লেখক: হুমায়ুন কবির সুমন

ম

শরীরটা খারাপ ছিল সেদিন।তাই স্কুল থেকে এসে ঘুমাতে সময় লাগেনি। সন্ধ্যায় ঘুম ভাঙতেই ফেসবুকে ঢুকলাম।খুব সম্ভবত নিউজফিডের দ্বিতীয় বা তৃতীয় পোস্টে জানতে পারলাম অভিজিৎ রায়ের উপর হামলা হয়েছে,তাও আবার বইমেলার মধ্যে।সত্যি বলতে গেলে আমার এক ফোঁটাও বিশ্বাস হয়নি।অভিজিৎ রায়ের উপর হামলা হতে পারে এই ভয় আমার ও আমার বন্ধু ‘ক’ (বন্ধুর নামটা প্রতীকী রেখে দিলাম) এর সবসময়ই ছিল।তবে আমাদের প্রতিটি আলোচনার শেষ হতো ‘আরে নাহ অভিজিৎ রায় এর উপর হামলার সাহস হবে না। উনি তো আর রাস্তার মানুষ না,বুয়েট পাস করা জ্ঞানী লোক,অজয় রায় এর সন্তান,মুক্তমনার মতো বড় একটা ব্লগ চালান তার উপর থাকেন আমেরিকাতে ‘ যুক্তিগুলো আমাদের একটুও খেলো মনে হয়নি তখন।আশ্বাস ছিল আমাদের নেতা নেত্রীদের অসাম্প্রদায়িক,প্রগতিশীল মনোভাবে।হামলার খবরটি নিশ্চিত হবার পর আমার মানসিক অবস্থাটা আসলে লিখে বোঝানো যাবে না।অভিজিৎ দা’র সাথে আমার কখনো দেখা হয়নি,কথা হয়নি তবুও তাকে মনে হতো নিজেদেরই একজন,অনেক আপন,অন্ধকারে আলো হাতে চলা আমার আইডল। সাথে সাথে ফোন দিলাম ‘ক’কে।আমার গলা কোনদিন এভাবে কাঁপেনি,কোনদিন আমি এক বাক্যের শুরুতে একবার আর শেষে একবার ঢোঁক গিলিনি। বললাম ‘অভিজিৎ রায়ের উপর হামলা হইছে’।ওর ও বিশ্বাস হলো না,ফোন রেখে বললো ‘আমি একটু নেটে ঢুকে দেখি’।

অভিজিৎ রায় এর কথা প্রথম জানতে পারি ২০১১ সালে।বন্ধু খুব করে রিকমেন্ড করলো ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’।দেশ থেকে অনেক কষ্ট করেও আনাতে পারলাম না।অগত্যা মুক্তমনাতে ফ্রি পিডিএফ ফরম্যাটে পড়লাম কিছু অধ্যায়।কি অসাধারণ কি সহজ ভাষায় লেখা সবকিছু।কোন অতিরঞ্জন নেই,বিজ্ঞানপাঠকে কঠিন করার অতিরিক্ত প্রয়াস নেই।আরও জানতে পারলাম এই বইয়ের আরেক লেখক রায়হান আবীর,আমার ক্যাডেট সম্পর্কীয় ভাই।ক্যাডেট কলেজে এর যা কিছু নিয়ে গর্ববোধ করেছি তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রায়হান ভাই।ক্যাডেট কলেজ ব্লগেও উনার লেখা নিয়মিত পড়তাম।’বিশ্বাসের ভাইরাস’এর কারনেই কিনা জানিনা মুক্তমনা পড়া শুরু করলাম।খুজে পেলাম বন্যা আহমেদের ‘বিবর্তনের পথ ধরে’। মেডিক্যালের স্টুডেন্ট হিসেবে বায়োকেমিস্ট্রি,অরগানিক কেমিস্ট্রি,জেনেটিক্স বা বায়োলজির উপর মোটামুটি ভালোই দখল ছিল কিন্তু বিবর্তন ব্যাপারটা কখনোই বুঝতে পারিনি ঠিক মত।ডারউইনের ‘অরিজিন অফ স্পেশিস’ হাতে নিলেই তালগোল পাকিয়ে যেত। বন্যা আহমেদের লেখা পড়ে মনে হলো বিজ্ঞান নিয়ে লিখতে হলে আসলে এভাবেই লেখা উচিত।কখনো ভাবিনি যেই হাত আর কলমের ছোঁয়ায় বন্যা আহমেদ হাজার হাজার পাঠককে অভিভূত করেছেন,সেই হাতটিকে দেখতে হবে রক্তমাখা।

ঐ সময় থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত অভিজিৎ রায়ের সব লেখা পড়েছি, কখনো হতাশ হইনি বরং অবাক হয়েছি একটা মানুষ কিভাবে এতকিছু জানতে পারে।এই মানুষটির রক্তাক্ত নিথর দেহটি রাস্তায় পরে থাকতে দেখে কষ্টের চেয়ে যে অনুভূতিটি হচ্ছিল তা হচ্ছে ঘৃণার। মূর্খ ধর্মান্ধদের প্রতি ঘৃণা,ধরি মাছ না ছুই টাইপের সুশীলদের প্রতি ঘৃণা,বইমেলার মত জনাকীর্ণ জায়গায় যে প্রশাসন তার নিরাপত্তা দিতে পারেনি তাদের প্রতি ঘৃণা,।আর ছিল অসহায়ত্ব,দুশ্চিন্তা। যে মানুষগুলো ২৫শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অভিজিৎ রায়ের নামই জানতো না,তার মৃত্যুর পর এরাই হয়ে গেল গবেষক,সমালোচক।ফেসবুকে ঝড় উঠল ‘কিন্তু’ ‘তবে’ হ্যান ত্যান অজুহাতের।অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুকে জাস্টিফাই করতে বাজারে আসলো বিভিন্ন ভালো নাস্তিক খারাপ নাস্তিক থিওরি।দেশের বুদ্ধিজীবী আর সুশীল সমাজকে দেখলাম ঘরের কোণে লুকাতে,অভিজিৎ রায়ের পক্ষে কথা বললে যেন মান সম্মান কল্লা সব যাবে।এমপি মন্ত্রীরাও নাকি লুকিয়ে লুকিয়ে সান্ত্বনা দিয়েছেন অভিজিৎ রায়ের পরিবারকে।সত্যি আজব এক দেশ!!!

ভালো থাকুন অভিজিৎ দা।যতদিন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা হবে,যতদিন মুক্ত মনের,ভয়হীন চিত্তের বিকাশ হবে এদেশে, ততদিন আপনি থাকবেন আলোর মশাল হাতে,প্রগতির মিছিলে।

হুমায়ুন কবির সুমন
আঙ্কারা
২৬/০২/২০১৬