অভিজিৎ রায়ের সাথে আমার কোন স্মৃতি নেই। ব্যাক্তিগত স্মৃতি থাকার আবশ্যকতা হয়তো ততটা ছিলনা কিন্তু আবশ্যকতা ছিল তার ভাবনার জগতের ভাগ পাওয়া। আমি গর্বিত কারণ আমি সেটা পেয়েছি। অন্য মুক্তমনাদের কাছে এটা কতটা গুরুত্বপুর্ন জানিনা তবে এটা আমার বড় পাওয়া। আমার চিন্তাধারায় সবথেকে বেশি প্রভাব ফেলেছে আরজ আলী মাতুব্বর এবং অভিজিৎ রায়। আমার সমসাময়িক সময়ে অভিজিৎ রায়কে পাওয়া তাই অনেক বড় কিছু। তবে দেখা হওয়ার আগেই তিনি এভাবে চলে যাবেন ভাবতে পারিনি। অভিজিৎ রায়ের লেখার সাথে কিভাবে পরিচিত হলাম সেটা একটু বলি! মাধ্যমিক শেষ করে ২০০৯ এর মাঝামাঝি ঢাকায় আসার পর একদিন নীলক্ষেতে গেছিলাম আরজ আলী মাতুব্বরের বই কিনতে। আরজ আলী সমগ্র কেনার পর নিউমার্কেটে ঢুকি বিবর্তনবাদ নিয়ে লেখা কোন বই মেলে কিনা সেজন্য। বিবর্তনবাদের বই কিনতে গিয়ে পাই বন্যা আহমেদের “বিবর্তনের হাত ধরে”। বইটা অসাধারণ ছিল এবং মুক্তমনার সাথে সূত্রপাত ঘটে মুলত ওই বইটার মাধ্যমেই। এরপর থেকে মুক্তমনায় ঢু মারা শুরু করলাম প্রতিনিয়ত। মুক্তমনার প্রায় সব ধরনের লেখাই পড়তাম পাশাপাশি ক্রস চেক করতাম তথ্যসূত্রগুলো, এরমধ্যে একজনের লেখা আমার কাছে খুব তীক্ষ্ণ আর দৃঢ় মনে হয়েছিলো, সেই একজন ছিল অভিজিৎ রায়। এরপর আর্কাইভ থেকে উনার প্রায় সব লেখাই আমি পড়ে ফেলি। অভিজিৎ রায়ের লেখার ধার ছিল অন্য রকম, তার লেখনী শক্তির তুলনা হয়না। দ্বিমাত্রিক জগতে আটকে থাকা ভাবনাগুলো তাই আমাদের ত্রিমাত্রিক মস্তিষ্কে আঘাত করতে যথেষ্ট। বলতে দ্বিধা নেই, ব্লগ এবং বিবর্তন নিয়ে পড়ে থাকায় সেবার ভর্তি পরিক্ষায় গাড্ডু মেরেছিলাম। তবে আফসোস ছিলনা, শিখেছিলাম অনেক, চিন্তাধারা বদলে গিয়েছিল অনেক।

মুক্তমনার সাথে বরাবরই ছিলাম-আছি, তবে লেখা হয়ে ওঠেনি। এর প্রধান কারণ মুক্তমনা আমার কাছে সবসময় অন্যান্য ব্লগ থেকে আলাদা, স্বচ্ছ আর দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিল যার উপযুক্ত মনে হতোনা নিজেকে; এছাড়া আমি এদেশের এমন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যেটাকে মৌলবাদের আখড়া বললেও কম বলা হয়। এটা তাদের জন্য বুয়েট বা ঢাবির সমতুল্য। এখানে তাই ব্লগ বা ব্লগার দুটোই অবাঞ্ছিত। মুক্তমনাতে আমি সুযোগ হলেই ঢুকতাম। অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর দুয়েকদিন আগে থেকেই মুক্তমনাতে ঢুকতে পারছিলাম না। ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় গ্রামে ছিলাম তাই ভেবেছিলাম নেটওয়ার্ক সমস্যা। ফেব্রুয়ারির ২৬ তারিখ রাতে হঠাত খবর পেলাম, বইমেলা থেকে ফেরার পথে অভিজিৎ রায় এবং বন্যা আহমেদের উপর হামলা করা হয়েছে। গ্রামের বাড়িতে থাকার কারণে সেভাবে কোন খোজ নিতে পারিনি। তবে বুঝতে পেরেছিলাম একটা রাত কতটা কষ্টকর এবং দীর্ঘ হতে পারে। আজ সেই রক্তাক্ত ২৬শে ফেব্রুয়ারি তবে বছরের খাতায় এক সংখ্যা বেড়েছে। অভিজিৎ দার সাথে দেখা করার ইচ্ছে ছিল অনেক তবে সেটা আর কখনো সম্ভব নয়। তিনি এখন সবকিছুর উর্ধে। একটি বছর পার হয়ে গেলো অভিজিৎ দার মৃত্যুর পর অথচ কিছুই হলোনা। বিচার দূরে থাক অপরাধীদের ধরাও হলোনা, পুলিশ নাকি কোন ক্লুই পায়নি! সব হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। হায়রে জাতি আমরা, নিজের আপন লোক গুলোকেও চিনতে পারিনি কখনো।

অভিজিৎ রায় মারা যাওয়ার পর অনেকের সাথেই কথা কাটাকাটি হয়েছে। সবথেকে মজার ছিল – আমার এক সিনিয়র ভাই কেমব্রিজে পড়াশুনা করেন, উনি অভিজিৎ রায়ের লেখা এবং তাকে ব্যক্তিগত আক্রমন করলে আমি শুধু একটা কথা বলেছিলাম, ওনার লেখার তথ্যগত একটা ভুল বের করুন, আপনার কথা আমি মেনে নিবো। অভিজিৎ দার প্রায় ৮০% লেখাই আমার পড়াছিল – তাই এরকম চ্যালেঞ্জিং কথা বলতে আমার ভাবতে হয়নি। উনি বরাবরই অভিযোগ করেছিলেন আমি নাকি অভিজিতের লেখা পড়িনি, পড়লে নাকি এমন বলতাম না। যাহোক শেষমেশ উনি কোথা থেকে যেন একটা কমেন্টের স্ক্রিনশুট দিয়েছিলেন, তাতে অবশ্য কিছু আক্রমণাত্মক কথা ছিল বৈকি কিন্তু সেগুলো আদতে দাদার মুখের কথা ছিলনা। ওগুলো বিশেষ এক কিতাব থেকে উৎসরিত বানী ছিল। আয়াতগুলো আমার জানা ছিল তাই আমি তাকে চেক করে দেখতে বললাম। উনি চেক করেছিলেন কিনা জানিনা তবে কিছুক্ষন পর আমার কমেন্টগুলো তার টাইমলাইন থেকে মিলিয়ে যেতে থাকলো এবং অতঃপর তিনি নিজেই হাওয়া হয়ে গেলেন (ডিলিটাইছেন এবং ব্লকাইছেন)। আসলে ছাগু প্রজাতি যেখানেই আর যত অত্যাধুনিক বিজ্ঞানেই পড়ুক না কেন – এদের সবার নিউরন একইভাবে আন্দোলিত হয়।

ছাগুরা ইদানিং একটা বক্তব্য প্রচার করে বেড়াচ্ছে যে অভিজিৎ রায় নাকি নাস্তিকদের কাছে নবীর সমতুল্য। আমি জানিনা তাদের এই বক্তব্যের মানে কি! নাস্তিকদের যেমন কোন ঈশ্বর থাকেনা তেমন কোন মুরিদও থাকেনা। অভিজিৎ রায় কোন দেবতা বা পয়গম্বর ছিলেন না এটাই আমার কাছে আরামদায়ক। অভিজিৎ রায়ের লেখাকে সমর্থন জানাতে কোন অলৌকিক সত্ত্বা টানার প্রয়োজন পড়েনা। লেখার মধ্য দিয়েই তার সুস্থ এবং স্বাভাবিক মননের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। লেখনী শক্তির কথা আর কি বলবো! হাতে চাপাতি তো এমনি তুলে নেয়নি মানুষখেকো হায়েনা গুলো। বেশ কিছুদিন আগে অভিজিৎ রায়কে নিয়ে এক ভদ্রলোকের (ভদ্দরলোক!) একটা লেখা পড়লাম। অভিজিৎ রায় কি ছিলেন তার থেকে কি ছিলেন না সেটা নিয়েই ব্যাস্ত দেখলাম ভদ্রলোককে। তার কোন বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ ও প্যাটেন্ট আছে কি নাই, ভারতের চর কিনা, বিজ্ঞান লেখেন নাকি গাঁজাখুরি বা উস্কানিমুলক লেখা লেখেন – এইসব নিয়ে খুব বিজি ভদ্রলোক। দেখলাম অভিজিৎ রায়ের বিজ্ঞানমনষ্কতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। অভিজিৎ রায়ের লেখাতেই কি স্পষ্ট নয় তিনি বিজ্ঞানমনষ্ক ছিলেন কিনা! নাকি প্যাটেন্ট বা বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ বেশি না থাকলে বিজ্ঞানমনষ্ক বলা যাবে না তাকে! এদেশের সবথেকে ভয়ংকর বিশ্ববিদ্যালয়ের সবথেকে আধুনিক বিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে দেখেছি, স্যারদের বিজ্ঞানমনষ্কতা এবং প্রবন্ধের অনুপাত রীতিমত হাসির খোরাক।

আমি বুঝিনা অভিজিতের বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ বা প্যাটেন্ট থাকুক বা না থাকুক তাতে কি এসে যায়! তিনি বিজ্ঞানী নন তো কি হয়েছে! আমরা তো তাকে বিজ্ঞানী হিসেবে চিনিনা, চিনি একজন মুক্তচিন্তার আধার হিসেবে। তিনি নিজেতো এমন কোন দাবী করেন নি বা নিজেকে নাস্তিকদের প্রফেট হিসাবে দাবী করেন নি। অভিজিৎ রায়ের সম্পর্কে ঠিকঠাক না জেনে কেউ কিছু বললো আর সেটার জন্য তাকে অসন্মান করতে হবে! তার কাজগুলোকে খাটো করতে হবে! অথচ ঠিক একইভাবে যখন কিছু মানুষ এদেরই কোন এক দেবতাকে বা পয়গম্বরকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন তখন কলমের বিপরীতে চাপাতি ধরতে হয়। এটা কি চিন্তার স্বাধীনতা, না ধর্মীয় উদারতা? এটা আসলে এলোমেলোভাবে বিন্যাস্ত অযৌক্তিক কথামালার সংকলিত রুপের ব্যাবহারিক প্রয়োগ মাত্র।

অভিজিৎ দার প্রতিটা লেখায় বিজ্ঞান ও যুক্তির ছাপ সুস্পষ্ট ছিল। সহজ ও তথ্য সমৃদ্ধ লেখাই ছিল তার অনন্য বৈশিষ্ট্য। তার কোন লেখাতে আমি আক্রমণাত্মক কিছু খুজে পাইনি। অনেক ব্লগার দেখি যুক্তি থেকে আক্রমণাত্মক শব্দের ব্যবহার অনেক বেশি করেন। এরকম হলে একজন অবিশ্বাসী এবং বিশ্বাসীর মধ্যে পার্থক্য থাকবে কি! ধর্মকে আক্রমন করে পারতপক্ষে খুব একটা লাভ আছে বলে মনে করিনা কারণ আজকের প্রত্যকটা ধর্ম হাজার বছরের বিশ্বাস। এই হাজার বছরের বিশ্বাসকে কখনোই তাচ্ছিল্য বা কটুক্তি মিশ্রিত কথা দিয়ে ভ্রান্ত প্রমান করা যাবেনা বরং তাতে ক্ষোভ, হতাশা ও বিদ্বেষের জন্ম দিবে যার ফলাফল আমরা হাতেনাতে পেয়েছি, হয়তো আরো পাবো। বহুদিন ধরে চলিত কুসংস্কারকে শুধুমাত্র বিজ্ঞান এবং যুক্তির আলোকেই চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে এবং ঠিক এভাবেই হারিয়ে গিয়েছে বহু কুসংস্কার আমাদের সমাজ থেকে।

যাহোক, এদেশে ব্লগার হত্যা এখন অতি পূন্যের কাজ এবং কাজটা নিয়মিতভাবে করছে ব্লগ দিয়ে ইন্টারনেট চালানো কিছু উম্মাদ। তবে অভিজিৎ রায়কে খুন করে তারা নিজেদের কতটা ক্ষতি করলো সেটা তারা নিজেরাও জানেনা। নিজেরাই নাস্তিকতাকে প্রোমোট করলো। পাশ্চাত্য ধর্মগুরুরা সম্ভবত অনেক আগেই এটি বুঝেছিল, যে নাস্তিকদের পাছায় আঙ্গুল দিলে তা নিজেদের মলদ্বারে গিয়েই ঠেকে। এজন্যই তারা এখন সভ্য এবং সেক্যুলার জীবন বেছে নিয়েছে। এভাবে আসলে কিছু দমিয়ে রাখা যায়নি আর কখনো যায়না। আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি অভিজিৎ রায়ের মৃত্যু এদেশে নাস্তিকের সংখ্যা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। অসি-মসির এই শক্তি পরীক্ষায় মসীর জয় অনিবার্য কিন্তু দুঃখের বিষয় এটাই যে, হুমায়ুন আজাদ, অভিজিৎ রায়, রাজীব হায়দার, ওয়াশিকুর বাবু, নীলয় নীল, অনন্ত বিজয়, দীপন……এরকম অনেক নক্ষত্রের অপমৃত্যুর সাক্ষী হতে হবে। তবে একটা কথা সদা সত্য যে পরিবর্তন আসবেই। আজ ব্যক্তি অভিজিৎ বেঁচে নেই এটাই সত্য কিন্তু আদর্শিক অভিজিৎ বেঁচে থাকবে চিরকাল প্রতিটা মুক্তমনার নিউরনে। হেলাল হাফিজের পৃথক পাহাড় কবিতার একটা লাইন খুব মনে পড়ছে, অভিজিৎ দার জন্য কবিতাটি লিখছি –

পৃথক পাহাড়
-হেলাল হাফিজ

আমি আর কতোটুকু পারি?
কতোটুকু দিলে বলো মনে হবে দিয়েছি তোমায়,
আপাতত তাই নাও যতোটুকু তোমাকে মানায়।
ওইটুকু নিয়ে তুমি বড় হও,
বড় হতে হতে কিছু নত হও
নত হতে হতে হবে পৃথক পাহাড়,
মাটি ও মানুষ পাবে, পেয়ে যাবে ধ্রুপদী আকাশ।
আমি আর কতোটুকু পারি?
এর বেশি পারেনি মানুষ।

অভিজিৎ রায়, তোমাকে হারিয়ে আমরা যেমন অভাগা তেমনি তোমার আদর্শ ধারন করতে পেরে আমরা গর্বিত। তোমার জন্য রইলো শুধু নির্লিপ্ত ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা।