।

আর একটা কারণেও সমস্যাটা বেশ জটিল। তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্র এক অর্থে অস্থায়ী। চুম্বক মেরু বা আহিত বস্তুকে সরিয়ে নিলে ক্ষেত্রও চলে যায়। চুম্বকত্ব বা আধান নষ্ট হলেও তাই। আবার বহু পদার্থই চৌম্বক গুণ বিশিষ্ট নয়। সমস্ত বস্তুও তড়িত পরিবাহী নয়। এছাড়া চৌম্বক বা বিদ্যুৎ পরিবাহীর উপরে কোনো চৌম্বক বা বৈদ্যুতিক পরিবাহী বস্তুর আবরণ দিয়ে দিলে তাদের ক্ষেত্রও আর সেই আবরণের বাইরে অনুভূত হয় না। কিন্তু মহাকর্ষ এত সহজে হার মানে না। সে এক ভয়ানক সর্বজনীন সার্বক্ষণিক বস্তুধর্ম। একমাত্র অন্য মহাকর্ষ ক্ষেত্রে অবাধে পতনশীল বস্তু সাময়িকভাবে তার নিজের মহাকর্ষ ধর্ম হারিয়ে বসে (যেমন সেই লিফটের অবাধ পতনের সময় হয়েছিল)। এছাড়া মহাকর্ষ ধর্ম কখনই বস্তুকে ছেড়ে যায় না।
এই সমস্যার সমাধানের সম্ভাব্য একটি মাত্র রাস্তার দিকে ইতিমধ্যে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন হেরমান মিনকাউস্কি। যিনি বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের এক জ্যামিতিক ভাষ্য নির্মাণ করে ফেলেছিলেন ১৯০৬ সালেই। ইউক্লিদের জ্যামিতিকে তিন থেকে চার মাত্রায় উন্নীত করে। সতর্ক পাঠকের মনে আছে নিশ্চয়ই, আমি আগে একবার, সময়ের মাপ কীভাবে নির্দেশাক্ষের গতির উপরে নির্ভর করে বোঝাতে গিয়ে ফস্‌ করে এই জ্যামিতির প্রসঙ্গ উত্থাপন করে ফেলেছিলাম। এবার কিন্তু সেই কথারই পুনরাবৃত্তি করতে হবে।

আমরা দেখব, আইনস্টাইনও এবার সেই দিকে চোখ ফেরালেন।

আসলে কাজটা নিউটনই শুরু করেছিলেন। তবে অনেকটা আনমনে, অখেয়ালে। সম্পূর্ণ তাৎপর্য হয়ত লক্ষ না করেই। গ্রহের গতি সম্পর্কে ধারণা করতে গিয়ে নিউটনের মনে হয়েছিল, প্রতিটি গ্রহের উপর যেন দুটো বল কাজ করছে। একটা সূর্যের দিক থেকে আসছে, কক্ষপথের অর্থে কেন্দ্রাভিগ (centrifugal force) আকর্ষণ বল। কক্ষপথের কোনো বিন্দুতে স্পর্শকের সঙ্গে উল্লম্ব দিক বরাবর সূর্যের অভিমুখে। আর একটা যেন বাকি বিশ্বের সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্র মিলিয়ে সেই স্পর্শক বরাবর এক বহির্মুখী বল (৯ নং চিত্র দেখুন)।
গ্রহটি এখন কী করবে? সে নিশ্চয়ই এই দুই বলের লব্ধি (resultant) বরাবর যাত্রা করবে।

এই লব্ধি পাওয়া যাবে কী করে? সেও নিউটনেরই আবিষ্কার। জ্যামিতির সাহায্য নিয়েই। এই দুই বলের মান ও দিক ধরে একটা সামান্তরিক আঁকলে তার কর্ণ বরাবর হবে সেই লব্ধি (law of parallelogram of forces)। গ্রহটি সেই বিন্দু থেকে সূর্যের দিকে পুরোটা ঢলে পড়বে না, কিন্তু একটু বুঝি হেলে যাবে। এই ভাবে প্রতিটি পর পর বিন্দুতে লব্ধি এঁকে যেতে পারলে সেই উপবৃত্তাকার পথ পাওয়া যাবে, যার কথা কেপলার বলে গিয়েছিলেন। নিউটনের কাছে এই জ্যামিতি ছিল নেহাতই কাজের সুবিধার ব্যাপার। অঙ্কটা সহজে ধরে ফেলা যায়।
আইনস্টাইনের মনে হল, আচ্ছা, এটাই আসল কথা নয় তো?

অ-ইউক্লিদীয় জ্যামিতির দিকে নজর গেল তাঁর। ইউক্লিদের থেকে এই জ্যামিতিগুলি আলাদা কেন হল? দরকারই বা হল কেন এদের? উনিশ শতকে গাউস, রিমান, লোবাচেভস্কি—এঁরা সব এত সময় ব্যয় করলেন কেন এদের পেছনে?

সেই কারণটা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দেরই আর একজন গণিতবিদ। উইলিয়াম ক্লিফোর্ড। তিনি বলেছিলেন, জ্যামিতি মানে নিছকই বস্তুর আকার প্রকার নয়। বস্তুর নানা রকম ভৌত ধর্মের সাথে জ্যামিতিক আকারের সম্পর্ক রয়েছে। কথাটা সেকালে খুব একটা কেউ আমল দেয়নি। এবার আইনস্টাইন দিলেন।

তখন বোঝা গেল, জ্যামিতি কোনো বিশুদ্ধ কল্পনা নয়। বস্তুজগতকে আমরা যে আকারে দেখি তার মধ্যেই জ্যামিতি নিহিত। ইউক্লিদীয় জ্যামিতি বস্তুজগত থেকে কিছু আকার আকৃতির ধারণাকে বিচ্ছিন্ন করে বিমূর্ত রূপে বোঝার এবং বোঝানোর চেষ্টা করেছিল। তাতে এমনিতে ভুল কিছু ছিল না। সুবিধাই বরং হয়েছে। কিন্তু আবার একটা ভ্রান্ত ধারণাও মনের মধ্যে বাসা বেঁধে ফেলেছিল এতকাল। যেমন, সরল রেখাকে আমরা যদ্দুর খুশি বাড়িয়ে ফেলতে পারি। ত্রিভুজ চাই—নাও না যত বড় ইচ্ছে। একটা সময় থেকে গণিতজ্ঞরা বুঝলেন, না, ইউক্লিদীয় জ্যামিতি হচ্ছে আসলে একটা সুবিধাজনক সংক্ষিপ্তসার। সাদা কাগজে, টেবিলের উপর, রাস্তার এপার-ওপার বরাবর সরল রেখা পেতে চান পাবেন। খুব কিছু অসুবিধা নেই। কিন্তু সমুদ্রের ধারে গিয়ে দাঁড়ান। দূর থেকে আসা নৌকোগুলোকে লক্ষ করুন। আপনার সঙ্গে ওগুলোর সংযোজক কোনো সরল রেখা আঁকা যাবে কিনা ভেবে দেখুন। দেখবেন, না, সম্ভব নয়। আপনার পায়ের তলা থেকে নৌকো পর্যন্ত যে রেখাটি আপনি আঁকবেন, সেটা সরল রেখা হবে না, জলতলের উপর দিয়ে ধীরে ধীরে বেঁকে যাবে (চিত্র নং ১০ দ্রষ্টব্য)।

আর একটা পরিচিত উদাহরণ দিই। প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার দূরবর্তী দিল্লির কুতুব মিনার আর কলকাতার শহিদ মিনারের পাদদেশের মধ্যে ক্ষুদ্রতম রেখাটি কি সরল রেখা হবে? তাকে ইউক্লিদীয় পদ্ধতিতে কি আঁকা যাবে? না। বরং, কেউ যদি সত্যিই আঁকতে যান, তিনি দেখবেন, একটুখানি এগিয়েই মাটি ভেদ করে যেতে হচ্ছে। অথবা, শহিদ মিনারের পাদদেশ থেকে আঁকা সরল রেখা কুতুব মিনারের উপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আর তা নয়ত আপনাকে ভূপৃষ্ঠের উপর দিয়ে দূরত্ব-সূচক রেখাটিকে নিজে থেকেই বেঁকে যেতে দিতে হচ্ছে (চিত্র নং ১১ দ্রষ্টব্য)।
আচ্ছা, এইবার আকর্ষণ জিনিসটাকে নিয়েও ভাবা যাক।

মনে করুন, পৃথিবীর বিষুব রেখার উপরে তিন হাজার কিলোমিটার ব্যবধানে দুই বিন্দু থেকে দুজন ব্যক্তি দুটো দ্রাঘিমা রেখা ধরে সোজা বিমানে চড়ে উত্তর মেরুর দিকে যাত্রা শুরু করলেন। আর অনেক দূর থেকে, একটা কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে কেউ তাঁদের যাত্রা পথের উপর লক্ষ্য রাখছেন। কী দেখবেন তিনি?

প্রথম প্রথম তাঁর মনে হবে, দুজনে সমান্তরাল ভাবে, বিষুব রেখার উপর লম্বভাবে পথ বেছে নিয়ে যাত্রা করেছেন। কিন্তু তাঁরা উত্তরে বেশ খানিকটা এগোনোর পর তাঁর মনে হতে থাকবে, দুজন যেন ক্রমশ পরস্পরের কাছাকাছি এসে পড়ছেন। যত এগোচ্ছেন, বিমানদুটির যদি ত্বরণ থাকে, ততই তাঁদের কাছাকাছি চলে আসার হারও বেড়ে যাবে। যদি ভূপৃষ্ঠের চেহারা তাঁর চোখে খুব স্পষ্টভাবে ধরা না পড়ে, তিনি এও হয়ত তখন ভাবতে শুরু করবেন, বিমানদ্বয় একে অপরকে আকর্ষণ করছে এবং তার ফলে কাছাকাছি চলে আসছে। এমনকি, বিমানদ্বয়ের কাছাকাছি আসার হারকে তিনি এক রকমের মহাকর্ষীয় ত্বরণ ধরে নিয়ে হিসাব কষে বের করে নিতে পারেন। তারপর, নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র দিয়ে এই দুই বিমানের পরস্পর আকর্ষণ বলকে অঙ্ক কষে বের করেও ফেলতে পারেন। তাতে কোথাও একটুও ভুল হবে না। অথচ, তলিয়ে দেখলে, সবটাই কিন্তু বিশুদ্ধ জ্যামিতির ব্যাপার।

এবার আইনস্টাইনের সামনে রাস্তা খুলে গেল। আর প্রায় বন্ধ হয়ে গেল আমাদের বোঝার দরজা। কেন না, অঙ্কটা এবারে এত জটিল আকার ধারণ করল যে আগেরটার মতো অত সহজে তো দূরের কথা, খুব উচ্চমার্গীয় গণিতের সাথে আলাপ পরিচয় না থাকলে দাঁত ফোটায় সাধ্য কার! আইনস্টাইন সাবধান করে দিলেন: “সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সাহায্যে যে কোনো নির্দেশতন্ত্রে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলিকে সিদ্ধ বলে দেখানোর সমস্যার সমাধান করা হল; আগের তত্ত্বে, অর্থাৎ, বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে সমাধান হয়েছিল কেবল মাত্র সমবেগে গতিশীল নির্দেশতন্ত্রের সাপেক্ষে। . . . এই কাজটা যেভাবে করা হয়েছিল তা বলতে গেলে আগের তুলনায় বেশ অনেকটাই অস্পষ্ট হয়ে যাবে। বিজ্ঞানের বিকাশে নতুন ভাবে উত্থিত সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আমাদের তত্ত্ব ক্রমাগত বিমূর্ত হয়ে ওঠে। অপ্রত্যাশিত অভিযানে সামিল হতে হয়। কিন্তু আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য একটাই, বাস্তবের আরও উন্নততর উপলব্ধি। তত্ত্ব যেভাবে পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করে তার যুক্তিশৃঙ্খলে নতুন নতুন গ্রন্থি যোগ করতে হয়। তত্ত্ব থেকে পরীক্ষার দিকে যাওয়ার পথে অপ্রয়োজনীয় কৃত্রিম কল্পনাগুলিকে সরিয়ে দেবার জন্য, আরও নতুন নতুন তথ্যের এলাকায় প্রবেশের স্বার্থে আমাদের এই যুক্তিশৃঙ্খল দীর্ঘতর হতে থাকবে। আর আমাদের প্রাথমিক কল্পনাগুলি যতই গভীরে যেতে এবং সরলতর হতে থাকবে, গাণিতিক যুক্তির প্রক্রিয়া ততই জটিল হয়ে উঠবে; তত্ত্ব আর পর্যবেক্ষণের মাঝখানের পথটা ততই দীর্ঘতর, সূক্ষ্মতর ও জটিলতর হয়ে উঠতে থাকবে।” [Einstein and Infeld 1938, 224-25]

আইনস্টাইন তো বলে খালাশ। আমাদের তাহলে উপায় কী? এত দূর এসেও সরে যাব?

না, উপায় যে একেবারে নেই তা নয়। শুধু চিন্তার প্রক্রিয়াকে আগের তুলনায় আরও একটু বেশি ক্ষুরধার করে তুলতে হবে। ত্রিমাত্রিক জ্যামিতির সঙ্গে প্রথমে বিভিন্ন বস্তুর বাহ্যিক আকৃতিগত ধর্মকে বুঝে ফেলতে হবে। তারপর তার সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন বস্তুর ভৌত-রাসায়নিক ধর্মকেও বুঝে নিতে হবে। কার্বন অণুগুলোর বিভিন্ন জ্যামিতিক বিন্যাসের ফলেই যে কোনোটা হয় কয়লা, কোনোটা হয় গ্রাফাইট আর অন্য কোনোটা হয়ে ওঠে হীরা—এ যদি আমরা খেয়াল করি তখন জ্যামিতি এক অন্য মাত্রা নিয়ে আমাদের চোখে ধরা দেবে। সমতল আয়না উত্তল লেন্স আর অবতল লেন্স যে বিভিন্ন রকম ছবি দেখায় তার পেছনেও যে জ্যামিতির খেলা রয়েছে তখন আমাদের চট করে মনে পড়ে যাবে। এমনকি ইলেকট্রন প্রোটন মেসন গ্লুওন কোয়ার্কেরও অনেক কিছু জিনিস জ্যামিতি দিয়েই যে ভালো বোঝা যায় সে কথাও মনে রাখতে হবে। আপনার আমার শরীরে কোন অণুর সাথে কোন অণুর বিক্রিয়া হবে, কারা রক্তে মিশে যাবে, কারা কারা বাথরুমে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেবে, ওষুধের অণুগুলি কীভাবে শরীরের কোথায় কীভাবে কাজ করবে—যদি শোনেন, তাও একে অপরের জ্যামিতির উপর নির্ভরশীল, তখন আপনার অনুভূতি কেমন হবে?

হ্যাঁ, সেই অনুভূতি দিয়েই বাকিটা বুঝতে হবে। ধীরে ধীরে। তার আগে এই অবধি এসে কী কী বুঝে নিলাম এখানে আর একবার পরিষ্কার করে বুঝে নিই। পরপর কয়েকটা জিনিস মনে রাখুন:
এক, মহাকর্ষ বস্তুজগতের এক সর্বত্রগামী ভৌত পরিঘটনা।
দুই, ত্রিমাত্রিক জ্যামিতিও সমস্ত পদার্থের এক সর্বব্যাপক আকার ও আচরণগত বৈশিষ্ট্য। [Vladimirov, Mitskievich and Horsky 1987, 29-30]
তিন, অতএব মহাবিশ্বের অন্যতম লক্ষণ হিসাবে মহাকর্ষের জন্যও জ্যামিতির কথা ভাবতে হবে।
চার, কিন্তু মহাবিশ্ব মানেই হল দেশ ও কাল মিলিয়ে এক চতুর্মাত্রিক সন্ততি (four-dimensional space-time continuum)।
পাঁচ, অতএব মহাকর্ষের জন্য দেশ-কাল মিলিয়ে এক চতুর্মাত্রিক জ্যামিতি নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে।
আগেই বলেছি, মিনকাউস্কি ইতিমধ্যেই এরকম জ্যামিতির কথা ভেবেছিলেন এবং তার গাণিতিক রূপ তৈরিও করে ফেলেছিলেন। সেই বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদের জ্যামিতি হল আসলে চতুর্মাত্রিক ইউক্লিদীয় জ্যামিতি। যা এক অর্থে বস্তুজগতের চার মাত্রায় সমতলের প্রতিনিধিত্ব করে। তার প্রতিটি বিন্দু দিয়ে অঙ্কিত চারটি অক্ষ পরস্পর সমবেগে গতিশীল এক একটি নির্দেশাক্ষকে বোঝায়। অর্থাৎ, তারা কার্যত অভিন্ন। কিন্তু, এবারে যে জ্যামিতির কথা ভাবতে হচ্ছে তার বিভিন্ন বিন্দুতে অঙ্কিত চার-অক্ষ বিশিষ্ট নির্দেশতন্ত্রগুলি প্রত্যেকটাই এক একটি স্বতন্ত্র নির্দেশাক্ষ। এক এক রকম ত্বরণের সাপেক্ষে। অসমতল বা অ-ইউক্লিদীয় চতুর্মাত্রিক জ্যামিতি। সেই জ্যামিতির বক্রপৃষ্ঠতলই মহাকর্ষ ক্ষেত্রকে ধারণ করে।
কী হল ব্যাপারটা? সহজ হতে হতেও আবার কেমন যেন গোল পাকিয়ে গেল মনে হচ্ছে!

আচ্ছা, ঠিক আছে। অন্যভাবে এগোনো যাক। আমরা কাগজে যে ছবি আঁকতে পারি, তা দুই মাত্রার জ্যামিতি। নানা রকম কায়দা করে তাতেই আবার আমরা তিন মাত্রার ছবিও বোঝাতে পারি। চার মাত্রার ছবি কাগজের উপরে এঁকে দেখানো কিন্তু অসম্ভব। একটা চলমান বা অস্থির ত্রিমাত্রিক ছবি দেখাতে হবে। আপাতত সেই চলমান ছবিটির একটা বিশেষ মুহূর্তের ছবি দেখানোর চেষ্টা করি। ছবিটা আইনস্টাইনই এঁকে দিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি তো জানতেন, আমাদের মতো লোকপ্রিয় ভাষ্যকাররা না বুঝে অনেক উল্টোপাল্টা কাণ্ড করে বসতে পারে। অতএব ঝুঁকি নেননি।

একটা নাইলনের বড়সড় চাদরের কথা ভাবুন। শামিয়ানার মতো করে টাঙানো আছে। বেশ টান-টান দেখাচ্ছে। এবার এর উপরে একটা বড় কাঠের গোলাকার বল এনে রাখা হল। কী হবে?

কেন, বলটা মাঝখানে চলে আসবে আর সেখানটায় একটা গর্ত মতো করে জমিয়ে বসে যাবে (চিত্র নং ১২ দেখুন)।
আইনস্টাইন বললেন, যথার্থ। দেশকালে যদি কিছু না থাকত সেও অমনি টানটান সমতলের মতো হয়েই থাকত। কিন্তু বস্তু আছে তো। আর যেখানেই বস্তু আছে, সেখানেই সে তুবড়ে যায়। সময়ের সাপেক্ষে অন্যান্য অবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে সেই তোবড়ানোটা বাড়ে কমে। এইবার সেই চাদরের এক ধারে একটা মার্বেল গুলি এনে রেখে দিন। সেটার কী অবস্থা হবে? যেখানেই ছেড়ে দিলেন, সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে? না। সাধারণ বুদ্ধিতেই বোঝা যায়, শামিয়ানার বক্রতল ধরে সেটি কাঠের গোলার দিকে এগোতে থাকবে। ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়বে। যত নীচের দিকে যাবে, গড়ানোর হার বেরে যাবে। নিউটনীয় সেই ত্বরণ। মনে আছে তো? তা, সেই রকমই ঘটতে থাকবে।
সূর্য পৃথিবীকে অনেকটা এইভাবেই নিজের দিকে টানছে।
“কিন্তু . . . !”

থাক থাক, বলতে হবে না। বুঝে গেছি কী জিগ্যেস করতে চাইছেন।
আরে মশাই, আমিও যেদিন প্রথম এই জিনিসটা শুনেছিলাম, একই প্রশ্ন করেছিলাম। হ্যাঁ, খুব স্বাভাবিক। আমাদের এই সব জটিল জিনিস বুঝতে যথেষ্ট সময় লাগে। আমরা একবারে সবটা ধরতে পারি না। “কিন্তু মা-ধরিত্রী তো একেবারে গড়িয়ে সূর্যমামার কোলে পড়ে যায় না! সে তো ঘুরতেই থাকে, চলতেই থাকে। তার কী ব্যাখ্যা দেবেন?” কি, ঠিক বলেছি না?

আসলে যদি মহাবিশ্বের বা এমনকি সৌরজগতের শামিয়ানায় শুধু সূর্য আর পৃথিবী থাকত, এবং তারা স্থির অবস্থায় থাকত, তাহলে জ্যামিতিটা অনেক সরল হত, পৃথিবী ওই মার্বেল গুলিটার মতোই গড়িয়ে একেবারে পড়েই যেত। কিন্তু এদিক ওদিক করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তো আরও অনেক কিছু। কতগুলো গ্রহই তো আছে। এদের ভারেও যে ব্রহ্মাণ্ড-রূপী শামিয়ানায় নানা জায়গাতে গর্ত তৈরি হয়ে উঁচুনীচু হয়ে আছে। আর এদের দূরত্ব আবার সূর্যের তুলনায় পৃথিবীর থেকে অনেক কম। ফলে এদের যার যার সৃষ্ট বক্রতলের নীচের দিকেই পৃথিবীর অবস্থান। গড়িয়ে পড়ার হারও সেই অনুপাতে বেশি। আর, এই সমস্ত কিছুই গতিশীল। তার ফলে, পৃথিবী কার দিকে কতটা গড়াবে, সেটাও এই সমস্ত গতিশীল জ্যোতিষ্কের বক্রতলের মধ্যেকার ওঠানামার অবস্থা ও পরিমাণ দিয়ে ঠিক হয়। ফলে কখনই সে একেবারে পুরোটা সূর্যের দিকে (বা অন্য কারোর দিকেই) ঢলে পড়ে না। বাকিরা সকলে মিলে তার জন্য মহাবিশ্ব-জ্যামিতির চতুর্মাত্রিক বক্রপৃষ্ঠে যে ন্যূনতম দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট পথরেখা তৈরি করে দেয়, পৃথিবী সেই পথ ধরেই চলতে থাকে। অন্যান্য গ্রহের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। গোটা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি জ্যোতিষ্কের জন্যও একই রকম ব্যবস্থা। এই হল গিয়ে ঘটনা!

যখন বস্তুগুলো ছোট ছোট এবং/অথবা তাদের মধ্যেকার দূরত্ব অনেক—অর্থাৎ, একটা বিশেষ বস্তুকে ধরলে সে যে পথ দিয়ে গড়াচ্ছে সেটা খুব একটা বক্র বা উঁচুনীচু নয়, সেই সব ক্ষেত্রে নিউটন এবং আইনস্টাইনের গণনা একই ফল দেবে। আপনি নিউটনের সহজ ফরমুলা ধরেই কাজ গুছিয়ে নিতে পারবেন। বলের পরিমাণ কম বলে কোনো ভুলটুল চোখে পড়বে না। জ্যামিতি-ট্যামিতি না ধরে বল এবং দূরবর্তী ভুতুড়ে ক্রিয়া ধরে কাজ করলেও মহাভারত (বা অন্য যে কোনো প্রাচীন গ্রন্থ) অশুদ্ধ হবে না। এই জন্যই এতকাল নিউটনের ফরমুলায় কিছুই অসুবিধা হয়নি। কিন্তু যখন বস্তুগুলো ভারি ভারি এবং/অথবা তাদের মধ্যে দূরত্ব তুলনামূলকভাবে অনেক কম—অর্থাৎ, ব্রহ্মাণ্ডের শামিয়ানা যেখানে ঘন ঘন বা অনেক বেশি তুবড়ে যাচ্ছে, সেই সব জায়গায় নিউটনের সূত্র ধরে কাজ করলে ভুলের পরিমাণ বেড়ে যাবে। তখন আইনস্টাইনের সূত্র ব্যবহার বাধ্যতামূলক।

দুটো উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
একটা বুধ গ্রহের চলন সম্পর্কিত গণনা। পাঠকরা অনেকেই হয়ত জানেন যে গ্রহগুলো যখন সূর্যের চারদিকে উপবৃত্তাকার পথে ঘোরে, তখন একেবারে নিখুঁতভাবে নিজ অক্ষের চারধারে ঘুরে ঘুরে চলে না, একটু নেচে নেচে চলে, মাথাটা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চলে। এই ঘোরানোর একটা হিসাব বিজ্ঞানীরা করতে পারেন। করেও থাকেন। অন্য গ্রহগুলোর ক্ষেত্রে নিউটনের ফরমুলা ধরে গণনা করে দেখা গিয়েছিল, পর্যবেক্ষণের সঙ্গে তাত্ত্বিক গণনার খুব একটা তারতম্য হয় না। দিব্যি মিলে যায়। কিন্তু বাধ সাধল বুধ গ্রহ। তার বেলায় হিসাব কিছুতেই বিজ্ঞানীদের খুশি করার মতো নিখুঁত হচ্ছিল না। পর্যবেক্ষিত হিসাবের থেকে ফাঁক অনেকটাই বেশি হয়ে যাচ্ছিল। কেন মিলছিল না, তার কারণও সঠিকভাবে বোঝা যাচ্ছিল না। এইবার আইনস্টাইনের তত্ত্ব প্রয়োগ করে যে হিসাব পাওয়া গেল, তা কিন্তু পর্যবেক্ষণের সঙ্গে খুব সুন্দরভাবে মিলে গেল। আর উপরি লাভ হল, আগের হিসাবের গণ্ডগোলের কারণও বোঝা গেল। বুধ সূর্যের সব চাইতে কাছের গ্রহ। সূর্যের তুলনায় বুধের ভর অত্যন্ত কম হলেও নৈকট্যের কারণে মহাকর্ষের সক্রিয়তা (অর্থাৎ, দেশ-কালের বক্রতা জনিত আঁকাবাঁকা ভ্রমণ)-ও খুবই বেশি। ফলে নিউটনের তত্ত্ব অনুযায়ী বুধ আর সূর্যের মধ্যে ক্রিয়াশীল আকর্ষণ বল ধরে যে হিসাব পাওয়া যায়, তাতে এই বাড়তি ঝঞ্ঝাটের অঙ্কটা ঢোকে না বা ঢোকানো যায় না। এই হল গিয়ে না মেলার সেই রহস্য। এতে বোঝা গেল, আইনস্টাইনের জটিল অঙ্কটা বিজ্ঞানের স্বার্থে একটা যথার্থ প্রয়োজনীয় অগ্রগতি।

দ্বিতীয়টা ঘটনাটি নানা কারণে আরও চমকপ্রদ। শোনা যায় ১৮০৪ সাল নাগাদ একজন জার্মান বিজ্ঞানী, জোহান গেওর্গ ফন সোল্ডনার, বলেছিলেন, বড় এবং ভারি বস্তুর মহাকর্ষের প্রভাবে আলোর পথও বেঁকে যেতে পারে। আইনস্টাইনের ভর-শক্তি তুল্যাঙ্ক সূত্র আবিষ্কারের পর নিউটনের সূত্র প্রয়োগ করে সোল্ডনারের বক্তব্য অনুযায়ী হিসাব করে দেখা যায়, কতটা বাঁকতে পারে।. [Soldner 1804; Vladimirov et al. 1987, 69; & Narlikar 1980, 157] আইনস্টাইনও বলে বসলেন, দূরবর্তী তারার আলো সূর্যের পাশ দিয়ে আসার সময় দেশ-কালের বক্রতার কারণে বেঁকে যায়। কোন তারার আলো কতটা বেঁকে যেতে পারে, তাঁর তত্ত্ব

থেকে সেটা বের করাও গেল। এবার একটা সুযোগের অপেক্ষা। মেপে দেখতে হবে কোন হিসাবটা ঠিক। সুযোগ এসে গেল তিন বছরের মধ্যেই। ১৯১৯ সালের ২৯ মে। পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ। দেখা যাবে দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে। সেই সময় সূর্যের কাছাকাছি কোণে থাকবে এমন একটি তারাপুঞ্জ হায়াড-নক্ষত্র থেকে আসা আলোকে দিনের বেলায় গ্রহণের সময় একবার, আর ছমাস আগে বা পরে রাতের আকাশ দেখে আর একবার ছবি তুলে রাখলেই পরে মেপে দেখা যাবে, ওই দিন দিনের বেলায় সে কতটা বেঁকে গিয়েছিল। অতএব, চল . . . না, দিল্লি নয়, পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধ!

তবে জার্মানির তখন ভিখিরির দশা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হেরে গিয়ে জয়ী মিত্রশক্তির কাছে যুদ্ধপণ দিতে দিতে তার অর্থনীতির তখন নাভিশ্বাস উঠেছে। এরকম কোনো বৈজ্ঞানিক অভিযানে ঢালবার মতো অঢেল পয়সা তার নেই। তাতে কী হল? যুদ্ধের পরম শত্রু দেশ ইংল্যান্ড থেকে উদ্যোগ নিলেন আর্থার এডিংটন (বিজ্ঞানীদের দেশাত্মবোধ আবার বেশ কম। নিজের দেশের জন্য যুদ্ধ করলেও শ্ত্রু দেশের বিজ্ঞানীদের প্রতি ভীষণ টান থাকে তাঁদের। আর সত্যের প্রতি প্রেম তো ভয়ানক রকম বেশি)। রয়াল অ্যাস্ট্রনমিক্যাল সোসাইটিকে বুঝিয়ে সুজিয়ে তিনি দুটি পর্যবেক্ষক টিম গঠন করলেন। একটা দল গেল ব্রাজিলে। আর একটা দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে একটা দ্বীপে। ছবি তুলে আনলেন তাঁরা। ছমাস পরে আবার ছবি তোলা হল। অঙ্ক কষে হিসাব করে দেখা গেল, তাঁদের পর্যবেক্ষণে প্রাপ্ত হিসাব নিউটনীয় গণনা থেকে প্রাপ্ত চ্যুতির তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ; আর, আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের তাত্ত্বিক গণনার সাথে প্রায় মিলে যাচ্ছে (চিত্র নং ১৩ দ্রষ্টব্য)।
সেই থেকেই হুলুস্থুলু কাণ্ড!

এখানে সোল্ডনারের কথা কীভাবে জানা গিয়েছিল সেই ব্যাপারে একটা মজার ঘটনা উল্লেখ করে যাওয়া দরকার। আইনস্টাইন মহাকর্ষ ক্ষেত্রে আলোকের বেঁকে যাওয়ার এই সম্ভাবনার কথা প্রথম বলেন ১৯১১ সালে, নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব ও তাঁর বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ভিত্তিতে। পরে ১৯১৬ সালে তিনি এই হিসাব সংশোধন করেন। এর কিছুদিন পরে জার্মানির আর একজন প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী, ফিলিপ লেনার্ড, আইনস্টাইনের বিরুদ্ধে ১৯২১ সালের একটি বিজ্ঞানপত্রে অভিযোগ করেন, তিনি নাকি সোল্ডনারের কাজ চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন।

পরবর্তীকালে যাঁরা এই অভিযোগ নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন, তাঁরা দেখেছেন, আইনস্টাইনের পক্ষে সোল্ডনারের কাজের কথা জানা না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। দ্বিতীয়ত, আলোকের বেঁকে যাওয়ার প্রসঙ্গটি বাদ দিলে আইনস্টাইনের মূল তত্ত্ব ও তার প্রয়োগের সঙ্গে সেই কাজের সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে। সুতরাং, বড় জোর একে একটা অনিচ্ছাকৃত বা অজ্ঞতাপ্রসূত অনুল্লেখ বলে অভিহিত করা যেতে পারে, ধারণা বা যুক্তি চুরির কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

লেনার্ডেরও একথা না বোঝার কথা নয়। আসলে তিনি প্রচণ্ড ইহুদি বিদ্বেষে ভুগতেন বলে আইনস্টাইনের খ্যাতির দীপ্তি সহ্য করতে পারছিলেন না। সেই বিদ্বেষ থেকেই এরকম একটি অন্যায় অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন। পরবর্তীকালে লেনার্ড অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে হিটলারের নাৎসি দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং আইনস্টাইনকে জার্মানি থেকে বিতাড়নের ক্ষেত্রে প্রধান পাণ্ডা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

মহাকর্ষীয় তরঙ্গ

তবে সেটাও শেষ নয়। এই সেদিন, গত ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সারা পৃথিবীতে একটা খবর আবার নতুন করে তুমুল উত্তেজনা ছড়াল। শোনা গেল, আইনস্টাইন বলে যাওয়ার একশ বছর পরে শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা কৃষ্ণগহ্বর থেকে আগত মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। আইনস্টাইনের এরকম একটা ভবিষদ্বাণী এতদিনে সঠিক প্রমাণিত হল।

স্বভাবতই হইচই শুরু হয়ে গেছে খবরটা নিয়ে। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব কী এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যা এই সেদিন নিশ্চিতভাবে পর্যবেক্ষণের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে গেল? প্রশ্নটা বিভিন্ন গণ-মাধ্যমে খানিকটা ভুলভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে; উত্তরটাও তার ফলে ভুল বা নিদেন পক্ষে অপর্যাপ্ত হতে বাধ্য। মনে রাখতে হবে, কৃষ্ণগহ্বর জাতীয় কোনো কিছুর কথা আইনস্টাইন বলেননি বা এমনকি ভাবেনওনি। তিনি যা বলেছিলেন তা হল: ম্যাক্সওয়েল সমীকরণ থেকে যেমন তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের হদিশ পাওয়া যায়, সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে তেমনই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্ব ও অঙ্কের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, তড়িচ্চুম্বক তরঙ্গ মানে যেমন তড়িচ্চুম্বক ক্ষেত্রের এক বিন্দু থেকে দূরস্থিত অপর কোনো বিন্দুতে একটা আলোড়নের ছড়িয়ে পড়া, মহাকর্ষের ঢেউ মানেও তেমনই দেশ-কাল চতুর্মাত্রিক জ্যামিতিতে কোনো বিন্দুতে ওঠা একটা ওঠানামা তার আশেপাশের বিন্দুগুলিতে ছড়িয়ে পড়া। এই দেশ-কাল জ্যামিতির ওঠানামা কখন ঘটে? যখন কোনো একটা ভারি বস্তু (যে কোনো কারণেই হোক) দ্রুত স্থান বদল করে। এই স্থান বদলের ফলে সেখানে সেই সংশ্লিষ্ট বস্তুর কিছু না কিছু শক্তিক্ষয় ঘটবে যা আবার মহাকর্ষীয় তরঙ্গ রূপে ছড়িয়ে পড়বে। তখন সেই সব জ্যোতিষ্ক থেকে আসা আলোক তরঙ্গগুলির উপরেও তার কিছু না কিছু প্রভাব পড়বে। যদি কোনো একটা আলোকিত বস্তু থেকে নির্গত আলোকের এই রকম কিছু প্রত্যাশিত পরিবর্তন পৃথিবীতে বসে দেখা যায়, তাহলে অঙ্ক কষে হয়ত বোঝা যাবে, সেই আলোক প্রদানকারী বস্তুটির কাছে থাকা অন্য আর একটি ভারি বস্তু দ্রুত স্থান পরিবর্তন করার ফলে তারা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ উৎপাদন করে চলেছে। (আসলে বলতে হবে, চলেছিল। যা আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি, তা আসলে লক্ষ লক্ষ বা কোটি কোটি বছর আগেকার ঘটনা।)

আর একটা ঘটনার কথা এখন অনেকেই হয়ত ভুলে গেছেন। ১৯৭০-এর দশকে আমেরিকান জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী, জোসেফ টেলর এবং তাঁর ছাত্র রাশেল হাল্‌স, দুটো পরস্পর যুগ্মভাবে ঘুর্ণায়মান নিউট্রন তারাকে দেখে তাদের মধ্যে একটার (যেটা ছিল আদতে একটি পালসার) থেকে নির্গত আলোর ঝলকের (খুব সামান্য হলেও) সময়ান্তর লক্ষ করেন। তার ভিত্তিতে তখন তাঁরা সেই পালসারের আবর্তনকাল নির্ণয় করে ফেলেন। তারপর তাঁদের চোখে পড়ে, সেই আবর্তন কাল ধীরে ধীরে কমে আসছে। তাঁরা অনুমান করেন, পালসারটি ঘুরতে ঘুরতে শক্তি হারিয়ে অপর নিউট্রন তারাটির দিকে গড়িয়ে পড়ছে। এই শক্তি হ্রাসের পরিমাণ হিসাব কষে তাদের থেকে উৎপন্ন মহাকর্ষের তরঙ্গ সম্পর্কে একটা পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। কেন না, এই শক্তিই আসলে এদের পারস্পরিক স্থান বদলের চতুর্মাত্রিক জ্যামিতিক আলোড়ন হিসাবে, অর্থাৎ, মহাকর্ষীয় তরঙ্গরূপে ছড়িয়ে পড়ছে। সেই দুজন বিজ্ঞানী সেটা দেখে ও দেখিয়ে (এবং আরও অনেক কিছু বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম করে) তার সুবাদে ১৯৯৩ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। [পাল ২০১১, ১৩৩-৩৬]

এবারকার ঘটনা কিন্তু সেই তুলনায় আরও অনেক বেশি চমকপ্রদ এবং নাটকীয়! এবারে আর নিছক আলোক সঙ্কেত নয়, সরাসরি দুটো কৃষ্ণগহ্বরের পারস্পরিক দ্রুত স্থান বদলের ফলে চতুর্মাত্রিক দেশ-কাল জ্যামিতিতে সেই অনুযায়ী দ্রুত ওঠানামার কম্পনই পৃথিবীর বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে এসে পৌঁছেছে। অর্থাৎ, আইনস্টাইনের দেশ-কাল বিষয়ক তত্ত্বটি আরও গভীরভাবে, আরও প্রত্যক্ষভাবে সত্য প্রমাণিত হল। ১৩০ কোটি বছর আগের ঘটনা এটা, যা বিজ্ঞানীরা এখন দেখতে পেলেন। দুটি কৃষ্ণগহ্বর, সূর্যের তুলনায় একটি ২৯ গুণ, আরেকটি ৩৬ গুন ভারি, যারা একে অপরকে কেন্দ্র করে ঘুরছিল, তারাই নাকি এক সময় ঘুরতে ঘুরতে একজন আর একজনের ঘাড়ে এসে পড়ে এবং ধীরে ধীরে পরস্পর মিলে যায়। কিন্তু মজা হচ্ছে, তখন তাদের মিলিত ভর দাঁড়াল কত জানেন? ৬২ খানা সূর্য-সমান। অর্থাৎ, তিন সূর্য সমান ভর পর্যবেক্ষণে প্রাপ্ত হিসাব অনুযায়ী শক্তিতে পরিণত হল। সে তো আর চুপ করে এক জায়গায় বসে থাকবে না। সেই শক্তিই মহাকর্ষ তরঙ্গের আকারে আলোকের গতিবেগে মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। চলতে চলতে আমাদের এই পৃথিবীতে সেই ঢেউ এসে পৌঁছল ১৩০ কোটি বছর বাদে এত দিনে (চিত্র নং ১৪ দ্রষ্টব্য)।

হ্যাঁ, আর সেই ঢেউ এল কিন্তু দেশ-কালের চার-মাত্রা জ্যামিতিতে ক্রমাগত মোচড় দিতে দিতে। পৃথিবীর বুকেও এই মোচড়ের অনুভূতি হল। ধরাও পড়ল। কেন না, বিজ্ঞানীরা এর জন্য খানিকটা প্রস্তুত ছিলেন। শিকারীদের বহু গুণ বেশি ধৈর্য নিয়ে। তাঁরা জানতেন, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আসা মানে তার একটা অন্যতম লক্ষণ হবে দৈর্ঘ্যের মাপ পরিবর্তন। তা সে যত সামান্যই হোক না কেন। কিন্তু তাকে কী দিয়ে মেপে ধরা হবে? সেই সময় ধারে কাছে যে কোনো বস্তু, যাকে দিয়েই মাপা হবে, সেও তো একইভাবে পরিবর্তিত হয়ে যাবে। তার মানে যেমন-তেমন স্কেল দিয়ে মেপে বোঝা যাবে না। সুতরাং আবার সেই আলোকের শরণাপন্ন হলেন তাঁরা। তার গতিবেগ যে কোনো নির্দেশাক্ষ বরাবর যে কোনো দিকেই ধ্রুবক। অতএব, আলোকের এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যেতে যে সময় লাগছে তা অনবরত মাপা হতে থাকলে, কোনো সময়ে যদি দেখা যায়, একই দূরত্ব যেতে বেশি বা কম সময় লাগল, বোঝা যাবে, আপেক্ষিকতার অর্থে দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন ঘটেছে। বিশেষ ধরনের গবেষণাগার তৈরি করা হয়েছে এর জন্য। জার্মানিতে এবং আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে। মাটির তলায় গর্ত করে ইংরেজি ‘এল’-আকৃতির দুটো করে ৪ কিলোমিটার লম্বা সুড়ঙ্গ। এই সুড়ঙ্গগুলির মধ্যে লেজার রশ্মি চলাচলের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তাদের আসা-যাওয়ার সময় বছরের পর বছর ঘড়ি ধরে মেপে যাওয়া হচ্ছে।

সুড়ঙ্গগুলি ‘এল’-আকৃতি কেন?
মনে রাখতে হবে, মহাকর্ষীয় অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ আসছে চতুর্মাত্রিক পথ ধরে। আমরা জানি, ত্রিমাত্রিক জ্যামিতিতে অনুদৈর্ঘ্যের কম্পন (ওঠাপড়া) হয় এক মাত্রায় (উল্লম্ব দিকে), আর তরঙ্গগতির অভিমুখ থাকে অন্য মাত্রায় (অনুভূমিক দৈর্ঘ্য বরাবর)। এই চতুর্মাত্রিক তরঙ্গগতির ক্ষেত্রে কম্পন হয় দেশ-এর দুই মাত্রায় আর তরঙ্গের গতির অভিমুখ থাকে দেশ-এর তৃতীয় মাত্রা বরাবর। কম্পনের এই বৈশিষ্ট্যের ফলে দেশের এক মাত্রায় প্রসারণ হলে অন্য মাত্রায় সঙ্কোচন হয়; আবার পরক্ষণেই প্রথম ক্ষেত্রে সঙ্কোচন হয়ে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে প্রসারণ ঘটে। এইভাবেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের বিস্তার হতে থাকে। এই কথা মাথায় রেখেই ‘এল’-আকৃতির সুড়ঙ্গ বানানো হয়েছিল। একদিকে প্রসারণ (অর্থাৎ, আলোর যাতায়াতে সময় বেশি লাগছে) দেখলে অন্য সুড়ঙ্গ বরাবর সঙ্কোচন (অর্থাৎ, আলোর সময় কম লাগছে) দেখা যাবে। এই দুটো হিসাবের মধ্যেও এমন একটা সূক্ষ্ম সঙ্গতি থাকা দরকার যাতে বোঝা যায়, অন্য কোনো উপদ্রব এসে মাপের তরতম ঘটায়নি। যা ঘটেছে তার জন্য আপেক্ষিকতার ক্রিয়াই দায়ী।

এইভাবে চলতে চলতে গত ২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার সুড়ঙ্গে প্রথম এই প্রসারণ ও সঙ্কোচন জনিত দৈর্ঘ্য পরিবর্তনের হদিশ পান বিজ্ঞানীরা। মনে হল যেন, আলো দুদিকের যাতায়াতে দুরকম সময় নিল। তখন থেকে মাপজোক করতে শুরু করে তাঁরা এই সেদিন নিশ্চিত হলেন, হ্যাঁ, ওরা এসেছিল। ঠিক যেমনটি ভেবেছিলেন সেই ঝাঁকড়া চুলওয়ালা বিজ্ঞানী তাঁর অদ্ভুত সমস্ত জটিল অঙ্কের সাহায্যে। নিশ্চিত হওয়া গেল, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ দেশ-কাল চতুর্মাত্রিক জ্যামিতি অবলম্বন করে সমস্ত বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ছে।

কালে কালে আরও কত কী দেখতে পাব কে জানে!! আপাতত, আমাদের এই গল্পও ফুরচ্ছে না, নটে গাছকেও এক্ষুনি মুড়তে দেওয়া যাচ্ছে না!!! ◙

গ্রন্থপঞ্জি

পাল, পলাশ বরন (২০১১), আইনস্টাইনের উত্তরাধিকার; বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, কলকাতা।
রায়, দ্বিজেশ চন্দ্র (২০০৫), অ্যালবার্ট আইনস্টাইন; বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, কলকাতা।

Einstein, Albert (1916), “The foundation of the general theory of relativity” (in German); Annalen der Physik, 49 (1916).
Einstein, Albert and Infeld, Leopold (1938), The Evolution of Physics; Cambridge University Press, Cambridge.
Einstein Albert (1954), Relativity: the special and the general theory; Methuen & Co., London.
Mukhopadhyay, Ashoke (2009), The Science and Philosophy of Einstein’s Theory of Relativity; Bodhoday Mancha, Kolkata.
Narlikar, Jayant V. (1980), The Structure of the Universe; Oxford University Press.
Soldner, J. G. v. (1804), “On the deflection of a light ray from its rectilinear motion, by the attraction of a celestial body at which it nearly passes by”; Berliner Astronomisches Jahrbuch 1804.
Vladimirov, Yu; Mitskievich, N and Horsky, J. (1987), Space Time Gravitation; Mir Publishers, Moscow.