ছবিটি ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।

ছবিটি ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।

আজ ইসলামী মৌলবাদীদের হাতে নিহত ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিষ্ট ওয়াশিকুর বাবুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। বেঁচে থাকলে এখন বাবুর বয়স হতো ২৮ বছর। বাবুকে নৃশংসভাবে হত্যার পর থেকে ওর পরিবারকে ফোন করে তাদের খোঁজ-খবর নেবার চেষ্টা করেছি। তারা ভাল নেই। পরিবারের একমাত্র পুত্র সন্তান, বাবা-মায়ের ভবিষ্যত স্বপ্ন আর ভরসা, আর বোনের একমাত্র ভাইকে এমন নৃশংসভাবে কেড়ে নেয়া হলে, একটি পরিবারের সঙ্গে রাষ্ট্র, সমাজ এবং ধর্ম কর্তৃক এতটা ভয়াবহ অন্যায় আচরণ করা হলে সেই পরিবারটির আর ভাল থাকার কথা নয়।

'ওয়াশিকুর বাবুর' স্মৃতি পেইজ থেকে সংগৃহিত

‘ওয়াশিকুর বাবুর’ স্মৃতি পেইজ থেকে সংগৃহিত

বাবুর জন্ম বাংলাদেশের একটি মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে। সামাজিক ও পারিবারিক ধর্মীয় বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসা বাবুর জন্য খুব সহজ ছিল না। আর্থিক অসচ্ছলতার কারনে নাম করা কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করা বা ভবিষ্যতের কথা ভেবে বড় কোন প্রশিক্ষণে শিক্ষালাভ করা বাবুর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তারপরও পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিকূল অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার অবিরাম সংগ্রাম করেছে সে। যে দেশে এই বয়সের বেশিরভাগ তরুণেরা আড্ডা আর হাসি-তামাশা করে সময় কাটায়, সেখানে সে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে নিজেকে প্রস্তুত করছিলো ভবিষ্যতের জন্য।

২০১৩ সালে যখন বাংলাদেশের চার ব্লগারকে গ্রেফতার করা হয়, তখন অনেক বড় বড় ব্লগার, লেখক আর বুদ্ধিজীবিরা সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে ভয়ে চুপ করেছিলেন। ওয়াশিকুর বাবু সেই মানুষদের একজন যে সেই সময়ে ঢাকা প্রেসক্লাবের সামনে উপস্থিত থেকে প্রতিবাদ করার সাহস দেখিয়েছিল। যার প্রমাণ পাওয়া যায় নিহত ব্লগার ও বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়ের ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ বইটিতে। এমনকি ২৬ ফেব্রুয়ারি যেদিন বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়কে বইমেলায় নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো, তখনও বাবু রাস্তায় নেমে মৌলবাদী খুনীদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নির্ভয়ে প্রতিবাদে করেছিল।

বিশ্বাসের ভাইরাস: অভিজিৎ রায় : ১ম সংস্করণ: পৃষ্ঠা: ৬৮

বিশ্বাসের ভাইরাস: অভিজিৎ রায় : ১ম সংস্করণ: পৃষ্ঠা: ৬৮

আমাদের অনেকের মতো বাবুর পরিবারের সদস্যদের মনে আজও সেই একই প্রশ্ন,- এই ছোট-খাট রুগ্ন দেহের ছেলেটা ইসলামের কি এমন ক্ষতি করেছিল, যে তাকে এত বড় পরিকল্পনা করে খুন করতে হলো? অথচ বাবুর নামতো জঙ্গীদের তালিকাতেও ছিল না। তাদের কি করে বোঝাই, এই অল্প বয়সী রুগ্ন ছেলেটি যে ধর্মের ভীত ধরে কত জোরে নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছিল, তা দেশের শক্তিশালী আর প্রতিষ্ঠিত অনেক লেখক, সাহিত্যিক আর বুদ্ধিজীবিরাও পারেননি।

ধর্মকারী থেকে সংগৃহিত

ধর্মকারী থেকে সংগৃহিত

এই রুগ্ন ছেলেটির মাথায় বুদ্ধি ছিল, কথায় যুক্তি ছিল, লেখায় ধার ছিল। সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আর ধর্মান্ধতা এবং ধর্ম-ব্যবসা নির্মূল করার প্রশ্নে সে মোটেও দূর্বল ছিল না। কোটি কোটি মগজহীন ধর্মান্ধদের দেশে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হবার জন্য বাবু একাই যথেষ্ট ছিল। বাবুর যৌক্তিক লেখা আর প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ এ অন্ধ- বর্বর জঙ্গী বিশাল জনগোষ্ঠীর হাতে বাবুকে খুন করাই ছিল একমাত্র সমাধান।

বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়কে ইসলামী মৌলবাদীরা হত্যার করার পর বাবু তার ফেসবুকে লিখেছিল ” কথার মৃত্যু হয় না”। কিন্তু তখনও বুঝতে পারেনি তার নিজের শক্তিশালী যৌক্তিক কথাগুলো অন্তর্জালে অমরত্ব পাবে। বাবুর ছোট ছোট যৌক্তিক লেখা আর প্রশ্নগুলো অন্তর্জালের মাধ্যমে এখন মানুষ আগের চেয়ে অনেক গুণ বেশি পড়ছে। বাবুর যৌক্তিক লেখাগুলো পড়ে যে সকল নতুন নতুন তরুণেরা ধর্মের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে আলোকিত জীবনের সন্ধান পাচ্ছে, কিংবা আমরা যারা বাবুকে ভালবাসি তারাই বাবুকে অমর করে রাখবো। বাবুর লেখার মৃত্যু নেই।

ওয়াশিকুর বাবুর প্রোফাইল থেকে সংগৃহিত

ওয়াশিকুর বাবুর প্রোফাইল থেকে সংগৃহিত

বাবুহীন এক বছর। বাবুকে হত্যা করে বাংলাদেশ, তার রাষ্ট্রধর্ম, আর ধর্মের কৃতদাসেরা গত এক বছরে কি অর্জন করেছে তা আমার জানা নেই। সেই দিনটি দেখার অপেক্ষায় রইলাম, যেদিন অভিজিৎ, অনন্ত, নীল, রাজীব, দীপন আর বাবুকে হত্যার ফল বাঙলাদেশ অবশ্যই ভোগ করবে; তা এখনও উপলব্ধি করার সময় আসেনি। বাবু হত্যার বিচার হয়তো বাংলাদেশ রাষ্ট্র কোনদিনই করবে না। কিন্তু মাত্র ২৭ বছরের রুগ্নদেহী এই তরুণ সারা বিশ্বের মানুষকে নিজের জীবন দিয়ে দেখিয়ে গেছে কিভাবে মেধা, যুক্তি আর সাহস দিয়ে কুংস্কার, ভন্ডামী, ধর্মান্ধতা আর ধর্ম-ব্যবসার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়। বাবুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে আজ শুধুই বাবুর স্মৃতির প্রতি অনেক শ্রদ্ধা ও ভালবাসা রইলো।

অন্ধকারের বিরুদ্ধে লড়াই করে আলোকিত বিশ্ব গড়তে বাবু এক নির্ভিক যোদ্ধা, অন্ধকারের দেশে এক আলোর পথের যাত্রী। ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যার বিচার চাই।

ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা (৩০ মার্চ, ২০১৬)