“চিৎকার কর মেয়ে দেখি কতদূর গলা যায়;
আমাদের শুধু মোমবাতি হাতে নীরব থাকার দায়;
আমাদের শুধু ধ্বজাভাঙা রথে এগিয়ে চলার দায়;
প্রশাসন শুধু আড়ালে থেকে হাততালি দিয়ে যায়।”

কী জানি তনু সেদিন কতটা চিৎকার করেছিল, যন্ত্রণায় কতটা ছটফট করেছিল, নিজেকে বাঁচাতে কী সে অনুনয় বিনয় করেছিল নাকি কোনোরূপ প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিল তার সম্ভ্রম রক্ষার্থে, আমরা তা কোনদিনও জানতে পারব না । আমরা কিছুদিনের জন্য অতি মানবিক হয়ে উঠব, ফেজবুকে স্ট্যাটাস দেব; মানববন্ধন করে রাস্তায় নামব, পত্রিকায় দু এক লাইন লিখব, কিম্বা তনুর সামধিতে দুটি ফুলের তোড়া দিয়ে এক মিনিটের সৌজন্য নীরবতা পালন করব। আর ততদিনে আবার নতুন কোন তনু ধর্ষিত হবে, হবে হত্যা, অতঃপর লাশ!আর আমরা এই একইভাবে আবারো আমাদের নীরবতা পালন করব; যেন এতেই আমাদের সব দায় শোধ হয়ে যায়।

তনুর হত্যার বিচার চাওয়ার আগে আসুন আমরা একটু পেছনে ফিরে দেখি কেন তনুরা ধর্ষিত হয়; আর এর দায়ই বা কার? ধর্ষণের এই তালিকায় তনুই শেষ নাম নয়, এবং তনুই শুরু নয়। পাঠককে একটু মনে করিয়ে দিতে চাই ইয়াসমিনের কথা, সীমা চৌধুরীর কথা। একইভাবে যারা আমাদের শান্তি, শৃঙ্খলা আর নিরাপত্তা বিধানের মালিক, আমাদের পুলিশ বাহিনীর হেফাজতেই ধর্ষিত হয়েছিল। ১৯৯৫ সালে রাতের আঁধারে পুলিশ ভ্যানে ইয়াসমিনকে গণ ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয়েছিল; সেদিন সেই হত্যার বিচারের দাবিতে ফুঁসে উঠেছিল দিনাজপুরের জনতা। আর আমাদের প্রশাসন, জনতার জমায়েতে গুলি চালিয়ে মেরে ফেলেছিল নীরিহ সাধারণ আরও সাতজনকে; আজতক সেই সাত খুনের মামলার বিচার পায়নি সাধারণ জনতা। কী বিচিত্র এই দেশ! আর কতটা অসহায় আমরা সাধারণ জনগণ!
বিচারের দাবীতে প্রাণ হারাতে হলে কার কাছে বিচার চাইব আমরা? বিচারহীনতার সংস্কৃতি-আইনের শাসনহীনতাই যখন দেশের মূল চালিকা শক্তি সেখানে জনতার ক্ষমতা কতটুকু? যে দেশে প্রশাসনের তত্বাবধানে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়; আর সেই ধর্ষণ জায়েজ করতে ধর্ষিতাকে পতিতা বলে চালিয়ে দেওয়া হয় সেখানে ধর্ষণ তো এক মামুলী ব্যাপার; এক অতি ক্ষুদ্র অপরাধমাত্র। যে দেশের সংস্কৃতি ধর্ষককে দিনের আলোয় বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ করে দেয়; আর ধর্ষিতাকে বয়ে বেড়াতে হয় আজীবনের দুঃসহ যন্ত্রণা সেখানে বিচার কেন হবে ধর্ষণের? কে করবে এর বিচার? বিচারপতির বিচার চেয়ে কে হারাবে এমন বেঘোরে প্রাণ? এ দেশের জনতা আজ বড় অসহায়।

যেহেতু ধর্ষণ সংঘটিত হয় ক্ষমতার প্রভাবে, আইনের ছায়াতলে, সুবিধেবাজদের মজা লোটার লক্ষ্যে আর বিচারহীনতার প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতির ফলে; জরিমানায় আর মধ্যস্থতায় যেখানে ধর্ষণের মামলা মিটমাট হয়ে যায় সেখানে নিত্য শুরু হবে ধর্ষণের উৎসব বিনা দ্বিধায় সেটাই স্বাভাবিক। তনুর ঘটনায় আজ উত্তাল হয়েছে বাংলাদেশের প্রতিটি কোণ; সরব হয়েছে ফেজবুক, আজকের তরুণেরা, মানবিক বোধ সম্পন্ন মানুষেরা নেমেছে রাস্তায়। কিন্তু অতি আশ্চর্যজনকভাবে আমাদের মিডিয়া রয়েছে নীরব। ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ পরেও আসেনি কোন দায়িত্বশীল বক্তব্য কুমিল্লা সেনানিবাস প্রশাসন থেকে। কোনরূপ বক্তব্য শুনিনি আমাদের প্রশাসন তথা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকেও। এতে কি এটাই প্রমানিত হয়না যে অস্ত্রের মুখে, বন্ধুকের নলের মুখে আমাদের মিডিয়া, আমাদের প্রশাসনও নীরব?

সম্প্রতি আমাদের নৌ পরিবহন মন্ত্রী নারী দিবসের এক অনুষ্ঠানে তার বক্তব্যে বলেছেন, “উন্নত বিশ্বের সবখানেই আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ধর্ষনের ঘটনা ঘটে; সে তুলনায় আমাদের ঘটনাগুলো তেমন কিছু নয়।” পহেলা বৈশাখে নারীর শ্লিলতাহানীর ঘটনায় আমাদের পুলিশের আইজিও একইভাবে বলেছিলেন,“এগুলো ছেলেপুলেদের দুষ্টুমী।” আর এ থেকেই খুব সহজে উপলব্ধি করা যায়, আমাদের প্রশাসন, আমাদের নীতি-নির্ধারকেরা তথা আমাদের ক্ষমতা কাঠামোর শীর্ষে থাকা দায়িত্বশীল মানুষগুলো ধর্ষণকে কী চোখে দেখেন। আর এটি নিরসণে তাদের স্বদিচ্ছাও আমাদের কাছে সুস্পষ্ট। একথা সত্য যে, ধর্ষণ কেবল বাংলাদেশের সমাজেই ঘটেনা, পৃথিবীর সকল দেশেই সভ্যতার আদিলগ্ন থেকেই ধর্ষণ ঘটছে। ধর্ষণের ঘটনা পৃথিবীর জন্মের মতই পুরাতন। নারী মাংসের গন্ধ শুঁকে শুঁকে পুরুষ হায়েনারা কামোত্তেজনায় মেতে না উঠলে তারা কীসের পুরুষ? এটাই তো পুরুষের আদি চরিত্র(?!)কিন্তু আমরা বিস্মিত হই যখন দেখি একটি স্বাধীন দেশে, সভ্য সমাজে, রাজনৈতিক মদদপুষ্ট গুণ্ডারা, প্রশাসন এবং রাষ্ট্রক্ষমতার ছায়াতলে থেকে প্রকাশ্যে, দিনের আলোয় এমনকি ধর্ষিতার নিজের ঘরেও ধর্ষণের হোলি খেলায় মেতে ওঠে!

আমাদের সাংস্কৃতিক রেওয়াজ অনুযায়ী যে কোন ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেই আমরা শ্রেণীবিশেষে ধর্ষিতার চরিত্র নিয়ে আদ্যোপান্ত চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে শুরু করি। খুঁজে বের করতে থাকি ঠিক কী কী কারণে একটি মেয়ে শিশুকে, কিশোরিকে, যুবতিকে কিম্বা একজন পুর্ণ বয়স্কা নারীকে ধর্ষিত হতে হয়। ঠিক কী কী উপায়ে তারা নিজের ধর্ষণ নিজেই প্রতিরোধ করতে পারত। এর মধ্যে বহুল প্রচলিত যেসব আলোচনা অতি প্রাধান্য পায়; সেগুলো হল, কী দরকার ছিল একা একা যাবার, কী দরকার ছিল অত রাত অবধি বাইরে থাকার, মেয়ে মানুষ হয়ে এত সাহস ভাল নয়, মেয়েদের কেন মেলায় যেতে হবে, কেন তাদের ভীড়ের মধ্যে যেতে হবে; এ জাতীয় হাজারো কেন আর কী দরকারের প্রশ্নে আমাদের দেশে বরাবরই ধর্ষণ জায়েজ হয়ে যায়। অপরপক্ষে, হাল্কা হয়ে যায় ধর্ষকের অপরাধ। কেউ বিশ্লেষণ করেনা ধর্ষকের চরিত্র নিয়ে; কেউ এক ঘরে করে রাখেনা ধর্ষককে, কেউ থু থু ছেটায় না ধর্ষকের মুখের ওপর; এমনকি ধর্ষকের ছবিও ছাপা হয়না আমাদের মিডিয়ায়, হয় ধর্ষিতার ছবি ছাপা। সেখানে লক্ষ চোখের সামনে ধর্ষিতার মৃত, নগ্ন শরীর আরেকবার ধর্ষণের শিকার হয়, কোর্টে মামলা উঠলেও বিপক্ষের উকিলের জেরার মুখে ধর্ষিতা শিকার হয় আরেকবার ধর্ষণের। কোন কোন ক্ষেত্রে ধর্ষণের মামলার বিচার হলেও ভিকটিমকে হত্যা করায় সেই বিচারের সুফল তার ভোগে আসে না; কিম্বা বেঁচে থেকেও সমাজের কারণেই তাকে আজীবন যন্ত্রণাদগ্ধ জীবন কাটাতে হয়। এ সমাজে ধর্ষিতা নারীর ভাল বিয়ে হয়না। সমাজ তাকে অচ্ছুৎ বলে ফেলে রাখে এক অনন্ত অভিশপ্ত জীবনের গর্ভে; যেখান থেকে তার মুক্তি মেলে না আর।

সমাজ মনোস্তত্ত্ববিদ ও জেন্ডার গবেষকদের ধর্ষণ বিষয়ক গবেষণার বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ব্যাতিরেকেও খুব মোটাদাগে ধর্ষণের কারণ হিসেবে যে বিষয়টি প্রথমতঃ এবং প্রধানতঃ উল্লেখ করা যায় সেটি হল; সর্বক্ষেত্রেই নারীর প্রতি সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গী। অর্থাৎ, পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, সমাজ তথা রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীই নারীকে প্রতিনিয়ত ধর্ষনের শিকার হতে বাধ্য করছে। যে দৃষ্টিভঙ্গী নারীকে করেছে অধস্থন, করেছে পণ্যসামগ্রী-ভোগ্যবস্তু। নারী কেবল পুরুষের শয্যাসঙ্গী হতেই জন্ম নিয়েছে, নারী কেবল পুরুষের যৌন আনন্দদানের মেশিন হিসেবেই স্বীকৃত। নারীর পুনুরুৎপাদনমূলক ক্ষমতা এবং ভূমিকা অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখেনি; ঘটেনি নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি। নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পুরুষের ওপরেই নির্ভরশীল। আর তাই নারী বিবেচিত হয় দ্বিতীয় লিঙ্গ হিসেবে। নারী হয়ে ওঠেনা পুরুষের সহযোদ্ধা, হয়না বন্ধু-সাথী। নারী হয়ে যায় অর্ধমানব কিম্বা উনমানব। নারী কখনোই হয়ে ওঠেনা নিজের শরীর আর মনের মালিক!

নারীর অর্থনৈতিক পরাধীনতা নারীকে করে গৃহবন্দী; কখনো শাসনের বেড়াজালে, কখনো ভালোবাসার শেকলে। চার দেয়ালের চৌহদ্দিতে নারীর জীবন বন্দী থাকুক; নারী থাকুক আলোহীন অন্ধকারে। নারী কেবল পুরুষের মনোরঞ্জনের সেবাদাসী হোক, পুরুষের উত্থিত লিঙ্গের উত্তেজনা নিবারণের সামগ্রি হোক; এই আমাদের সমাজ মানসের চেতনা। যা হাজার বছর ধরেই লালিত। সুতরাং, একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ধর্ষণ কেবলই নিছক কোন দুর্ঘটনা নয়, নয় কোন মনোবৈকল্যের কারণ কিম্বা কোন দুষ্টচক্রের ষড়যন্ত্র। এ আমাদেরই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ! অধস্থনের ওপর পিতৃতন্ত্রের শক্তি আর দম্ভের প্রতিভূত্বে মেতে ওঠা সমাজ; চিরাচরিত শ্রেণী শোষকের সমাজ।

সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসে এহেন যখন পরিস্থিতি সমাজ এবং রাষ্ট্রের তখন ধর্ষণ নির্মূল কীভাবে সম্ভব? ওপরে বর্ণিত কারণের সাথে একমত হয়ে প্রথমতঃ এবং শেষতঃ একটিই সমাধান হতে পারে; নারীর প্রতি সমাজের তথা পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন সাধন। যদিও আমাদের সমাজে সেই পরিবর্তন কতটা সহজসাধ্য ও দ্রুতলয়ে ঘটানো সম্ভব সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তথাপিও এর কোন বিকল্প নেই; যতদিন আমরা নারীকে মানুষ হিসেবে দেখতে না শিখব, নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হবে না ততদিন। যতদিন নারী-পুরুষের সামাজিক সাম্যতা অর্জনে সক্ষম হব না আমরা, ততদিন অরক্ষিত থাকবে আমাদের মেয়েরা-বোনেরা-মায়েরা। নারীর এগিয়ে যাবার সকল পথ হবে রুদ্ধ। অর্ধেকেরও বেশি জনগোষ্ঠীকে এভাবে অবদমিত করে পিছিয়ে পড়বে আমাদের রাষ্ট্র-সমাজ।

সুতরাং একথা বলা নিষ্প্রয়োজন, নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনে ব্যক্তিমানস থেকে শুরু করে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, সমাজ তথা রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ এখন শুধু সময়ের দাবিই নয় অতীব জরুরি। আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের সকল নিউরণে দীর্ঘদিন ধরে গেঁথে থাকা ছেলেতে মেয়েত পার্থক্য নিরূপণে তাদের আচার-আচরণ, পোশাক-আশাক, কর্মবিভাজন এবং শিক্ষাগ্রহণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে এখন আমূল পরিবর্তন দরকার। দরকার মননের পরিচর্যার আর মানবিকতা বোধ জাগ্রত করার। আর এই চর্চার প্রথম ক্ষেত্র অবশ্যই পরিবার।
(১) প্রতিদিনের জীবনের বেড়ে ওঠায় ছেলে শিশুটির মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া দরকার তার বোনটিও তারই মত খেলাধুলা করতে পারে, পরতে পারে স্বাচ্ছন্দ্যময় পোশাক, আনন্দ-উৎসবে যেতে পারে তারই মত সকল জায়গায়।
(২) ছেলে শিশুদের নিজের বোনের প্রতি যেরূপ মায়া-মমতা, শ্রদ্ধা-ভালবাসা তা যেন তার প্রতিবেশিনী, সহপাঠিনি কিম্বা বন্ধুদের বোনের জন্যও সমভাবে থাকে সেই শিক্ষা দেওয়া।
(২) স্বামী-স্ত্রীর সুসম্পর্ক দেখেও সন্তানেরা বিশেষত ছেলে শিশুরা নারীকে সম্মান করার শিক্ষা পেয়ে থাকে। যে পরিবারে স্বামী তার স্ত্রীকে সম্মান করে, সেই পরিবারের ছেলে সন্তানেরা মাকে সম্মান করে, ভালোবাসতে শেখে, এবং এই শিক্ষা তারা পরবর্তীতে ব্যক্তিগত জীবনেও প্রয়োগ করে।

দ্বিতীয় পর্যায়ের দায়িত্ব শিক্ষকদের; যারা মানুষের দ্বিতীয় জন্মদাতা হিসেবে স্বীকৃত;
(১)পরিবারের পরে শিশুর প্রথম শিখন ক্ষেত্র হল বিদ্যালয়; শিশুরা শিক্ষকদেরকে বাবা-মায়ের চেয়ে অধিক বেশি সম্মান করে। ছেলে শিশুরা শিক্ষকদের কাছে সহপাঠিনীদেরকে তাদের কোন আচরণ, কথা ও কাজে কোনভাবে ছোট, হেয় কিম্বা অসম্মান না করার শিক্ষা পেলে তারা তা অন্তরে ধারণ করবে এবং প্রতিদিনের জীবন চর্চায় নিয়ে আসবে।
(২) কর্মবিভাজনের ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়েতে যে বৈষম্য বিদ্যমান সেটি নিরসনেও শিক্ষকদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা; মেয়েরাও পারে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে যেকোন পেশা নির্বাচন করতে ও সফল হতে এই বিশ্বাস সহপাঠিনীদের প্রতি সকল ছেলেদেরই থাকতে হবে।
(৩) শিক্ষালাভ এবং কর্মক্ষেত্রে মেয়েরা বন্ধু হতে পারে; প্রতিপক্ষ কোনভাবেই নয়; একে অপরের সম্পূরক বা পরিপূরক হতে পারে এই বিশ্বাস স্থাপনেও শিক্ষকদের ভূমিকা রয়েছে।

তৃতীয়তঃ এবং সর্বোপরি এর দায় রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।
(১) রাষ্ট্রে শুধু আইন থাকলেই চলবেনা, যুগোপযোগী আইন প্রণয়ণ ও তার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে হবে।
(২) একটি মানবাধিকার পুর্ণ নারী–পুরুষের সমতাভিত্তিক সমাজ নির্মানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আন্তরিকতা থাকতে হবে।
(৩) ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রীতা কমিয়ে অতি দ্রুত আরও ভয়াবহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে; যাতে একজন ধর্ষকের সারাজীবনের সকল অর্জন ম্লান করে দিতে পারে ধর্ষণের মত একটি অপরাধ।
(৪) মিডিয়ায় ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষিতার ছবি প্রকাশ না করে ধর্ষকের ছবি প্রকাশ ও ধর্ষকের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে হবে। যাতে করে ধর্ষক সারাজীবন নিজের কৃতকর্মের যন্ত্রণায় ধর্ষিতার মত একইভাবে দগ্ধীভূত হয়।আর এভাবেই সম্ভব এ জাতীয় জঘ্যণ কর্মকাণ্ডের ভয়াবহতা প্রশমন।

আসুন ধর্ষণ প্রতিরোধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলি, ধর্ষণের পিতৃতান্ত্রিকতা ভুলে ধর্ষণমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে ঘৃণা করি ধর্ষককে; সামাজিকভাবে ধিক্কার জানাই ধর্ষককে। আমাদের ছেলেদেরকে শেখাই জোর করে কারও যোনিতে বীর্যপাতে কোন শৌর্য নেই; সেটা কাপুরুষোচিত; সেটা লজ্জার। আর মেয়েটিকে শেখাই ধর্ষণের দায় তার নয়, তার শরীরেরও নয়, এ লজ্জা এ কলঙ্ক সমাজের, রাষ্ট্রের; ঘুরে দাঁড়াতে শেখাই মেয়েদের। যাতে করে তাদের আর না হতে হয় লালসার শিকার, আর মরতে না হতে হয় ধর্ষনোম্মুখ সমাজের ক্রীড়নক হয়ে!

অন্যথায় নারী মাংসভোজীরা মাংসের গন্ধ শুঁকে শুঁকে আরও ধর্ষণ করতেই থাকবে। শত হিজাবের আড়ালেও আমরা পারবনা আমদের প্রিয় কন্যাটিকে, বোনটিকে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা দিতে। ধর্ষকের লালা ঝরবে ওদের শরীরে, পড়বে হিংস্র নখরের থাবা। আমাদের কেবল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে ইয়াসমিন, স্মৃতিকনা, কল্পনা, পূর্নিমা আর তনুদের তালিকা। আর দীর্ঘ এই তালিকার শেষে দাঁড়িয়ে দেখব আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ কেবল পেছনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। হেরে যাচ্ছি আমরা। পরাজিত হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতার অর্জন, ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

বিঃদ্রঃ লেখাটি সিলেট টুডেতে প্রকাশি হয়েছে ২৯/০৩/২০১৬ তারিখে।