আমার অফিসে এক মহিলা সহকর্মী আছেন। উনি লেখালেখি করেন। অ্যামাজনে ই-বুক পাব্লিশ করেন। বেশ গোছানো কাজ। প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে সব কিছুতেই প্রফেশন্যালইজমের ছাপ আছে। উনার গল্প ও উপন্যাসগুলো মূলত ভ্যাম্পায়ারের প্রেম কাহিনী। আমি যদি twilight ছবিটা না দেখতাম তাহলে এই জনপ্রিয় জনরাঁ আমার আছে অচেনাই থেকে যেত।

আমি উনার একটা বই পড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। ইংরেজি যেটাকে বলে “নট মাই কাপ অফ টি” – সেটা মনে হয়েছে। ওনার বইয়ের বিক্রি খুব বেশি না। মাসে হয়ত ৫০/১০০ কপি বিক্রি হয়। কিন্তু এই ধারার বই থেকে মিলিওনিয়ার হয়েছে মানুষ। উনিও সেই আশাতে লেখালেখি আর মার্কেটিং দুটোই চালিয়ে যাচ্ছেন।

ওনার কাছ থেকে কিছুদিন আগে এক তথ্য জানলাম। এক রোমান্টিক ভ্যাম্পায়ার গল্পের লেখিকা গত পাঁচ বছর ধরে আরও কয়েকজনের লেখা চুরি বই ছাপাচ্ছেন। সেই লেখা চোর নাকি এক মিলিওন ডলারের বেশি কামিয়েছে এই কুম্ভিলকতা থেকে। কিন্তু চোরের দশ দিন আর গেরস্তের একদিন।

এই কাহিনী শুনে আমার প্রথম প্রশ্ন ছিল এই ডিজিটাল যুগে চুরি ধরতে এতো দিন লাগলো কেন? উনি জানালেন যে চোর লেখিকা কয়েকটা কাহিনী মিলিয়ে গল্প বানান – এবং সেই সঙ্গে স্ট্রেইট রিলেশনশিপের গল্পকে গে আর লেসবিয়ান রিলেশনের গল্প বানান। আমি প্রথমবারের মতো জানলাম এই এই জনরাঁর গে এবং লেসবিয়ান ভার্সনও আছে। আমার অজ্ঞানতা সীমাহীন। এটা থাকাই উচিৎ। আমার জানার পরিধি বাড়াতে হবে।

এইবার বাংলাদেশের প্রসঙ্গে আসি। আমার এক অনুজপ্রতিম লেখককে জিজ্ঞেস করেছিলাম বই মেলাতে যখন কোন বই ভালো চলে তখন আসলে কত কপি বিক্রি হয়। সে জানালো ১০০০/১২০০ অতিক্রম করলে সেটাকে বেশ ভালো বিক্রি বলে গণ্য করা যায়। এই থ্রেশোল্ড খুব কম লেখকই অতিক্রম করতে পারেন।

বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষ। আর মেলাতে বই বিক্রি হয় নগন্য পরিমানে। এই পরিসংখ্যান আমাকে অবাক করেনি। আমি মানুষের বাসাতে গেলে কী পরিমান বই আছে সেটা মন দিয়ে লক্ষ্য করি। সেটার সাথে চিন্তাভাবনার সুক্ষ্ণ সংযোগ থাকে। যেই চিত্রটা দেখি সেটা আশংকা করার মতো।। আমি নিজেও তেমন পড়ুয়া নই। আরও অনেক বেশি পড়া উচিৎ সেটা অনুভব করি। মার্কিন দেশে বই পড়াকে উৎসাহিত করা হয়। মেয়েদেরকে বড় করতে গিয়ে দেখছি সেটা। মানুষ যে এখনও চিন্তা করতে পারে সেটার অন্যতম প্রামান্য দলিল হচ্ছে বই।

আমরা কে কী বই পড়ব অথবা প্রকাশ করব, কোনটা আবর্জনাতে ফেলে দিব আর কোনটা তাকে সাজিয়ে রাখব, কোন কবিতার লাইন প্রেমিকাকে শোনাব, কোন গল্পের লাইন আড্ডাতে কোট করব, কোন বই গভীর রাতে বালকবেলা ডেকে আনবে, কোন বই আমাদের হাসাবে, কাঁদাবে, ভাবাবে সেটার সিদ্ধান্ত আমাদের হাতে এবং একমাত্র আমাদেরই হাতে। গানের জলসাতে যেমন প্রধান অতিথি হচ্ছে শ্রোতা তেমনি বইকে বাঁচিয়ে রাখা অথবা বিস্মৃতির অতলে ফেলে দেওয়া পাঠকেরই কাজ।

সেই হিসাবে যৌনতা মিশ্রিত রোমান্টিক ভ্যাম্পায়ার উপন্যাসের যেমন পাঠক থাকবে তেমনি রিচার্ড ডকিন্সেরও পাঠক থাকবে। একটি দেশ, একটি সমাজ, একটি প্রজন্ম, একটি জনপদ ঠিক এইভাবেই চিন্তাতে, দর্শনে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে ঋদ্ধ হয়। এইভাবেই অন্ধবিশ্বাসের কারাগার থেকে মুক্তি মেলে।

কিন্তু লেখালেখির জন্য যদি লেখককে নিজ বাসা থেকে শুরু করে ব্যস্ত রাজপথে মরে পড়ে থাকতে হয়, তখন বুঝতে হবে আমাদের কোন সমস্যা আচ্ছে। আমরা যদি বুদ্ধিমান হই তাহলে মানুষের বাসার তাকে বইয়ের সংখ্যা থেকেই চট করে বুঝতে পারি আমরা কোন পথে ধাবমান।

আমাদের দেশে যাদের বই প্রচুর বিক্রি হয় তাঁরা নিজেরাই নিজেদের বইয়ে পাঠক তৈরি করেছেন। তৈরি পাঠক এই দেশে খুব কম। রসময় গুপ্ত ছাড়া আর সবাইকে পাঠক তৈরি করে বই লিখতে হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাস আসলেই আমার ফেসবুক ফিডে প্রচুর লেখক বন্ধুদের নিজের বইয়ের বিজ্ঞাপনে নামতে দেখি। অনেক বছর আগে ফার্মগেটের এক ক্যাসেটের দোকানে এক লোককে দেখেছিলাম কিছু ক্যাসেট দোকানিকে গছানোর চেষ্টা করছে। অবাক হয়ে দেখলাম ক্যাসেটের কভারে সেই লোকেরই ছবি। ফেব্রুয়ারি আসলেই সেই গায়ক কাম হেড অফ মার্কেটিং কথা মনে পড়বেই!!! ব্যাপারটা আমার কাছে একটু কেমন কেমন লাগলে পরে বুঝেছি – যস্মিন দেশে যদাচার। এতো আয়োজন করে বইমেলা করা হলেও শেষ পর্যন্ত বইটা আসলে একটা ব্যবসা, আলু পটল, পেঁয়াজের মতো আরও একটি পণ্য। বই বিক্রি না হলে এই ব্যবসারও লালবাতি জ্বলতে বাধ্য।

আর একদিন পরেই অভিজিৎ রায় হত্যার এক বছর পূর্ণ হবে। আমাদের প্রকাশনা জগতে এই ঘটনা এক বিরাট মাইলস্টোন। এর পর পরই আমরা জেনে গেছি যে আমাদের বুঝেশুনে লেখা উচিৎ। দুর্দান্ত কলামিস্ট, মিডিয়া কর্মী, কবি, সাহিত্যিক, সরকারী আমলা সবাই একই সুরে কথা বলেছে। দুই মলাটের মধ্যে এমন এক মরাণাস্ত্র যে লুকিয়ে রাখা যায় আমরা কেউই আগে জানতাম না। বহুদিন এমন ঐকমত্য দেখতে পাইনি।

অভিজিৎ রায়ের লেখা অনেক বছর ধরে পড়ছি। ১৯৯৭/৯৮ সালে সম্ভবত যায় যায় দিন পত্রিকাতে অভিজিতের লেখা প্রথম পড়েছিলাম। মুক্তমনা নামে একটা ইমেইল গ্রুপ ছিল, সেটারও সদস্য ছিলাম। সচলায়তনেও অভিজিৎ সক্রিয় ছিল, মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা সে। আমি অভিজিতের সাথে ফেসবুকে যুক্ত ছিলাম। এই দীর্ঘ সময়ে মাত্র একবার মাত্র যোগাযোগ করেছিলাম। একটা বই কিনতে চেয়ে মেসেজ দিয়েছিলাম তাকে। সে বইটার পিডিএফ আমাকে পাঠিয়ে দেয়।

আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে অভিজিৎ চাইতো মানুষ পড়ুক। যেখানে সবচেয়ে বেশি অন্ধকার সেইখানেই আলোর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। অভিজিৎ সম্ভবত সেটা জানতো। অন্ধকারে আততায়ী লুকিয়ে থাকে। আলোতে তার প্রকাশ অনিবার্য। অন্ধকার দীর্ঘস্থায়ী হলে সেটাও কারো কারো জন্য মুনাফা নিয়ে আসে।

লেখালেখির মধ্যে আনন্দ আছে। আত্মপ্রকাশের আনন্দ। সৃষ্টির আনন্দ। কিছু কিছু লেখা মনকে বিবশ করে দেয়। কিছু কিছু লেখা পাখির পালকদের মত হালকা। কোন কোন লেখার ভার বয়ে বেড়াতে হয় দীর্ঘকাল। কিন্তু দিনশেষে ওরা সবাই আনন্দ নিয়ে আসে। সেই সামান্য আনন্দটাই অসামান্য। সেই আনন্দটা পাটিগণিতের নিয়মে চলে না – সেটা যতজন মিলে ভাগ করে নিবে, ততই বেড়ে যাবে!!! এই প্রতিদিন অঙ্ক কষে যাপন করা জীবনের মাঝে ওই ভাগ করে নেওয়া আনন্দাটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া। অমরত্বের লোভে কেউই লেখে না, সবচেয়ে বড় নির্বোধটাও না। কিন্তু কেউ কেউ অমরত্ব পেয়ে যায়। সেটা লেখার প্রোডাক্ট নয় বরং বাই প্রোডাক্ট।

অভিজিৎ বহু বহু মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল, সম্ভবত সে নিজেও জানতো না ঠিক কতখানি শক্তিশালী হতে পারে হাতের কলম।

বেঁচে থাকো অভিজিৎ তোমার সৃষ্টির আনন্দে, সেই আনন্দের আলোকধারাতে দূর হয়ে যাক অন্ধকার।