যৌনকর্মী, শব্দটা কানে এলে বা কোন কাগজের পাতায় দেখলে যেন চিরচেনা কল্পচিত্র ভেসে ওঠে; স্বল্পবসনা, মুখে রঙের বাহার ভার নিয়ে হেলেদুলে চলার ছলাকলায় কোন নারীচিত্র, বাংলাভাষায় সবচাইতে প্রচলিত যে শব্দটা প্রমিত এবং কথ্য ভাষায় সচরাচর ব্যবহার হয়ে থাকে, বেশ্যা। আর এই চিত্র মনের কোঠায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে দেওয়ার দায়িত্বটা প্রায় পঞ্চাশ দশকের উপর ধরে দিয়ে আসছে চলচ্চিত্র মাধ্যম, এরপর একে একে দায়িত্বটা অন্যান্য মাধ্যম নিজদায়িত্বে কাঁধে তুলে নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ব্যবহারের আকৃতি পাল্টানোর প্রয়োজনই মনে করলো না। শুধুমাত্র কিছু হাতেগোনা কিছু নির্মাতাকে করতালির ভাগ দিতে হয়, যারা কিনা কোন কোন ছাত্র-ছাত্রী জীবনের তাগিদে, কোন নারী বা পুরুষ অর্থসংস্থানের অন্য কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে অথবা কোন একাকী মায়ের সন্তান – সংসারের প্রয়োজনে যৌনব্যবসাকে বেছে নিতে বাধ্য হওয়ার মতো সমসাময়িক চালচিত্র তুলে ধরছে শ্রেণীভেদে।

পুরুষ যেখানে শাসক, সেখানে তাদের যৌনসম্ভোগ মেটায় যে কর্মীরা, তারা নারীই হতে হবে, সেই তো স্বাভাবিক গতানুগতিক শুধু নারী-পুরুষে যৌন সম্ভোগীদের জন্যে।। কিন্তু সেই নগরবধূদের জায়গায় যদি রাতে নেমে আসে বিপরীত লিঙ্গের সদস্যরা, কি নামে ডাকবেন তাদেরকে, নগরস্বামী? ইংরেজি ভাষায় বেশ কিছু ডাকনাম আছে, যার বেশিরভাগ অকথ্য; জন (John), এস্কর্ট (escort), রেন্ট বয় (rent boy), মডেল (model), ম্যাসার (masseur, হাসল (hustler), ট্রিক (trick),টার্নিং ট্রিক(turning trick), জিগোলো (gigolo) প্রভৃতি। কিন্তু প্রমিত ভাষায়; সে বাংলা, ইংরেজি অথবা অন্য কোন ভাষায় ওদের পেশাদারী নাম ‘পুরুষ বেশ্যা’। বেশ্যা শব্দটা অর্থ যদি সহজ প্রবেশ্য হয়, জানিনা পুরুষের ক্ষেত্রেও তাই প্রযোজ্য কিনা! আজকের দিনে এসব অপশব্দে অপ্রস্তুত হওয়াকে পাশ কাটিয়ে, ভাষায় লিঙ্গের প্রভেদ সংকুচিত করার উপায়ান্তরে এবং পেশাগত দিক বিবেচনায় যারা প্রত্যক্ষ যৌনশিল্পে জড়িত, তাদেরকে বলা হয় ‘যৌনকর্মী’।

ছুটির দিনে এদের অনেকেই মোটা অর্থে অনেক নারীর সঙ্গী হয়, তাই তারা escort, সহযাত্রী, রক্ষী, অনেকে এদেরকে ডাকে রেন্ট বয় বা ভাড়াটে পুরুষ নামে, যেমনটা নারীর ক্ষেত্রে বলা হয়, কল গার্ল। এদের অনেকের নিজস্ব পছন্দ আছে, আগে থেকেই জানিয়ে দেয় নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দগুলো। যেমন; ভালো গাড়ি চড়াতে হবে, ভালো হোটেল বা কটেজে রাখতে হবে, এইসব বিভিন্ন পেশাদারী আবদার। যেসব পুরুষ যৌনকর্মীরা পথের উপর অপেক্ষা করে, তাদেরকেই সাধারণত ডাকা হয় জন(John), ট্রিক বা টার্নিং ট্রিক। কৌতুক বা বাঁক কৌতুক কেন তা জানা নেই হয়ত আমাদের, কিন্তু জীবন যে তাদের সংকৌতুকময়, কত নারী পুরুষের রাতের বাঁক, তাতে সন্দেহের অবকাশ কোথায়!

মডেল, ম্যাসার এবং হাসলার, এই ত্রয়শব্দ কখনো কখনো ধাক্কা দিয়ে নজর কাড়ে, কিন্তু সরাসরি এই শব্দগুলো পুরুষ যৌনকর্মীদের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যায় না, কেউ কেউ মডেলিং এবং ম্যাসাজের পাশাপাশি যৌনব্যবসায়ে আলিপ্ত হয়, কিন্তু তাই বলে সবাইকে এর অন্তর্ভুক্ত করাটা যুক্তিসঙ্গত নয়। সমাজে অনেকেই একসাথে দুই পেশায় সংলিপ্ত থাকে, কোন ডাক্তার যদি গায়ক হন, তাহলে তার দুই কর্মক্ষেত্রকে সমাজ এককাতারে ফেলে না। অন্যদিকে একজনকে কেন্দ্র করে যেমন সব ডাক্তারকেই গায়ক মনে করা হয় না, তেমন করেই সব মডেল, ম্যাসার নিশ্চয় যৌনকর্মী নন। এধরণের পদ সম্বোধন সমাজে ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টির সাথে সাথে কিছু বিরূপ সংস্কার তৈরি করে, এবং করেছেও। যার প্রতিফলন দেখি এইসব পেশাদার শব্দগুলোকে নিজ নিজ গণ্ডিতে অবস্থান করতে না দেয়া।

হাসলার শব্দটা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। ফরাসী শব্দ ‘জিগোলো’, অনেক দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে, যা কিনা শুধুমাত্র নারী গ্রাহকদের জন্য প্রযোজ্য।
যেসব পুরুষ সমকামী নয়, কিন্তু সমকামী পুরুষদের জন্য কাজ করে তাদেরকে ডাকনাম, গে ফর পে (gay for pay), ট্রেড(trade)। সত্যি কথা বলতে, প্রথমে ট্রেড ডাকনামটা শুনে খুব হাস্যকর মনে হয়েছিল, বাণিজ্য কোনটা নয়? অর্থের মাপকাঠিতে সমাজ যেখানে মূল্যবোধগুলোকে পথে টেনে বাণিজ্য করছে, সেখানে যৌনকর্মীর গায়ে ট্রেডমার্ক নামের লেবেল এঁটে কি মজা যে পেল তারা, তা শুধু তারাই জানে। কর্মক্ষেত্র অনুযায়ী ছোট বড়, উঁচুনিচু ভেদাভেদের মাপকাঠিতে যখন লেবেল দেয়া হয়; যৌনকর্মীদের মতো যারা সমাজে অসহায় আর নিপীড়িত অবস্থার শিকারে যৌনপেশায় আসতে বাধ্য হয়, তাদের বেলায় তো কোন ছাড় নেই, লেবেল দেয়ার অধিকার তো আর তাদের গ্রাহকদেরই।

এ বিষয়ে নিয়ে যখন পড়ার চেষ্টা করছিলাম; বাংলাদেশ এবং ভারতে এদেরকে কি কি নামে ডাকে জানার ইচ্ছা হলো, কিছুটা জানলাম, পড়ে ভ্রু আপনিই টেনে উপরে উঠলো অবাক হতে। যে পেশাই হোক না কেন, কি করে সম্ভব একজন মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষকে এইসব নাম দেওয়ার? জানিনা, সেইকারণেই কিনা, ইংরেজি ভাষাভাষী ছাড়াও অন্যান্য দেশে ইংরেজি শব্দগুলো বেশি চালু, কিন্তু সেগুলোও কি অপমানের ডাক নয়? প্রতিটি মানুষের কর্মজীবন তৈরি করে সমাজ কাঠামো, আর্থিক ভারসাম্যহীনতা, মানসিক টানাপোড়েনের জন্য। যে মানবিকতার জলাঞ্জলি দিয়ে আসছি আমরা হাজার বছর ধরে, তার বিনিময়ে কিছু পেশা শুরু করার ভূমি আমরা তৈরি করেছি, তার মধ্যে যৌনব্যবসা উল্লেখযোগ্য।

টরন্টো শহরের এক পুরুষ যৌনকর্মীর নিজ পেশা নিয়ে মন্তব্য, সে একাকিনী মহিলাদেরকে সাহায্য করছে বাঁচার উপায় খুঁজতে। যে কারণে সে কোন পুরুষের সঙ্গী হয় না। যে সব নারীরা একা চলতে চলতে জীবনে ক্লান্তি ডেকে আনে, ধীরে ধীরে নিস্তেজ হতে থাকে, তখন সে ছুটির দিনে তাদের সহচর হয়ে আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করে। যারা তার সঙ্গ পায়, তারা অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস এবং আত্মসচেতনা নিয়ে নতুন একটা সপ্তাহ শুরু করে। সে খেয়াল রাখে যেন তার গ্রাহক নারী কোনমতেই তাকে শুধুমাত্র যৌনকর্মী মনে না করতে পারে, সে ঐ সময়ে বন্ধু হয়, মানসিক এবং শারীরিক আনন্দ দেওয়ার কৌশল প্রতিনিয়ত সে চর্চা করে, (তার ওয়েব পেইজ থেকে নেয়া)।

এমনটা তো হয়েই থাকে, অনেকেই সেই চেষ্টা করে বৈকি, হয়ত গ্রাহকরা সেটা অনুধাবন করেও, নাহলে এই সঙ্গ তো কেবল বন্ধুত্ব নয়, খরচ এবং তখরচ দুটোই থাকে। তাছাড়া, গ্রাহকদের সকলেই কোন না কোনভাবে যৌনজীবনে নিঃসঙ্গ ধরে নেয়া যায়, কিন্তু তাদের গ্রাহক গোস্ঠীকে দলবদ্ধভাবে ধনিনী ধরে নেয়া যায় না। তাছাড়া, পৃথিবীর সবকোণেই যখন নারী একই কর্মক্ষেত্রে, একই অবস্থানে থেকে পুরুষের চাইতে বেশি কাজ করে পুরুষের চাইতে অপেক্ষাকৃত কম উপার্জন করে। গ্রহিতা গ্রাহক তো কিছু গ্রহণলাভের জন্যেই ব্যয়ের পথ ধরে।

লক্ষ্যনীয় যে, নারী পুরুষের আয়ের তারতম্য এই পেশায়ও অন্য পেশার মতোই। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অরগানাইজেশনের ২০১৪ সালে আটত্রিশটি দেশের উপর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সবপেশার নারী পুরুষের আয়ের ভেদাভেদ ৪ থেকে ৩৬ শতাংশ। যৌনব্যবসায় পুরুষের চাইতে নারী সংখ্যা বেশি, তবুও অর্থ আয়ের ক্ষেত্রের মইটাতে নারী আগেভাগে চড়তে পারলো না। এই পেশায় লিঙ্গভেদে আয়ের তারতম্য নজর কাড়ার মতো, নারী-পুরুষের আয়ের ভেদাভেদ এই কর্মক্ষেত্রটিও ছাড়লো না। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ ঘেঁটে দুজন এস্কোর্টের সাক্ষাৎকার থেকে কিছুটা জানা গেল এই বিষয়ে। একজন নারী কর্ল গার্ল হিসাবে দিনপ্রতি আনুমানিক যদি ২,০০০ ডলার উপার্জন করে (তারতম্য তো আছেই), সেইক্ষেত্রে একজন পুরুষ রেন্ট বয় দিনপ্রতি উপার্জন করে ৩,০০০ ডলার, তারতম্য সেক্ষেত্রেও নিশ্চয় প্রযোজ্য। বাংলাদেশে ব্যক্তি নির্ভর আয়, নেট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, কারো ২০০ টাকা রেট ঘন্টায় আবার কেউ ২,০০০ থেকে ৫,০০০ টাকা রেটে একটা রাত দিচ্ছে। ভারতে একজন পুরুষ রেন্ট বয়ের উপার্জন জানা গেল টুইটার এবং ভারতীয় নেট বিজ্ঞাপন থেকে জানা গেল, ভারতে শহর এবং ব্যক্তিভেদে ঘন্টায় উপার্জন করে ২০০ রুপী থেকে ৫০০ রুপী পর্যন্ত, অবশ্যই এই পেশায় তারতম্যটা ধরে নিতেই হবে। তবে উল্লেখযোগ্য এই যে বিজ্ঞাপনদাতাদের বেশিরভাগই জানিয়েছে তাদের সাথে দরদাম চলবে, যে কোন ধরণের এবং বয়সের নারীদের সঙ্গ দিতে তারা প্রস্তুত। আরো একটা বিষয় নজর কাড়ার মতো, এদের অধিকাংশ জানিয়েছে যে তারা কর্মসংস্থানে ব্যস্ত। ব্যাপারটা মন্দ নয়, অনেক নারীর একটা চাকরি দেওয়ার ক্ষমতা আছে বৈকি, তারা একাকীও হতে পারে। থাইল্যান্ড, নারী এবং পুরুষ উভয় যৌনকর্মী যেখানে বিপুলাকারে কর্মরত, সেখানে তেমন একটা বড় পরিমাপের বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি রাস্তায় এবং পথে লাইসেন্সবিহীন ভ্রাম্যমান যৌনকর্মীর আধিক্য লক্ষ্যণীয়। সেইজন্য ঐ দেশে পর্যটকদেরকে স্বাস্থ্য বিষয়ে সতর্কীকরণের ব্যবস্থাও মজুত রাখা হয় তার পাশাপাশি। ২০০৮ সালে থাইল্যান্ড সরকার যৌনকর্মী পাচার, ব্যবসা নিয়ে নতুন আইন পাশ করেছে, বিশ্বের অনেক দেশে বিপুলভাবে সমাদৃত, কিন্তু দুর্নীতির কারণে তার যথার্থ প্রয়োগ নেই, এমনটাই অভিযোগ মানবাধিকারকর্মীদের।অন্যদিকে দেখা যায়,পশ্চিমের দেশগুলোতে যারা এই ব্যবসায় লিপ্ত, তাদের অনেকের নিজস্ব ওয়েবপেইজ আছে, সেই পাতায় স্পস্ট করে জানানো আছে গ্রাহকের করণীয় এবং দায়িত্ব। পেশীবহুল তবে মার্জিত, অতি সুসজ্জিত এবং আকর্ষনীয় ছবিসহ সেইসব পেইজের দেয়াল। তাছাড়া ঐ নির্দিষ্ট রেন্ট বয়ের কাছে সে কি কি সুযোগসুবিধা, সেবা এবং পরিচর্যা গ্রাহক পেতে পারে, সে বিবরণ আকর্ষণীয়ভাবেই তুলে ধরা হয়, কিছু দাবী দাওয়াও আছে সেখানে; যেমন, গ্রাহকের কি কি ব্র্যান্ডের গাড়ি থাকতে হবে, কটেজে না বাড়িতে থাকবে, কি খাবার খাওয়াতে হবে, এইসব আবদার পেশাদারী মোড়কে। আরো কিছু তথ্য জানা গেল এমন কিছু পেইজ ঘেটে; খুব স্পস্ট করে জানানো আছে এইসব পেইজে; কে সমকামীদের সঙ্গ দিতে চায়, কে শুধুমাত্র নারীর সঙ্গী হতে চায় এবং কারা উভয়ের সঙ্গ দিতে আগ্রহী। যদিও এইসব দাবী দাওয়া কর্ল গার্লদের পেইজেও দেখা যায়। যাইহোক, অর্থ আর আয়ের বিষয় এইক্ষেত্রে খুবই আনুসঙ্গিক, কারণ, এই পেশাও একটা বাণিজ্য। এই পেশায় যদি পুরুষের আয় বেশি হয় নারীর চাইতে তাহলে এটাও ভুললে চলবে না, পুরুষ যৌনকর্মীদের গ্রাহক শুধুমাত্র নারীই নয়, ধনী, উচ্চবিত্ত এবং অনেক প্রভাবশালী পুরুষও। অর্থের বাড়তি অঙ্কটার আমদানী সেই পাল্লাতেই ভারী। যে কারণে, ব্যক্তিগতভাবে সমকামী না হলেও এই পেশায় অনেক কর্মী সমকামী পুরুষের সঙ্গী হয়।

দেখা যাক নারীবাদীরা কি মনে করেন, নারীবাদীরা পুরুষের যৌন পেশায় আসা নিয়ে সোচ্চারভাবে কিছু না বললেও যে একেবারেই বলেননি তা কিন্তু নয়। কট্টর নারীবাদীরা বেশ্যাবৃত্তির বিরোধীতা করছে চিরকাল, সেটা নারী কিংবা পুরুষ হোক। তারা অস্তিত্ববাদী বা উদারপন্থী নারীবাদীদের মতো যৌনকর্মকে সমাজের বুকে মেনে নিয়ে আইনসম্মত করাটা মানবতার বিরোধীতা মনে করে। যেমন করে সমাজে পুরুষরা নারীকে শোষন করে যৌনপেশায় কাজ করায়, তেমনি পুরুষরাই কিছু পুরুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এই পেশায় নিয়োগ করে শোষন করছে, অর্থবলে-ক্ষমতাবলে।

এটা ঠিক যে, অনেক পুরুষ স্বেচ্ছায় এই পেশায় নিজেকে জড়ায়, কিন্তু অন্যদিকে অস্বীকার্য যে অনেক কম বয়সী পুরুষ বাধ্য হয় সমকামী পুরুষের মনোরঞ্জনে-যৌন চাহিদায়। এমন কি বয়োঃসন্ধিকালে অনেক অল্প বয়সী পুরুষ এই পেশায় নিয়োজিত হয়, সমকামী না হয়েও।অবশেষে অর্থাভাবে অনেকেই এই পথকেই বেছে নেয় পেশা হিসাবে। তাছাড়া, অপ্রাপ্ত বয়স থেকে এই পেশায় থাকার কারণে মানসিকভাবে অন্য পথটাও তাদের চেনা ওঠে হয়ে না। কিন্তু পুরুষ হওয়ার কারণে এরা নির্যাতিত হয় না, সেটা সঠিক তথ্য নয়। নারী যৌনকর্মীদের মতোই এরা ধর্ষিত হয়, শারীরিকভাবে অত্যাচারিত হয়, আর্থিকভাবে প্রতারিত হয়। সেইজন্য পাশ্চাত্যে পুরুষদের ‘রেপ ক্রাইসিস সেলটার’ গুলোতে এতো ‘জন’দের ভিড়। সমকামী পুরুষ এবং যৌনকর্মীরাই সেখানে বেশি। যৌনকর্মী, হোক সে নারী কিংবা পুরুষ, যৌন হয়রানির শিকারের আধিক্য তাদের উপরই বেশি, তারা যদিও সকল লয়ে বসে আছে সর্বনাশে আশায় – তবুও ছাড় নেই। তাদেরকে যেমন ইচ্ছা ব্যবহার করা যায়, তারা ভোগ্য মানুষ, অর্থশালী নারী-পুরুষ উভয়েই তাদেরকে ব্যবহার করে ইচ্ছানুযায়ী, প্রথমে আর্থিকভাবে ঠকানো তারপর শারীরিক নির্যাতন। পুলিশও ওদের পক্ষে থাকে না, থাকলেও পুলিশী উপর্যুপরি প্রশ্নে জর্জরিত হতে হয় ওদেরকে। তাছাড়া, বেশিরভাগ দেশেই তো ওরা বেআইনি, পুলিশের সাহায্য আশা করতে পারে না, অত্যাচারী গ্রাহকেরা তা অবগত বলেই অত্যাচারের পথ বেছে নেয়। অনেকসময় ওরা নির্যাতন সয়ে নিয়ে ক্রাইসিস লাইনে ফোন করে কথা বলে অবস্থার প্রতিকার চায়, মনের সান্ত্বনার পথটাও বোধহয় পায় এইভাবে। সেইজন্যই অস্তিত্ববাদীরা এবং উদারপন্থীরা মনে করে যে যৌনকর্মীদের জন্য বিশেষ আইন থাকা প্রয়োজন। এই পেশায় কর্মী এবং গ্রাহকদের স্বাস্থ্যের বিষয়টাও যেখানে খুব জরুরী। যেমন; এইচআইভি ছাড়াও অন্যান্য যৌনরোগ ছড়ানোর আশঙ্কামুক্ত হওয়া। কর্মী বা গ্রাহক, কেউই যেন কোন অনাচারের শিকার না হয়, সাথে সাথে যৌনকর্মীরা বয়সকালে রাস্ট্রের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয় সেইজন্য তারা উপযোগী আইন গঠনের পক্ষে। এতো সোচ্চার হয়েও কোন লাভজনক সাড়া দিচ্ছে না অধিকাংশ দেশের সরকার। তবে সংগ্রাম অব্যাহত আশার সংকল্পে।

এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে পুরুষের বেশ্যাবৃত্তি কি আইনসম্মত? অনেক দেশেই এই পেশা বিধিসম্মত, কিছু দেশে আংশিক আইনি, আবার কোন কোন দেশে সম্পূর্ণ বেআইনি। যৌনব্যবসায় নারী পুরুষের আইন প্রকৃতপক্ষে এক, কিন্তু কোন কোন দেশে ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ অঞ্চলেই পুরুষের যৌনব্যবসা বেআইনি নেভাডা অঞ্চল ছাড় দিয়ে, কিন্তু পুরুষ যৌনকর্মীদের সাথে বসবাস নিষিদ্ধ। ২০০৯ সাল পর্ষন্ত যুক্তরাষ্ট্রে শুধুমাত্র রোড আইল্যান্ডে পতিতাবৃত্তি বিধানসম্মত ছিল। কানাডায় পুরুষের বেশ্যাবৃত্তি আইনসিদ্ধ কিন্তু রাস্তায় দাঁড়িয়ে দরদাম বা কারবারি নিষিদ্ধ। ভারতে পুরুষের যৌনব্যবসা বেআইনি নয়, তবে অপ্রাপ্তবয়স্ক কোন পুরুষকে জবরদস্তি করে এই ব্যবসায় নামানো বা প্রলুব্ধ করাটা বেআইনি। বাংলাদেশে নারীর যৌনব্যবসা আংশিক আইনি কিন্তু পুরুষের যৌনব্যবসা বেআইনি। তবুও বেড়েই চলেছে, বিভিন্ন সামাজিক কারণে। বাংলাদেশে ৮৮% অপ্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ দালালদের বঞ্চনার শিকার হয়ে এই পেশা বেছে নেয় (ইনসিডিন বাংলাদেশ, ২০০৬)। থাইল্যান্ডে যৌনব্যবসা সম্পৃক্ত সবকিছুই আইনসিদ্ধ, যেমন নারী পুরুষ উভয়ের যৌনব্যবসা, বেশ্যালয় এবং দালালি।

পৃথিবীতে ৫০% দেশে যৌনব্যবসা আইনি, ৩৯% দেশে বেআইনি এবং আংশিক আইনি ১১% দেশে। তবে নারী পুরুষের ক্ষেত্রে তারতম্য আছে অনেকগুলো দেশে (প্রোকন.অরগ, ২০১৩)। পুরুষ বেশ্যালয় বাংলাদেশ এবং ভারতে বেআইনি। কানাডায় বহুল পরিচিত ‘বোউডি হাউজ, যেখানে নারী এবং পুরুষ উভয় যৌনকর্মী থাকতো’, এই চলতি বছরের জুন মাসে কানাডার নতুন আইনে সুপ্রিম কোর্টে সবধরণের বেশ্যালয় বেআইনি ঘোষনা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে নেভাডায় যুক্তরাজ্যের লন্ডনেও পুরুষ বেশ্যালয় আছে। সেদেশে ‘বাথহাউজ’ নামে পরিচিত অনেক পুরুষ বেশ্যালয় থাকলেও, সঠিক কোন ঠিকানা নেই। পুরুষ বেশ্যালয়ের একটা ডাকনাম বহুল পরিচিত, ‘আস্তাবল’। সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহরে ২০১০ সালে প্রথম বিলাশবহুল সমকামী পুরুষদের জন্য বেশ্যালয় তৈরি করা হয়। ১৮১০ সালে লন্ডনের ভেরা স্ট্রিটে এমনই এক পুরুষ বেশ্যালয় গড়ে ওঠে যা ঐ শহরে ডাকা হতো ‘মলি হাউজ’ (স্কট, সোস্যাল সিমিওটিকস, ২০০৩)। মলি হাউজকে একদিকে যেমন দেখা হতো সমাজচুত্যির দৃষ্টিভঙ্গীতে, তৎকালীন মানুষের নজরদারী ছিল এই হাউজের উপর, সমাজ নিয়ে তো সমাজের মানুষগুলোর কৌতূহল কোনকালেই কম নয়। অনেকের কাছে এটা নতুন বিষয়ও ছিল তখন।

আঠারোশো শতাব্দীতে যখন যাওয়া হলো তখন ঐ সময়কার কথা না এই বিষয়ে তুলে না ধরলেই নয়। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অনেক যুদ্ধ ফেরত সৈনিক এই পেশায় লিপ্ত ছিল কিন্তু সেইসময়ে পুরুষের বেশ্যাবৃত্তি নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন সমাজের মাথাদের ছিল না।সেটা কতিপয় জনগোষ্ঠির মধ্যেই যেমন সীমাবদ্ধ ছিল, তেমনি এই বিষয়ে তৎকালিন সমাজে সাধারণ মানুষের ধারণাও ছিল সামান্য।উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে পুরুষ যৌনব্যবসাকে পৌরুষত্বের বিচ্যুতি বলেই ধরা হতো এবং নির্দিষ্ট একটা শ্রেণীর আওতাভূক্ত মনে করা হতো, এখনকার মতো এটা কোন মারাত্মক সমস্যা বা এই বিষয়টাকে শাসনে রাখার মতো ব্যাপার চিন্তাবিদ বা বৈজ্ঞানিকদের তখনো হয়নি। এরপর বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পুরুষের যৌনব্যবসাকে বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ পর্যায়ে ফেলা হলো, এই টনক নড়ার বড় একটা কারণ হলো পৃথিবীতে এইচআইভি/ এ্যাইডসের বিস্তার। যদিও অন্যান্য যৌনরোগ কিন্তু পৃথিবীতে আগে থেকেই ছিল। সেই থেকেই পুরুষের যৌনব্যবসাকে শুধুমাত্র নৈতিক স্খলন না ভেবে সমাজসেবীরা বিষয়টাকে সমাজের সমস্যা বিশেষ করে স্বাস্থ্য সমস্যায় রুপান্তরিত করলো। শুধু তো তাই নয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিক আলোচনায় উঠে এলো বিষয়টা (স্কট, ২০০৩)। অবশ্য, স্বাস্থ্যের বিষয়টা নারী যৌনকর্মীদেরকে নিয়ে চিন্তা করা হয়েছে আগেই। অনেক সমাজসেবী বেশ্যালয় আইনের আওতাভুক্ত রাখতে চায় এই বিষয়টাকে মাথায় রেখে যে, সেখানে সরকার স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় কনডম, ওষুধ ছাড়াও অন্যান্য জিনিস সরবরাহ করতে পারবে। বলা বাহুল্য যে, এই প্রক্রিয়ায় কিন্তু অনেকটা ঝুকি প্রতিরোধ করা গেছে, দরিদ্র দেশগুলোতেও এনজিওর মাধ্যমে স্বাস্থ্যের ঝুকি বিষয়ে শিক্ষাদান এবং আনুসঙ্গিক উপাদান সরবরাহের বিষয়টি সফল।

পুরুষের দেহব্যবসা সভ্যতার নতুন কোন মোড় নয়। প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। পতিতাবৃত্তিকে মনে করা হয় পৃথিবীর আদিমতম ব্যবসা, যদিও এই বিষয়ে অনেক তর্ক আছে। তবে, রোমান এবং গ্রীক পুরাণেও এমন অনেক চরিত্র পাওয়া যায় যা প্রমাণ করে সেইসময়েও পুরুষ দেহব্যবসা প্রচলিত ছিল এবং বাধ্য করা হতো তাদেরকে এই পেশা বেছে নিতে। ইতিহাসেও পাওয়া যায় এমন ঘটনা, প্লেটোর রচনা ‘ইলিসের ফিডো’ এমনই একটা সত্যকাহিনী। হিব্রু বাইবেলেও পুরুষের যৌনব্যবসার কাহিনীর উল্লেখ আছে। কাজেই, বলা যেতে পারে পুরুষের যৌনব্যবসা কোন সময়, কাল, স্থান বা প্রজন্মভেদে নয়, নারীদের পাশাপাশি চলে আসছে বহুকাল ধরেই। সমাজে পুরুষ শাসকদের প্রয়োজনে নারীদেহকে ব্যবহার করা হয়েছে অনেক বেশি মাত্রায়।

যত তর্কই থাকুক না কেন, বেকারত্ব একটি উল্লেখযোগ্য কারণ পুরুষের যৌনব্যবসার। যদি সমকামীদের প্রশ্ন তোলা হয়, তাহলে তো বলতেই হয় যে আর্থিক সচ্ছল পুরুষ সমকামী নিজের সাথী বেছে নিয়ে সুস্থ জীবনযাপন করছে। এই পথে অনেকেই জড়িয়ে যায় মাদক ব্যবসায়ীদের দলে এবং মাদকাশক্ত হয়ে পড়ে। সত্যতা আছে কিনা জানিনা, অনেকেই মনে করে নারীর তুলনায় পুরুষ যৌনকর্মীদের কারণে এইচআইভি প্রতিরোধ কঠিন হয়ে পড়ছে। যদিও এর কোন সঠিক পরিসংখ্যান মেলেনি। পুরুষ ষেমন করে নারী যৌনকর্মীদের প্রতি অবিচার করে তেমনি পুরুষই গ্রাহক এবং দালালবেশে পুরুষ যৌনকর্মীদেরকে অপব্যবহার এবং অত্যাচার করে চলেছে, বিশেষ করে দেখা যায় সমকামীদের মাঝে। তবুও অল্প সময়ে অর্থ যোগানের পথ হিসেবে বেছে নেয় অনেকে, এর উল্টো দিকে কেউ কেউ বাধ্য হয় নিতে। যুদ্ধ পরবর্তীতে এবং যুদ্ধ চলাকালীন তাই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাড়ছে নারী-পুরুষ উভয়ের যৌনব্যবসা। এই পেশায় কিছু চাহিদা তো আছেই, সুদর্শন এবং সুসজ্জিত হতে হয়, আয়ত্ত করতে হয় নারীর মনরঞ্জনের বিভিন্ন কলাবিদ্যা। এইক্ষেত্রে একটা কথা বলতেই হয়, লিঙ্গ বিভেদের কারণে নারী এবং সমকামীরা যেমন অত্যাচারিত বেশি তেমনি দুর্বল পুরুষেরাও। সমাজে যে কোন অন্যায় অত্যাচারের পিছনে কাজ করে শ্রেণী, জাতি, ধর্ম এবং বর্ণ বিভেদ। এদের পায়ে পায়ে হাঁটে অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা। প্রতিদিন তাই আর্তনাদে ভরা অন্তর নিয়ে নারী-পুরুষভেদে বিশাল অঙ্কের জীবন গতানুগতিকতা আর অভ্যস্ততায় গা ভাসিয়ে দিয়ে নাম কেনে ‘বেশ্যা’।