আজ ২৬ শে ফেব্রুয়ারী ।ডঃ অভিজিৎ রায়ের মহাপ্রয়ান দিবস। বিজ্ঞানমনস্ক এবং যুক্তিবাদীদের জন্য এক বেদনার্ত দিবস।

ইতিহাস সাক্ষী – ধর্মের কারাগারে আবদ্ধ প্রাণীরা জাগতিক প্রক্রিয়ার বাস্তবতা গ্রহন করতে পারেনা। এরা তাই ব্রূনো, হাইপেশিয়া, গ্যালিলিওদের পিশে মেরেছে। বিজ্ঞানের প্রান্তিক আবিষ্কারগুলো অভিজিৎ স্রোতস্বিনীর মত প্রাঞ্জল বাংলা ভাষায় প্রকাশ করছিলেন প্রবন্ধে এবং বইএর আকারে। বিজ্ঞানের আলোয় দিগন্তরেখা বৃদ্ধিপায়। অন্ধকার দূরীভূত হয়। ধর্ম হয়ে যার কোনঠাসা, চিড়ে চ্যাপটা, সংকীর্ণ।অস্তিত্ত্ব হয় বিপন্ন। ফলে তলোয়ার দিয়ে যে ধর্মের জন্ম হয়েছে তার অনুসারীদের হাত থেকে অভিজিৎও রক্ষা পায়নি।

অভিজিতের হাতে ছিল কলম আর মানসিক প্রতিবন্দীদের হাতে আছে তলোয়ার আর মগজে লাল মুলার লালসা। মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া আছে – তলোয়ার দিয়ে বিজ্ঞানীদের মাথাটা কেটে ফে্লা ঈমানী দায়িত্ব। পুরষ্কার হিসেবে তোমাদেরকে যুবতী মুলা দেওয়া হবে। মহাবিশ্বের কোথায় নাকি স্বর্গ আছে। সেখানে যুবতী মূলার চাষ হয়। মৃতরা নাকি ওখানে বেঁচে উঠবে যুবতীদের সাথে যৌন সংগম করার জন্য। সাথে মদ্য থাকবে ফ্রি।

২০১২ সালের ৪ঠা জুলাই হিগ্‌স কণার অস্তিত্বের প্রমান বেরোলো। বিজ্ঞানীদের আনন্দের সীমা নেই। আনন্দে পিটার হিগসের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় অভিজিৎ বাংলা ভাষায় একটা বিস্তারিত প্রবন্ধ লিখে দিলেন হিগস বোসনের উপর – “সার্ন থেকে হিগ্‌স বোসন – প্রলয়-নাচন নাচলে যখন আপন ভুলে!”
বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। কিন্তু অভিজিৎ লিখলেন অত্যন্ত সহজ কবিত্বমাখা ভাষায়। প্রবন্ধের নামেই তার পরিচয়। তার লেখা যেমন সুললিত, নামগুলোও তেমনি কবিত্ব পূর্ণ। যেমন – “আলো হাতে চলিয়াছে আধারের যাত্রী”, “মহাবিশ্বে প্রাণ এবং বুদ্ধিমত্তার খুঁজে”, “সখি ভালবাসা কারে কয়”, “শুন্য থেকে মহাবিশ্ব”, ইত্যাদি।

বিজ্ঞানের প্রান্তিক বিষয় গুলো অভিজিৎ এভাবেই বাংলা ভাষা-ভাষীদের কাছে তুলে ধরতেন। গত দুসপ্তাহ আগে Gravitational Wave সনাক্ত হয়ে গেল। অভিজিৎ নেই। তাই আমরা বিস্তারিত জানা থেকে বঞ্চিত হলাম।

অভিজিতকে মেরে ফেলে ধর্মবাদীরা ভেবেছে – মিথ্যাকে ওরা টিকিয়ে রাখতে পারবে। কিন্তু গ্যালিলিও, হাইপেশিইয়া, ব্রুনোদের হত্যা করে কি সূর্যকে পৃথিবীর চারপাশে ঘুড়ানো গেছে? অভিজিতকে খুন করে কি বুঝানো যাবে পৃথিবী সমতল এবং সূর্য প্রতিদিন ঘোলা জলে ডুবে এবং পরদিন পুবের আকাশে উঠে?

অভিজিৎ একটি নক্ষত্রেরও নাম। নক্ষত্রের মৃত্যু নাই। অভিজিতের নশ্বর দেহটি নাই।
কিন্তু তাঁর সত্য প্রতিষ্ঠার প্ল্যাটফরমটির মৃত্যু নাই। অন্ধ বিশ্বাসীদের মগজে মিথ্যা বিশ্বাস ভাইরাসের মত জেঁকে বসে থাকে। এদের মগজে যুক্তিবোধ বলে কিছু নাই। মানুষে মানুষে বিভেদ, হত্যা, লুন্ঠন, ধর্ষনের মত মানবেতর কাজে এরা দীক্ষিত, হাতে তলোয়ার। মিথ্যাকে টিকিয় রাখতে এরা নিরপরাধ মানুষ খুন করার মন্ত্রে দীক্ষিতে। বিজ্ঞান দিয়ে অভিজিৎ প্রমাণ করেছেন ধর্ম মিথ্যা বিশ্বাস ছাড়া আর কিছুই নয়। বলেছেন ধর্ম মানুষের মগজে ভাইরাসের মত কাজ করে। তাই এরা হিতাহিত জ্ঞান শুণ্য। এটাই অভিজিৎ রায় এক ডজনের অধিক বইয়ে প্রকাশ করে গেছেন। স্বল্প জীবনে অভিজিৎ রায় যথেষ্ঠ লিখে গেছেন। তাঁর প্রজ্জলিত আলোকের মশাল চির দীপ্যমান। অভিজিতের পথ ধরে বাংলাদেশ ধর্মমুক্ত হবে। পৃথিবীও হবে। অভিজিতের মৃত্যু নেই, হার নেই।

বাংলাদেশের অগনিত তরুণ আলোকের পথে হাটছে সন্তর্পণে। কে ঠেকাবে এদের? এরা ঈশ্বরের অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। প্রশ্নবিদ্ধ করছে ধর্ম প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রচারকদের। বাংলাদেশে এই কালচারটা নতুন। এটা অভিজিতের আত্মত্যাগের ফসল।

ফেব্রুয়ারী ভাষা আন্দোলনের মাস। মুক্তির মাস। এই পবিত্র মাসেই বিপথগামী ঘাতকেরা অভিজিতকে নিঃস্তব্ধ করে দিয়েছে। যুগে যুগে মিথ্যায় বিশ্বাসীরা এরকম ঘৃন্য কাজই করে আসছে। এদের এই বিশ্বাসটাকেই বিশ্লেষণ করা দরকার। বিশ্বাসের মূল যে দর্শণ বা ধর্মবাদ, সেটা নিয়েই নিরপেক্ষ আলোচনা করা দরকার। ধর্মের লালসালুর চাঁদর খুলে ফেলা দরকার। এর নগ্নরূপটা বেরিয়ে আসুক। ঈশ্বর নামক অলীক পদার্থের দোহাই দিয়ে ধর্মবাদ সৃষ্টি হয়েছে। যে “বাদ” মানুষে মানুষে ঘৃনা সৃষ্টি করে, হত্যা, ধর্ষণ করে তার বিলুপ্তি দরকার।

পৃথিবীর সভ্য সরকারগন সাহস করে সমস্ত ধর্ম বন্ধ করে দিক। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত জাপান ১৯৪৭ সালে ধর্ম শিক্ষা বাতিল ঘোষনা করেছে। জাপানের মানুষদের জীবন-যাত্রা কি তাতে ব্যাহত হয়েছে, স্তব্ধ হয়ে গেছে? চীন সরকার ধর্মকে পৃষ্ঠপোষন করে না। সিরিয়া এবং ইরাকের ধর্মপ্রাণ মুমিনদের চেয়ে কি জাপানি এবং চীনারা খারাপ? কারা মনুষত্ত্বহীন এবং কারা মানবিক?

আমি কোন অলীক বস্তু নিয়ে ভাবি না। অলীককে ভয় করার প্রশ্নই আসে না। ভয় করি অলীকে বিশ্বাসীদের। ওর মানুষ খুন করে। মেয়ে লোক পেলেই ধর্ষণ করে। সাধু-সন্যাসী, তেতুল হুজুরদের থাবা থেকে সাধারণ মানুষের মুক্তি হোক। অভিজিৎ সারা জীবন এই কথাটিই বিজ্ঞান দিয়ে বুঝিয়েছে। তাঁর চেষ্টা বৃথা যায়নি। বাংলাদেশে নতুন প্রজন্মের বিরাট অংশ এখন মুক্ত। এরা জনসমক্ষে আসতে শুরু করেছে। নরখাদকরা কতদিন এদেরকে রুদ্ধ করে রাখতে পারবে?

স্কুলের বয়স থেকেই বুঝেছিলাম কোনটি সঠিক আর কোনটি অলীক। অভিজিতের লেখার ভেতর দিয়েই আমি মহাবিশ্বের বিশালতা অনুভব করতে শিখেছি। মহাবিশ্বে স্বর্গ- নরকের স্থান নেই।বাংলাদেশের হাজার হাজার তরুণ-তরুণীদের মত অভিজিৎ আমার আত্মবিশ্বাসকে পোক্ত করেছে।

অভিজিৎ হত্যার বিচার? বিচার আমি কখনই চাইনি। বিচার করে কি অভিজিতকে ফেরৎ পাওয়া যাবে? ব্যর্থ সরকারের পুলিশ মাঝে মাঝেই বলে – খুনীদেরকে সনাক্ত করা হয়েছে। হয়ে থাকলে ধরছিস না কেন? সরকারের এই মস্করা আমার সহ্য হয় না। সরকারের ছেলে যুবরাজ জয় কিন্তু কোন ভড়ং করেনি। সাফ সাফ বলেছে – নাস্তিক এবং মুক্তমনা-যুক্তিবাদী হওয়ার কারনে অভিজিৎ হত্যার বিচার আমরা করতে পারব না। পারবি না তো তোরা সরকারে আছিস কেন? তোরা জানিস না যে প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা বিধান তোদের সাংবিধানিক দায়িত্ব। তোরা নপুংসক। তোরা ইতিহাসে কলংকিত হয়ে থাকবি।

অভিজিতের আমার সাথে কোনদিন দেখা হয়নি। ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠার সুযোগ হয়নি। কিন্তু মুক্তচিন্তা এবং যুক্তিবোধের জগতে আমরা একই অনন্তলোকের অধিবাসী। আমরা প্রতিমূহুর্তে দূর থেকে দূরে ভেসে চলেছি। সেই অনন্তলোক মহাবিশ্বে স্বর্গ-নরক নেই। ভগবান-আল্লাহদের কোন রাজত্ব নেই। আজ ৩৬৫ দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। আমার ঘোর এখনও কাটেনি। মনে হয় অভিজিৎ ফিরে এসে আবার লিখতে শুরু করবে।