লেখক : প্রীতম চৌধুরী

২০০৬-২০০৭ সালের কথা । ক্লাস সেভেন-এইটে পড়ি তখন । ঝালমুড়ি খেয়ে কাগজে হাত মুছতে গিয়ে চোখ পরলো কাগজটার লেখার উপর – “স্ট্যান্ডার্ড বিগ ব্যাং মডেলের বিদায় কি তবে আসন্ন ?” লেখক –অভিজিৎ রায় । আমি ভাবি একি কথা ! বরিশাল বিভাগীয় শহর হলেও মফঃস্বল শহরের চেয়ে বিজ্ঞানে খুব একটা উন্নত না । ব্লগ টলগের নাম তখনও শোনা হয়ে উঠেনি । বিগ ব্যাং থিওরি অনেকটা হট কেক টাইপ বিষয় বিধায় এইটা জানি । সেই বিগ ব্যাংয়ের বিদায় হয়ে যাচ্ছে ! সায়েন্স ওয়ার্ল্ড নামটা দেখে সাথে সাথে চলে গেলাম বুক ভিলায় । খুঁজে খুঁজে সংখ্যাটা বের করে কিনে ফেললাম ।
সেই প্রথম অভিজিৎ রায় নামটার সাথে পরিচয় ।

২০১০ সাল , নটরডেম কলেজে ভর্তি হয়েছি কেবল । ইতোমধ্যেই সায়েন্স ওয়ার্ল্ড বন্ধ হয়ে গেছে লস চলার কারনে । ঢাকা এসে অনেক কয়টা জিনিসের সন্ধান পেলাম । বাংলা ব্লগ, আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রীসহ কিছু বই, জিরো টু ইনফিনিটি পত্রিকা এবং সবকিছুর মধ্যে কমন অভিজিৎ রায় । নিজের পিসি নাই, আছে একটা কমদামি জাভা ফোন । তাই সাইবার ক্যাফে বসে বসে মুক্তমনা ব্লগ ঘাটাইয়া চলি । গোগ্রাসে গিলি তার লেখা । বিজ্ঞান জিনিসটাও এতো সোজা , এতো মজার হইতে পারে ! কোন প্রাচীন গল্পকার যেন সরল ভাবে সব গল্পের জাল বুনে মোহমুগ্ধ করে চলেছে । শুধু বিজ্ঞানই না , দর্শনেও কি দখল । যদিও অবিশ্বাসী হয়েছি আগেই, তার লেখা পড়ে আমার সেই ভাবনাগুলো আরো শক্তপোক্ত হচ্ছে, ভীত খুঁজে পাচ্ছে আমার ব্যক্তিগত দর্শন । কি জটিল বিষয়গুলো অসাধারণ সেন্স অফ হিউমারের সাথে বর্ণনা করে চলেছেন যে আপনার এক মূহুর্তেও বোরিং মনে হবে না । দাদার সেন্স অফ হিউমারের একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই তার আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী বইটা থেকে –

“ ‘ বলি আমরাও পারতাম ’
-কি পারতি ?
মহাকর্ষ আবিষ্কার করে তাক লাগিয়ে দিতে পারতাম ?
-তো সমস্যা কোথায় ?
সমস্যা হলো নিউটনের মাথায় আপেল পড়ায় সে মহাকর্ষ আবিষ্কার করেছিলো । আমাদের দেশেতো আপেল নেই, আছে কাঁঠাল । তা মাথায় পড়লেতো আবিষ্কার করার আগেই হাসপাতালে দৌড়াতে হবে । ”

একটা বিজ্ঞানের বইয়ে মহাকর্ষ বুঝানো যদি শুরু হয় এইভাবে সেই বই না পড়ে ফেলে রাখার কোন উপায় থাকে পাঠকের ? তো যখন আমি তার এহেন গুণমুগ্ধ ভক্ত হয়ে বসে আছি , এরমধ্যে আরেকটা ঘটনা ঘটে গেছে । ফেসবুকে আমি অভিজিৎ রায়কে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে ছিলাম এবং তিনি তা এক্সেপ্ট করেছেন । তার লেখা দেখি, পড়ি । সাহস করে কমেন্ট করি না । একদিন দুরুদুরু বক্ষে তাকে মেসেজ করলাম । তখন নিউট্রিনো আলোর বেগকে পেছনে ফেলে দিয়েছে এই খবরে সারাবিশ্ব নড়েচড়ে বসেছে । দাদকে বললাম,
“ দাদা কমেন্ট বক্সে কিছু বলতে সাহস হলো না । আমার মনে হয় নিউট্রিনোর বেগ খুবই বেশি বলে, নিউট্রিনোর ক্ষেত্রে সময়ের প্রসারণ আর স্পেসের সংকোচন ঘটে থাকতে পারে, যেমনটা ঘটে মিউওনের বেলায় । তাই সে আলোর চেয়ে কম সময়ে ওই পথ অতিক্রম করেছে । ”
আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি এপ্রিসিয়েট করে বললেন এ নিয়ে একটা লেখা লিখে মুক্তমনায় দাও । সাহস হয়নি । ইস্টিশনে লিখেছি , সচলেও টুকটাক লিখেছি; কিন্তু মুক্তমনায় লেখার সাহস পাইনি । মুক্তমনায় লিখেছি তবে পরে । অভিজিৎ রায়ের মুক্তমনায় লিখবো !! বাপরে ! আর একদিন দাদার কাছে একটা লেখা চাইলাম বরিশালে বিজ্ঞান পত্রিকা বের করবো বলে, দাদা দুদিন সময় চেয়ে পাঠিয়ে দিলো । ছাপাতে পারি নি । অর্থাভাবে পত্রিকাই বের হয়নি । যে দেশে টাকার অভাবে পত্রিকা বের করতে পারা যায় না । দিনের পর দিন লস খেয়ে বন্ধ হয়ে যায় সায়েন্স ওয়ার্ল্ড , সেইখানে অভিজিৎ রায় নিরলস ভাবে চেষ্টা করে গেছেন , আলো হাতে ছুটে চলেছেন আঁধার দূরের প্রচেষ্টায় । অসংখ্য মানুষকে সংগঠিত করেছেন যুক্তিবাদী আন্দোলনের সাথে । অভিজিৎ রায়কে আমি মনে করি গুরু । গুরু দ্রোণাচার্য , যিনি পথ দেখিয়েছেন অসংখ্য কর্ণ ,অর্জুন,একলব্যকে; তার কাছ থেকে কোন কর্ণ ব্যর্থ মনোরথে ফিরে যায়নি, কোন একলব্যকে আঙুল কেটে দিয়ে যেতে হয়নি । বরং তিনি নিজেই আত্মহুতি দিয়ে গেলেন আরো অগণিত কর্ণ-অর্জুন-একলব্যদের জন্য ।
অভিজিৎ রায় স্বপ্ন দেখতেন বিজ্ঞান, মানবতাবাদ ও যুক্তিবাদের আলোকে সমাজ প্রতিষ্ঠার । তার মতে, বিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চ ডিগ্রিলাভ আর বিজ্ঞান সচেতনতা সম্পূর্ণ আলাদা দুটি জিনিস । অভিজিৎ রায় প্রচলিত এই বিশ্বাসটি মানতে চাইতেন না যে, বাংলাদেশের শিক্ষার্থী, তরুণ-তরুণী, সাধারণ মানুষ বিজ্ঞানবিমুখ। বরং তিনি বিশ্বাস করতেন সহজ ও সাবলীলভাবে বিজ্ঞানকে উপস্থাপন করা হচ্ছে না বলেই আমাদের সমাজে বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতি ও সচেতনতার এতো অভাব । আমি কখনোই এটা বলার ধৃষ্টতা দেখাবো না যে আমিই অভিজিৎ । অভিজিৎ রায়েরা সহসা জন্মায় না । কিন্তু অভিজিৎ রায়ের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে সহজ ভাষায় বিজ্ঞানের প্রসার করার চেষ্টা আমি করে যাবো । গুরু দ্রোণের যোগ্য একলব্য শিষ্য নাই বা হতে পারলাম যোগ্যতার অভাবে, কিন্তু সাধারণ এক পদাতিক সৈন্যতো হতে পারিই……