২৬ ফেব্রুয়ারি যত এগিয়ে আসছে ততই যেন ভেতরটা গুমোট হয়ে আসছে। দেখতে দেখতে একটা বছর চলে গেল, কিন্তু অনুভূতিগুলো এখনো যেন তীব্র।

অভিজিৎ দা’কে চিনি সেই ২০০৭ থেকে। তখনো অবশ্য জানতাম না যে এই মানুষটা আমার জীবনে কত বড় প্রভাব ফেলতে যাচ্ছেন। অন্যান্য বিজ্ঞান বই কেনার পাশাপাশি “মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে” বইটার পাতাও উল্টাচ্ছিলাম। বইয়ের লেখার ধরন, প্রতি অধ্যায়ের শুরুতেই রবীন্দ্রনাথের কবিতা আর বিবরণে সহজ ভাষা চোখ কেড়ে নিলো। অভিজিৎ রায় আর ফরিদ আহমেদ তখনো আমার কাছে পরিচিত নাম নয়। তবে বইয়ের বিষয় আর লেখার ধরনই আমাকে বইটা কিনতে একরকম বাধ্যই করেছিলো। পাতলা, হালকা একটা বই। কিন্তু কি অবিশ্বাস্য ভার এই বইয়ের যে আমার ১৮ বছরের যাপিত জীবন আর জীবনের ধারণাকেই নাড়িয়ে দিলো। অনেকটা সেই প্রলয়ংকারী ভূমিকম্পের মত যা পৃথিবীর আবর্তনকেই নাড়িয়ে দিয়েছিলো। তবে হ্যা, তখনো কক্ষচ্যুত করতে পারেনি। সেই কাজটাই নিখুঁত ভাবে করলো বন্যা আহমেদের “বিবর্তনের পথ ধরে” এবং তা এর কিছুদিন পরেই। সেই ২০০৭-এই। বন্যাপুর বইটাই একেবারে ১৮০ ডিগ্রী কোণে ঘুরিয়ে দিলো জীবনদর্শন আর লক্ষ্য।

এমনটা নয় যে, আমি এর আগে কোনো বিজ্ঞান বই পড়িনি। বরং সেই ১ম শ্রেণী থেকেই যখন পড়তে শিখেছি তখন থেকে সবচেয়ে বেশী আমাকে টেনেছে বিজ্ঞানই। যুক্তি-নির্ভর মস্তিষ্ক দিয়ে লড়েছি অনেক বিতর্ক প্রতিযোগিতা। ঘেঁটেছি আরজ আলী মাতব্বর সহ নানা দর্শনের নানা জনের বই। কিন্তু কোনো বইই আমার ওপরে এতোটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। আমার দৃঢ় এবং ‘প্র্যাকটিসিং’ বিশ্বাসে বিন্দুমাত্র চিড় ধরাতে পারেনি, যতটা পেরেছিলো এ দুটো। প্রথমে হালকা আর পরে তীব্রভাবে। তাঁদের বই দুটোর মাহাত্ম্য তাই আরো বেড়ে যায় এই কারণেই।

বইদুটো যে কতজনকে উপহার দিয়েছি। প্রথম অধ্যায়ের প্রাণ আর আত্মার সংজ্ঞাতেই অনেকে আটকে থেকেছে আজো। অনেকে সেই বাঁধন ছিঁড়ে চলে গেছে বিবর্তনের পথে। কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব হতো যদি উনারা তাঁদের নিত্যদিনের পরিশ্রমী জীবন থেকে সময় বের করে আমাদের জন্য না লিখতেন?

বন্যা আহমেদ আর অভিজিৎ রায় স্মরিত হতে থাকেন তাঁদের অসাধারণ লেখনী দিয়ে জীবন পাল্টে দেয়ার জন্যেই, যতদিন পর্যন্ত না আবিষ্কার করলাম মুক্তমনা-কে।
মুক্তমনা আমার জীবনে দেখা দিলো এক স্বর্ণ-খনি রূপে। প্রায় লেখারই পিডিএফ নামিয়ে রাখতাম। পড়তাম বারংবার। ছড়িয়ে দিতাম অন্যদের মাঝেও।

তবে অভিজিৎ দা’র সাথে (অনলাইনে) সরাসরি কথা বলার সুযোগ হয় বড় অন্ধকার সময়ে। বিরাট হৃদয়ের মানুষটি তখন লড়ছেন ব্লগারদের জেল থেকে বের করার জন্য। আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন আদায়ের চেষ্টায় তখন তাঁর রাত আর দিন একাকার। আর আমার দৌড় সেই সর্বোচ্চ স্ট্যাটাস আর কমেন্টে। তবুও ঐ সময়ে আমার মত এক অথর্বকে তিনি নিজেই সরাসরি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালেন ফেসবুকে। যখন রিকোয়েস্ট পাঠালেন তখন মধ্যরাত পেরিয়ে ভোর হতে চলেছে প্রায়। যে মানুষকে শ্রদ্ধা আর দূর থেকে দেখার ইচ্ছাতে সবসময় ফলোই করে চলেছি, রিকোয়েস্ট পাঠাতেও কেমন যেন সংকোচবোধ করেছি সেই মানুষটার কাছ থেকে এই সাড়া পেয়ে আমার পুরো শরীর কাঁপছিলো তখন। সেই ভোররাতেই তাঁর সাথে প্রথমবারের মত কথা হল। জানলাম, বুঝলাম, মানুষটা তাঁর লেখার মতই উদার, নিরহংকার আর সাধাসিধে।

অভিজিৎ দা’র সাথে কথা বলার অনেকদিন পরেও জানতাম না বন্যা আহমেদ উনার স্ত্রী। যেদিন জেনেছিলাম সেদিন দাদার সাথে কি খুনসুটিই না করেছিলাম। দাদা কথা দিয়েছিলেন, বন্যা আপুর সাথে কথা বলিয়ে দিবেন। আততায়ীর হিংস্র আঘাতে সেই কথা রাখার আর সুযোগ হলো না তাঁর।

কিন্তু কেন এই আঘাত? অবিশ্বাসীদের দিকে মডারেটদের যে অশ্লীলতার অভিযোগ সেই অভিযোগে তো অভিজিৎ রায় কখনোই অভিযুক্ত ছিলেন না। এমনকি চরম আঘাতেও উনার মুখ দিয়ে স্ল্যাং বেরোয়নি। উনি উনার নিজস্ব ধারায় বিজ্ঞান ও গবেষণাভিত্তিক যুক্তিপূর্ণ লেখা নিয়েই তো ব্যস্ত ছিলেন। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানো একজন ডক্টরেট যিনি তাঁর পেশার কাজে ব্যস্ত থাকেন, তিনি তো পারতেনই অন্য সবার মত খেয়ে পরে আনন্দে মেতে জীবনটা পরিপূর্ণ ভাবে উপভোগ করতে। কিন্তু কেন সেটা তিনি করলেন না? এত সুন্দর আর আরাম আয়েশের জীবন ছেড়ে কেন কণ্টকাকীর্ণ এক পথে তিনি হাঁটলেন? কেন অন্ধ এই সমাজে আলো ছড়ানোর মত অসাধ্য সাধনে ব্রতী হলেন? কেন এটাকেই জীবন উপভোগের পথ হিসেবে বেছে নিলেন? হয়তো একজন সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ছিলেন বলেই। সত্যিকার মুক্তচিন্তার পরিবারে বড় হয়েছিলেন বলেই তিনি পারেননি যেই সমাজে বেড়ে উঠেছিলেন সেই সমাজের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতাকে ভুলে যেতে। আর এইজন্যেই পেশাগত কাজের পাশাপাশি এতোটা সময় তিনি দিয়ে গেছেন এই জাতির জন্য। তাঁর একেকটা বই লিখতে কত সময় লেগেছে, কত বই, কত তথ্য-উপাত্ত ঘাঁটতে হয়েছে সেটা যারা তাঁর বই পড়েছেন তারাই জানেন। তাই আপাত দৃষ্টিতে সেই অসাধ্য সাধনে তাঁর মৃত্যুর ঘটনা চোখে পড়লেও আসলে তিনি তাঁর পুরো জীবনটাই দিয়ে গেছেন এই কাজে। মানুষকে জাগানোর কাজে। মানুষের মাঝে প্রশ্ন তৈরি আর সেই প্রশ্নের উত্তরটাও দক্ষ হাতে তাদের সামনে তুলে আনতে। আর এটাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় অপরাধ। সত্য বিজ্ঞান আর যুক্তির প্রসারের দোষে দুষ্ট তিনি। আর এইজন্যেই তাঁর ওপর হামলা।

অভিজিৎ দা’র অকাল মৃত্যুর প্রতিবাদে চট্টগ্রামে হওয়া মানববন্ধন আর মিছিলে অনেক মানুষ এসেছিলেন। প্রবীণ আর তরুণদের পাশাপাশি সবচেয়ে নজর কেড়েছে পীঠে ব্যাগ ঝোলানো স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলের দল। বোঝাই যাচ্ছিলো ওরা হয় প্রাইভেট পড়ে এসেছে কিংবা প্রাইভেট পড়ার নাম করে ব্যাগ কাঁধে বাসা থেকে বেরিয়েছে। এইসব নতুন কুঁড়ি, এইসব কিশোরেরাই আমাদের আগামী, আমাদের শক্তি। অভিজিৎ দা’র অনেক বড় গুণ ছিল এমন অনিসন্ধিৎসু কিশোর মনে ঢুকতে পারার অসাধারণ ক্ষমতা। বোধ করি, কচি মাথাগুলো হাতছাড়া হতে থাকাটাও তাঁর প্রতি ধর্মান্ধ জঙ্গীদের তীব্র ক্ষোভের অন্যতম কারণ। নিজেকে দিয়ে চিন্তা করলেও তো দেখি, আমিও তাঁর লেখার স্বাদ আস্বাদন করেছিলাম এমনই এক বয়সে।
সেইদিনই স্কুল পড়ুয়া এক ছেলের কাঁদো কাঁদো মুখে শুনেছিলাম, “আমার বাবার মৃত্যুতেও আমি এমন কষ্ট পেতাম না, যতটা কষ্ট পেয়েছি অভিজিৎ দা’র মৃত্যুতে।”
শুনে একটু শকড হতে পারেন। ভাবতে পারেন, কীভাবে বললো এই কথা সেই ছেলেটা। কিন্তু সত্যিটা হল এই বিপুল ভালবাসা শুদ্ধ থেকে শুদ্ধতর।
অভিজিৎ দা’র প্রতি এই ভালবাসা কোনো গদি বা চেয়ারের ক্ষমতা পাওয়ার জন্য লোক দেখানো নয়, নয় কোনো কামুক ভালবাসা, নয় পরের জীবনে হুরের লোভে, নয় কোনো মোহে, এ কেবলই নিখাদ ভালবাসা। যে ভালবাসার উৎস নির্ভেজাল যুক্তি আর জ্ঞান।

অদ্ভুত ধর্মান্ধ মানবাস্ত্র তাঁর শরীরকে স্তব্ধ করে দিতে পেরেছে ঠিকই; কিন্তু তাঁকে, তাঁর লেখার শক্তিকে কি আসলেই স্তব্ধ করতে পেরেছে বা কখনো কি পারবে?
আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের পর নাকি সেই লাভা যেই জমিতে পড়ে সেই জমিতে পরবর্তীতে উল্টো আরো ফসল বেশী ফলে, উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ে আরো বহুগুণে…
ঠিক একই অবস্থা হবে বাংলায়। একজন অভিজিৎ রায়কে হত্যা করে সেই সব অন্ধদের আসলে শুধু শেষ পর্যন্ত একটা লাভই হয়েছে, অভিজিৎ রায় আর নতুন কোনো লেখা লিখতে পারবেন না। কিন্তু তাতে কি তাঁর দেখিয়ে যাওয়া আদর্শ মুছে যাবে চিরতরে? বরঞ্চ যারা অভিজিৎ রায়কে চিনতো না তারাও এখন তাঁকে চিনছে, জানছে। এই চেনা আর জানার সুযোগ তৈরি করবে আরো অনেক মুক্তমনের মুক্তচিন্তার ও মুক্তবুদ্ধির মানুষ।

আর আমরা যারা অনেক আগে থেকেই অভিজিৎ দা’কে, তাঁর আদর্শকে নিজেদের করে নিয়েছি এখন তাদের সময় সেই আদর্শকে ছড়িয়ে দেয়ার। আমাদের বাঁচতে হবে, খেতে হবে, কাজ করতে হবে, অর্থ উপার্জন করতে হবে, এই সব কাজ অভিজিৎ দা’ও করতেন; কিন্তু এই সবের পাশাপাশি বিজ্ঞান আর যুক্তি নিয়ে লেখার, মানুষকে জানানোর যেই সময় তিনি বের করে নিতেন আজ আমাদেরও সময় এসেছে তেমনি সময় বের করে নিয়ে কাজ করার। তাঁর অসমাপ্ত কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। নজরুলের সেই ‘দুরন্ত পথিক’ হতে হবে আমাদের। একজন পথিক সেই পথে প্রাণ হারালেও দুঃখ পাবে না, পাবে না কষ্ট। কারণ সে জানে সেই পথে এগিয়ে আসছে আরো হাজারো লক্ষ দুরন্ত পথিক।
অভিজিৎ দা’র মৃত্যুকে সার্থক করতে এটাই হোক আমাদের প্রথম আর প্রধান কাজ।

আমাদের প্রত্যেকেরই মৃত্যু হবে এক সময়, কোনোভাবেই একে আটকানো যাবে না। কোনো ঐশী গ্রন্থে লেখা আছে বলে নয়, এটাই প্রকৃতির বিধান, তাই এর বাইরে যাবার উপায় নেই। অনন্ত বলেও প্রকৃতিতে কিছু নেই। এই মানব সভ্যতা একসময় শেষ হবেই, আসবে নতুন কোনো প্রাণ। সূর্যের শক্তি ফুরিয়ে এলে এই সৌরজগৎও একদিন থাকবে না। মহাবিশ্বে এলোমেলো ঘুরবে গ্রহগুলো অথবা আটকা পড়বে অন্য কোনো নক্ষত্রের বাঁধনে। তাই ওসব নিয়ে ভাবিনা। শুধু ভাবি, যেহেতু মৃত্যুকে এড়ানোর উপায় নেই, তাই মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত এমনভাবে কাজ করে যাবো যে, মৃত্যুর সময় মুখে হাসি নিয়ে, হৃদয়ে সন্তুষ্টি নিয়ে, নিজের কাছে নিজে স্বচ্ছ থেকে মরতে পারবো। অস্ফুটস্বরে নিজেকে নিজে বলে যেতে পারবো- “পেরেছি…”

তাই বলতে চাই
‪#‎অভিজিৎ_রায়_হতে_চাই‬

যত আঘাতই আসুক
‪#‎বিজ্ঞানযাত্রা_চলবে‬