কোরিয়া ১৯৫০: এক কিশোর সৈনিকের স্মৃতিগাঁথা

পর্ব-১, পর্ব-২, পর্ব-৩, পর্ব-৪, পর্ব-৫, পর্ব-৬, পর্ব-৭, পর্ব-৮, পর্ব-৯, আগের পর্ব

পর্ব-১১

যখনই সময় পেতাম গোটা বছর জুড়েই আমি আমার ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি চালিয়ে যেতাম; বিশেষ করে কেরোসিন-কুপির আলোতে সেই সব দীর্ঘ শীতের রাত গুলোতে। আমার আগের ৬ষ্ঠ গ্রেডের শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকের অব্যাহত সহায়তায় আবার আমি সিনজু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন পত্র জমা দিলাম। ১৯৪৭ সালের গ্রীষ্মে আবার কলেরার প্রকোপ দেখা দিলো কিন্তু সেটা গত বছরের মতো অতোটা ব্যাপকতা নিয়ে ছড়িযে পড়লো না কাজেই স্বাভাবিক যাতায়াতে সরকার কর্তৃক কোন নিয়ন্ত্রনও আরোপ করা হলো না। আমি সময় মতো সিনজু গেলাম এবং ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহনও করলাম। বছর-জোড়া প্রস্তুতিতে আমার পরীক্ষা শেষ হলো অপেক্ষাকৃত সহজেই। পরদিন বিদ্যালয়ের মূল ফটকের বুলেটিন বোর্ডে আমি আমার আবেদন পত্রের ক্রমিক নম্বরটা পেলাম। আমি পাস করে গিয়েছি!

সেপ্টেম্বর ১৯৪৭-এ যখন শেষ পর্যন্ত সফল ভাবে আমি সিনজু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম সে এক অবিস্মরণীয় অনুভূতি! বলে বুঝানো যাবেনা যে, ধোপদুরস্ত স্কুল ইউনিফর্মে, কলারে উজ্জ্বল স্কুল ব্যাজ এবং স্কুলের ব্যাজ সম্বলিত হ্যাট সহ আমার সে সময়ের অনুভূতি, এককথায় সে ছিলো দুর্দান্ত রকমের আকর্ষনীয় এবং গর্বের। সে সময় সব মাধ্যমিক বিদ্যালয় গুলোর ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুলের নির্ধারিত পোষাক এবং ব্যাজ ব্যবহার বাধ্যতামুলক ছিলো। সে সময়ের প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বেশীরভাগ কলেজ গুলোই তখন সহশিক্ষা (coeducational) মূলক এবং সব লিবারেল আর্টস মাধ্যমিক বিদ্যালয় গুলো আলাদা আলাদা শিক্ষা কার্যক্রম চালাতো। সিনজু বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি ছিলো শহরের ভেতরে, তবে আমাদের বিদ্যালয় থেকে বেশী দুরে নয়।

দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে যারা এসেছিলো, তাদের অনেকের সাথেই আমার বন্ধুত্ত্ব হলো। স্কুলে ছিলো অসাধারন চৌকষ শিক্ষক বৃন্দ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৬-বছরের পাঠ চুকিয়ে যখন বিক্ষ্যাত এক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র হলাম, তখন এক ধরনের অসম্ভব সাধনের উৎফুল্লতায় মন ছিলো ভরপুর। সম্পূর্ন ভিন্ন এক ধরনের অনুভূতি এসেছিলো যেখানে ছিলো ভবিষ্যতের জন্যে স্বপ্নময় আশা, উচ্চাকাঙ্খা যা কিনা পুরোটাই ছিলো পড়াশুনা কেন্দ্রীক। আবহটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একেবারেই বিপরীত ছিলো অর্থাৎ প্রতিটি অধিত বিষয়ের আলাদা আলাদা শিক্ষক ছিলেন। পাঠ্যক্রমে ছিলো বিভিন্ন বিষয় যেমন, ইংলিশ সাহিত্য থেকে শুরু করে বিজ্ঞান এমনকি ইউরোপের ইতিহাস পর্যন্ত সব। রসায়ন ও পদার্থবিদ্যার মতো বিষয়ের জন্যে পরীক্ষনের কাজে পরীক্ষাগাঢ়েও যেতে হতো। আমি প্রায়ই রসায়ন কিংবা গনিত ক্লাবে যাবার পথে শিক্ষকের সাথে কিংবা বড়ভাইদের সাথে কথা বলতে থামতাম। তাঁরা আমাকে জগতের সর্বোত্তম ছাত্রের মতো মর্যাদায় উৎসাহ দিতেন। অত্যন্ত আন্তরিকতায় আমার সব গুলো প্রশ্নের উত্তর বলতেন, বুঝাতেন। আমি সত্যিই ভাবতাম যে এনারা রসায়ন এবং গনিতের সব কিছু জানেন এবং বুঝেন! ফলে আমি অচীরেই রসায়ন ও গনিত ক্লাবে যোগ দিয়েছিলাম। মজার ব্যাপার হলো মাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষের শেষে আমি উচ্চ বিদ্যালয়ের রসায়ন, পদার্থবিদ্যা ও ক্যালকুলাস পড়া শেষ করে ফেলেছিলাম! স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে প্রায়ই আমি পুরনো বই এর দোকানে যেতাম এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন বই ঘাঁটাঘাঁটি করতাম। জাপানী উপনিবেশীকতার চিহ্ন হিসেবে তখনো বেশীরভাগ বই পত্রই জাপানী ভাষাতেই পাওয়া যেতো।

ছাত্রাবাসে একবছর কাটাবার পর আমি এক ব্যক্তিগত বাসার এক রুম ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করলাম। সেখানে নিজেই নিজের খাবার রান্না করতাম এবং এভাবে সিনজু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষ (যা আমেরিকান শিক্ষা ব্যবস্থায় অষ্টম ও নবম গ্রেডের সমমানের) অতিক্রম করলাম। শহড়ের বাইরে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে আমাকে পড়াবার জন্যে এসময় আমাদের পারিবারিক জমি-জমার বড় একটি অংশ বিক্রি করে বাবা-মা আমার জন্যে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। আর আমিও এসময় তাঁদের সাথে একাত্ব হয়ে আমার ব্যাক্তিগত ব্যায় সংকোচনের মাধ্যমে তাঁদের সহযোগীতার চেষ্টা করতাম। ১৪-১৫ বছর বয়েসে আমার জন্যে রান্না করে খাওয়াটা যদিও খুবই কষ্টের ছিলো তবুও নিজে রান্না করে খাওয়াটা সবচেয়ে সাশ্রয়ী ছিলো বিধায় পারিবারিক অর্থনৈতিক টানাপোড়েনটাকে সামাল দিতে ঐ পথই আমাকে বেছে নিতে হয়েছিলো। মা আমাকে কিছু সহজ রন্নার পদ্ধতি বাতলে দিয়েছিলেন যেমন, ভাত সেদ্ধ, কিছু জাতীয় ভাবে সমাদৃত খাদ্য-খাবার, স্যূপ ইত্যাদি। আলস্য বশতঃ প্রায়ই আমার রান্না সম্পূর্ন হতো না, আধা-কাঁচা অবস্থাতেই খেয়ে ফেলতাম। মা’ আমাকে বলেছিলেন চাল গুলো বারবার করে ধুয়ে নিতে যাতে ধোয়ার পরে জলটা একেবারে পরিষ্কার থাকে। আর বলেছিলেন, সেটা একটা গামলায় ধুয়ে নিতে, ডেকচিতে চড়াবার আগে যাতে ভারী ময়লা-পাথর-বালির কণা নীচে থিতিয়ে পড়ে, এবং তার পরে সঠিক পরিমানে জল সহ সেদ্ধ করে নিতে। রান্নার পরে আমার ভাত মাঝে মাঝেই হয় স্যুপের মতো গলে যেতো, নতুবা শক্ত চালই থেকে যেতো কিংবা রান্নাই হতো না; যেহেতু সব সময়ই জল হয় বেশী হতো, নতুবা কম হতো! অথবা ভাত যেতো পুড়ে কারণ খামখেয়ালীতে জ্বলন্ত উনুনে ভাত লম্বা সময় ধরে পরে থাকতো! গ্রীষ্ম বা শীতের ছুটির পরে যখন সিনজুতে ফিরতাম তখন বাড়ি থেকে আসার সময় ব্যাগ ভর্তিকরে কিছু চাল আর বাড়িতে তৈরি আনুসঙ্গীক খাবার-দাবার গুলো নিয়ে আসতাম। আমার মা সব সময়ই কিছু আনুসঙ্গীক খাবার প্রস্তুত রাখতেন যেমন সয়া-সশে মাখানো শুকনো মাংস, সব্জীর আচার, মসলাদার মুলোর ঘনক (কাকতুগী, kaktugi) এবং আমার প্রয়োজন মতো ছোট্ট একটা বয়াম ভর্তি কিমচি (রশুন, পেঁয়াজ, আদা, শুকনো মরিচের গুড়ো লবন ও অন্যান্য রসদ সহযোগে পাচনকৃত একধরনের বাধাকপি বা ক্যাবেজ, Kimchi)। সারাদিনের বাস ভ্রমনটা হতো বড্ড বিরক্তিকর বিশেষ করে অনিয়ন্ত্রিত কিমচির উৎকট গন্ধে। কারণ ওটা মসলা সহযোগে পাচনকৃত এবং তৈরী হতো একধরনের বাধাকপি ও মূলো দিয়ে। অবশ্য বাসের অন্যান্য যাত্রীরাও অন্যান্য এ-রকম ঘ্রানযুক্ত বিভিন্ন দ্রব্য নিয়েই যাতায়াত করতো বলে কেউ কিছু মনে করতো না। বাবা স্কুলের বেতন, বই এবং সব্জি-পাতি বাবদ কিছু টাকা দিতেন সাথে। বাড়ি থেকে আনা খাবার-দাবার গুলো বেশী দিন রাখা যেতো না আর তাই শহরের কেন্দ্রস্থলে সপ্তাহান্তে রোববারে যে হাট বসতো, সেখান থেকেই আমাকে প্রয়োজনীয় খাবার সংগ্রহ করতে হতো। মাংসের যেহেতু দাম বেশী তাই হাতে পয়সা থাকলে আমি সাধারনতঃ সব্জী এবং মাছই বেশী কিনতাম। এতো সব কিছুর পরেও আমি দেখলাম যে আমার সহপাঠীরা কেউ কেউ আমাকে অপছন্দ করছে! বিশেষ করে যখন আমি একটা সুতলীর মাথায় বাঁধা মাছ ঝুলাতে ঝুলাতে মাছ বিক্রেতার কাছ থেকে বাড়ি ফিরতাম, পথে। যাইহোক এসব অসুবিধা এবং স্বাচ্ছ্যন্দ্যহীনতা সত্ত্বেও আমি উৎফুল্ল ছিলাম যে একটা ভালো মাধ্যমিক স্কুলে পড়াশুনা করছি। আমি সহজেই এইসব অসুবিধাগুলোর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছিলাম এইজন্যে যে, একটা কাঙ্খিত স্কুল এবং পড়াশুনার আকর্ষনীয় পরিবেশ আমি পেয়েছিলাম।

১৯৫০ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষামন্ত্রনালয় মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরটিকে সুগ্রন্থিত করার প্রয়াসে এক যুগান্তকারী উচ্চাভিলাষী সিদ্ধান্ত নিল। এ সময়ের আগে প্রচলিত ব্যবস্থাটি ছিলো “৬-৬-৪” বা ছয় বছরের প্রাথমিক শিক্ষাস্তর, ছয় বছরের মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর এবং ৪ বছরের মহাবিদ্যালয় স্তর। যাইহোক, ১৯৫০ সালে মন্ত্রনালয় নতুন যে শিক্ষা কর্মসূচীর প্রবর্তন হলো, এ কর্মসূচী অনুযায়ী তৃতীয় বর্ষের মাধ্যমিক শিক্ষার্থী (অর্থাৎ নবম গ্রেডের শিক্ষার্থী) একটি নতুন প্রচলিত জাতীয় পর্যায়ের পরীক্ষায় অংশগ্রহন করতে পারবে। এ পরীক্ষায় সে কৃতকার্য হলে সেই বছরের ১লা জুন থেকে শুরু হওয়া পরবর্তী ধাপের উচ্চবিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে ভর্তি হতে পারবে। এর পরে তিন বছরের উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রম শেষে তারা কলেজে ভর্তির জন্যে ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ন হতে পারবে। তাদের জন্যে শিক্ষাকার্যক্রমটি ছিলো “৬-৩-৩-৪”। প্রত্যেক প্রদেশেই তখন এই নতুন পদ্ধতির জন্যে প্রতিষ্ঠিত উচ্চবিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিলো অপ্রতুল। প্রত্যেক লিবারেল আর্ট উচ্চবিদ্যালয়ে তখন ছিলো দুটো শাখা। একটি হলো লিবারেল আর্টস প্রধান (মানবিক শাখা) এবং অন্যটি ছিলো গনিত ও বিজ্ঞান প্রধান (বিজ্ঞান শাখা)। আর প্রত্যেক শাখায় আসন সংখ্যা ছিলো ষাটটিতে সীমিত। যারা উচ্চবিদ্যালয়ের জন্যে জাতীয়ভাবে গৃহীত পরীক্ষায় অকৃকার্য হতো অথবা যারা ঐ পরিক্ষার জন্যে বসতো না তারা মাধ্যমিক স্তরের প্রচলিত পদ্ধতিতেই অর্থাৎ “৬-৬-৪” শিক্ষাকার্যক্রমের আওতায় থেকে যেতো। সেই ছয় বছরের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম শেষে তারা কলেজে ভর্তি পরীক্ষার জন্যে বিবেচিত হতো।

আমি উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তির জন্যে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরীক্ষায় অংশগহন করে কৃতকার্য হই এবং ১লা জুনে শুরু হওয়া সেনজু উচ্চবিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। এদিকে ২৫ শে জুন যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন আমি উচ্চবিদ্যালয়ে কেবল মাত্র তিন সপ্তাহের শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহন করেছিলাম। আমার বয়স তখন ১৬ বছর, অথবা প্রচলিত পদ্ধতির চন্দ্র বছর অনুযায়ী ১৭ বছর। বিদ্যালয়ে আমরা পাশ্চাত্যের (Western) দিনপঞ্জীই ব্যবহার করতাম, সে অনুযায়ী আমি তখন ১৬ বছরের বালক। প্রচলিত চন্দ্রবছর গননা মাঝে মাঝে বয়স নিরুপনে কিছু মজার এবং অগ্রহনযোগ্য সমস্যা তৈরী করতো। এই পঞ্জীকা মতে সদ্য জন্মানো কোন শিশুর বয়স ধরা হতো এক বছর। যদি শিশুটি কোন বছরের ডিসেম্বরের শেষ দিনে ভূমিষ্ট হতো তাহলে চন্দ্রমাস অনুযায়ী পরদিন অর্থাৎ ১লা জানুয়ারীতে তার বয়স হতো দুই বছর! অথচ সে তখন মাত্র ২-দিনের শিশু!

আমার সংক্ষিপ্ত তিন সপ্তাহের উচ্চবিদ্যালয় জীবনে অনেক কিছুই ততদিনে শিখেছিলাম! উল্লেখযোগ্য শ্রমসাধ্য বিষয় গুলোর মধ্যে ছিলো ইংলিশ এবং বিশ্লেষনী জ্যমিতি (Analytical Geometry)। সময়টা আমার জন্যে ছিলো নতুন জীবনের আকাঙ্খায় এক উত্তেজনাময় কাল। আমার একটা গর্ব ছিলো যে, নতুন নিয়মের একটা শিক্ষাক্রমের আওতায় উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহনের সুযোগ আমি পেয়েছি। কিন্তু অধিকতর গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে আমার সামনে অনেক গুলো নতুন অথচ সম্ভাবনাময় বিষয়ে পড়াশুনার সুযোগ এখন অবারিত হলো। শিক্ষকেরা সাধারনতঃ এখানে প্রেষনে যোগদান করতেন সেনজু মাধ্যমিক বিদ্যালয় অথবা অন্য স্বনামখ্যাত মাধ্যমিক বিদ্যালয় গুলো থেকে। স্বভাবতঃই তাঁরা সবাই হতেন তাঁদের নিজ নিজ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও অত্যন্ত খ্যতিমান এবং তাঁদের এই স্বগর্ব উপস্থিতি গোটা ক্যম্পাসেই একটা উদ্দীপনা ছড়িয়ে দিতো; ফলে শিক্ষনে ও চিন্তনে তা ব্যাপক প্রভাব ফেলতো শিক্ষার্থীদের মাঝে। আমি দারুন উপভোগ করতাম শিক্ষাঙ্গনে ব্যাপক ব্যাপ্তীতে ঢুকে পড়া মনিষীদের সেই সব বুদ্ধিবৃত্তিকতা, মনন ও চিন্তনের আবহকে। যেখানে শিক্ষন ও পরিশিক্ষনের এক অনিঃশেষ এবং আদিগন্ত সম্ভাবনা-সুযোগ যেন বিরাজমান। আমি গনিত ও রসায়ন ক্লাবের সাথে যুক্ত হয়েছিলাম। স্কুলের নিয়মিত ক্লাশের পরে সেখানেই আড্ডা দিতাম; কাটাতাম আলাপচারিতায়, আলোচনায় শিক্ষকবৃন্দের সাথে আরোও বেশী, নতুন ও অগ্রসর কিছু তথ্য জেনে নিতে।

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটা বাধ্যতামূলক বিষয় ছিলো মিলিটারী ট্রেনিং। সপ্তাহে দুই ঘন্টার সেই ট্রেনিং আমাদের নিতে হতো। জাতির প্রয়োজনে জরুরী দুর্যোগপুর্ণ মুহূর্তে আত্মনিয়োগের প্রয়োজনেই এই মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করা হতো। সেই সময়টাতে অবশ্য আমরা ব্যাপক আকারের রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যদিয়েই যাচ্ছিলাম। বিশেষ করে দক্ষিন কোরিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে স্থানীয় কমিউনিষ্ট গেরিলা এবং উত্তর কোরিয়ার কমিউনিষ্ট গেরিলাদের আকষ্মিক আক্রমন, গুপ্ত হত্যা ও গুপ্তচর বৃত্তিতে গোটা দেশ ছিলো অস্থির। তারা স্থানীয় থানায় হামলা চালাতো, হামলা চালাতো সরকারী কর্মকর্তাদের উপড়ে, হত্যার উদ্দ্যেশ্যে আক্রমন করতো প্রত্যন্ত অঞ্চলের ধনাঢ্য এবং জমির মালিকদের। তারা বেছে বেছে আক্রমন ও হত্যা করতো তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রী সাংম্যান এর আ্যসোসিয়েশন ফর দ্য র‍্যাপিড রিয়েলাইজেশন অব ইনডেপেন্ডেন্স পার্টির (Association for the Rapid Realization of Independence Party) বর্ষীয়ান ক্ষমতাধর সদস্যদের। গেরিলাদের এই আক্রমন সাধারনতঃ স্থানীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অর্থনীতিকে পর্যূদস্ত করতো আর নিরস্ত্র অসহায় সাধারন নিরপরাধ মানুষের জীবনকে হুমকীতে ফেলে দিতো। সিনজু দক্ষিন কোরীয় অঞ্চলের একটা গুরুত্ত্বপূর্ন মহানগর ছিলো যার জনসংখ্যা ছিলো তখন ষাট হাজার। গেরিলারা এই শহরটিকেও আক্রমনের লক্ষ্যে পরিনত করেছিলো। পশ্চিম সিনজুর পার্বত্য এলাকায় কমিউনিষ্ট গেরিলারা বিভিন্ন শহরে সে সময় হত্যা করেছিলো অসংখ্য মানুষ, ধ্বংস করেছিলো অসংখ্য ঘর-বাড়ি ও ভবন।

ঠিক পরের দিন, সোমবার, ২৬শে জুন বরাবরের মতোই আমি স্কুলে গিয়েছিলাম। নিয়মিত ক্লাশ হচ্ছিলো এবং স্কুলের স্বাভাবিক কাজকর্মও চলছিলো সেদিন। যদিও আমার জানা ছিলো যে, শহরে রাস্তায় রাস্তায় মিলিটারী ও দাঙ্গা পুলিশের তৎপরতা বেড়েছে! তবুও সরকারী অফিসের কাজকর্ম ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র গুলোর স্বাভাবিক তৎপরতাই ছিলো। কিন্তু রাজধানী সিউল থেকে যে খবর আসছিলো তা ছিলো বিভ্রান্তিকর ও আশংকার। আমরা খবর পাচ্ছিলাম যে উত্তর কোরিয়ার কমিউনিষ্ট বাহিনী দক্ষিনে তাদের রক্তক্ষয়ী অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে। একেবারে যথার্থ ৩৮ সমান্তরাল লাইন বরাবর তারা এ উপত্যকায় নেমে আসছে! রাজধানী সিউলের দূরবর্তী প্রত্যন্ত এলাকা গুলোতে তারা ইতোমধ্যে তাদের ভারী অস্ত্রশস্ত্র সমেত নির্মম ও নির্দয় আঘাত হেনেছে! মুখোমুখি হয়েছে অপেক্ষাকৃত সহজ ও ছোট দক্ষিন কোরীয় প্রতিপক্ষ সেনাবাহিনীর বিপরীতে। দক্ষিন কোরীয় সেনাবাহিনী (ROK Army) অতিশয় হালকা অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত এবং অত্যন্ত শোচনীয় ভাবে বিশাল এক শক্তিধর বাহিনীর বিপরীতে লড়াইরত! এটা ছিলো সম্পূর্ন অপ্রস্তুত অবস্থায় প্রস্তুত ও সুসজ্জ্বিত অনুপ্রবেশকারী উত্তর কোরীয় কমিউনিষ্ট সৈন্যদের সাথে এক অসম মোকাবেলা। খবরের কাগজ গুলোতে ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু ছিলোনা কিন্তু একটা গুজব শোনা যাচ্ছিলো যে ব্যাপক ধ্বংস সহ বিশাল সংখ্যায় দক্ষিন কোরীয় সেনা ও নিরস্ত্র সাধারন মানুষ নিহত ও আহত হয়েছেন সেই আক্রমনে। প্রথমদিকে আমরা শুনেছিলাম যে পশ্চিম তীরবর্তী হেজু-অংজিন (Haeju-Ongjin) সীমান্তবর্তী এলাকায় লড়াই চলছে, যা আগেও প্রায়ই বহুবার হয়েছে। হানাদার বাহিনী যখন হামলা শুরু করে তখন একেবারে শুরুতে দক্ষিন কোরীয় সেনা বাহিনীর (ROK Army) হাতে একটি ট্যাঙ্ক পর্যন্ত ছিলোনা! সবচেয়ে ভালো অস্ত্র বলতে যা বোঝায় তখন দক্ষিণ কোরীয় বাহিনীর হাতে ছিলো কিছু সাঁজোয়া যান যা দিয়ে রাজধানী সিউল কে রক্ষা করতে হবে; অন্য দিকে শতাধিক রাশিয়ায় তৈরী ট্যাঙ্ক নিয়ে উত্তর কোরীয় সেনারা চালিয়েছে অতর্কিতে আক্রমন!