এক
২৫ এপ্রিল ছিল তনুসহ সারা দেশে অব্যাহত গুম-খুন-ধর্ষণ ও বিচারহীনতার প্রতিবাদে সারা দেশে আধা বেলা হরতাল। গুম-খুন-ধর্ষণের প্রতিবাদের এই দিনটিতেই খুনীরা মেতে উঠেছিল হত্যাযজ্ঞে! ২৫ তারিখ বিকালে রাজধানীর কলাবাগানের লেক সার্কাসে ঘরে ঢুকে কুপিয়ে খুন করা হয় জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু এক নাট্যকর্মী মাহবুব তনয়কে। যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির কর্মসূচি কর্মকর্তা জুলহাজ (৩৫) সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সাময়িকী ‘রূপবান’ সম্পাদনায় যুক্ত ছিলেন এবং তার বন্ধু মাহবুব রাব্বী তনয় (২৬) লোকনাট্য দলের কর্মী; হামলায় দুজনে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। অন্যান্য চাপাতি-খুনের মতই খুনীরা যাওয়ার সময় “আল্লাহু আকবার” শ্লোগান দিতে দিতে চলে যায় বলে প্রতিবেশীদের বরাতে আমরা জানতে পাই। আশা করা যায়, শীঘ্রই টুইটারে কিংবা কোন ওয়েবসাইট থেকে আইএস বা আনসার আল-ইসলাম এর দায় স্বীকারের ঘোষণা চলে আসবে। যেরকমটি এই ঘটনার ঠিক দুদিন আগে, মানে ২৩ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপককে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে খুন করার পরে আইএস এর দায় স্বীকার করা বার্তা আমরা পেয়েছিলাম।

অধ্যাপক রেজাউল করিম

অধ্যাপক রেজাউল করিম

জুলহাস মান্নান

জুলহাস মান্নান

মাহবুব তনয়

মাহবুব তনয়

২৫ এপ্রিল দিনটি শুরু হয়েছে গাজীপুরের কাশিমপুর মহিলা কারাগারের সার্জেন্ট ইনস্ট্রাক্টরকে গুলি করে হত্যার মধ্য দিয়ে। এর পর একে আমরা চাপাতি ও কোপাকুপির রক্তাক্ত দুনিয়ায় প্রবেশ করি। রাজধানীর ঘটনা ছাড়াও ঢাকার বাইরে- ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যুবককে গলা কেটে হত্যা, কুষ্টিয়ায় স্কুলশিক্ষককে কুপিয়ে হত্যা, রাঙ্গুনিয়ায় ২ যুবককে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়! ধর্ষণের প্রতিবাদের দিনটিতে কিছু ধর্ষণের চিত্রও তুলে ধরা যাকঃ সিলেটের ওসমানী নগরে “ধর্ষণে বাধা দেয়ায় শিশুকে পানিতে ফেলে হত্যা”, “লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূকে ধর্ষণ”।

এরকম হত্যা-খুন-ধর্ষণমুখর দিনটিতে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কি বসে ছিল? না, মোটেও নয়। হরতালে পিকেটারদের ঠেঙ্গানোর ব্যস্ততার পাশাপাশি তারা দ্রুততার সাথে একত্রে গ্রেফতার ও বিচারের মত কাজেও পারদর্শিতা দেখিয়েছে। খবরটি দেখিঃ “ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাতে ২ শিক্ষকের কারাদণ্ড”! বাগেরহাটের চিতলমারীতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের ঘটনায় স্থানীয় হিজলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ দুই শিক্ষককে ৬ মাস করে কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। দণ্ডাদেশপ্রাপ্তরা হলেন প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণপদ মহলী (৪৬) ও বিএসসি শিক্ষক অশোক কুমার ঘোষাল (৫৫)। সোমবার দুপুরে উপজেলা ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আনোয়ার পারভেজ এই দণ্ডাদেশ দেন। চিতলমারী থানার ওসি (তদন্ত) মো. রবিউল ইসলাম জানান, রোববার দুপুরে হিজলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিএসসি শিক্ষক অশোক কুমার ঘোষাল ১০ম শ্রেণির বিজ্ঞান ক্লাসে হযরত মুহাম্মদ (স.)- কে নিয়ে কটূক্তি করেন। এ ঘটনা নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনার জের হিসেবে সোমবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে কয়েকশ’ শিক্ষার্থীর অভিভাবক স্কুল ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন। পরে বিষয়টি প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণপদ মহলীকে জানালে তিনি ওই বিএসসি শিক্ষকের পক্ষ নিয়ে পুনরায় কটূক্তি করেন।

রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের দেশে হিন্দু শিক্ষক বিজ্ঞান পড়ান, স্কুলের প্রধান শিক্ষক হন- এ কিভাবে মানা যায়!
রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের দেশে নারী যথোপযুক্ত পর্দা করবেন না, অন্তসত্তা নারীর স্ফীত পেট বাইরে থেকে বুঝা যাবে, এ কেমনে মানা যায়!
রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের দেশে নবীকে নিয়ে কটুক্তি- এ কেমনে মানা যায়!
রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের দেশে সমকামী হওয়া, সমকামীদের ম্যাগাজিন বের করা, সমকামীদের রঙধনু র‍্যালী বের করা- এ কিভাবে মানা যায়!

দুই
এরকম ঘটনাবহুল দিনে প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী (ওলামা)লীগ সভানেত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কোন বানী দিবেন না- এতখানি দায়িত্বহীন নিশচয়ই তারা নন। তারা যথারীতি বানী দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন,

“এ ধরনের হত্যাকান্ডের পেছনে কারা রয়েছে সবাই তা জানে। দেশকে অস্থিতিশীল করতে বিএনপি-জামায়াত চক্র এ ধরনের নানা গুপ্ত ও জঘন্য হত্যাকা- চালিয়ে যাচ্ছে”।

রাজশাহীতে শিক্ষক এবং কলাবাগানে বাড়িতে ঢুকে দুজনকে কুপিয়ে হত্যার প্রেক্ষাপটে ২৫ এপ্রিল রাতে গণভবনে দলীয় নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি একথা বলেন।

আর ওদিকে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহেব তার বানীতে জানিয়েছেন, দেশ আমাদের পুরোপুরি নিরাপদ আছে। ৯ দিনে ৪০ চাপাতি-খুনেও আসলে দেশ নিরাপদে থাকতে পারে বৈকি, সেটাই মন্ত্রী সাহেবের মুখ থেকে শুনিঃ

“আমি মনে করি না, সারাদেশে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড চলছে। এটি বিছিন্নভাবে দু-একটা ঘটছে এবং আমাদের দেশে যারা আগে থেকে জঙ্গি তৎপরতায় সম্পৃক্ত ছিল, তাদেরই একটি ভগ্নাংশ কিংবা তারা প্রয়াস পাচ্ছে।”

আইএস কর্তৃক দায় স্বীকারের বার্তাকে ভুয়া বলে উড়িয়ে দিয়ে আসাদুজ্জামান কামাল বলেন,

“প্রত্যেকবার আমরা প্রমাণ করেছি, আইএস-টাইএস নয়, এগুলো আমাদের দেশের ‘হোমগ্রোন’ জঙ্গি। আমরা সব সময় বলি, এগুলো প্রাথমিক অবস্থায় ছিল ছাত্রশিবির, তারপর জেএমবি, তারপর হরকাতুল জিহাদ, তারপর আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আনসার আল ইসলাম। এসব জঙ্গি সংগঠনগুলো একের পর এক তৈরি হয়েছে। আত্মপ্রকাশ করতে চেষ্টা করছে। আমরা নিয়ন্ত্রণ করেছি।”

বানী প্রদানের সাথে সাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জোর গলায় দাবিও করেন,

সবাইকে (জঙ্গি সংগঠন) চিহ্নিত করেছি এবং আমাদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। প্রায় সব হত্যাকাণ্ডের খুনিদের চিহ্নিত করেছি এবং ধরেছি। বিচারের মুখোমুখি করেছি।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী- স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বানী থেকে যে বিষয়গুলো আমরা অনুধাবন করতে পারি, তা হচ্ছেঃ
১/ আমাদের দেশে কোন আইএস, আল কায়দা, আনসার আল-ইসলাম- এদের কোন অস্তিত্ব নেই! সবই মিডিয়ার সৃষ্টি।
২/ খুনী কারা- এটা সকলেই জানে। দিবালোকের মত পরিস্কার। সরকারী তদন্ত- ফদন্তের কোন দরকার নেই।
৩/ বিএনপি- জামাতই যাবতীয় গুপ্ত হত্যা- খুনের (এবং ধর্ষণের সাথেও কি??) সাথে যুক্ত ও জড়িত। ভীষণ ষড়যন্ত্রে তারা লিপ্ত।
৪/ যেহেতু বিএনপি-জামাত হচ্ছে মূল হোতা, আওয়ামীলীগ সরকারকে এইসব নিয়ে বিব্রত করার কিছু নেই। বিএনপি-জামাত হচ্ছে খুনী, শুধু শুধু আওয়ামীলীগ সরকারকে এসব হত্যা, খুন নিয়ে বিরক্ত করা কেন? যান গিয়ে বিএনপি-জামাতকে জিজ্ঞেস করেন।
৫/ এসমস্তই দেশকে অস্থিতিশীল করার লক্ষে বিএনপি-জামাতের গভীর ষড়যন্ত্র।
৬/ কিন্তু, এগুলো খুবই বিচ্ছিন্ন ঘটনা।
৭/ বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো দেশকে অস্থিতিশীল করার লক্ষে হলেও, দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি “আল্লাহর রহমতে মাশা’আল্লাহ” খুব ভালো আছে, খুবই নিরাপদ আছে।
৮/ জঙ্গীরা সব জামাত থেকে উদ্ভুত এবং সব সরকারের নিয়ন্ত্রণেই আছে।
৯/ এখন পর্যন্ত সমস্ত চাপাতি-খুনীকে চিহ্নিত, গ্রেফতার ও বিচার করা হয়েছে, এমন গোপনীয়তার সাথে যে কাকপক্ষী, খুনী কেউই টের পায়নি।
১০/ এসব খুনের ক্ষেত্রে সরকারের কোন দায় নেই। একদমই নেই।

তিন
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল হিসাবে এবং বাংলাদেশের প্রধান দলগুলোর মধ্যে সেক্যুলার বলে পরিচয় দেয়া একমাত্র দল হিসাবে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের প্রতি আমাদের দেশের প্রগতিশীল অংশের দীর্ঘদিনের আশা আকাঙ্খা, ভালোবাসা- সব যেন টলে উঠছে। অনেক প্রগতিশীল বন্ধুই যেন হিসাব মিলাতে পারছেন না। একদম দলান্ধ ও আওয়ামীলীগের সাথে বস্তুগত সুবিধার সম্পর্ক যাদের, তারা বাদে সকলেই আওয়ামীলীগের এহেন আচরণে হতাশ ও ক্ষুব্ধ! যুবলীগ সদস্য নাজিমুদ্দিন সামাদের সর্বশেষ ফেসবুক স্ট্যাটাসটি এখানে উল্লেখ করা যায়। নিজের প্রাণ দিয়ে আইন শৃঙ্খলার অবনতি ও জঙ্গীবাদের উত্থান প্রমাণ করার আগে তিনিও সরকারের উদ্দেশ্য বলে গিয়েছেনঃ

‘সরকার, এবার একটু নড়েচড়ে বসো বাবা। দেশের যা অবস্থা, আইনশৃঙ্খলার যা অবনতি, তাতে গদিতে বেশিদিন থাকা সম্ভব হবে না। জনরোষ বলে একটা কথা আছে। এটার চূড়ান্ত পরিণতি দেখতে না চাইলে এক্ষুনি কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার সকল অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে। নতুবা দিন ফুরিয়ে আসবে খুব দ্রুত।’

একটি জায়গা আমাদের প্রগতিশীলরা বুঝতে ভুল করছেন বলে অনেকেই অবাক হচ্ছেন, কান্নাকাটি করছেন, আওয়ামীলীগ সরকারের বোধোদয়ের আশা করছেন এবং সবক দিচ্ছেন! কেউ কেউ বলছেন, সরকার প্রকৃত বন্ধুদের চিনছে না, তাজউদ্দীনকে ফেলে মোশতাককে পুষছে, হেফাজতকে যতই দুধ কলা দিয়ে পোষা হোক, তারা কোনদিন নৌকায় সিল মারবে না, উল্টো সময় সুযোগে ছোবল মারবে …

বাস্তবে, আওয়ামীলীগ এইসবই জানে ও বুঝে! জেনে বুঝেই সে এই লাইনে এগিয়েছে .. এই বিষয়টা আমাদের প্রগতিশীল বন্ধুরা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন, তত তাড়াতাড়ি তাদের মোহ পুরোপুরি দূর হবে!

হেফাজত ওরফে ওলামা লীগে পেটে ঢুকে যাওয়া বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ

হেফাজত ওরফে ওলামা লীগের পেটে ঢুকে যাওয়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

প্রথমত বুঝতে হবে, আওয়ামীলীগ কোনভাবেই ভোট বা নির্বাচন নিয়া ভাবিত না, অর্থাৎ সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচন তার দূরতম পরিকল্পনাতেই নেই! তার এমনই আত্মবিশ্বাস যে, বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক এর দাবিতে বা সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে এই সরকারকে সামান্য টলাতে পারবে বলে তারা মনে করে না! সেইরকম সামান্য সম্ভাবনা দেখলেই বিএনপি জামাতকে আরো কোনঠাসা করার সক্ষমতা তাদের আছে বলে তারা বিশ্বাস করে! আর কেউ নেই যে যারা দেশে গণতন্ত্র, নির্বাচনের অর্থেও গণতন্ত্র আনয়নের জন্য বড় রকম আন্দোলন গড়ে তোলার সামর্থ্য রাখে!

দ্বিতীয়ত বুঝতে হবে, ভোট নির্বাচন এসব না থাকলে প্রগতিশীল বন্ধুদের কোন প্রয়োজন আওয়ামীলীগের কাছে নেই! এরা সরকার উৎখাতের মত কোন ক্ষমতা রাখে না বলে এদের রাগ অভিমান ক্ষোভের কোন গুরুত্ব নেই! এই অংশটুকু আওয়ামীলীগের কাছে ভোটের রাজনীতিতে মধ্যবিত্ত ও তরুন প্রজন্মকে আকর্ষণ করতে দরকার, কিন্তু ভোটহীন ব্যবস্থায় মধ্যবিত্ত বা তরুন প্রজন্ম কোনটাই থ্রেট নয়! তাছাড়া, কিছু পোষা প্রগতিশীল দিয়ে কাজ চালানোর বুদ্ধি যেমন আছে, তেমনি সে বিশ্বাস করে আওয়ামীলীগ এর বিপরীতে বিএনপি – জামাত – জঙ্গি জুজুর ভয়ে এই প্রগতিশীল বন্ধুরা এবং সংখ্যালঘু অংশ কখনোই বিএনপি জামাতের পক্ষ নিবে না!

তৃতীয়ত বুঝতে হবে, এইরকম ভোটবিহীন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তার জন্য বড় থ্রেট কি? তত্বাবধায়ক সরকার ও গনতন্ত্রের দাবিতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন নিয়া তার কোন হেডেক নেই! বিএনপির মুরোদ জানা আছে, সেটা আগেই বলেছি! আওয়ামীলীগকে এইসব দিয়া নামানো যাবে না বলে মনে করে, একমাত্র পুরা দেশজুড়ে তান্ডব তৈরি করে দেশকে অচল করে সরকারকে উতখাত করা ছাড়া উপায় নেই বলে তারা মনে করে! সেই জায়গা থেকে তারা তিনটা থ্রেট চোখে দেখে –
এক/ হেফাজত ও ইসলামিস্টরা
দুই/ সেনাবাহিনী
তিন/ বিদেশী সমর্থন
এটা ভালোভাবে বুঝে বলেই, তারা এই তিনটাকেই পুরো তোয়াজের উপরে রাখে! এবং কোন তোয়াজের মূল্যই কম নয় ..

চার
ছেলেবেলায় রূপকথার গল্প পড়েছিলাম যেখানে এক রাজত্বে রাক্ষস এসে পড়ায় রাজা নিজে টিকে থাকার জন্য রাক্ষসের সাথে রফাদফা করে চুক্তির মধ্য দিয়ে, সেই অনুযায়ী সে প্রতিরাতে পর্যায়ক্রমে প্রজাদের রাক্ষসের হাতে তুলে দেয়া শুরু করে, এমনকি নিজ সন্তানকেও মানে রাজকন্যাকে রাক্ষসের হাতে তুলে দিতে দ্বিধা করে না! আমাদের রানী একটা না, তিনটি রাক্ষসের হাতে আমাদের তুলে দিয়ে তার রাজত্ব টিকানোর চেস্টা করছেন .. নিজ সন্তানদের (প্রগতিশীল বন্ধুরা এখনো নিজেদের সন্তানই মনে করেন) তুলে দিয়েছেন হেফাজতি রাক্ষসের মুখে, তাই এই রাক্ষস নিয়েই তারা চিন্তিত বেশি, সরবও বেশি! বাকি দুই রাক্ষসও বাংলাদেশকে এক ভয়ানক পরিণতির দিকে নিচ্ছে!

তনুর ঘটনায় সেনারাক্ষসের চেহারা কিছুটা চোখে পড়লেও, একে খাইয়ে দাইয়ে মোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়া আগেই শুরু হয়েছে! সিভিল বিভিন্ন কাজে, উচ্চপদে সেনানিয়োগ, নিত্যনতুন ক্যান্টনমেন্টের নামে বিশাল বিশাল সরকারি খাস জমি, রিজার্ভ ফরেস্ট এর বরাদ্দ, সেনানিবাস এর জন্য আলিশান সব প্রজেক্টই শুধু না, সেনাবাহিনীকে একটা ব্যবসায়িক জায়ান্ট হওয়ার আয়োজনও সম্পন্ন!

অপরদিকে ভারত, আমেরিকা, জাপান, চীন, রাশিয়া … সবাইরে যেমনে তোয়াজ করছে, রামপাল রূপপুর থেকে শুরু করে বন্দর বিদ্যুৎ তেল .. সমস্ত কিছুর মাধ্যমে দেশটারে চিপড়ায় খাওয়ার বাহারি নাম এরা দিয়েছে “উন্নয়ন” .. গার্মেন্টস শ্রমিক আর প্রবাসী শ্রমিকদের রক্তঘামের টাকায় দেদারছে লুটপাটের পরেও আমাদের প্রবৃদ্ধির হার উচ্চ, আর সেইটা দেখাইয়া ও উন্নয়নের গল্প শুনেইয়া তিন রাক্ষসের খোরাক হওয়াকে জায়েজ করে …
রূপকথার গল্পের সাথে আমাদের গল্পের আরো পার্থক্য আছে, বড় পার্থক্য হচ্ছে এইখানে রানীরা নিজেরাও বড় রাক্ষসে পরিণত হয়েছে! ফলে প্রজারা তিনটা না চারটা রাক্ষসের খোরাক যোগায় .. এদের লুটপাটের হা এত বড় যে, শেয়ারবাজার – ব্যাংক থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট ফ্লাইওভার পদ্মাব্রিজ সমস্তই তাদের পেটে হাজার হাজার কোটি টাকা ডলার ঢুকায় .. সবচেয়ে সস্তা শ্রমের ও কাঁচামালের দেশে দুনিয়ার সবচেয়ে কস্টলি উন্নয়ন অবকাঠামোর (এবং সবচেয়ে জঘণ্য মানের অবকাঠামোর) গর্বিত মালিক আমরা .. সবই চতুর্থ রাক্ষসের কৃপা ..

রূপকথার গল্পে ভিনদেশী রাজপুত্র এসে রাক্ষসকে মেরে রাজকন্যাকে উদ্ধার করে, বিনিময়ে পায় অর্ধেক রাজত্ব ও রাজকন্যা! প্রজাদের যখন নিয়ে যাচ্ছিল, তখন কোন রাজপুত্রের দেখা পাওয়া যায়নি! রূপকথার গল্পে প্রজারা সবসময়ই অগণ্য চরিত্র! আমাদের বর্তমান রূপকথাতেও অনেক সময় প্রজারা অগণ্য! সেই কারণেই আমাদের প্রগতিশীল বন্ধুরা বড় বিচ্ছিন্ন, বড় একা! আর এইটা যেহেতু আসল রূপকথা না এবং এইখানে রাক্ষসও চারটে, কোন উদ্ধারকর্তা রাজপুত্তুরের সম্ভাবনা এইখানে শুন্য!

পাঁচ
জনগণের পরিণতি তো একেবারেই ভয়াবহ, সেদিকে আওয়ামীলীগের কোন খেয়াল নেই দেখে, প্রগতিশীল বন্ধুদের অনেকেই আওয়ামীলীগকেও ভয়ানক পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। নাজিমুদ্দিন সামাদ যেমন তার শেষ স্ট্যাটাসে সরকারকে জনরোষের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। একজনকে দেখলাম, তাজউদ্দিন আহমেদকে উদ্ধৃতি করতে যেখানে তিনি বঙ্গবন্ধুকে বাকশাল করার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সাবধান করছেনঃ “আপনি আপনার স্বাভাবিক মৃত্যুর পথ বন্ধ করছেন” বলে। অনেক আগে থেকে আওয়ামীলীগের বিরোধী কিংবা শত্রু শিবিরের লোকজন শেখ হাসিনাকে আরেকটি ১৫ আগস্টের অপেক্ষায় থাকার কথা বলতো! কিন্তু এবারে আওয়ামীলীগের সেই বন্ধুদেরও দেখছি- আবার ১৫ আগস্ট এর সম্ভাবনার ব্যাপারে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।

আমার ধারণা, এরকম কিছুর আশঙ্কার ব্যাপারে আওয়ামীলীগ এবং শেখ হাসিনা যথেস্টই ওয়াকিবহাল এবং সচেতন। শেখ হাসিনাকে হত্যার প্রচেস্টা তো কম হয়নি! ফলে, সাবধান তিনি হতেই পারেন। তাছাড়া এই সময়কালে আসাদুজ্জামান নুরের উপরে হামলা এবং ফটিকছড়িতে আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের উপরে হামলা- সেখান থেকে উপর থেকে তৃণমূল পর্যায়ে নিরাপত্তার ব্যাপারে আওয়ামীলীগ যথেস্টই সচেতন বলেই মনে হয়। অন্তত বঙ্গবন্ধুর মত “আমাকে কে মারতে পারে” ধরণের আত্মবিশ্বাস আজকের কোন নেতা কর্মীর নেই, শেখ হাসিনার নেই- অন্যদের তো নেই-ই। ফলে, সবারই নানাস্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা আছে।

ব্যবস্থাগুলো হচ্ছে এরকম … কোন মন্ত্রী- প্রতিমন্ত্রীই আজ নিজ নিজে নির্বাচনী এলাকায় থাকেন না, সেখানে জনগণের সাথে মিশেন না, কালেভদ্রে সভা সমাবেশ করতে যান দলীয়-সরকারী নিরাপত্তার বিষয়টা সন্তোষজনক নিশ্চয়তা পেয়েই। এমনকি অসংখ্য জেলা- থানা নেতারাও নাকি এলাকায় মৌসুমী যোগাযোগ করেন। স্থানীয় নেতাকর্মীরা নিজেদের ও উর্ধতন নেতার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অস্ত্র ও বাহুবলের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়েছেন। এমনকি- বাড়িঘরের নকশা পালটে নিরাপত্তার ব্যবস্থাও নাকি অনেকে করেছেন। ঢাকাস্থ এক মন্ত্রীর বাসভবন সম্পর্কে আমার এক বন্ধুর অভিজ্ঞতা হলো- ঐ বাসায় ঢুকার কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনি তো আছেই, তারপরেও পেছনের গোপন রাস্তা দিয়ে পালানোর বিশেষ ব্যবস্থাও আছে। আমার পরিচিত (দু সম্পর্কীয় আত্মীয়) স্থানীয় নেতার ক্ষেত্রেও দেখি- বাসার প্রাচীর উচু করা ও তারকাটা দেয়া, মজবুত গেইট এর ব্যবস্থা করা, বাসার ভেতরে দরজার সামনে শাটারিং গেট দেয়া … এসব সম্পন্ন করতে।

ফলে, ভয় বা আশঙ্কার কথা প্রগতিশীল বন্ধুরা যেটা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, সেটা আওয়ামীলীগের নেতারা ভালোই জানেন, এবং আমার ধারণা এই আশঙ্কার জায়গা থেকেই তারা মরিয়া হয়ে ক্ষমতা হাতে রাখতে চায়। যতদিন সম্ভব, যেভাবে সম্ভব।

এই আশঙ্কার কথা মাথায় রেখে সমস্ত মন্ত্রী উপমন্ত্রী পাতিমন্ত্রী সংসদ সদস্যরা আরেকটা কাজ করছেন। তা হলে বিদেশে, মানে ইউরোপ- আমেরিকা- কানাডায় প্রভৃতি দেশে ব্যাকাপ ঠিকানা তৈরির চেস্টা করছে। কথিত আছে হাজার হাজার কোটি টাকা/ ডলার বিদেশে পাচারের সাথে আওয়ামীলীগের হোমড়া চোমড়া নেতা, মন্ত্রী- সংসদ সদস্যরা যুক্ত। এবং এর সাথে ঐ নিরাপত্তাজনিত আশঙ্কা কাজ করে। ব্যাপারটা হচ্ছে এমন- যদি কোন কারণে ক্ষমতা হাতছাড়া হওয়ার মত পরিস্থিতি হয়, তাহলে যাতে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে বিদেশে কোথাও মাথা গোজার ঠাই থাকে। বাংলাদেশে ব্যাংক লুট থেকে শুরু করে যাবতীয় সব লুটপাটের টাকার বড় অংশ সরাসরি বিদেশী একাউন্টে জমা হচ্ছে- এই আশায় যে, বাংলাদেশ অবাসযোগ্য হয়ে উঠলে যাতে বাসযোগ্য একটা নিবাস পাওয়া যায়।

ছয়
প্রগতিশীল বন্ধুদের দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেটায় আবার ফিরি! আওয়ামী লীগকে আজকের আওয়ামীলীগ বানানোর পেছনে তাদের দায় যে সবচেয়ে বেশি এইটা বুঝতে হবে! আওয়ামীলীগ বিএনপির বাইরে বিকল্প গণতান্ত্রিক শক্তি গড়ে তোলার আগ্রহ না থাকুক, যে সমস্ত বাম গণতান্ত্রিক শক্তি এখনো আওয়ামীলীগ বিএনপির কেনা ভাঁড়ে পরিণত হয়নি, তাদের মধ্যে আশার আলো না দেখুক, অন্তত বিএনপি জামাত জুজুর ভয়ে আওয়ামীলীগের সমস্ত অন্যায় অপকর্মকে সমর্থন দেয়ার যে কি ফল হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন! একটা জিনিস বুঝবেন জনগণের ম্যান্ডেট নেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলে, খোদ শয়তানও সমঝে চলে! শক্তিশালী বিরোধীদল থাকলে, উন্নয়ন যতই ব্যহত হোক জনগণের ক্ষোভকে সবসময় উপেক্ষা করা সম্ভব হয় না! মনে রাখবেন, ‘জঙ্গিবাদী’ বিএনপি জামাত জোটই কিন্তু জেএমবি বাংলা ভাই নির্মূলে বাধ্য হইছিলো ..

সাত
একটা সন্দেহের কথা দিনে দিনে জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকার বা সরকারী বাহিনী এই সমস্ত ঘটনার সাথে সরাসরি যুক্ত থাকতে পারে- এরকম বক্তব্য ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। এই ধারাবাহিক ‘আল্লাহু-আকবার’-খুন বা চাপাতি-খুন দমনের ব্যাপারে সরকারের বিন্দুমাত্র আগ্রহ না দেখানো, উলটো খুনীদের প্রশয় ও উৎসাহ দেয়া- সেই সন্দেহের পালেই হাওয়া দেয় বৈকি। অনেকের ধারণা সরকারী ইন্টেলিজেন্স বাহিনীর সরাসরি সংযোগ থাকতে পারে। বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের উত্থান দেখানোর মাধ্যমে আওয়ামীলীগ দেশে ও বিদেশে নিজেকে একমাত্র বিকল্প ও অটোমেটিক ‘চয়েস’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে, আওয়ামীলীগের প্রস্থান মানেই জঙ্গীবাদের ক্ষমতায় যাওয়া- এরকম জুজুর বিপরীতে নিজের ক্ষমতা আকড়ে ধরাকে লিগালাইজ করার চেস্টা থাকে … টুকটাক জঙ্গী অপারেশন চললে আওয়ামীলীগের সেই নিজ ক্ষমতার লিগাল গ্রাউন্ড তৈরি হয়ে যায়, ফলে আওয়ামীলীগের ক্ষমতায় থাকা নিরঙ্কুশ হয়ে ওঠে- এমন করেও অনেকেই যুক্তি করছেন। আমার কাছে এসব রটনাকে একদম উড়িয়ে দেয়ার মতো তথ্য বা যুক্তি নেই, কেবল মনে হয় – এরকম ভয়ানক ‘রিস্কি’ গেম খেলে আদৌ কতখানি লাভ বা এই গেম শেষ পর্যন্ত নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার মত আত্মবিশ্বাস কি আওয়ামীলীগের আছে? আওয়ামীলীগ সরাসরি এইসব হত্যা-খুনগুলোর সাথে আছে কি নেই, কিংবা তার জঙ্গী সম্পৃক্ততা আছে কি না- তা সময়েই বলে দিবে, তবে যে ভয়ানক নিষ্ক্রিয়তা দেখিয়ে তারা একের পর এক খুনের মহোৎসব চালিয়ে যেতে দিয়েছে, তাতে সরাসরি যদি যুক্ত নাও থাকে, তাদের হাতে আমি চাপাতি দেখি, তাদের হাতে-মুখে-জিহবায় তাজা রক্ত দেখি।

একটু আগে ‘রিস্কি’ গেম এর কথা বললাম! ক্ষমতার লোভে মরিয়া হয়ে- এখনো যে গেম খেলছে তা মোটেও এতটুকু কম রিস্কি নয়! দেশটা তো শেষ, ভয়ানক সব রাক্ষস আমরা তৈরি করছি … যে চর্বি-মেদ যুক্ত সেনাবাহিনী আমরা তৈরি করছি, তা ঝরানো আদৌ সম্ভব হবে কি না, যেভাবে বিদেশীদের কাছে দাসখত দিয়ে যাচ্ছি- সেগুলো কোনদিন বাতিল করা আদৌ সম্ভব হবে কি না বা সুন্দরবন থেকে শুরু করে আমাদের নদী নালা, খালবিল, কৃষি জমি- সব ধ্বংস হলে আবার ফেরত পাবো কিভাবে- যে ঘৃণার চাষ হচ্ছে, জঙ্গীবাদ যেভাবে যে জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সংখ্যালঘুদের যেভাবে মেরেকেটে দেশে থেকে বিতাড়িত করা হচ্ছে- সব মিলে দেশ ও দেশের মানুষের জন্যে ভয়ানক পরিণতি এড়ানোর কোন উপায় নাই হয়তো, কিন্তু এসবকি আওয়ামীলীগের জন্যে সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণ করছে? একেবারে ও টানা যতদিন পারা যায় থাকি ও লুটেপুটে খাই- এই নীতিতে বড়জোর কত বছর তারা থাকবে? থাকতে পারবে? এই দৈত্যগুলো যখন মহাদৈত্যে পরিণত হবে, তখন মহাদৈত্য সেনাবাহিনী কিংবা মহাদৈত্য জঙ্গী বাহিনীকে সামলাতে পারবে তো? আর সেই সময়ে লেজ গুটিয়ে বিদেশে সকলে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ আসলেই পাবে? কি ভয়ানক রিস্কি গেমই না খেলছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ …

করুণাই হয় …