কোন প্রস্তুতি নেই, অভিজিৎ রায় কে নিয়ে লিখবো। আমি তো শুধু শুনতাম কিংবা পড়তাম সে কথা গুলো, চিন্তা গুলো, যেগুলো গুটিগুটি বর্ণমালায় ফুলেল হয়ে উঠতো কম্পিউটারের স্ক্রীনে যখন তিনি কী-স্ট্রোক করতেন ক্রমাগত। একদিন প্রতিদিনের মতোই সুন্দর সকালে সে সুসজ্জিত বর্ণমালার বাগানে নিঃশ্বাস না নিলে বন্ধ হয়ে আসতো ভেতর থেকে সব! এখনো তার ব্যতিক্রম নেই। বহু কষ্টে অর্জিত সামান্য শক্তিতে ক’টা কথা না বললে নিজের প্রতিই অবিচার হবে। সে হবে অক্ষমতার, মূক ও বধিরের সমান কাতারে দাঁড়িয়ে থাকা কলাগাছ তুল্য।

মুক্ত-মনায় যেদিন প্রথম আমার আসা, সেদিনের অনুভূতি এখনো আমাকে তাড়িত করে। এমন এক আড্ডাখানা, যেখানে প্রতিনিয়ত চলে যুক্তি আর পাল্টা যুক্তির ধারালো অস্ত্রের বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই। আমার জীবনে এমন অনেক অনেক স্মৃতি আছে যেগুলো নিখাদ আড্ডার প্রাণবন্ত উপাখ্যান! নেশাসক্তের মতো আড্ডাটা বোধ করি ‘মুক্তমনা’ই হবে। কারণ এতো পড়তে হয় আর বক্তব্য প্রয়োগের মার-প্যাঁচ কষতে হয় বলাই বাহুল্য যে সত্যিই শ্রমসাধ্য ব্যাপার বটে একটা! এর চেয়ে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান পড়ানো ঢের ঢের সহজ কাজ। কারণ আছে। আমি যখন পড়াই তার আগে এ পড়ানোর একটা উদ্দেশ্য স্থির করি। সেটিকে যুক্তি গ্রাহ্য করার মানসে পঠন-পাঠন সহ এর কারিগরি, সামাজিক নিরিখের উপযোগিতা আর মানসে প্রথিত দিকনির্দেশনাটিও চূড়ান্ত করে নিই, যাকে অন্যভাবে আমরা বলি বিজ্ঞানের দর্শন। কিন্তু এসবের থোড়াই কেয়ার করে শিক্ষার্থীরা! বরং দেখি ‘মুক্তমনা’য় সে বেশ কাজে লাগে! এখানে প্রত্যেকেই যেন একাধারে ছাত্র এবং শিক্ষক! বিজ্ঞানের ভেতরটা আর কে জানতে চায়, চায় শুধু বাহিরের চাকচিক্য। কাজ করবো, ফল বেরোবে, বড় বড় জার্নালে প্রকাশিত হবে! আর আমি হবো “কি হনুরে…”! কিন্তু এ গবেষণার যে তাৎপর্য, বিশ্ব সংসারের অহর্নিশি আরোহণে এর যে একটা ভুমিকা আছে, সেটা আমরা দেখতে চাইনা। পাছে আমাদের চিরায়ত বিশ্বাস, রক্ষণশীল মন, নিয়ন্ত্রনাধীন পারিবারিক ও সামাজিক উত্থান, তাতে বিঘ্ন ঘটে! যে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই আমাদের প্রাত্যহিক সূর্য্য দেখা, তা স্বীকার করতে আমাদের বাঁধে। প্রাচীন গ্রন্থরাজীর সমতল বিশ্ব সমতল থাকেনি, পৃথিবী ব্রম্মান্ডের কেন্দ্রে থাকেনি, নিষিদ্ধ অজেয় আকাশ অজেয় থাকেনি, পৃথিবীর চতুর্দিকে গ্রহ নক্ষত্রে-রা ঘোরে নি, পাহাড় গুলো আকাশের পিলার হয়নি, ছয় দিনে বিশ্ব সৃষ্টি করে সপ্তম দিনে কেউ বিশ্রাম নেয় নি, যা বিলিয়ন বিলিয়ন বছরের ধারাবাহিক রূপান্তর! আজব এক আড্ডা স্থল আমি আবিষ্কার করেছিলাম। ততোধিক অবাক হয়ে ছিলাম যখন এর কর্ণধারদের একেএকে স্পর্শ পেলাম। দুটি নাম আমাকে এখানে বলতেই হবে, একজন আমাদের অভিজিৎ রায় আর অন্য জন ফরিদ অহমেদ।

এই যে ক’টা লাইন লিখছি, এ লেখার ক্ষমতাটাই পেয়েছিলাম অভিজিৎ রায় আর ফরিদ আহমেদ এর কাছে! আর লিখতাম তো রোমান হরফে! অভ্র বাংলাতে লিখতে শিখেছিলাম ফরিদ আহমেদের কল্যাণে! রোমান হরফের মন্তব্য গুলোকে এক সময় অভ্র-বাংলায় রূপান্তর পর্যন্ত করে দিয়েছিলেন অভিজিৎ দা, তবুও যেন লিখি! কালক্রমে একটু অভ্যস্ত হলাম লিখতে। অভিজিৎ রায় কথা নিলেন, এ যেনো অনুক্ষন বজায় রাখি। আর ফরিদ ভাই এর কত যে বকুনি আমি খেয়েছি অভ্রতে ঠিক করে লিখতে পারছি না বলে, বানানের বর্ণনাতিত রকমের হযবরল-র কারণে, তার ইয়ত্তা নেই!

আমার এক বান্ধবী আছে ঢাকায়। সে ‘মুক্তমনা’য় যুক্ত নয় তবে সংস্রবে কিছুটা পরিচয় হয়তো ছিলো। কঠোর ধার্মিক আর চমৎকার একটি মন আছে তার। একই উদ্দেশ্যে সমসাময়িক কালেই শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা অধ্যাপক অজয় রায়ের ছাত্র ছিলাম। অধ্যাপক অজয় রায়ের কৈশোরোত্তীর্ণ ছেলেটি তখনো আজকের অভিজিৎ রায় হয়ে উঠেন নি, তবে আমরা তাকে জানতাম। সেই প্রথম দর্শন থেকেই অধ্যাপক রায় কে কেনো আমাদের এতো আপন আর স্বজন মনে হতো? উত্তরটা ভবিষ্যতের জন্যে তোলা থাক।

গত বছর ২৬শে ফেব্রুয়ারী দুপুরে অভিজিৎ রায়ের একটা স্ট্যাটাস পড়লাম ফেসবুকে। নিয়মিত কিছু আপডেটও পড়েছিলাম তাঁর সাম্প্রতিক প্রকাশিত কয়েকটা বই নিয়ে, মিজান রহমানের সাথে ‘শুণ্য থেকে মহাবিশ্ব’ আর ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি বিদেশিনীর খোঁজে’! দুটো বইই ‘মুক্তমনা’য় প্রকাশিত হয়েছে ধারাবাহিক ভাবে, আমি পড়েছিলাম। বই দুটো যোগাড়ের তোর-জোড় তখন চলছে। ক’দিন থেকে তাঁর সাথে কথাও চলছে কোন কোন বই যোগাড় করছি, লিস্ট করছি, কাটছি, ফের যোগ করছি; কতো কিসিমের কারসাজি! সেই বান্ধবীর কল্যাণে বই দুটো তখন আমার হাতে পৌঁছুতে কেবল বাকী। বাসায় ফিরে রান্না করো, ছেলেকে খাওয়াও, নিজে খাও। আবার পর-দিন স্কুল থেকে ফিরে ছেলে কি খাবে তার একটা ব্যবস্থা করে মধ্য রাতে শুবার আয়োজন করছি। এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল, “International Call….তারপরে রিং……..”। ধরতেই ও-পাশ থেকে উদ্বিগ্ন এবং ততোধিক উৎকন্ঠায় বান্ধবী আমাকে জানালো, “কেশব, খবর পেয়েছিস? তোর অভিজিৎ রায়কে আজকে বই মেলায় কুপিয়েছে…! জানিনা উনি বেঁচে আছেন কিনা, তবে হাসপাতে নিয়েছে শুনেছি।“ ও আরোও বললো, “তুই অন লাইনে আয় আমি দেখে জানাচ্ছি টিভির খবর।“ আমি অসার কিন্তু ও উদ্বিগ্ন তখন, একটা উক্তি শুধু মনে পড়ছে ওর, বলছিলো “পৃথিবীর ভালো মানুষ গুলো আর থাকল না রে…!” আমি ঘটনার আকস্মিকতায় সম্পূর্ণ বোবা তখন! মাথাটা টলছে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কি ঘটছে। ওর কথার উত্তরে সম্ভবতঃ বলেছিলাম, “ওঁ-তো সাধারন লোক নয়, বাংলাদেশে ভয়ানক কিছু একটা ঘটবে!” ছেলেকে প্রেশারের ওষুধটা আনতে বলে কম্পিউটার অন করলাম। অনেকটা যন্ত্রের মতো, বোধ হীন জন যেমন করে ঠিক তেমন। স্কাইপিতে ভিডিও অন করতে বললো বন্ধুটি। করলাম। টেলিভিশনের খবর সরাসরি শুনলাম। এই যে এতো গুলো সময় কেটে গেলো, আমি জানিনা আমি কি বলেছিলাম ওকে। আমার মনে নেই একটুও। তবে মাথায় ঘুরছিল অধ্যাপক অজয় রায়ের কথা। এর মধ্যে ফেসবুকে ও মুক্তমনায় ক্লিক করলাম, ফেসবুকে বন্ধুরাও তত ক্ষনে অনেকেই জেনেছে সে ভয়াবহ রকমের আঘাত সম্পর্কে। মাথায় অ্গ্নূৎপাৎ হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল বিশ্ব ভ্রম্মান্ড তছনছ করে দিই! ফেসবুকে কথা হচ্ছিলো, ফরিদ ভাই, কাজি রহমান, হাসান সেলিম সহ অনেকের সাথেই। এই আকস্মিক শকটা কেউই স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেনি। আর তখন সবচেয়ে জরুরী ছিলো যে অভিজিৎ রায় আছেন তো, তা নিশ্চিত হওয়া। ক্রমে ক্রমে আশাহতের দিকেই পাল্লাটা হেলতে শুরু করলো। কিছুতেই মানতে পারছিলাম না এই যে এতো বড় একটা সম্ভাবনাকে আমরা এভাবে নিঃশেষ করে দিলাম! বুকের ভেতরে কান্না জমছিল, কিন্তু বের হচ্ছিলোনা। বের হয়নি, হয়তো অনেকেরই হয়নি। একটা দলা-পাকানো জমাট শক্তি হয়ে হয়তো কোথাও আটকে আছে! একদিন ঠিক বের হয়ে আসবে অযুত-নিযুত বজ্রের শক্তি হয়ে। সেদিন সবার সাথে কাঁদবো। বান্ধবীটি আমার মনের অবস্থা জানতো। সে সান্ত্বনা দিলো, ওষুধ খেতে বললো, পানি খেতে বললো, ঘুমাতে বললো…..; কিন্তু আমি এর কোনকিছুর ভেতরেই যেতে পারলাম না। নির্বাক, নির্ঘুম রাত কাটলো আমার। ঐ যে আকস্মিক আঘাতের যে রেশ আজও পুরোপুরি কাটেনি। কিন্তু শক্তি আর আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছিলো দুজন মানুষের কাছ থেকে। প্রথমতঃ অভিজিৎ রায় স্বয়ং জানতেন রক্ত আর অসম্ভব যন্ত্রনা ছাড়া মুক্তি আসে না। বলেওছিলেন তিনি। এ রাজনৈতিক বা শারীরিক মুক্তি নয়; মনের মুক্তি। চিন্তার মুক্তি। এ লড়াই সাক্ষ্যাত ত্রিমূখী-হাঁ ডাইনির সাথে। এক হলো নিজের সাথে, সমাজ-কালের দ্বৈরথে কিম্ভূতকীমাকার অসম্পূর্ণ কালাচড়নের সাথে আর সবশেষে ছদ্মবেশের সাথে। আর দ্বিতীয়ত অধ্যাপক অজয় রায়, একজন স্বার্থক বাবা, একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন শিক্ষক। যাঁকে এ-জাতি কখনোই কিছু দিতে পারেনি, তিনি দিয়েছিলেন। আমরা ভিক্ষুকের মতো হাত পেতে তা নিয়েছি। যিনি এখনো এ জাতির অভিভাবক। তাঁর ভেতরের বলিষ্ঠতাই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে, রক্ষা-কবচের মতো। এই যে অভীষ্টতা, মাটির উপড়ে শক্ত ভাবে দাঁড়িয়ে থাকার আত্মবল, তাঁর কাছ থেকেই শেখা।

ওরা-তো জানেনা, যে আলো নিয়ে অভিজিৎ রায় নেমে এসেছিলেন শ্বাপদ সঙ্কুল পথে, সে পথে এখন ঐ আলো হাতেই আঁধারের যাত্রীরা বেড়িয়েছে পথে হাজারে-কোটিতে! ২৬শে ফ্রেব্রুয়ারী তাই একটা মাইল ফলক মানব জাতির ইতিহাসে, একটি কম্পাস, রেখে গিয়েছিলেন অভিজিৎ রায়; যেমন রেখে গিয়েছিলেন সক্রেটিস, ব্রুণো, হাইপাশিয়া, গ্যালিলিও, ডারুইন প্রমুখ মানব ইতিহাসের এক একজন দিকপাল। এ দিনটিই অসংখ্য মানুষকে শিখিয়েছে আসলে আলোটুকুকে চিনতে। এর আঁচ লেগেছে অনেক হৃদয়ে। সেগুলো প্রথাগত দেয়াল ভেঙ্গে বেরিয়ে এসেছে নতুন পথে। থাক না যে থাকতে চায় বালিতে দু’চোখ গুঁজে! মরুদ্যানের ধুলি ঝড়ে ওরা হারাবেই। ডুবে যাবে কালের অনন্ত অন্ধকারে। অভিজিৎ রায়-রাই এগিয়ে যাবে আলো হাতে শেষ পর্যন্ত! এ এক অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। নইলে যে মানব জাতি হেঁড়ে যায়! কাজেই সভ্যতার অন্তিম পরিণতিতেও অভিজিৎ রায়-রাই থাকবে টিকে; এটিই অমোঘ সত্য। মহাকালের শিক্ষা।