আজ অভিজিতের মৃত্যুদিনে তাঁকে স্মরণ করছি, তাঁর অনুপস্থিতি অনুভব করছি। তবু এই শোকের মাঝে আমি বলি অভিজিৎ এই বইটি তাঁর জীবদ্দশায় বের করে যেতে পেরেছিল, সে বুঝেছিল বইটি ভবিষ্যৎ পড়ুয়াদের চিন্তার খোরাক হবে, তাদের মনের দুয়ার হয়ত খুলবে। শত শোকের মাঝে এই আনন্দটুকু ফুটে উঠুক।

nothing
‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ বইটিতে গুণে গুণে ৪০০টি পাতা আছে। অধ্যাপক মীজান রহমান আর ড. অভিজিৎ রায় যেন তাঁদের জীবনের শেষ লেখা ভেবে এতে সবকিছু উজার করে দিয়েছেন – তাঁদের যা কিছু জ্ঞান, চিন্তা, নতুন ভাবনা, নতুন জ্ঞান আহরণের ইচ্ছা সব একাকার করে বাঙ্গালীকে উপহার দিয়েছেন গণিত ও বিজ্ঞান চিন্তার এক জ্ঞানকোষ – ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’। বাংলা ভাষায় গণিতে শূন্যর ধারণা ও আধুনিক বিজ্ঞানে শূন্যতার ভূমিকার ওপরে এত বিস্তৃত আলোচনা আর আছে কিনা আমি জানি না।

কোনো প্রশ্নই বিজ্ঞানীদের কাছে অনভিপ্রেত নয়। তাদের কৌতূহল গভীর, তাদের চিন্তা ভাবনা অসীমের দিকে ধাবমান। সেইসব চিন্তা মানুষকে করে তোলে যেমন জ্ঞানময় ও ভবিষ্যৎমুখী তেমনই সহনশীল। বইটির দ্বিতীয় অংশ মহাবিশ্বের উৎপত্তি-সংক্রান্ত; সেখানে অভিজিৎ রায় বিজ্ঞানীদের জটিল গবেষণাকে সহজ ভাষায় আমাদের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন যাতে আমরা নিজেরাই সেইসব কঠিন গভীর প্রশ্নগুলো নিয়ে মাথা ঘামাই; আমরা যাতে প্রজ্বলিত হই জ্ঞানের আনন্দে।

বইটির প্রথম ভাগে মীজান রহমান দেখিয়েছেন প্রাচীন সভ্যতার দর্শনগুলিতে শূন্যতার বোধ উপস্থিত থাকলেও সংখ্যা হিসাবে তাকে উদ্ভাবন করতে গণিতবিদের বেশ বেগ পেতে হয়েছে। প্রাচীন গ্রীসে শূন্যতার প্রতি একটা অনীহা ছিল, পিথাগোরাস, প্লেটো বা অ্যারিস্টোটল ভাবতেন মহাবিশ্বে শূন্যস্থান বা ভ্যাকুউম বলে কিছু নেই। অন্যদিকে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে শূন্যতার স্থান ছিল, সেটাই হয়তো ব্রহ্মগুপ্তের হাতে ০ হিসেবে গণিতের খাতায় স্থান পেল সপ্তম শতাব্দীতে। এরপরে বাগদাদে ইসলামী রেনেসাঁর আল খোয়ারিজমির মত গণিতবিদদের হাত ধরে ০ পৌঁছাল ইউরোপে। শূন্য ও অসীমের ধারণা ইউরোপে নতুন করে রূপ পেল, সেই রূপের চূড়ান্ত সফলতা অর্জিত হল আইজাক নিউটনের ক্যালকুলাস আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে।

মীজান রহমান গণিতের এই কাহিনী গড়েছেন এক মোহময় ভাষা দিয়ে। সেই ভাষারই একটা উদাহরণ দিই –

“শূন্যকে সংখ্যার আসরে বসাবার পর পুরো একটা ‘সংখ্যারেখার’ ধারণা নির্মিত হবার সুযোগ পায় মানুষের মনে। ‘শূন্য’ হয়ে গেল ধনাত্মক ও ঋণাত্মক সংখ্যামালার মাঝখানে একটা সেতুর মতো। অন্যভাবে ভাবতে গেলে শূন্য যেন একটা কাচের আরশি, যেখানে দাঁড়িয়ে ধনাত্মক রাশি তার প্রতিবিম্ব দেখতে পায় ঋণাত্মক রাশিতে। ধণাত্মক ও ঋণাত্মক সংখ্যা একে অন্যের সখা হয়ে গেল, তাদের মাঝে সৃষ্টি হলো এক নিরবচ্ছিন্ন প্রতিসাম্য। এ যেন সৃষ্টিরই দ্বৈত রূপ; এক দিকে ধন, আরেক দিকে ঋণ; এক দিকে জন্ম, আরেক দিকে মৃত্যু–দুটি একই বাস্তবতার বন্ধনে নিবিড়ভাবে আবদ্ধ।”

ওপরের প্যারাটির মধ্যেই প্রকৃতির একটি নীতি স্পষ্ট্ভাবে ফুটে উঠেছে, সেটি হল প্রতিসাম্য, সিমেট্রি। প্রকৃতি যেমন ধনাত্মক ও ঋণাত্মক সংখ্যার বোধ তৈরি করে, তেমনভাবেই বাস্তবে সৃষ্টি করে মৌচাকের ষড়ভূজ, সূর্যমুখী ফুলের মধ্যে বীজসমূহের অবস্থানকে ফিবোনাচ্চি পর্যায় দিয়ে বর্ণনা, আমাদের গ্যালাক্সির দুই সর্পিল নাক্ষত্রিক বাহু যা কিনা একে অপরের প্রতিবিম্ব। কিন্তু প্রতিসাম্যের ধারণা প্রকৃতির আরো গভীরে নিমজ্জিত; স্থান ও সময়ের প্রতিসাম্য আমাদের দিয়েছে ভরবেগ ও শক্তির নিত্যতার সূত্র।

অভিজিৎ রায় রিলে দৌড়ের ব্যাটনের মত মীজান রহমানের কাছ থেকে মানুষের ০ সৃষ্টির ইতিহাস ও প্রতিসাম্যের ধারণা লুফে নিয়ে দৌড়ালেন সামনে আধুনিক সময়ের দিকে। গড়লেন এই সময়ের মহাজাগতিক তত্ত্বসমূহের আবির্ভাবের ইতিহাস। তার মধ্যে রয়েছে আইনস্টাইনের মাধ্যাকর্ষণ সমীকরণ, হাবলের মহাবিশ্বের প্রসারণ আবিষ্কার, বিগ ব্যাংগ মডেলের উদ্ভাবন, ১৯৮০র দশকের অতিস্ফীতি তত্ত্ব, বর্তমানের তমোশক্তির ধারণা যা কিনা মহাবিশ্বের প্রসারণকে ত্বরাণ্বিত করছে। কিছুই বাদ দেন নি অভিজিৎ, এমন কি হিগস কণা আবিষ্কারের কাহিনীকে বিস্তারিতভাবে লেখা হয়েছে।

বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে মহাবিশ্বের সমস্ত গালাক্সিসমূহ একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, সেটাকে তাঁরা বলছেন মহাবিশ্ব প্রসারমান। একে অন্যভাবে বলা যায় মহাবিশ্বের স্থান-কালের গঠন প্রসারিত হচ্ছে। কাজেই সুদূর অতীতে মহাবিশ্বের বস্তুসমূহ খুব কাছাকাছি অবস্থায় ছিল। বস্তুসমূহ বলা ঠিক হবে না, বস্তুসমূহ সৃষ্টির আগে সেটি ছিল হয়তো কোনো বিশেষ পদার্থজনিত ক্ষেত্র। একই সাথে কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব বলছে বায়ুশূন্য শূন্যতা বলে কিছু নেই, সেই শূন্যতায় ক্রমাগতই হাইজেনবার্গ অনিশ্চয়তায় কণার আবির্ভাব ঘটে ও তাকে অবলোকন করার আগেই আবার শূন্যে তার বিলুপ্তি হয়, যদিও পরোক্ষভাবে তাদের অস্তিত্বের নিশ্চয়তা মেলে। একে বলা হচ্ছে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন।

সেই কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের হার ধরে অনেক বিজ্ঞানী বলছেন শূন্য থেকে মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্ভব।

বিজ্ঞানীদের কাছে এই শূন্যতার সংজ্ঞা হল আমরা সাধারণভাবে যে vacuum (ভ্যাকুউম, বায়ুশূন্য শূন্যতা) ভাবি তা নয়। এই শূন্যতা হল এমন একটি ব্যাপার যেখানে কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। ভ্যাকুউম স্থান-কাল মেট্রিক বা গঠনের ওপর ভিত্তি করে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখে। এই মহাবিশ্ব থেকে সমস্ত বস্তুকণা অপসারিত করলেও মহাবিশ্ব তার স্থান-কালের গঠন বজায় রাখবে, অর্থাৎ মহাবিশ্বের অস্তিত্ব বিলোপ হবে না। সেই মহাবিশ্ব nothing নয়। তাহলে nothing জিনিস কী? সেটা হল যখন স্থান-কালের গঠনের বিলোপ হবে। একেবারেই ‘কিছু না’।

সেই “কিছু না” যার মাঝে স্থান ও সময়ের অস্তিত্ব নেই, ফাঁকা জায়গা বলতে যা বুঝাই সেটাও নেই, সেই জিনিসটা কী হতে পারে? তাকে তো আমরা চিন্তাই করতে পারি না। ‘কিছু না’ কথাটার মাধ্যমে আমরা সবকিছুর অনস্তিত্বকে চিহ্নিত করতে পারি। তবে অনস্তিত্বর সংজ্ঞা বা চরিত্র নিয়ে দার্শনিকেরা সবসময় অস্বস্তি বোধ করেন। ফরাসী দার্শনিক সার্ত্র এই নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন, নাম দিয়েছিলেন Being and Nothingness। এখানে Being বলতে বিদ্যমান বস্তু বা চেতনার কথা বোঝানো হয়েছে। আপাততঃ আমি একে বিদ্যমান (অস্তিত্ব) ও অনস্তিত্ব বলে অভিহিত করতে পারি। সার্ত্র লিখছেন –

Nothingness must be given at the heart of Being, in order for us to be able to apprehend that particular type of realities which we have called negatites. But this intra-mundane Nothingness cannot be produced by Being-in-itself; the notion of Being as full positivity does not contain Nothingness as one of its structures. We can not even say that Being excludes it. Being lacks all relation with it. Hence the question which is put to us now with a particular urgency: if Nothingness can be conceived neither outside of Being, nor in terms of Being, and if on the other hand, since it is non-being, it can not derive from itself the necessary force to “nihilate itself,” where does Nothigness come from? .

আমার পক্ষে দার্শনিকের কারিগরী ভাষা বোঝা মুশকিল। হয়তো সার্ত্র বলতে চাইছেন অনস্তিত্ব মানে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই, কিন্তু সেটা বলতে গিয়ে আমাদের অস্তিত্বের বা চেতনারই আশ্রয় নিতে হচ্ছে। অনস্তিত্বর আবার নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য সমস্ত জিনিসকে ধ্বংস করা প্রয়োজন, কিন্তু সেই ধ্বংস সাধনের জন্য যে প্রক্রিয়ার দরকার সেটা অনস্তিত্বের নেই। তাই অস্তিত্বের বাইরে অনস্তিত্বকে ব্যাখ্যা করতে আমাদের অসুবিধা হচ্ছে। এই নিয়ে যে একটা দ্বন্দ্ব বিদ্যমান, কারণ অনস্তিত্বেকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমরা ‘কিছু না’কে অস্তিত্ব দিচ্ছি। সার্ত্রকে কেন nothingএর বোধ এত যন্ত্রণা দিচ্ছিল সেটা হয়তো এখন আমরা একটু বুঝতে পারছি।

কিন্তু দার্শনিকেরা যেখানে হাল ছেড়ে দেন, বিজ্ঞানীরা হাল ছাড়েন না, কারণ বিজ্ঞানীদের হাল ছাড়বার উপায় নেই। তাদেরকে এগিয়ে যেতে অসম্ভবের সঙ্গে লড়াইয়ে। এক সময়ে তারা ধারণা করছিলেন মহাবিশ্বের অস্তিত্ব অসীম সময় ধরে, এর কোনো শুরু নেই, কিন্তু দেখা গেল অসীম সময় ধরে অবস্থান করলে আমাদের আকাশের অন্ধকার হবার কথা কারণ সব তারাদের তাদের জ্বালানী ফুরিয়ে নিভে যাবার কথা। কাজেই মহাবিশ্বের প্রসারণ হোক বা না হোক, এর বয়স অসীম হতে পারে না, অসীম হতে হলে নতুন জ্বালানী প্রয়োজন, নক্ষত্র বানানোর জন্য নতুন সংহত গ্যাসের দরকার, সুপারনোভা থেকে বর্জিত পুরাতন গ্যাস দিয়ে হবে না। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রই বলছে মহাবিশ্বের বয়স অসীম হতে পারে না। এরপর বিজ্ঞানীরা যখন আবিষ্কার করলেন মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে তাঁরা ধারনা করলেন মহাবিশ্বের হয়ত একটা শুরু আছে।

কিন্তু সেই শুরুটা কীভাবে হতে পারে? ‘কিছু না’ অবস্থা থেকে মহাবিশ্বের উদ্ভব হতে পারে? অনেক বিজ্ঞানী বলছেন ‘কিছু না অবস্থার মধ্যে থেকে কিছু সৃষ্টি হতে পারে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমে। এর জন্য হাইজেনবার্গ অনিশ্চয়তা তত্ত্ব, কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও আপেক্ষিকতার মিলিত এক মডেল কাজ করে। সেই অনিশ্চয়তায় ‘কিছু না’র মধ্যে স্থান-কালের গঠন রচিত হতে পারে এবং সেই গঠন যদি কোনো কোয়ান্টাম ক্ষেত্রের শক্তির মাধ্যমে খুব দ্রুত অতিস্ফীত হয় সেই গঠন বেশ বড় সময়ের জন্য স্থিত অবস্থা প্রাপ্ত হবে এবং ‘কিছু নাতে মিলিয়ে যেতে পারবে না। আমাদের মহাবিশ্ব সেই অতিস্ফিতীরই ফল। পদার্থবিদ্যা বলে বস্তু ও মহাকর্ষের শক্তি যোগ করলে ফলাফল হবে শূন্য, কাজেই শূন্য (কিছু না) থেকে এই মহাবিশ্বের উদ্ভূত হওয়া সম্ভব।

অভিজিৎ এই কাহিনিই বলেছেন এক সাবলীল ও চমকপ্রদ ভাষার মাধ্যমে। এর একটি উদাহরণ দিই। বর্তমান মহাজাগতিক মডেল বলে ক্রমাগত প্রসারণের ফলে মহাবিশ্বের সমস্ত বস্তু যখন একে অপর থেকে দূরে সরে যাবে তখন মহাবিশ্বের শীতল মৃত্যু হবে। এই বেদনাদায়ক পরিণতিটাই অভিজিৎ লিখছেন এভাবে –

“মহাবিশ্বের এই অন্তিম পরিণতির ধারণাগুলো হয়তো আমাদের নৈরাশ্যবাদী বানিয়ে দিতে পারে, কিন্তু একটি কথা মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞানের কাজ কেবল মিথ্যা প্রবোধ ও সান্ত্বনা দেয়া নয়। সত্যনিষ্ঠভাবে বাস্তবতার মুখোমুখি করানোও বিজ্ঞানীদের দায়িত্ব। সত্যনিষ্ঠভাবে বাস্তবতার মুখোমিখি করানোও বিজ্ঞানীর দায়িত্ব। বাস্তবতা রুঢ় বা কঠিন হলে সেটাকে মিথ্যার ‘সান্ত্বনার প্রলেপ না লাগিয়ে বস্তুনিষ্ঠভাবেই সেটাকে বর্ণনা করেন তাঁরা। আমাদের প্রকৃত, আমাদের মহাবিশ্ব যেমন, ঠিক তেমনভাবেই একে ব্যাখ্যা করেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালবাসিলাম, সে কখনো করে না বঞ্চনা’।”

মানুষকে বাঁচানোর জন্য কেউ নেই। মানুষকে নিজে নিজেই বাঁচতে হবে। সেই বাঁচা বাস্তবকে গ্রহণ করেই বাঁচা, সেটাই মানুষের মনুষত্ব। এই দর্শন গ্রহণ করেই মানুষ হয়ে ওঠে মহীয়ান।

এই জটিল ধারণাগুলোয় অভিজিৎ রায় তাঁর বইয়ে তুলে ধরেছেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল এইসব চিন্তার বাইরে চিন্তাগুলো নিয়ে মানুষ ভাববে। তারা দেখবে মানব সভ্যতার গবেষণার ফসল মানুষকে কী ধরণের চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ দিচ্ছে। বিজ্ঞানীরা জিজ্ঞেস করছেন বস্তুর ভর কোথা থেকে আসে, প্রশ্ন করছেন প্রাকৃতিক নিয়মগুলোর উৎস কী, মাথা ঘামাচ্ছেন ‘কিছু না’র সংজ্ঞা নিয়ে। এইসব ভাবনায় কোনো শৃঙ্খল পরানো নেই, সেই চিন্তা জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত, কোটি কোটি গ্যালাক্সির নাক্ষত্রিক সঙ্কেতে সেই চিন্তা স্নাত। এই ধরণের প্রশ্ন ও উত্তর খোঁজার ইচ্ছা সাধারণ দর্শন বা ধর্মচিন্তা থেকে অনেক বেশী গভীর, অনেকই ভাবতে পারবে না যে এই ধরণের প্রশ্ন করা সম্ভব, এই ধরণের গবেষণা করা সম্ভব।

যারা সেটা ভাবতে পারে না তারা এই বাঁধনমুক্ত জ্ঞানের প্রয়াসে ভীত হয়ে থাকে, তাদের চিন্তা চেতনা একটা সঙ্কীর্ণ কুয়ার বাইরে প্রসারিত হতে পারে না। সেই ভীতি থেকে তারা সমস্ত জ্ঞানের আলোকে নিভিয়ে দিতে চায়। হাইপেশিয়াকে নির্বোধ জনতা শকটের পেছনে টেনে-হিঁচড়ে মেরেছিল, জিয়োর্দানো ব্রুনোকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছিল, অভিজিৎ অনন্তকে চাপাতি দিয়ে হত্যা করেছিল। সমস্ত ধরণের আলো নেভাতে তারা প্রকাশকদের মেরে ফেলতে দ্বিধা করে না। শূন্য থেকে মহাবিশ্বের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী সেই অজ্ঞানতার ছুরি থেকে অল্পের জন্য বেঁচে ফিরেছেন, অন্য এক প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন ফেরেন নি। অনন্ত অজানাকে জানার যে ভাষা সে ভাষা বুঝতে না পারলে অজ্ঞ মানুষেরা এটা করেই যাবে। কিন্তু এসব করে জ্ঞানের গভীর আকাঙ্খার আগুন নেভে না।

আজ অভিজিতের মৃত্যুদিনে তাঁকে স্মরণ করছি, তাঁর অনুপস্থিতি অনুভব করছি। তবু এই শোকের মাঝে আমি বলি অভিজিৎ এই বইটি তাঁর জীবদ্দশায় বের করে যেতে পেরেছিল, সে বুঝেছিল বইটি ভবিষ্যৎ পড়ুয়াদের চিন্তার খোরাক হবে, তাদের মনের দুয়ার হয়ত খুলবে। শত শোকের মাঝে এই আনন্দটুকু ফুটে উঠুক।