(ক)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন জন্মগ্রহন করেন তার প্রায় ১৪ বছর আগে পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জন্মের সময় পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স ৪৩ বৎসর। পিতামহ দ্বারকানাথ আরবি এবং পার্সি ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেছিলেন। সংস্কৃত, প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্র, মুসলিম ঐতিহ্য,পারসিক সাহিত্য এবং পাশ্চাত্য ইংরেজি সাহিত্যের সংমিশ্রণ ঘটাতে আগ্রহী ছিলেন দ্বারকানাথ। ব্রিটিশ কায়দাকানুন রপ্ত করেছিলেন নিজের ব্যবসা-বানিজ্য ও জমিদারীর সুবিধার্থে। ধর্মাচরণে তেমন মনোনিবেশ করেছিলেন ব’লে জানা যায় না।

কিন্তু পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম জীবনে ছিলেন প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্র অধ্যয়ণে একনিষ্ঠ।এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়, তাঁর প্রথম জীবনে “ তত্ত্ববোধিনী সভা”-র সাথে সংশ্লিষ্টতা। পন্ডিত রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত “ তত্ত্ববোধিনী সভা” ছিল মূলত সত্যান্বেষী সংঘ, যার লক্ষ্য ছিল প্রাচীন ধর্মশাস্ত্র বিশেষত উপনিষদ অধ্যায়ণের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা প্রচার করা। জানা যায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৪৩ সালে এ “ তত্ত্ববোধিনী সভা”-র পক্ষে “ তত্ত্বাবোধিনী পত্রিকা” প্রকাশও করেছিলেন। প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্র অধ্যয়ণের ফলেই এক সময় তাঁর মনে হয়েছিল, তখনকার প্রচলিত অনেক হিন্দু আচার অনুষ্ঠান প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্র থেকে অনেক বিকৃত। তাই এ প্রচলিত হিন্দু আচার অনুষ্ঠান বর্জনের পক্ষে জোরালো যুক্তি প্রচারের লক্ষ্য নিয়েই তিনি “ব্রাহ্ম সভা” –যা পরবর্তীতে “ব্রাহ্ম সমাজ” নামে পরিচিত , সেখানে যোগদান করেন। এক সময়ে “ব্রাহ্ম সমাজ”-এর তিনটি ধারার অন্যতম একটি ধারা দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি থেকেই পরিচালিত হতো।
এ রকম এক মিশ্র পারিবারিক পরিবেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহন করেন ১৮৬১ সালের ৭ মে। সেদিন ছিল ২৫ বৈশাখ ১২৬৮ বংগাব্দ। নিজের বাঙালি পরিবার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, “ হিন্দু, মুসলমান ও ব্রিটিশ, এ তিন সংস্কৃতির সংগমের ফল”।

(খ)
বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির সংমিশ্রিত পরিবারে জন্ম নিয়েও রবীন্দ্রনাথ কখনোই ভিন্ন ভিন্ন ধর্মকে একটি একীভূত মিলিত ধারায় প্রবাহিত দেখতে আগ্রহী ছিলেন না। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের শেষ জন্মদিনের কিছু আগে লিখিত প্রবন্ধ, যা তাঁর সর্বশেষ প্রবন্ধ, “সভ্যতার সঙ্কট”-সেখানে তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন কিভাবে ধর্মের নামে ভারত হিন্দু-মুসলিম দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছে। তবু তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে কখনোই এ ধারা দু’টো সংমিশ্রণের চেষ্টা করেননি। অনেকে বলে থাকেন, মুগল সম্রাট আকবরের ব্যর্থ প্রচেষ্টা থেকে তিনি শিক্ষা নিয়েছিলেন। কেননা, সম্রাট আকবর “দ্বীন-এ এলাহি” নিজের মহাপ্রতাপশালী ক্ষমতা সত্বেও সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ আগাগোড়া ধর্মীয় ভেদাভেদ থেকে মুক্ত থাকতেই চেয়েছিলেন। তাই তাঁর রচনায় ঈশ্বর এক নৈর্ব্যক্তিকতায় বর্ণিত হয়েছে, সেখানে কারও কোনো বিশ্বাসের সাথে দ্বন্ধ দেখা দেয় না। বরং এক আনন্দ, সুন্দর ও মনোজাগতিক বিকাশ ও প্রশান্তির উপায় হিসেবে ঈশ্বরের দেখা মেলে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ও গানে। এ প্রসংগে গীতবিতানের পূজা পর্বের গানগুলোর উল্লেখ করা যেতেই পারে।

গীতাঞ্জলি ও নোবেল পুরষ্কার রবীন্দ্রনাথকে বিশ্ব তথা পাশ্চাত্য বিশ্বে পরিচিত করে। যদিও রবীন্দ্রনাথ নিজেই তখন একটু দ্বিধায় ছিলেন নিজের রচনার ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে। এ নিয়ে তিনি বন্ধু উইলিয়াম রোদেস্টাইনকে লিখেছিলেন,” আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, কতখানি অনিচ্ছায়,কত দ্বিধা সংকোচের মধ্যে আমি আমার “গীতাঞ্জলির” পান্ডুলিপি আপনার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। এ বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ ছিল না যে আমার ইংরেজির কোনও ছিরি ছাঁদ নেই। তার বাক্যগঠনের জন্য কোনও বিদ্যালয় ছাত্রকে ভর্ৎসনা করা যেতে পারত”।

সেই বন্ধু উইলিয়াম রোদেনস্টাইনকে একবার ইরেজ কবি ফ্রান্সিস কনফোর্ড বলেছিলেন,” রবীন্দ্রনাথের বাহ্যিক রূপ দেখে এখন আমি একজন শক্তিধর ও কোমলহ্রদয় যিশুখ্রিস্টের কল্পনা করতে পারি, যা আগে কখনো পারতাম না”।

এ প্রসংগে জাপানি নোবেল জয়ী সাহিত্যিক ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা তাঁর ইস্কুলে পড়া রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি চারণে বলেছেন,” তাঁর কপালের দু’পাশ দিয়ে সাদা চুলের গোছা আলতো নেমে এসেছে; কপালের ঠিক নীচে দু’পাশে যে চুলের গুচ্ছ সেও দীর্ঘ দু’গাছি দাড়ির মতো নেমে এসে গালের দাড়ির সংগে মিশে এক হয়ে গেছে।ফলে, সেই বালক বয়সে, তাঁকে দেখে আমার মনে হয়েছে তিনি যেন কোনও প্রাচ্যদেশীয় যাদুকর”।

(গ)

রবীন্দ্রনাথের এ “ঋষিকল্প “ চেহারা সারা বিশ্বময় দ্যুতি ছড়ালেও তিনি চিন্তায় ছিলেন আধুনিক ও বাস্তববাদী। এ প্রসংগে গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের তুলনামূলক আলোচনা করে অনেকেই দেখিয়েছেন, সমসাময়িক ভারতীয় দুই “মহত্তম মানুষ” নিজ নিজ ক্ষেত্রে দুই অক্ষ থেকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী আরেক গুনী ব্যক্তিত্ব ডঃ অমর্ত্য সেন তাঁর “ তর্কপ্রিয় ভারতীয়” গ্রন্থে এ নিয়ে বিশদ যে আলোচনা করেছেন, তা প্রনিধানযোগ্য।
প্রধানতঃ দু’টো বিষয় নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর সাথে তুলনা টানতে সবাই পছন্দ করেন। একটি হলো মূর্তিপুজা ও অন্যটি গান্ধীর “চরকায় সুতো কাটা”। বলা বাহুল্য এ দু’টো বিষয়েই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন গান্ধীর বিপক্ষে।

মূর্তিপূজা প্রসংগে ইংরেজ ধর্মযাজক রেভারেন্ড সি, এফ, এন্ড্রুজ তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন,

“ গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে একটি আলোচনার বিবরণ জানা যায়। আলোচনার প্রথম বিষয় ছিল মূর্তি; গান্ধী তার সপক্ষে ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করেন, সাধারণ মানুষ বলামাত্রই নিজেকে বিমূর্ত চিন্তার স্তরে তুলতে পারে না।আর অনন্তকাল বয়ঃপ্রাপ্ত মানুষের সংগে শিশুর মতো আচরণ করাটা রবীন্দ্রনাথ সহ্য করতে পারেন না। পতাকাকে প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করে ইউরোপে যেসব বড় বড় কাজ হয়েছে গান্ধী তার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। রবীন্দ্রনাথ সহজেই সে যুক্তি খন্ডন করেন। কিন্তু গান্ধী নিজের বক্তব্যে অটল থাকেন এবং ইউরোপের পতাকাতে ঈগল ইত্যাদির ছবির সংগে পার্থক্য টেনে তাঁর নিজের চরকা বসানো পতাকার কথা বলেন।“

গান্ধীর চরকায় সুতো কাটার উপদেশের সমালোচনায় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অক্লান্ত। রবীন্দ্রনাথ গান্ধীর এ উপদেশের অর্থনৈতিক অবাস্তবতার কথা উল্লেখ করেছেন। নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ডঃ অমর্ত্য সেন রবীন্দ্রনাথের এ যুক্তিকে সমর্থন ক’রে বলেছেন, “ রবীন্দ্রনাথের মতে, চরকা যে শুধু অর্থনীতির দিক থেকেই অর্থহীন, তাই নয়, মানুষকে গভীরভাবে কোনও বিষয় নিয়ে চিন্তায় প্রবৃত্ত করানোরও কোনও উপায় এর মধ্যে নেই। চরকায় কিছু ভাববার দরকার হয় না। পুরাকালের উদ্ভাবিত একটি যন্ত্রকে বিচারশূন্য ও শক্তিহীনভাবে নিরন্তর চালিয়ে গেলেই হলো”।

বাস্তবতা ও যুক্তিকে রবীন্দ্রনাথ কত প্রাধান্য দিতেন তা তাঁর একটি লেখার উদ্দ্বৃতি থেকেই বোঝা যায়,

“ আমরা যারা প্রায়ই যুক্তিকে অগ্রাহ্য করবার প্রবৃত্তিকে খুবই গর্বের বিষয় বলে মনে করে থাকি, যুক্তির জায়গায় অন্ধ বিশ্বাসকে স্থাপন করে তার খুব গুনগান করি, আধ্যাত্মিক বলে তাকে মুল্য দিই, এর দাম তাদের চুকিয়ে দিতে হয়; আমাদের মনে ও অদৃষ্টে নেমে আসে অন্ধকার”।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ৮০ বছরের জীবনে সচেষ্ট থেকেছেন অন্ধকার থেকে আলোতে উত্তরণের ব্রতে। কী কবিতা, কী গান, কী গল্প –উপন্যাস -প্রবন্ধ কিংবা প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান সবক্ষেত্রেই তিনি প্রাণের মুক্তির কথা, বুদ্ধির মুক্তির কথা বলে গেছেন।

(ঘ)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চেয়েছিলেন তাঁর আশি বছরের জন্মদিনে অন্য কেউ তাঁকে নিয়ে গান লিখুন। তাই যখন তাঁকে বলা হলো, “এবার পঁচিশে বৈশাখে সমস্ত দেশ আপনার জন্মোৎসব করবে, এই দিনকে উপলক্ষ্য করে একটি গান রচনা না হলে জন্মদিনের অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ হয় না”।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উত্তরে বলেছিলেন, “ আমি নিজের জন্মদিনের গান নিজে রচনা করব, লোকে আমাকে বলবে কি। দেশের লোক এত নির্বোধ নয়, ঠিক ধরে ফেলবে যে, নিজের প্রচার নিজেই করছি। চেষ্টা কর এখানে যাঁরা বড় বড় কবি আছেন, তাঁদের দিয়ে গান লেখাতে”। এর পরে কবি নিজেই অনেকের নাম বলে বলেছিলেন, “ তাঁরা কি কবিতা লিখতে পারেন না?”

তাই আশ্চর্য হ’তে হয় যে, কবি জীবিত থাকতে কবিকে নিয়ে গান কিংবা কবিতা রচনা করতে আগ্রহী হননি। অথচ কবির মৃত্যুর পরের এই দীর্ঘ সময়ে বাংলাসাহিত্যের খুব কম কবি-সাহিত্যিকই আছেন যাঁরা রবীন্দ্রনাথের আলোকে নিজেকে আলোকিত করার প্রয়াসী হোননি।

একবার কবি তাঁর জীবনের শেষ বৎসরে আক্ষেপ করে বলছিলেন, “আমি যখন চলে যাব তখন দেশ বুঝবে আমি দেশের জন্য কি করেছি”। এর পরেই নাকি তিনি কিছুক্ষণ নীরব থেকে গেয়ে উঠেছিলেন, “ সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে”।

সবার অনুরোধে কবি নিজেই উদ্যোগী হ’লেন তাঁর আশিতম জন্মদিনের গান রচনা করতে। তাঁর জন্মদিনের কবিতাগুলো এনে দিলে তিনি “পঁচিশে বৈশাখ” কবিতাটির “ হে নূতন দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ” অংশটি একটু অদলবদল করে সুরে সংযোজন করেছিলেন। জন্মদিনের এই গানটিই তাঁর জীবনের সর্বশেষ গান।
আর রবীন্দ্রনাথের এ সর্বশেষ গানটি দিয়েই রবি জন্মোৎসব পালিত হয়ে আসছে ১৯৪১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত। যাঁকে ছাড়া আমাদের ভাষা থেমে যায় শব্দহীন নীরবতায় পঁচিশে বৈশাখ আমাদের প্রতিদিনের সাথী সেই রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন।

সহায়ক গ্রন্থঃ
১। তর্কপ্রিয় ভারতীয়- অমর্ত্য সেন
২।রবীন্দ্রসংগীত- শান্তিদেব ঘোষ