অভিজিৎ রায়ের কোথাও কোনো শাখা নেই, ছিলো না, নিজেও তিনি ছিলেন এক মহীরুহ বা হয়ে উঠছিলেন। অবশ্য, তাঁকে প্রশ্নটা করা হলে তাঁর প্রাণখোলা, মনকাড়া সুন্দরতর হাসিটা দিয়ে তিনি বলতেন হয়তো নিউটনের মতনই, আমি যদি কিছু দেখে থাকি, তবে তা দানবদের কাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে। বিনয় ও আন্তরিকতা ছিলো তাঁর প্রিয়তর দুটি পোশাক, তাঁর চশমা ও জিন্সের মতনই, নিশ্চয় সেসবের মতো দরকারিও তিনি ভাবতেন সেসব। আজ আমি যদি নিজের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই অন্তর্চক্ষু বিশদ ও বিস্ফারিত করে, আমি কিছুটা বদলে গেছি তাঁর মৃত্যুর পর থেকে। কখনোই মহান, উদার, সাহসী, লড়াকু, সুধীর ইত্যাদি গুণাবলির আধার ছিলাম না তেমন, কিন্তু অভিজিৎ রায়ের সেই কাপুরুষোচিত বা ধার্মিকোচিত অমানবিক হননকর্মের পর থেকে আমি আর কিছু লিখতে পারি না গুছিয়ে, পারি না ভাবগুলো সাজিয়ে ভাষার পাতে সাজিয়ে চমৎকার দৃষ্টিলোভন ও হৃদ্য ভোজ্যদ্রব্য প্রস্তুত করতে। তিনি চলে গিয়ে আমায় অনেক ভীরু, অনেক অকর্মণ্য, অনেক পলায়নপর করে দিয়ে গেলেন, অথচ এই মুহূর্তে প্রয়োজন ঠিক এর উল্টোটিই।

অন্য অনেক প্রশ্নের মতন অভিজিৎ রায়ের নির্দয় হত্যাকাণ্ডটি আমাদের সামনে যে-প্রশ্নটি তুলে ধরেছে বারংবার, সেটা হলো, বাংলাদেশের কী হবে এখন, কী হবে প্রগতিশীলতার আন্দোলন বা লড়াইয়ের, কী হবে মুক্তবুদ্ধির চর্চার, কী হবে অবিশ্বাসের অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহসের?

বলা বাহুল্য, এই প্রশ্ন মানবসভ্যতার প্রায় কাছাকাছি বয়েসিই, যদি সভ্যতার সংজ্ঞায়ন করতে হয়, সেটা জন্ম দেবে অনেক বিতর্কেরই হয়তো। সভ্যতা যার নাম, সেটা মূলত মানুষের ঘরবাঁধার ভিত্তিটা মজবুত করার একটা পদ্ধতিই মূলত। নানা শৃঙ্খলে, নানা নিয়মে, নানা চিরায়মানতার মুখোশে বহুজনহিতায়, বহুজনসুখায় সভ্যতাচিহ্নটি আমাদের ভেতরকার বিদ্রোহী বাউলটাকে প্রশ্ন করার ও খেপে শেকল-ছেঁড়ার রাস্তা দেখিয়েছে নানা সময়েই। নির্দ্বন্দ্ব হয়েই সফলভাবে বলা যায়, এই দ্বান্দ্বিকতার প্রবহমানতা চিরন্তনই হবে।

যদি ধরে নেই, বাঙালির জাতিসত্তার অহমিকাবোধের ও পরিচয়ের গাঢ়তর শেকড় সাতচল্লিশের পর থেকেই শুরু, তাহলেও দেখবো আমরা, নানা দিকে এই অবাধ্যতার, দ্রোহের ও অবিশ্বাসের চিহ্নরেখা বিদ্যমান। তমদ্দুন মজলিশ নামের সাংস্কৃতিক যে-সংগঠনটি জন্ম নেয় বিজাতীয় নামের আড়ালে, সেটিতেও কিন্তু সেই সাংস্কৃতিক উন্নয়নের পাশাপাশি অমান্যতার কিছু ছাপ ছিলো। নিঃসন্দেহে শিখা গোষ্ঠীর সাথে তাদের তুলনা দূরদেশময়, কিন্তু ওই পরিবেশে সেটিও একদম ‘কিছু না’ থেকে ‘কিছু’-র জন্ম হিসেবেই দেখতে হবে।

ঋত্বিক যেমনটা বলেন, বা তাঁর মুখাপেক্ষী নীলকণ্ঠ, রাষ্ট্র থাকলে রাষ্ট্রদ্রোহিতা থাকবেই, তেমনি, ধর্ম থাকলে, শাসন থাকলে, অনুশাসন থাকলে, তার বিপক্ষে, তার প্রতিবাদে, তা ধ্বংস করার মানসে লোকেরাও জেগে থাকবে লালকমল-নীলকমল হয়ে, এক পহরে বা দুপহরে বা পহরে পহরেই। এই ধর্ম তারুণ্যের, এই স্বভাব মানুষের, এই চরিত্র জীবনেরও। পুরনো সভ্যতার ছেঁড়াখোঁড়া পাতার ভেতরেও সেসব স্পার্টাকাসদের কাহিনি জ্বলজ্বল করে রক্তের অক্ষরে।

বেদে দেখা দিয়েছে সংশয়, যজ্ঞ কি কার্যকর, দেবতারা কি আছেন? বাইবেলে যিশু নতুন নিয়মে শিষ্যদের আশ্বাস দিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই দেখে যাবে ঈশ্বরপুত্রের রাজত্ব এবং তা আসেনি কখনোই, এখনো নয়, তা সে বুশ বা ট্রাম্প যতোই চেঁচান। কোরানের সুরা অবতীর্ণ হয়ে আবার মুছেও ফেলা হয় শয়তানের প্রভাবান্বিত বলে সেসব। সন্দেহ ঘুণপোকাটি চরমতম ঈশ্বরবিশ্বাসী বা দেশপ্রেমিকের বুকের ভেতরেও কুরে কুরে খায়, কেউ রাখে চেপে, কেউ দোলে মাতাল তরণীতে।

এই দোলাচল কাজ করে দুদিকেই। ডকিন্স তাঁর ‘দ্য গড ডিল্যুশন’ (২০০৬)-এ একটি সাতঘরের মাপকাঠির প্রস্তাব করেছেন যার একপ্রান্তে চূড়ান্ত আস্তিক, অন্যপ্রান্তে চূড়ান্ত অবিশ্বাসী। নিজেই, স্বীকার করেছেন তিনি, চূড়ান্ত অবিশ্বাসী নন। পাঁচের কাছাকাছি আছেন তিনি অবিশ্বাসের দিকে হেলে, নিজের সম্পর্কে তাঁর এমনটাই মতামত, অতএব কা পরে অন্য কথা! অভিজিৎ রায়ের খুনের পর অবিশ্বাসী যাঁরা নিঃসংশয় ছিলেন অবিশ্বাসের ভবিষ্য বিজয়গৌরব সম্পর্কে, তাঁরাও থমকে গেছেন অনেকটাই। কলম চলবে বলে নাড়া তুলে কেউ নিজের কাজে ফিরে গেছেন, কেউ ঘরবসতিতে, কেউ রৌপ্যরাক্ষসের ফিকিরে, কেউ লাভের লভ্যাংশ খুঁজতে। এর ভেতরেও কেউ ব্যবসায় সফলতা কুড়িয়ে তুলে নিয়েছেন ঘরে, সেসব কথা নাহয় পরেই হবে কখনো, ধন্য তাঁরা অবশ্যই।

রূপবদলের অজস্রতা চোখে পড়েছে অভিজিৎহননের পরের মর্মান্তিক কৃষ্ণকুটিল দিনগুলোয় ও রাতে।

মুক্তিযুদ্ধ, একাত্তর, বাঙালি ইত্যাদি নিয়ে ব্লগপোস্টের পর পোস্ট লিখে রীতিমত বীরপুরুষ বনে-যাওয়া অমি রহমান পিয়াল সরাসরিই বলে বসলেন এই ব্লগারহত্যার মোচ্ছবে, দৃশ্যশ্রাব্য গণমাধ্যমে, নাস্তিকেরা এসাইলামের জন্যেই এসব লেখালেখি করে। অন্যত্র তিনি এও বলেন যে, ব্লগাবর্তে যখন জামাতশিবিরের ছাগুরা কোণঠাসা হয়ে পড়তো, তখন নাস্তিকেরা (গড়পড়তা এভাবেই বলা হয়েছিলো) আরেকটা ক্যাচাল তৈরি করে তাদের বাঁচিয়ে নিতো। অভিজিৎ রায়ের প্রতি এহেন অবমাননাকর মন্তব্য তিনিই করলেন, যাঁকে অভিজিৎ রায় তাঁর কমরেড-ইন-আর্মস ভাবতেন, জোয়ান বায়েজকে নিয়ে লেখা ব্লগপোস্টটি উৎসর্গ করেছেন যাঁকে, একটি ফেসবুক নোটও লিখেছেন তাঁর সমালোচনায়, যা কী যে বিনীত ও গ্রেসফুল ইন ইটস ঔন কোয়ালিটি। সুখের বিষয়, তিনি নিজেও এখন ইউরোপে তাঁর পরিবারের সাথে মিলিত হয়ে আনন্দঘন দিনযাপন করছেন, উগ্র নাস্তিকেরা শত বাধাতেও তাঁকে ঠেকাতে পারে নি!

মাসকাওয়াথ আহসান বেজায় দুঃখ করে তত্ত্বপ্রসব করলেন যে, ইহা ইসলামিক গোঁড়ামো ও আধুনিকতার অসম টেনশনের ফলাফল, এবং এমনই হবে।

যে কুলদা রায় অভিজিৎ রায় ও ফরিদ আহমদেকে জামাতি দালাল বলে যত্রতত্র মলত্যাগ ও আক্রমণ করে বেড়িয়েছেন, তিনি এবার পাকাচুলো বুদ্ধিজীবীদের নীরবতা দেখে একের পর এক স্যাটায়ারত্যাগ করতে লাগলেন। নিজের এতবড় অন্যায়ের জন্যে বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ করেন নি তিনি বা ক্ষমাপ্রার্থনাও। অন্যদের আক্রমণ করতে পারছেন, এই আনন্দেই অভিজিৎপ্রদত্ত বলদা রায় নামটি সার্থক প্রমাণ করলেন তিনি বারংবার।

সালাফি সেকুলার বলে অভিজিৎ রায়কে উগ্র নাস্তিক প্রমাণ করতে চাওয়া ও তাঁর হত্যার আগে অজুহাত তৈরির সহায়ক পারভেজ আলম উচ্চকণ্ঠ হলেন অভিজিৎ হত্যার বিচার চেয়ে। তবে, প্যারিস ম্যাসাকারের আগে বা পরেও তিনি মুসলিমদের নিয়ে বাকিরা যেন বিদ্বেষপোষণ না-করে সেটার ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। মিষ্টি করে নিজে অবশ্য তিনি দুষ্টু বলে দেবেন মাঝেমধ্যে, শুনতে ভালো লাগে।

পরের পর চারছক্কা হাঁকিয়ে গেছেন পিনাকি ভট্টাচার্য, শাহবাগের আন্দোলনের সময় যিনি তুমুল যুদ্ধাপরাধীর বিচারের সমর্থক, এবার তিনি উলঙ্গ হয়ে সূক্ষ্ম ‍ও স্থূলভাবে অভিজিতের রক্তের ওপর মসজিদ, মিনার, মাদ্রাসা বানিয়ে দেন, পারলে সমগ্র ছাপ্পা্ন্ন হাজার বর্গমাইলের ওপরেই। আমজনতার সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিয়ে তিনি অভিজিৎ রায়ের খুনের জন্যে দায়ী করেন অনেকটা তাঁকেই, মুক্তমনা ব্লগটির নানা চুলচেরা সমালোচনায় তিনি ও তাঁর আরেক সদগুরু বা গুরুভাই মাসুদ রানাও উঠেপড়ে লাগেন। সদালাপ নামের চরম দুশ্চরিত্র ও বমনোদ্রেককারী আবর্জনা ব্লগটি, যাকে অভিজিৎ রায় বলতেন প্যারাসাইট এবং আমি বলতাম সদাপ্রলাপ, মৃত অভিজিতের নাড়িভূঁড়ি, রক্তমাংস সহাস্যে খেয়ে ও রক্তাক্ত মুখ তুলে তুমুলতীব্র আর্তনাদ করে আবারো অনেকের প্রিয়ভাজন হয়েছে।

প্রবীর ঘোষ রীতিমত একহাত নিয়েছেন হত অভিজিৎকে, পিনাকি বা অন্য আরো কিছু জ্ঞানবোদ্ধার মতে, শ্রীমান রায়ই দায়ী তাঁর নিজের হত্যাকাণ্ডের জন্যে। চমৎকার পর্যবেক্ষণ নিঃসন্দেহে। অনুজের শ্রদ্ধা ও অনুরক্তির প্রতি অনবদ্য ট্রিবিউটই বটে! বেঁচে থাকলে অভিজিৎ লজ্জায় মারাই যেতেন সম্ভবত।

কবীর সুমনও মুসলিমদের রক্ষায় এগিয়ে এলেন। আবার ইদিগে গানও রচে বসলেন অভি-বন্যাকে নিয়ে। বিপ্লবী সঙ্গীতযোদ্ধা যখন পূতিগন্ধ ছাড়েন, তখন বড্ড বমি পায় বৈকি। বদলায় মন, বদলায় বিশ্বাস। অভিজিৎ রায় আবারও মৃত্যুপরবর্তী সঠিকতার খাতায় টিক পেলেন।

ইংল্যান্ডে বন্যা আহমেদের ভোলতেয়ার লেকচার নিয়ে গ্রাম্য কুঁদুলে রমণীর অভ্যস্ত ভঙ্গিতে প্রদত্ত তসলিমা নাসরিনের ফেবু পোস্টটিও অনেকের মুখে হাসি ফুটিয়েছে, অনেক তসলিমাদ্বেষীরও, কারণ, তিনি নাস্তিকদেরই যে আক্রমণ করেছেন এবার! তসলিমাফিটিশাক্রান্ত অনেকে অবশ্য তাতেও লাইক ও লৈখিক সমর্থন দিয়ে তাঁর মনোবেদনা কথঞ্চিৎ প্রশমন করেছেন, যেটা দুর্মুখ নিন্দকদের সমালোচনাঘাতে তিনি সঞ্চয় করেন।অভিজিৎখুনের পর তাঁর হাতে বাংলাদেশের ব্লগারদের দেশান্তরের জন্যে ২০ হাজার ডলার নিয়েও কোনো কেনো অপবাদকারী কিছুমিছু বলেছেন, আশা করি, সেসবই ভুলমাত্র।

এমনকি কল্পনাতীত ব্যথাহত অজয় রায়ও এক পর্যায়ে ব্লগারদের উদ্দেশ করে বলেন, তারা যেন এমন কিছু লেখালেখি না-করেন, যা অন্যদের আঘাতের কারণ হয়ে ওঠে। হায়, তাঁর উপদেশ মান্য করলে নিশ্চয় তিনি আজ এই অকালপুত্রবিয়োগের বেদনা পেতেন না। তবে, ধর্মহীনদের ধর্মই আলাদা জাতের কিনা! মনে পড়ে যায়, চতুরঙ্গ উপন্যাসের নাস্তিক জ্যাঠামশায়ের মৃত্যুর পর তার অনুজের ব্যাঙ্গাত্মক আফসোসের জবাবে তারই সন্তান ও বিপথগামী তথা ঈশ্বরদ্রোহী শচীশের সেই গর্বোদ্ধত মস্তকে উচ্চারণ, হাঁ, নাস্তিকদের মৃত্যু এমনি করিয়াই হয়!

যদিও অপ্রাসঙ্গিক, তবুও মনে আসে, অজয় রায়ের কি কখনো মনে এসেছিলো পুত্রশোকের ভেতরেও গর্বিত পিতার মাইকেলি বিবরণ, “যে শয্যায় আজি তুমি শুয়েছ, কুমার প্রিয়তম, বীরকুলসাধ এ শয়নে সদা!”? অন্যায় বটে, তবে মন তো মনই!

যাহোক, ফিরি ব্যাটিং ক্রিজে। ইনিংসটা শুরু করার পর শেষ তো করতেই হবে, যেহেতু ব্লগারের হাতেই এটা।

এমন খেয়োখেয়ির তালিকা শুরু করলে সেটা নিয়েই একটি বই রচে ফেলা সম্ভব। তবে, আমাদের মূল লক্ষ্য আসলে অন্যদিকে নিবদ্ধ। আমি অবশ্য অভিজিৎ বা বন্যা আহমেদকে নিয়ে অসুস্থতম খেউড়, যেসব প্রায়ই মেলে অনলাইন বা ছাপানো নিউজ মিডিয়ার ফেসবুক পেজের খবরের নিচের মন্তব্যবাক্সে, সেসব আনছি না, কারণ সেগুলো মানসিক ক্যান্সার ওয়ার্ডের ওটির বর্জ্য, দর্শনমাত্রেই অসুস্থ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।

আমরা এই প্রশ্নের উত্তর চাই যে, অভিজিৎ রায়ের হত্যার পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কিভাবে বুদ্ধি ও চিন্তার মুক্তির আন্দোলন এগিয়ে নেওয়া যায়। মাথার ওপর আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার ডেমোক্লিসের খড়্গ সদা উত্তোলিত, নিশিতাস্ত্র হাতে নিশীথ রাতে বা নির্বিকল্প দিনেও হয়তো ঘাতকের সুলুকসন্ধানী চিলনজর, প্রশাসনের ঢিমে তেতালা এছলামিক ছালানা জলসা, বাংলা একাডেমির মহাপরিচারকের আরক্ষাধ্যক্ষের সাথে সুর মিলিয়ে উস্কানিমূলক লেখা লিখতে মানা করার আহ্লাদি আবদার, সরকারের মোনালিসা হাসির আড়ালে রক্তক্ষত চাপা-দেওয়ার অবিরল প্রচেষ্টা, এতশত কিছুর ভেতর সামাজিকভাবে নাস্তিকদের নিগৃহণ বা অত্যাচার তো বাদই দিতে হয়। ব্লগ বা ফেবুতে যেহেতু মানুষজন মুখ ফসকে দুচারটে সত্যি কথা বা মনের ব্যথা প্রকাশ করেই ফেলে, তাই সেসবও আটকে দেওয়ার অবিরাম চেষ্টায় হয়রান রাষ্ট্রযন্ত্র বেশ কিছুটা সফলও বটে।

তাহলে উপায়? বিধেয়? গন্তব্য?

সেই বহুচর্চিত, অপছন্দগন্ধময়, শতাব্দীপ্রাচীন কথাটাই বলতে হয়, চরৈবেতি। থেমো না। আটকে যেও না।

ইতিহাসের দিকে ফেরাই নজর।

বেদ অপৌরুষেয়, বেদবিরোধীরা নাস্তিক ও নরকবাসী, এমনটা আর মানেন না কেউই।

গ্যালিলিওকে অপমান ও পরাজয় স্বীকার করে নিতে হয় ১৬৪৪-এ। কিন্তু, বিংশ শতাব্দীতে এসে হার মানে ক্যাথলিক চার্চ নিজেই।

ইলুমিনাতিরা হত হয়ে পথে রক্তাপ্লুত দেহে পড়ে থাকলেও আজ তারাই জয়ী, চার্চ নয়।

কঠিন ও কঠোরভাবে চিত্রাঙ্কন নিষিদ্ধ থাকলেও নবি মুহম্মদের নানা ছবি মধ্যপ্রাচ্য থেকেই মেলে। ছবি-আঁকা, গান করা বা শোনা, নারীদের বন্দিদশা থেকে মুক্তিলাভ অনেক ক্ষেত্রেই জয় পেয়েছে শরিয়ার ওপরেই।

সমগ্র বিশ্বজুড়ে ক্রমাগত বাড়ছে অজ্ঞেয়বাদী, অবিশ্বাসী, সংশয়ীদের সংখ্যা, নৈতিকতার দিক থেকেও তারা অনুন্নত নয় কোনেভাবেই। এমনকি নাস্তিকেরা সংখ্যাগুরু যেখানে, সেখানেও উন্নতির গ্রাফ ঊর্ধমুখিনই।

আসবে পথে আঁধার নেমে, তাই বলে কি রইবি থেমে? তুই বারে বারে জ্বালবি বাতি হয়তো বাতি জ্বলবে না তাই বলে তো ভীরুর মত বসে থাকলে চলবে না, রবীন্দ্রনাথ সর্বদাই প্রাসঙ্গিক, সর্বক্ষেত্রেই।

কৌশল প্রয়োজন অবশ্য। সেটা নির্ধারণ করতে হবে ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত অভিজ্ঞতা, প্রয়োজনীয়তা ও দায়বদ্ধতা থেকে। আগে বেঁচে-থাকাটা জরুরি, ঝামেলা এড়িয়ে থাকাও। কৃষ্ণ, যিশু বা মুহম্মদও এসাইলামের সন্ধানে স্বভূমিত্যাগ করেছিলেন, কৃষ্ণ অবশ্য জন্মদিনে বা রাতেই। ব্যাপারটা জানলে নিশ্চয় গেরুয়াবাদীরা ঝান্ডা তুলবে, এসাইলামের কথাও ব্যাদে বা গীতায় আছে। তবে, কবয়ো বদন্তি, মহাজনো যেন গতোঃ স পন্থাঃ। যাঁরা বাইরে যাচ্ছেন, তাঁরা বাইরে থেকে লিখবেন, আজকাল তথ্য অতোটা দুর্লভ নয়। যাঁরা দেশে আছেন, তাঁরা গ্রাউন্ড জিরোতে থেকে, সংগঠিত হয়ে, সতর্ক থেকে যেভাবে সম্ভব কাজ করবেন্। সবসময় হুটহাট করেই সব হবে না, ধৈর্যধারণও জরুরি, সাময়িকভাবে একপা পিছিয়ে গিয়ে দুপা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করাও রণকৌশলেরই অঙ্গ। শিশুকিশোরদের মনে বিজ্ঞান জানানো ও প্রশ্ন জাগানোর কথা ভাবতে হবে নানা ভাবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দিতে হবে শিক্ষা ও নতুন চিন্তার বীজ। কাজ করতে হবে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে, বড় সব প্রকল্প সাধিত হয় এভাবেই। বোকা বুড়ো ছোটো আঘাতে বড় পাহাড়ও ভেঙে ফেলেছিলো, ইউএসপি ছিলো একাগ্রতা ও অধ্যবসায়। জ্ঞানের মতো, ইউক্লিডকে স্মরি, চেতনাবিকাশেও কোনো সরল পন্থা ন বিদ্যতে অয়নায়।

যাঁরা লড়তে চান, এই জড়িবুটিটোটকা তাঁদেরই জন্যে, স্বদেশে বা বিদেশে। যাঁরা গড্ডলিকা প্রবাহে ভাসমান হতে ইচ্ছুক, তাঁরা নিশ্চয় পড়বেনই না প্রথমত এই লেখাটিই।

অভিজিৎ রায়, আপনি থাকছেন স্যার।

আপনি হেরে যাবেন না, যুগের ধর্ম একথাই বলে। ইতিহাস তুমি কেঁদো না, পরিবর্তন আসে।

এবার আমি ঘর আঁধার করে কাঁদবো, আমার আজকের লেখার দায়িত্ব শেষ হয়েছে।

মিস ইউ, অভিদা। আই লাভ ইউ, ম্যান। ফ্রম হিয়ার টু ইনফিনিটি এন্ড বিয়ন্ড।