ধর্ম বলতে সাধারণত: আমরা দু’ধরণের ধর্মের কথা বুঝে থাকি। এক-মানুষ বা বস্তুর সহজাত ধর্ম, দুই-উপাসনা ধর্ম (worship religion) ।

সহজাত ধর্ম হল একটি মানুষের বা বস্তুর বৈশিষ্ট্য বা গুণাগুণ, ইংরেজিতে যাকে বলে properities ।যেমন-পানির ধর্ম-সমুচ্চশীলতা, নীচের দিকে প্রবাহিত হওয়া, অগ্নি নির্বাপন করা, আমাদের তৃষ্ণা মেটানো, ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে বাস্প হয়ে যাওয়া, শূণ্য ডিগ্রি সেলসিয়াসে বরফ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। আগুনের ধর্ম পোড়ানো, তাপ সৃষ্টি করা, বাতাসের ধর্ম প্রবাহিত হওয়া, অক্সিজেন দ্বারা আমাদের জীবন রক্ষা করা ইত্যাদি। তারা কোন উপাসনা করে না । ফলত: তাদের কিংবা অন্য যেকোন বস্তুর কোন উপাসনা ধর্ম নেই । উপাসনা ধর্ম আছে একমাত্র মানুষের। একমাত্র মানুষই তার নিজের ধর্ম অনুসারে উপাসনা বা প্রার্থণা করে থাকে।

রাষ্ট্র কি? খুব সহজভাবে বললে-একটি ভূ-খণ্ড, সে ভূ-খণ্ডে বসবাসকারী একটি জনগোষ্ঠী এবং সে জনগোষ্ঠীর সম্মতিতে এবং তাদের প্রতিনিধিত্বের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি সরকার বা কর্তৃপক্ষ-যার প্রধান কাজ হল উক্ত ভূ-খণ্ডের জনগোষ্ঠীর সার্বিক কল্যাণ । এ অর্থে রাষ্ট্রকে একটি সংঘ বা সমিতিও বলা যেতে পারে। রাষ্ট্র কি কোন জৈবিক সংস্থা?-না। রাষ্ট্র কি কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টি?-তাও না। বস্তুত রাষ্ট্র একটি কনসেপশন বা ধারণা। তাকে বুঝা যায়-ধরা-ছোয়া যায় না। তাই রাষ্ট্রের যে ধর্ম, তাহল রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট-যেমন-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র, রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, কল্যাণমূলক রাষ্ট্র ইত্যাদি । রাষ্ট্র যে বৈশিষ্ট্যেরই হউক না কেন, তার কোন উপাসনার প্রয়োজন নেই, সে উপাসনা করে না । রাষ্ট্রের মাথায় টিকি, টুপি পড়ানো যায় না, রাষ্ট্রকে খৎনাও করানো যায় না। রাষ্ট্র উপাসনা করে না । কারণ কোন রাষ্ট্র স্বর্গ বা নরকে যাবে, এমন অদ্ভূত দাবী কেউ কখনো করে না। সুতরাং তার কোন উপাসনা ধর্মের প্রয়োজন কেন থাকবে?

যারা বলেন-সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হিসাবে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম রাখলে ক্ষতি কি? তাদের বিষয়টি অন্যভাবে ভেবে দেখতে বলি। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দেশ বলে যদি ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা যুক্তিসঙ্গত হয়, তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর দেশের রাষ্ট্রধর্ম কেন সনাতন হিন্দু ধর্ম হবে না, আর,এস,এস, এর রামরাজ্যের দাবীর আমারা কিভাবে বিরোধীতা করব? সংখ্যাগরিষ্ঠ খৃষ্টান ও বৌদ্ধদের দেশের রাষ্ট্রধর্ম কেন খৃষ্টানধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম হবে না।

তা যদি আমরা মেনে নিই, তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে ? বিশ্বের সকল দেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে কোন না কোন ধর্ম থাকবে । তাহলে ফলাফল কি দাঁড়াচ্ছে্? প্রত্যেক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রধর্মের বাহিরের জনগোষ্ঠী হীনমন্যতায় শুধু ভুগবে না, তাদের অনেক ধর্মীয় আচারানুষ্ঠান পালন থেকেও তারা বঞ্চিত হবে। এ কথা বলাই বাহুল্য যে, মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে আজ যত মুসলিমদের বসবাস, মুসলিম প্রধান নয়, এমন দেশগুলোতে মুসলমানদের সংখ্যা তার চেয়ে ঢের বেশী । তাহল কি দাঁড়াচ্ছে?

প্রায় প্রত্যেক দেশেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নিগৃহীত কিংবা তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান করার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হবে। নীট ফলাফল দাঁড়াবে-বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিমও তাদের ধর্মীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। তা কি আমাদের কাম্য হতে পারে?

এ কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, যারা রাষ্ট্রের সাথে কিংবা রাজনীতির সাথে ধর্মকে মিশিয়ে ফেলতে চান, তারা আসলেই ফেরেববাজ,শঠ, কিংবা মধ্যযুগীয় পশ্চাতপদতাকে আকঁড়ে থাকা বিভিন্ন ধর্মের গণ্ডমুর্খ মৌলবাদী গোষ্ঠী । ধর্মকে তারা কেবল রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়। তাদের কেউই প্রকৃত অর্থে ধার্মিক কিনা প্রশ্ন করা যায়।

আমরা কেন ভুলে যাব, গণআন্দোলনের তোড়ে স্বৈরাচারী এরশাদের গদি যখন টলটলায়মান, তখন সে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার মাধ্যমে চমক সৃষ্টি করে শেষ রক্ষা পেতে চেয়েছিল। ব্যক্তি জীবনে এরশাদ যে কেমন ধার্মিক, তার ফিরিস্তি দেওয়ার কি কোন প্রয়োজন আছে?

এবার আসি ঐতিহাসিক পটভূমিতে। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে এ উপমহাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রাম যখন সফলতার দ্বার প্রান্তে, তার শেষ পর্যায়ে নানা রাজনৈতিক চক্রান্তের ফলশ্রুতিতে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক একটি ধর্মীয় রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। তার শোষণ নিপীড়ন থেকে মুক্তি পাওয়ার আকাঙ্খা থেকেই এদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন-বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদী চেতনার ভিত্তিতে।

আমাদের সেদিনের শ্লোগান ছিল-জাগো, জাগো-বাঙ্গালি জাগো। তুমি কে, আমি কে-বাঙালি, বাঙালি। এ বাঙ্গালি জাতির মধ্যে ছিল হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, আরো বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় । যে কারণে স্বাধীনতার অব্যবহিত পর আমাদের সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনার প্রতিফলন হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজিত হয়েছিল । আজ আমাদের রাষ্ট্র যদি সে অবস্থা থেকে সরে আসে, তাহলে তা হবে মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের সাথে চুড়ান্ত বেঈমানী। সেটাই যদি আমরা মেনে নিই, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে বাগাড়ম্বরতার কোন অধিকার আর আমাদের থাকে না।

দেশের কতিপয় প্রতিতযশা নাগরিক তথাকথিত রাষ্ট্রধর্মের বিরুদ্ধে যথার্থভাবেই একটি রীট করেছিলেন দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আদালতে । এ জাতীয় রীটকে আইনের ভাষায় বলা হয়-Public interest litigation (PIL) বা জনস্বার্থে মামলা-যা দেশের যে কোন নাগরিক অবশ্যই করতে পারেন। আইনের ছাত্র হিসাবে আমাদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারকদের অভিমত শুণে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। ঐ রীট দাখিল করার এখতিয়ার বা Locus standi না থাকার অজুহাত তুলে তারা রীট পিটিশনটি খারিজ করে দিয়েছেন। আহা-মরি মরি। দেশের সংবিধান নিয়ে কথা বলার কিংবা মামলা করার Locus standi বা এখতিয়ার যদি বাংলাদেশের কোন নাগরিকের না থাকে, তাহলে সে এখতিয়ার কার থাকবে? তাহলেতো দেশের সংবিধান-যাতে বলা আছে জনগণ হল দেশের মালিক-তা পাল্টাতে হয়। মাননীয় বিচারপতিদের এ প্রশ্নের জবাব একদিন দিতে্ই হবে।

আদালতের এ আদেশে, অর্থাৎ মামলা খারিজের কারণে যারা উদ্বাহু নৃত্য করছেন-তাদের বলি-এ কিন্তু শেষ নয়। সমাজ-সভ্যতার ক্রমবিকাশের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব, অগ্রগতির চাকাকে কখনো কখনো পেছনে টানা যায়-কিন্ত তা সাময়িক-চুড়ান্ত বিচারে সমাজ এগিয়েই চলেই । আজকের যুগে এগিয়ে যেতে হলে, উন্নত সমাজ গড়তে হলে,মানবাধিকার সংরক্ষণ, সুশাসন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন অগ্রগতি অর্জন করতে হলে, আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার কোন বিকল্প নেই। বিজ্ঞান ভিত্তিক সেকু্লার রাষ্ট্র ছাড়া কোন রাষ্ট্র আধুনিক রাষ্ট্র হয়ে ওঠতে পারে না।

বাজারে মাছ কিনতে গেলে আগে আমরা মাছের কানকো উল্টিয়ে দেখি-মাছে পচন ধরেছে কিনা। কারণ মাছের পচন মাথা থেকে শুরু হয়। একটি জাতির পচন্ও নাকি শুরু হয় তার মাথা থেকে। মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগের আদেশ বা রায় তার প্রতিফলন কিনা জানি না । জীবনানন্দ দাশের প্রিয় কবিতাটি দিয়ে আমার এ লেখা শেষ করতে চাই-

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই–প্রীতি নেই–করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।