লেখকঃ মোহাম্মদ মাহমুদুর রশিদ

বীরাঙ্গনা’ শব্দটি ইদানিং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে নতুনভাবে অধিকমাত্রায় প্রচলিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে যে সকল নারী অবদান রেখেছেন তারা দীর্ঘকাল তাদের যথাযথ স্বীকৃতি পাননি। সম্প্রতি এই সকল বীর নারী তথা বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। এটি সাধু উদ্যোগ। এর ফলে ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয় বা ধারণা হয়ে উঠলেও ভাষায় এর প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনেক ব্যবহারকারীর দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছুটা কুন্ঠা ও অবমূল্যায়ন ভাব পরিলক্ষিত হয় -এ কথা বলা যায়। ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দের সঠিক অর্থ ও না বুঝার কারণে এর প্রায়োগিক গুরুত্ব উপেক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু এর মাসুল ভয়ংকরভাবে গুণতে হচ্ছে সেই সম্মানিত নারীকে যার উপর এই শব্দ বা প্রত্যয়টি খেতাব হিসেবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করার কারণে উদ্দিষ্ট সম্মানিত নারীকে সম্মান প্রদর্শনের পরিবর্তে প্রকারান্তরে যেন অপমানই করা হচ্ছে। তাই ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দটির গভীরে গিয়ে আমরা দেখবো এর প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ কতটা গুরুত্বপূর্ণ আমাদের জাতীয় জীবনে।
যে কোন ভাষার মতোই বাংলা ভাষাতেও শব্দের প্রায়োগিক দিকগুলো এর প্রণেতা ও ব্যবহারকারীদের রুচি ও ভাষাজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। বাংলাভাষায় ‘বীরপুরুষ’ শব্দটি পুরুষের জন্য একচ্ছত্র অধিকারের জন্য হলেও ‘বীরনারী’ শব্দটি ততটা প্রচলিত ছিলো না। ইতিহাসের সেরা বীরনারীদের ক্ষেত্রে তাই প্রয়োগ করা হতো ‘বীরাঙ্গনা’ অভিধাটি। আমার মনে আছে বাংলার বীর নারী সখিনার গল্পটি যখন স্কুল পাঠ্যের দ্রুতপঠন পুস্তকে পড়ানো হতো, তখন ঐ গল্পের শিরোনাম ছিলো ‘বীরাঙ্গনা সখিনা’। শব্দ শুনেই আমরা বুঝে যেতাম এটা কোন বীর নারী হবেন। আবার ব্যকরণ বইয়ে ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দটিকে ‘বীর যে নারী’ এভাবে সমাসবদ্ধ করে দেখানো হতো। বীরাঙ্গনা শব্দটি তাই ছোটবেলা থেকেই আমাদের কাছে পরিচিত ছিলো। কিন্তু এর বিশেষার্থ অভিধানে অনেক পরে লিপিবদ্ধ হয়।
বাংলা ও বাঙালির মননের ধারক ‘বাংলা একাডেমি’ প্রণীত বাংলা অভিধানে ‘বীর নারী’ শব্দটিকে যেমন সরাসরি স্থান দেওয়া হয়েছে তেমনি ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দটিকেও বিশিষ্ট করা হয়েছে। এর পরে আবার শুধু ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দের অর্থ হিসেবে দেওয়া হয়েছেÑ বীর নারী, বীর্যবতী নারী, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নির্যাতিতা বা আত্মজাগরিণী নারী। অতএব এখানে পরিষ্কার যে বীরাঙ্গনার সাধারণ অর্থ ‘বীর নারী’ এবং বিশেষ সংজ্ঞায়িত অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যে সকল নারী অংশগ্রহণ করেছেন, আত্মত্যাগ করেছেন বা নির্যাতিত হয়েছেন। লক্ষণীয়, এখানে কোথাও নারীকে ‘ইজ্জতহীন’ বা ‘সম্ভ্রমহীন’ বলা হয়নি। তাহলে নেতিবাচক এই শব্দগুলো ব্যবহার হচ্ছে কেন? কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, অভিধান খুলে শব্দ জানার ধৈর্য বাঙালি জাতির নেই। কোন একটা ভুল মুখেমুখে বা লেখায় প্রচলিত হয়ে যাবার পর ঐ ভুল দ্বিতীয়বার করতে বাঙালি জাতির আর লজ্জাবোধ হয় না। এমনকি ঐসব কূপমন্ডূকেরা নির্লজ্জের মতো বলে ফেলে বাংলা ভাষা ব্যবহারে নাকি ভুল কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু হয়তো তারা জানে না শব্দের ভুল ব্যবহার কতটা মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনে। আর প্রতিক্রিয়াশীলরা তো দের হীন মানসিকতার কারণে ইচ্ছে করেই বিভিন্ন ভ্রান্ত তৈরী করে থাকে এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করে -যার মধ্যে শব্দের ভুল অর্থ তৈরী করা তাদের প্রধান অস্ত্র।
অধ্যাপক অজয় রায় সম্পাদিত ‘বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস’ গ্রন্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন ও এ. টি, এম. যায়েদ হোসেন লিখিত ‘মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গনা’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ রয়েছে যেখানে বীরাঙ্গনা শব্দটির ব্যবহার ও বীরাঙ্গনাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাভাষায় বীরাঙ্গনা শব্দটির অনুপ্রবেশ ছিলো খুবই ইতিবাচক, প্রয়োগ ছিল যথার্থ; কিন্তু সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো নেতিবাচক। এই কারণে এই শব্দটির প্রয়োগকারীদের অবহেলার কারণে অপপ্রয়োগকারীরা বেশি আধিপত্য তৈরী করেছিল। তারা এদেশে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে যেমন বিভিন্ন সম্মানজনক খেতাব ঘোষণা করা হয়েছিলো, তেমনি বীর ও ত্যাগী নারীদের জন্যও খেতাব ঘোষণা করা হয়েছিলো। এই খেতাব হচ্ছে বীরাঙ্গনা। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসে এ বছররেই ২১ ফেব্রুয়ারি পাবনা জেলার নগরবাড়ি থানার এক বক্তৃতায় স্পষ্ট করে বলেন,
“আজ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বারা নির্যাতিত মহিলারা সাধারণ মহিলা নয়। তারা এখন বীরাঙ্গনা খেতাবে ভূষিত।…… মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে তাদের অবদান কম নয় বরং কয়েক ধাপ উপরে…… তাই তাদের বীরাঙ্গনার মর্যাদা দিতে হবে এবং যথারীতি সম্মান দেখাতে হবে।”
অত্যন্ত সরল এবং স্পষ্ট ভাষায় বঙ্গবন্ধু যে কথাটি বলে গেলেন, দুঃখজনক যে, সেই কথার মর্মার্থ হযতো দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ সঠিকভাবে উপলদ্ধি করতে পারেননি। তাই সাধারণ মানুষকে দোষ দেওয়া যায় না। যেমন: আমি যে সকল ঐতিহাসিক পুস্তকাদিতে তথ্যানুসন্ধান করেছি সেসব পুস্তকেও বাংলায় বীরাঙ্গনা বা বীর নারীদের ক্ষেত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ঐ নারীরা তাদের ইজ্জত বা সম্ভ্রম হারিয়েছেন। এদেশের রাজনৈতিক নেতৃবর্গও প্রতিদিনই তাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে বীরাঙ্গনাদের ইজ্জতহীন বা সম্ভ্রমহীনভাবে তুলে ধরছেন। এই ক্ষতিকর শব্দগুলোর কারণে ঐসব নারীরা তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে পুনরায় ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। বলাবাহুল্য যে, এসব শব্দাবলী ব্যবহারের মাধ্যমে তাদেরকে পুনরায় নির্যাতিত করা হচ্ছে।
‘ইজ্জত’ বা সম্ভ্রম কী? এটা কিভাবে গঠন হয়? এটা কি শারিরীক বিষয় নাকি ব্যক্তিত্বের বিষয়- ইত্যাদি বিচার বিবেচনা না করে ঢালাওভাবে মুক্তিযুদ্ধে দুই লক্ষাধিক বীর নারীদের ‘ইজ্জতহীন’ বা ‘সম্ভ্রমহীন’ উল্লেখ করাটা অন্যায়।
বাংলা একাডেমির অভিধানে ইজ্জত এর অর্থ হিসেবে লেখা আছে- মান, সম্মান, সতীত্ব, আব্রু (শালীন)। সম্ভ্রম মানে হচ্ছে সম্মানযুক্ত। এই দু’টি শব্দের মধ্যে এটাই কি প্রতীয়মান হয় না যে, কোন একজন নারী বা পুরুষকে ইজ্জতহীন বা সম্ভ্রমহীন বলতে যা বুঝানো হচ্ছে তার শব্দগত মানে দাঁড়ায় ঐসব ব্যক্তি (নারী বা পুরুষ) মান সম্মানহীন হয়েছিলেন কিংবা সতীত্ব হারিয়েছিলেন? সমস্যা হচ্ছে; এখানে রয়েছে দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যাপার। প্রথমত, যুদ্ধে নির্যাতিতা বা ত্যাগী নারীদের সম্মানহীন এবং সতীত্বহীন বলা যাবে না। যুদ্ধে পুরুষও শারিরীক-মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হন। এতে পুরুষের গৌরব বাড়ে। একই যুদ্ধে যদি নারী নির্যাতনের শিকার হন তবে তার সম্মান কমবে কেন? আবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের নির্যাতনের শিকার হলে তার সম্মান বাড়ে, তবে নারীদের কমবে কেন? আসলে নারীর সম্মান কমে না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যুগে যুগে নারীদের অবহেলিত অপমানিত দেখতে চেয়েছে বলেই তাদের দৃষ্টিভঙ্গী এখানে উপচে পড়ে নির্যাতিতা নারীর গায়ে। তাই তাকে সম্মান দেওয়া হয়না। যদিও নারীদের প্রতি বেশিমাত্রায় যৌন নির্যাতন করা হয় তবুও ভাবতে হবে তাদের সম্মান কমেনি। কারণ নারীদের সম্ভ্রমও পুুরুষদের মতো একই নিয়মে গড়ে ওঠে। এটা কোন ঠুনকো বিষয় নয়। ব্যতিক্রম ক্ষেত্রে কোন নারী কর্তৃক স্বেচ্ছায় অনৈতিক কাজ বা অবৈধ যৌনকর্ম করা আর জোরপূর্বক ভদ্র সভ্য নারীকে যৌন নির্যাতন করা এক নয়। তাই নির্যাতনের ফলে নারী হয়তো কুমারীত্ব হারায়, কিন্তু কখনই সতীত্ব কিংবা সম্ভ্রম হারায় না।
দ্বিতীয়ত, যুদ্ধে নির্যাতনের শিকার নারীকে কেন সতীত্বহীন বলা যাবে না। একটি নারী সারাজীবন তার সতীত্ব অক্ষুণœ রাখলেও যুদ্ধের সময় নিজের সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় তাকে যৌন নির্যাতন করা হলো। কিন্তু এটা নিশ্চয়ই তার সতীত্ব হানি নয়। সতীত্বের সাথে ইচ্ছার যোগ রয়েছে, চিন্তার যোগ রয়েছে। ইচ্ছা বা চিন্তার বাইরে জোর করে যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণ করলেই তা সতীত্বহানি নয়। এ বিষয়ে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গী একইরকম এবং এসব যুদ্ধে নির্যাতিতা নারী এমনকি যুদ্ধ শিশুকেও সম্মানজনকভাবে স্বীকার করা হয়। কিন্তু হায়রে বাংলাদেশি! হায়রে সমাজ! এর কানে যেন এসব কিছুই ঢুকে না।
পুরুষের মতোই নারীর ইজ্জত বা সম্ভ্রম নারী বা পুরুষের সম্পদ। এটা তাদের অর্জন করতে হয়। কেউ এমনিতে দেয়া যায় না নেয়া ও যায় না। মান, সম্মান, ইজ্জত বা সম্ভ্রম আদান-প্রদান বা ক্রয়-বিক্রয় অযোগ্য। বিদ্যা-শিক্ষা, রুচিবোধ, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবোধ, চিন্তাগত পরিসর, নৈতিকতা, আচরণ, দক্ষতা, ইত্যাদি মিলে গড়ে ওঠে নারী বা পুরুষের ইজ্জত বা সম্ভ্রম। অন্যায়ভাবে কাউকে নির্যাতন বা জুলুম, শারিরীক, মানসিক বা যৌন নির্যাতনে তাদের সম্ভ্রম বা ইজ্জত মিলিয়ে যায় না, এই সত্যটা সবার আগে অনুধাবন করা উচিত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নির্বিচারে কাউকে আটকে রাখলে বা নির্যাতন করলে তার সম্মান কমে না। বঙ্গবন্ধুর কমেনি, নেলসন ম্যান্ডেলার কমেনি। ভুল দৃষ্টিভঙ্গির কারণে কাউকে নির্যাতন বা অবজ্ঞা কিংবা অপদস্থ করলেও তার মান-সম্মান বা সম্ভ্রম কমে না। সক্রেটিস, মহানবী মুহম্মদ (সঃ), এদেশিয় নারী খনা কিংবা ভিনদেশিও জোয়ান অব আর্ক এর প্রতি জুলুম নির্যাতন তাদের মান-সম্মান কমাতে পারেনি। তাই দেখা যায়, শুধুমাত্র নারী-পুরুষের বৈষম্যই এখানে একমাত্র বা বিষয় নয় Ñযার কারণে বীরাঙ্গনাদের প্রতি সুদৃষ্টি ছড়াতে বাংলাদেশের বর্তমান সমাজও ব্যর্থ।
বাংলাদেশে নারীর প্রতিযুদ্ধের সময় যারা নারী নির্যাতন করেছে বা যারা এর পক্ষ অবলম্বন করেছে তারা তো নারীকে অপমানিত দেখতে চাইবেইÑ এটা স্বাভাবিক। কিন্তু যারা চায়নি নারী অপমানিত হোক, তারাও ভাষা ব্যবহারের দৈন্যতার কারণে নির্যাতনকারীদের দলে পড়েন। একটি সমাজে সবসময়ে দু’টো ধারা বিদ্যমান থাকে; মূলধারা ও বিপরীত ধারা। বাংলাদেশে এই ভাগে দুটি হতে পারে এরকম: মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ধারা। কিন্তু দুঃখজনক হলো, সামাজিক অচলায়তনের প্রশ্নে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ধারা অধিকতর সংহত। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুসারী অল্পসংখ্যক ব্যক্তিবর্গ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের রাজনৈতিক সমর্থকদের অনেকেই যেন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের সাথে একই সামাজিক অচলায়তনে বসবাস করছেন। সেখান থেকে বের হতে হলে যে জ্ঞানচর্চা দরকার, তাতে তাদের বড়ই অনীহা। জ্ঞানচর্চার ঘাটতির কারণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও মনের অজান্তেই তাদের বিপক্ষদের পক্ষ নিচ্ছেন। এসব কারণে স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরেও এদেশের বীর নারীদের ‘ইজ্জতহীন’ বা ‘সম্ভ্রমহীন’ হিসেবে উল্লেখ করার মত বিব্রতকর কাজ আজও নির্দ্বিধায় চলে আসছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কোন মোড়লশ্রেণীয় বা ধর্মের লেবাসধারী প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক ধান্ধাবাজেরা যখন একাত্তরসহ যে কোন নারীকে যখন দোষী সাব্যস্ত করেছে বা অপমানিত করেছে তখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যারা আছেন তারা সেটাকে সঠিকমতো বাধা দিতে পারেন নি। এই বাধাহীনতার সুযোগে সাম্প্রদায়িক অপশক্তিরা প্রথমেই নির্যাতনের খড়গ হানে নারীর প্রতি। শুধু মুক্তিযুদ্ধে নয়, এই শ্রেণীটি যুগ যুগ ধরে নারীকে অপমানিত-নির্যাতীত করে আসছে, আজো সচেতনভাবে অপমান করে যাচ্ছে পরিবারে, সমাজে, পথে-ঘাটে, মাঠে-ময়দানে, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে সর্বত্র।
আজ তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বপক্ষের সবাইকেই এই ভুল ভাঙ্গাতে এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, শব্দভেদের কারণে সৃষ্ট অপমান মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে করুণ ও অমানবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিলো। এসময় যুদ্ধকালীন নারী নির্যাতনকারিরা যুদ্ধ পরবর্তী সময়েও ধর্মীয় উন্মাদনার অজুহাতে অনেক নারীকে নির্যাতন করেছে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে ত্যাগী নারীগণ সমাজে কুলটা, কলঙ্কিনী, অমঙ্গলের কারণ ইত্যাদি অভিধায় অভিযুক্ত হয়েছিলো। একারণে অনেক স্বামী তাদের নির্যাতিতা স্ত্রীকেও পরিত্যাগ করেছেন। পরিবার থেকে পিতা কন্যাকে, ভাই বোন কে বের করে দিয়েছে। নির্যাতিতা নারী কোথাও কোনও স্থান না পেয়ে আত্মহত্যা করেছে এমন নজীরও অনেক। অনেক নারী কষ্টকর ও অমানবিক জীবন বেছে নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, ঐসব নারীর সন্তান পরিবার ও আশ্রয়দানকারীকেও একইভাবে অপমান করা হযেছে এবং এখনও হচ্ছে। এসব কিছুর মূলে যারা দায়ী তারা হচ্ছে সামাজিক কু-দৃষ্টিভঙ্গীর অধিকারী ও শব্দের ভুল প্রয়োগকারী।
বাংলাদেশের বীর নারীদের সম্ভ্রমহীনভাবে উপস্থাপন করতে যারা বীরাঙ্গনা শব্দের ভুল প্রয়োগ করে থাকেন তাদের তালিকাটি দুঃখজনকভাবে অনেক দীর্ঘ। ধরে নিচ্ছি, তারা এই ভুলটাকে গুরুত্বসহকারে নেননি। এই তালিকায় প্রথম স্থান দেয়া যায় এদেশের বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিতি পেতে চান এমন ব্যক্তিবর্গকে, যেমন: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ, সমাজচিন্তাবিদ, মিডিয়ায় টকশো উপস্থাপনকারী, কবি ও লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, সাংবাদিক আরো অনেকে। ভুল প্রয়োগকারীর সবচেয়ে বড় যে দলটি তাদের মধ্যে রয়েছেন বক্তব্য-বিবৃতি বা বাণী প্রদানকারী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও আমলা। এই ভুল ধারণাটি এভাবে সর্বত্র ছড়িয়ে যাচ্ছে ও শেকড় গেড়ে বসছে। ভুল চলে এসেছে পাঠ্যপুস্তকে, তাই শিক্ষকের ভুল পড়িয়ে যাচ্ছেন আর শিক্ষার্থীরাও ভুল শিখছে। তাই আমার মনে হয়, উক্ত বীরাঙ্গনা প্রত্যয়ের ভুল ব্যাখ্যা না করার জন্য এবং সম্মান বা সম্ভ্রম শব্দটির সঠিক অর্থ প্রয়োগে ও ব্যবহারে রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা ও অনুশাসন আবশ্যক। তাছাড়া এটা মানবিক অধিকারের প্রশ্ন যে, নারী বা পুরুষ কাউকে সম্মান বা সম্ভ্রমহীন বলার অধিকার যেন কারো না থাকে।
বীর নারীদের ভিন্ন অর্থে উপস্থাপন করার এই ভুল ভাঙ্গতে মিডিয়া অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আশা করি মিডিয়া সেটা করবে। সকল ইতিবাচক মানসিকতার ব্যক্তি, যারা ফেসবুকসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় লেখালেখি করেন, তাদের প্রতি অনুরোধ আসুন আমরা বীরনারীদের প্রতি ভ্রান্ত শব্দ ব্যবহার থেকে নিজেরা বিরত থাকি এবং অন্যদেরকে বুঝাই। সকল প্রকাশক ও সম্পাদকের প্রতি অনুরোধ রইলো, দয়া করে ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দের যথার্থ অর্থের ব্যবহারকে নিশ্চিত করুন। রাজনৈতিক নেতৃবর্গের প্রতি অনুরোধÑ দয়া করে ভাষা সংশোধন করুন, নতুবা ভুলের মাসুল প্রতিষ্ঠিত হয়ে নিজের গায়ে ফেরত আসবে।
আসুন আজ থেকে আবার বলিÑ মুক্তিযুদ্ধের নারীরা নির্যাতিতা, অধিক সম্মানিত। বাংলাদেশ ও এ দেশের সকল নাগরিক তাদের কাছে ঋণী। সেইসাথে কোন নারী বা পুরুষকেই সম্মান বা সম্ভ্রমহীন বলা যাবে না।