কোনভাবেই মেনে নিতে পারছি না-কতিপয় মূঢ়-মুর্খ-ধর্মান্ধ নরপশুর হাতে সমকালের একজন অনন্য মেধাবী, দেশপ্রেমিক মুক্তচিন্তার প্রতিকৃত ড. অভিজিৎ রায়কে জীবন বলি দিতে হল। ঘটনার দিন সকালে তার ফেইস বুকে একটি মেসেজ পাঠিয়ে জানতে চাই-কিছু দিন ধরে মুক্তমনা ওয়েব পেইজ ব্লক পাওয়া যাচ্ছে-এটা কি কোন টেকনিক্যাল সমস্যা-নাকি সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। জবাবে অভিজিৎ রায় লিখেছেন-হয়ত সরকার বন্ধ করে দিতে পারে। আপনি প্রক্সি সার্ভার এ চেষ্টা করুন, দেখা যাক কি করা যায়।

আমি তখনো জানি না, অভিজিৎ ঢাকায় এসেছেন। ঐ দিন বিকাল ৩-০০ টার ট্রেনে ঢাকা যাচ্ছিলাম। রাত ৯-৩০ টার দিকে-আমি তখনো ট্রেনে-প্রবাসী অনুজ নাছির আলম রুয়াইস-আবুধাবি, থেকে আমাকে ফোন করে জানায়-অভিজিৎ দুর্বৃত্তের হামলায় নিহত-তার স্ত্রী গুরুতর আহত। প্রত্যুত্তরে আমি তাকে বলি-অভিজিৎত আমেরিকায়। সে বলে-বই মেলা উপলক্ষে তারা বোধহয় দেশে গেছে।

কিছুক্ষণের মধ্যে আমার মোবাইলে ব্রেকিং নিউজের এস,এম,এস, আসল-অভিজিৎ সস্ত্রীক আক্রান্ত-গুরুতর আহত। প্রচণ্ড উৎকণ্ঠায়ও একটু আশার আলো দেখলাম-অভিজিৎ হয়ত বেচেঁ আছে। না-মিনিট দশেক পরের এস,এম,এস, নিশ্চিত করল –Avijit Roye hacked to death ।

প্রচণ্ড বেদনায় মোচড় দিয়ে ওঠে হৃৎপৃণ্ড-এটা কি হল !
ড.অভিজিৎ রায় মুক্তমনা নামে একটি ব্লগ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে আমি মুক্তমনায় লেখা পাঠাই অতিথি লেখক হিসাবে। পরে মুক্তমনা ব্লগের সদস্য হই । পরবর্তী সময়ে মুক্তমনার একজন ব্লগার লেখক হিসাবে আমারও একটি ব্লগ হয়। একজন বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক হিসাবে অত্যন্ত মেধাবী ও সাহসী ছিলেন অভিজিৎ। মুক্তমনায় দেদারছে লিখতেন অভিজিৎ।

তাঁর প্রথম গ্রন্থ :“আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী”(অঙ্কুর প্রকাশনী-২০০৫ ইং সাল) একটি অসাধারণ গ্রন্থ। তার পর একে একে “মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে”, “স্বতন্ত্র ভাবনা”, “অবিশ্বাসের দর্শন”, “বিশ্বাস ও বিজ্ঞান”, “শূন্য থেকে মহাবিশ্ব”, “বিশ্বাসের ভাইরাস” সহ আরো কয়েকটি বিজ্ঞান ভিত্তিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। বিজ্ঞানমনস্ক পাঠক তৈরীতে তার বিশ্বাসের ভাইরাস একটি অনন্য ও অসাধারণ গ্রন্থ। তাঁর সম্পাদিত “বিশ্বাস ও বিজ্ঞান” গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ে ‘ধর্ম ও বিজ্ঞানের সহাবস্থান’ নামক আমারও একটি নিবন্ধ স্থান পেয়ছে।

‘মুক্তমনা ওয়েব সাইট’ সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, সর্বোপরি ধর্মান্ধতার বিপরীতে একটি বিজ্ঞানমনষ্ক সমাজ বিনির্মানের চ্যালেঞ্জ নিয়েই আত্মপ্রকাশ করেছে। ধর্মান্ধরা ঠিকই বুঝেছে-অভিজিতের শাণিত লেখনির প্রত্যুত্তরে তাদের কোন যুক্তি নেই। তাঁর প্রতিটি যুক্তি ধর্মান্ধদের মরণ কামড় দিচ্ছে। কেবল ধর্মান্ধ-জঙ্গীরা নয়-অসুস্থ রাজনীতির ধারক-বাহকেরাও মুক্তমনাকে সমর্থন করে না-বরং ভয় পায়-তার যুক্তিবাদীতার কারণে। তাই অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের সপ্তাহখানেক পূ্র্ব থেকেই সরকার ‘মুক্তমনা ওয়েব সাইট ব্লক করে রেখেছে-কোন ঘোষণা ছাড়াই-যে বিষয়ে অভিজিতের সাথে হত্যাকাণ্ডের মাত্র কয়েক ঘন্টা পূর্বেই আমার বাক্য বিনিময়।

অভিজিৎ রায়ের এ মধ্যযুগীয় বর্বর হত্যাকাণ্ড আমাদের কেবল ব্যাথিত ও ক্ষুদ্ধ করে নি-করেছে প্রতিশোধ প্রবণও। তাই আমরা এর প্রতিশোধ নেব-চরম প্রতিশোধ। তবে খুনী ধর্মান্ধদের খুন করে নয়-সকল প্রকার ধর্মান্ধতা, অপবিশ্বাস, কুসংস্কার এর বিরুদ্ধে মুক্তচিন্তার লড়াইকে আরো বেগবান ও শাণিত করে।
প্রিয় অভিজিৎ, তোমার প্রজ্জ্বলিত মশাল হাতে আমরা এগিয়ে যাবই।
মুর্খরা জানে না, ব্যক্তিকে হত্যা করা যায়-তার আদর্শকে কখনো হত্যা করা যায় না। মুক্তচিন্তার লড়াই এগিয়ে যাবেই।