২০১০। মধ্য-কলকাতার এক প্রখ্যাত মিশনারি স্কুলের এক নিস্তব্ধ আপিসঘরে বসে আমি লিখছি। সামনের দেয়ালে নির্বাক ‘যিশুর মুকুটে কাঁটা’… তাঁর দেহে রক্তের ফোঁটা। জানলার শতাব্দীপ্রাচীন রঙিন কাচ দিয়ে আলোর তীক্ষ্ণ রেখা পড়েছে তাঁর গায়ে। সেই অদ্ভুত রঙিন আলোয় বিদ্ধ হয়ে তিনি ক্রুশ থেকে ঝুলছেন নির্বাক-নিঃশব্দ। আমিও দারুণ দ্বিধার ক্রুশে ঝুলছি।

ক’দিন আগেই এই স্কুল থেকে চাকরির একটি ইন্টারভ্যুর জন্য ডেকেছে। আমি সেসময় একটি পাবলিক স্কুলে চাকরি করি। কিন্তু এই প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী স্কুলের ডাক পেয়ে আহ্লাদে আটখানা হয়ে এসেছি ইন্টারভ্যু দিতে। এখানে আসতে প্রথমেই দিয়েছে একটা বিরাট ফর্ম… তাতে নানা অবান্তর প্রশ্ন ভর্তি। সে ফর্মে জিজ্ঞেস করেছে আমার ধর্ম কী। আর সেখানেই আমি পড়েছি আতান্তরে। ভাবছি সত্যি কথাটা লিখব নাকি হিন্দু লিখব। শেষে লিখলুম হিউম্যানিস্‌ম।

ইন্টারভ্যু বোর্ডে তিনজন ৪৫ মিনিট ধরে আমাকে একটিই কথা জিজ্ঞেস করে চললেন যে আমি কেন হিউম্যানিস্ট। মানে মানুষকে আমি কোন সাহসে ঈশ্বরের থেকে বড় ভাবি! যতই বলি আজ্ঞে আমি তো ধর্ম পড়াতে যাইনি… কে কার কথা শোনে! শেষে যখন জানলেন আমি নিরীশ্বরবাদী, তাদের তো প্রায় ভূত দেখার মত চমকে ওঠার জোগাড়। সে বিস্তর কথা কাটাকাটি, তর্ক-বিতর্ক ইত্যাদি। বলাই বাহুল্য চাকরিটা আমার হয়নি। কিন্তু যেটা হল সেটা হচ্ছে সেক্যুলার স্কুলের চিন্তাটা চেতনে জাজ্জ্বল্যমান হয়ে উঠল। কেবল অবচেতনের আলস্যে সে চিন্তা আর শুয়ে-বসে আড়ালে থাকল না।

সেক্যুলার স্কুল বলতেই প্রথমেই আমাদের মাথায় আসে যে স্কুল সেক্যুলার নয় সেই স্কুলের কথা। আর সেইসব অ-সেক্যুলার স্কুলের মধ্যে প্রথমে আসে মাদ্রাসা। সেখানে বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান ইত্যাদির সাথে ইসলাম ধর্মশিক্ষাও হয়ে থাকে। সে আমাদের কারুর-ই পছন্দ নয়; আমরা তো নিঃসন্দেহ জানি-ই এবং বিজ্ঞাপিত-ও করি যে সেগুলি আসলে তালিবান কি আল-কায়দা কি আইসিস চালায়। সেখানে পড়েও নিশ্চয়ই তাদের-ই ছেলেপুলে! তার পরে আসে মিশনারি স্কুলগুলো। যদিও সে সব স্কুলগুলোকে নেহাত আর এস এস বা বজরং দলের সদস্য না হলে আমাদের অতটা সাম্প্রদায়িক বা অ-সেক্যুলার বলে মনে হয় না। চাই কি খুঁজলে অক্সিলিয়াম কি ডন বস্কো কি সেন্ট পল্‌সে দু’চারটে বিজেপি নেতার ছেলেমেয়েও বেরিয়ে পড়তে পারে। তা সেখানে অন্যান্য বিষয়ের সাথে বাইবেল পাঠ-ও করতে হয় বৈকি। হয়ত অনেক স্কুলেই তার জন্য আলাদা ক্লাস থাকে না কিন্তু অ্যাসেম্বলি ইত্যাদি সময় ছেলেমেয়েদের বাইবেলের নির্যাস বাধ্যতামূলকভাবে আস্বাদন করতে হয় বৈকি!

যে স্কুলকে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় প্রায় মোটেই সাম্প্রদায়িক মনে করে না সেটি হল রামকৃষ্ণ মিশন। সেখানে ভাল ভাল ছেলেরা পড়ে। সেখানে কী পড়ানো হয় দেখতে গিয়ে দেখতে পাচ্ছি বাংলা ইংরেজি ইতিহাস ভূগোল বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ের সাথে রয়েছে ইন্ডিয়ান কালচার নামক একটি বিষয় যা ১০০ নম্বরের একটি পূর্ণ পত্র। রামকৃষ্ণ মিশন বয়েস্‌ হোম হাইস্কুল রহড়ার পঞ্চম শ্রেণীর সিলেবাসে যা আছে তা এই রকম –

secular school

secular school 2

[তথ্যসূত্রঃ http://www.rkmissionrahara.org/syllabusDoc/Bengali%20Medium%20-V.pdf ]

আমাকে বলুন সুধী পাঠক মাদ্রাসা ধর্মশিক্ষা করায় বলে সাম্প্রদায়িক, অ-সেক্যুলার ইত্যাদি হলে কোন যুক্তিতে রামকৃষ্ণ মিশন সেক্যুলার? দুটো আলাদা ধর্মশিক্ষা কিন্তু সমান ক্ষতিকর। কোন যুক্তিতে রামকৃষ্ণ মিশন প্রগতিশীল? প্রগতিশীলতার কথায় মনে পড়ল প্রত্যেক রামকৃষ্ণ মিশন কিন্তু কেবল ছেলেদের জন্য। সঙ্ঘের মেয়েদের স্কুল অনেক কম আর সেগুলি আলাদা। কিন্তু পিছিয়ে পড়া সাম্প্রদায়িক মাদ্রাসার যা হিসেব দেখছি তা এই রকম :

পশ্চিমবঙ্গে মোট অনুমোদিত মাদ্রাসার সংখ্যা ৬১৪। তন্মধ্যে ৫৫৪ টি কো-এডুকেশন, কেবল মেয়েদের ৫৭টি এবং কেবল ছেলেদের ৩ টি।

[তথ্যসূত্রঃ http://www.wbbme.org/recognisedMadrasahs.aspx ]

এইবেলা আর একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দিকে সুধী পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে রাখি। দেখা যাচ্ছে রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে এই হিন্দু ধর্মশিক্ষাটি কিন্তু চলছে ভারতীয় সংষ্কৃতির নামে। সুতরাং বাচ্চারা জানছে ভারতীয় সংস্কৃতি মানেই কেবল হিন্দু ধর্ম। কেবল রামকৃষ্ণ-সারদা-বিবেকানন্দ-চৈতন্য ইত্যাদি! মুসলিম-খ্রিস্টান পার্শিদের কথা তো ছেড়েই দিলাম। এমনকি আদিবাসী ধর্মগুলিও, যেমন ধরা যাক সাঁওতাল ধর্মও কিন্তু ভারতীয় নয়। যদিও নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে সাঁওতাল ধর্ম (যা ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ীও আলাদা একটি ধর্ম এবং মোটেও হিন্দু ধর্মের অন্তর্গত নয়) যতটা ভারতীয়, সনাতন হিন্দু ধর্ম ততটা ভারতীয় মোটেই নয়। এক দিকে ‘বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান’ আর অন্যদিকে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে দেখানোর এই অসাংবিধানিক চেষ্টা! চমৎকার শিক্ষাব্যবস্থা!

যে স্কুলগুলো সততই সেক্যুলার বলে দাবি করে সেই ইংরেজি মাধ্যম বাণিজ্যিক স্কুলগুলির দিকে তাকানো যাক। না, কেন্দ্রীয় শিক্ষাপর্ষদ CBSE তে ধর্মশিক্ষা সিলেবাসে নেই। আর এই পাবলিক স্কুলগুলি ধর্মশিক্ষার আলাদা ক্লাসও নেয় না। (এখানে বলে রাখা ভাল, আমরা কিন্তু ইংরেজি মাধ্যম কর্পোরেট স্কুলগুলির এক সামগ্রিক চিত্র সামনে রেখে আলোচনা করছি। ভারতবর্ষে অগনিত এমন স্কুলের অগনিত ট্রাস্টির মধ্যে কোনও স্কুলে যদি ধর্মশিক্ষার আলাদা ক্লাস নেওয়া হয় তবে তা সত্যিই ব্যাতিক্রম।) ব্যবসায়িক কারণেই কর্পোরেট স্কুলগুলিতে সরাসরি কোনও ধর্মশিক্ষার ক্লাস রাখা হয় না কারণ কোনওভাবেই তারা কোনও ধর্মেরই ছাত্রকে বিমুখ করতে চান না। ছাত্র বা তার অভিভাবক সেখানে ক্লায়েন্ট। সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষতার একটা বাতাবরণ না রাখলে ক্লায়েন্ট হারাতে হতে পারে যা ব্যবসায়িক দিক থেকে মোটেই কাম্য নয়।

কিন্তু ধর্ম অতি সাঙ্ঘাতিক কাঁঠালের আঠা। ব্যবসায়িক কারণে সেকুলার জামা পড়লেও সে জামার হাতার নিচে ধর্মের আঠা চিটচিট করে। জানান দেয় তার অস্তিত্ব প্রতি মুহূর্তে। ফলে আলাদা ক্লাস না থাকলেও বিভিন্ন অছিলায় ধর্মের বীজ কচি মাথায় ঢুকিয়ে দিতে সেই আপাত সেক্যুলার স্কুল ছাড়ে না।

মর্নিং অ্যাসেম্বলি যেমন। সকাল-সকাল সব ছাত্রছাত্রী এক যায়গায় জড়ো হ’য়ে প্রার্থনাসঙ্গীত গায় ও অতঃপর নানা কার্যক্রম ও প্রয়োজনীয় ঘোষণা চলে ১০-১৫ মিনিট ধরে এবং এ সব শেষে ছাত্ররা পুনরায় নিজ নিজ ক্লাসঘরে ফিরে যায় ও তাদের দৈনিক পঠন-পাঠন শুরু হয়। এখন এই প্রার্থনাসঙ্গীতটির যে শিক্ষায় কী প্রয়োজন, তা পরিষ্কার নয়। এই গানগুলো ধর্মসঙ্গীত এবং মূলত হিন্দু ধর্মসঙ্গীত। কিছু খ্রিস্টান হিম(Hymn)-ও গাওয়া হয় কিন্তু সেগুলোও খুবই সাবধানে চয়ন করা হয়ে থাকে। সেই হিম-গুলোই কেবল বেছে নেওয়া হয় যেগুলো আলাদা করে খ্রিস্টধর্মের কোনও কথা বলে না, কেবল সাধারণ ভাবে কোনও এক ঈশ্বরের কথা বলে। সুফি অঙ্গের গান যদি নেওয়া হয় সেখানেও একই নিয়ম মানা হয়… যে সব গানে মালিক, উপরওয়ালা ইত্যাদি বলে ঈশ্বরকে সম্বধন করা আছে কেবল সেই সব গানগুলি-ই অনুমতি পায়। মানে মোদ্দা কথা হল, যেগুলোকে হিন্দু বলে চালাতে তেমন অসুবিধে হয় না।

ফলে বোঝা যায় এই গানগুলির প্রয়োজন শিক্ষার্থীর নয়, শিক্ষাব্যবস্থার। এই গান গুলির উদ্দেশ্য শিক্ষা নয়, বরং গোপন রাজনৈতিক অভিসন্ধি।
দ্বিতীয়ত, স্কুলগুলির বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রারম্ভে নানা ধর্মীয় শ্লোক ব্যবহার করা হয়। যেমন উদ্বোধনী গান : গনেশ বন্দনা—“বক্রতুন্ডায় একদন্তায়ঃ গৌরীতনয়ঃ” ইত্যাদি। এই হল সেক্যুলার স্কুলের সেক্যুলার অনুষ্ঠান।

তৃতীয়ত, স্কুলে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উদযাপন। যেমন দিওয়ালি। বা গণেশ চতুর্থী। পশ্চিম বাংলায় সরস্বতীপুজো ইত্যাদি। কোনও কোনও স্কুলে সেক্যুলার নামক ধোঁকার টাঁটি বজায় রাখতে ক্রিস্টমাস-ও উদযাপন করা হয়। বলাই বাহুল্য এক দশকের ওপর বিভিন্ন স্কুলে কাজ করে কোথাও দেখলাম না একই রকম সমারোহে ঈদ পালিত হচ্ছে! এছাড়াও নানা ছোট ছোট অ্যাক্টিভিটি, যেমন বাচ্চাদের সুতো গিয়ে গণেশ মূর্তি বানানো। সুতো দিয়ে জিরাফও বানানো যেত। বোঝাই যাচ্ছে স্কুলগুলি ধর্মেই আছে নিঃসন্দেহে, জিরাফে নেই।

এখন একবার সেক্যুলার শব্দটির আভিধানিক অর্থটা ঝালিয়ে নেই।

Chamber’s Dictionary-তে আছে :

“The belief that the state moral education etc. should be independent of religion.”

Oxford Dictionary-তে আছে :

“The doctrine that morality should be based solely in regard to well-being of mankind in the present life to the exclusion of all consideration drawn from belief in God.”

Webster’s Dictionary বলছে :

“The belief that religion and ecclesiastical affairs should not enter into the functions of the state.”

আর একটি বিকল্প সংজ্ঞাও এখানে পাওয়া যায়—

“A system of doctrine and practices that rejects any form of religious faith and worship.”

স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে সেক্যুলার শব্দের অর্থ কোনওরকম ধর্মীয় সংস্পর্শ না-রাখা। যাকে চলতি কথায় বলা হয়, ‘separation of church and state.’ সুতরাং সেক্যুলার শিক্ষায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত থাকবে এটাই দস্তুর হওয়া উচিৎ। কিন্তু তেমন আর হল কই!

আমরা ভারতীয়রা যেটা করলাম সেটা ভারি মজার। আমরা সেক্যুলার শব্দের ওই ধর্ম-মুক্ত সংজ্ঞাটাকে অস্বীকার করে বললাম যে ওই সব সংজ্ঞা হল সেক্যুলার শব্দের পাশ্চাত্য ধারণা — ‘Western Secularism’!১ এবং একই সাথে আমরা আমাদের মতো একটা সংজ্ঞা বানিয়ে নিলাম যাতে সেক্যুলার বলতে বোঝালাম সব ধর্মের সমাহার — ‘সর্বধর্ম সমাভব’। কী কাণ্ড! যে শব্দের মানে ছিল কোনও ধর্ম না থাকা, তার মানে হয়ে দাঁড়াল সব ধর্ম থাকা। এই অদ্ভুত অর্থভেদের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সমাজ গবেষক ডঃ স্বর্ণ রাজগোপালান বলেছেন, যেভাবে ইয়োরোপে রাজনৈতিক পথে রাষ্ট্র ও ধর্ম আলাদা হয়ে গিয়েছিল তেমনটি ভারতবর্ষে সম্ভব হয়নি। তার প্রধান কারণ প্রথমত ভারতের বিভিন্নতা আর দ্বিতীয়ত ভারতে এমন কোনও সর্বোচ্চ ও একমাত্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কোনওদিন ছিল না যার কাছ থেকে সেক্যুলার ক্ষমতা নিয়ে নেওয়া যেত তথা ‘separation of Church and State’ সম্ভব ছিল না, যেহেতু তেমন কোনও স্পষ্ট চার্চ-ই ছিল না বা এখনও নেই। ফলত সেক্যুলারের সংজ্ঞা এক অদ্ভুত অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট ধোঁয়াশায় রয়ে গেছে।২

এই দ্বন্দ্ব স্বভাবতই শিক্ষাক্ষেত্রেও অবশ্যম্ভাবীভাবে রয়েছে। ধরা যাক, ভারতীয় সংবিধানে বলা আছে সম্পূর্ণ সরকারি অর্থে পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনও রকম ধর্মশিক্ষা নিষিদ্ধ।৩ আবার ১৯৫৯ সালে সেন্ট্রাল অ্যাডভাইসারি বোর্ড অফ এডুকেশান এক বিশেষ কমিটি নিয়োগ করে, তারা স্কুলে সুপারিশ করে যে ধর্মীয় ও নৈতিক ক্লাস থাকা বাঞ্ছনীয়।৪ ১৯৬৬ সালে কোঠারি কমিশন-ও বলে যে রুটিন করে কিছু সময় ধর্মশিক্ষার জন্য সংরক্ষিত করা বাঞ্ছনীয়। কমিশন এও বলে, ‘…as all religions stress certain fundamentals of character.’৫

যেটা স্পষ্ট বোঝা যায় না তা হল, যে সব ‘ফান্ডামেন্টালস অফ ক্যারেক্টার’ বাচ্চাদের শেখানো প্রয়োজন বলে কোঠারি কমিশন মনে করেন সেগুলি এমনিই শেখালেই হয়; তার জন্য ধর্ম পড়াতে হবে কেন? আর এইসব সুপারিশগুলি সংবিধানের উক্ত ধারার সাথে কি আদৌ সংগতিপূর্ণ?

স্ববিরোধ এখানেই শেষ নয়। সম্পূর্ণ রাষ্ট্র পরিচালিত স্কুল গুলিতে যদি ধর্মশিক্ষা নিষিদ্ধ হয় তবে সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত ও বেসরকারী স্কুলগুলোতে তা নয় কেন? শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মের অনুপ্রবেশ যদি ভারতীয় সেক্যুলার প্রকৃতির পরিপন্থী হয় তবে তা সব স্কুলেই পরিপন্থী। এবং সব স্কুলেই তা বন্ধ করা প্রয়োজন। তাহলে মাদ্রাসা, বা মিশনারি স্কুল বা রামকৃষ্ণ মিশন বা আর এস এস পরিচালিত স্কুলগুলি ধর্মশিক্ষা চালিয়ে যেতে পারে কোন যুক্তিতে? এ তো হতে পারে না যে, কেবল সরকারি হাসপাতালে ভুল চিকিৎসা করা নিষিদ্ধ। কিন্তু বেসরকারি নার্সিংহোমে ভুল চিকিৎসা চলতেই পারে সে ক্ষেত্রে সরকারের কোন মাথাব্যথা নেই!

এখন সেক্যুলার বলতে যদি সর্ব ধর্ম সমাভব ধরি তাহলে স্কুলে ধর্মের অনুপ্রবেশ ঢুকলেও তাকে সেক্যুলার বলতে হয়। কারন স্কুল যদি সব ধর্মকে সমান ভাবে দেখে এবং গুরুত্ব দেয় তাহলে সে ভারতীয় মতে সেক্যুলার।

এখন এটা একটা নিখাদ আকাশকুসুম। সব ধর্ম বলতে কী বোঝায়? কতগুলো ধর্মকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। মানে হিন্দু, ইসলাম, খৃষ্ট, বৌদ্ধ জৈন, শিখ, পার্শি, কনফুসিয়ান… সব বলতে আর কত? এই সব ধর্মের উৎসব পালিত হবে তো স্কুলে? সব ধর্মের শিক্ষা হবে তো ক্লাসে? এটা কি আদৌ সম্ভব? কোন বুদ্ধিমান মানুষ তা মনে করেন না। এবং স্বাভাবিক ভাবেই সেটা হয়ও না। যেটা চলে সেটা ওই সর্ব ধর্ম সমাভব-কে সামনে রেখে একটা সেক্যুলার ঢাল বানানো আর তার পেছনে যে কোনও একটি বিশেষ ধর্মের প্রচার। শিশুদের ছেলেবেলা থেকে একটি বিশেষ ধর্মের প্রতি বাধ্য করে তোলা।

মোহনদাস গান্ধী বলেছিলেন, ‘The State would look after secular welfare, health, communications, foreign relations, currency, and so on, but not your or my religion. That is everybody’s personal concern.’ এ কথা শোনাও যায় ইতিউতি যে ধর্ম যার যার ব্যক্তিগত। সেটাই হওয়া উচিত। কিন্তু স্কুলে তাকে টেনে আনলে কীভাবে আর ধর্ম ব্যাক্তিগত থাকে! স্কুল তো আর শৌচাগারের মত ব্যক্তিগত জায়গা নয়। এখানে বলে রাখা ভাল, ১৯৭২ সালে UNESCO কর্তৃক গঠিত ‘ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন দ্য ডেভেলপমেন্ট অফ এডুকেশন’ কিন্তু পরিষ্কার করে বলে যে সম্পূর্ণ মানুষ তৈরি করতে স্কুলে ধর্ম শিক্ষার মোটেই কোনও প্রয়োজন নেই।

বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স বলেছিলেন, ‘…but if you hear anybody speak of a ‘Catholic child’, stop them and politely point out that children are too young to know where they stand on such issues, just as they are too young to know where they stand on economics or politics.’৬ এই সহজ সত্যিটা না বুঝলে এইরকম একের পর এক পঙ্গু প্রজন্ম তৈরি হতে থাকবে। ফলে এ কথা সহজেই বোধগম্য যে, শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে সচেতনভাবে সব রকম ধর্মীয় অনুষঙ্গ বাদ দিতে হবে। ওই সর্ব ধর্ম সমাভব নয়, বরং সম্পূর্ণ ধর্মমুক্ত স্কুলই প্রকৃত বাস্তবোচিত সেক্যুলার স্কুল।

১ Problems of Education in India, Ramnath Sharma and Rajendra Kumar Sharma, Atlantic Publisher; p: 227-228।
২ Secularism in India, Swarna Rajgopalan; published in William Safran, ed. Democratic Republic and the Problems of Religion; Frank Cass London 2001।
৩ “no religious instruction shall be provided in any educational institution wholly maintained out of State funds.” Article 28(i), Indian Constitution.
৪ Secular Education, A.K. Ghosh, The Statesman, April 18, 2015.
৫ ibid.
৬ The God Delusion, Richard Dawkins, Bantam Press. p: 3।