বর্তমানে ফেসবুক কি ব্লগস্ফিয়ার, সব জায়গায় দুই একটা শব্দ বেশ বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে কয়েক বছর ধরে।এর মধ্যে প্রধানতম একটি হচ্ছে “মুক্তমনা”। সাধারন যারা আম-জনতা তাদের বেশিরভাগের কাছে মুক্তমনা হচ্ছে নাস্তিক আইডেন্টিটির ধারক।কিন্ত এমনটি কি হবার কথা ছিল??যে মুক্তচিন্তা করে তাকেই বলে মুক্তমনা।নাস্তিকতার যথেচ্ছ ব্রান্ডিং এর কারনে মুক্তমনা শব্দটি এখন নাস্তিকদের ঔরসজাত শব্দ বলে মনে করা হয়,ঠিক যেমন “জয় বাংলাকে” মনে করা হয় আওয়ামিলীগ এর সম্পত্তি।আসুন একটু অভাজনের দৃষ্টিতে দেখে নেই মুক্তচিন্তা:
আমার চোখে মুক্তচিন্তা: চিন্তা করতে গিয়ে প্রথমেই প্রশ্ন আসল “মুক্তচিন্তা” শব্দটি আসলে কতটা যুক্তিযুক্ত! যার মন সব ধরেনের বন্ধন, ইজম,তত্ত,আবেগ ইত্যাদির উর্ধে গিয়ে চিন্তা করতে সক্ষম,সত্যিকার অর্থে সেই হচ্ছে প্রকৃত মুক্তমনা।কিন্ত দু:ক্ষজনক হলেও সত্য,এইরকম হওয়া বাস্তবিক ক্ষেত্রে কারো পক্ষেই সম্ভবপর না।কারন ছোটবেলা থেকে যতই আমরা তথ্য আহরন করছি,ততই আমরা কোন না কোন তত্তে বাধা পড়ছিই।হোক তা আস্তিক্যবাদ,নাস্তিক্যবাদ,মার্ক্সবাদ,ভাববাদ, বস্তুবাদ, স্কেপটিসিজম,সুফিবাদ বা যেকোন কিছু।বিজ্ঞানমস্কতা ও এক ধরনের “বাদ” ই বলা চলে।সুতরাং দেখা যাচ্ছে,আমরা কোন কিছুর সাপেক্ষে,কোন কিছুর কনটেক্সটে কোন কিছুর আলোচনা করি।এবং এটাই স্বাভাবিক। কারন কোন কিছুকে বেইস না ধরে আপনি কোন চিন্তা করতে পারবেন না।চিন্তার পূর্বশর্তই হল তথ্য আহরন ও তার মাঝে সমন্বয়। অত:পর অর্জিত জ্ঞানের আলোকে অন্য নতুন বিষয়ে চিন্তনের মাধ্যমে জ্ঞানকে আরো সমৃদ্ধ করা।তাই যখনই কোন বিষয়ে আপনি চিন্তা করবেন,আপনার আগের অর্জিত জ্ঞানের আলোকেই করবেন।তাই পরম “মুক্তচিন্তা” করা আসলে কারো পক্ষেই সম্ভব না।পরম সত্য যেমন নাই,পরম মিথ্যা যেমন নাই,তেমনি পরম মুক্তচিন্তাও নাই।তবে কাঠামো ভেদে কোন কোন চিন্তা মুক্তচিন্তার খুব কাছাকাছি যেতে পারে, কিন্ত পুরোপুরি কখনোই নয়।তবে এটা আলোচ্য বিষয় হতে পারে-কোন চিন্তা বেশি বাস্তবধর্মী ও কল্যানকর।

নাস্তিকতা কি মুক্তচিন্তা?: আগেই বলেছি- পুরোপুরি মুক্তচিন্তা কখনোই করা সম্ভব নয়।কিন্ত বাংলাদেশের অধিকাংশ নাস্তিক নিজেদের মুক্তচিন্তক দাবী করেন- আসলেই কি তাই?তার আগে প্রথমেই আসি নাস্তিকতার সাথে মুক্তচিন্তার কতটুকু সম্পর্ক আছে।প্রচলিত যেকোন ধর্মবিশ্বাস এ যার আস্থা নাই,সাধারনত সহজ বাংলায় সেটাই নাস্তিকতা।দুনিয়াতে যত ধরনের চিন্তার বন্ধন রয়েছে,ধর্মীয় বন্ধন তার মধ্যে প্রধানতম।তাই কেউ যখন নাস্তিক হয়, স্বভাবতই সে চিন্তার একটি বড় প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে যেতে পারে।কিন্ত তার জন্য তাকে অন্য কাঠামোর বেসিসে চিন্তা করতে হয়।যেমন বিজ্ঞান,দর্শন ইত্যাদি।তাই নাস্তিকতাকে মুক্তচিন্তার ক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়ে রাখা যায় কেবলমাত্র।বাংলাদেশের অধিকাংশ নাস্তিকদের (সিংহভাগ) কেবলমাত্র অন্য ধর্মের বিদ্বেষ ছড়াতেই ব্যাস্ত থাকে।বিরোধিতা করা আর বিদ্বেষ ছড়ানোয় অনেক ফারাক।ধর্মের অনেক খারাপ দিক আছে নি:সন্দেহে, কিন্ত তার অনেক ভাল দিক ও আছে।নির্মোহ মুক্ত(!)চিন্তক ব্যাক্তি এর খারাপ দিকগুলোর সমালোচনার সাথে সাথে এর ভাল দিক গুলোও মেনে নিবেন।প্রকৃতির রহস্যময়তা দেখে আদিম মানুষ অবতারনা করেছিল ঈশ্বর এর ধারনার।বিজ্ঞান যত এগুচ্ছে, তত অনেক বদ্ধমূল ধারনার পরিবর্তন হচ্ছে।কিন্ত যতদিন পর্যন্ত পৃথিবীর সব মানুষ প্রকৃত বিজ্ঞানশিক্ষা না পাচ্ছে,যতদিন পর্যন্ত বিজ্ঞান সব রহস্যের সমাধান করতে না পারছে,ততদিন ধর্মের ধারনা থাকবে।এবং একজন নির্মোহ চিন্তকের উচিত সবকিছু নির্মোহ ভাবে চিন্তা করা।আর প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তি সর্ব অবস্থাতে উগ্রপন্থার পরিত্যাগ করে,যৌক্তিক আলোচনা করে।

কেন সব নিয়ম ভাঙতেই হবে? : বর্তমান সময়ের সব মুক্তমনাদের একটি কমন উক্তি: তারা কোন নিয়মের বন্ধনে বাধা থাকতে চান না।কিন্ত সত্যিই কি সম্ভব? কিংবা উচিত?পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে,মানুষের আধিপত্যের শুরু থেকে অসংখ্য ধারনা,নিয়ম, প্রথার সৃষ্টি হয়েছে।আবার কালের বিবর্তনে অনেক প্রথার বিলুপ্তি হয়েছে,ভবিষ্যতে হবে।এসব প্রথার বিলুপ্তির কারন,তারা ছিল অপ্রাসঙ্গিক, অযৌক্তিক এবং অকল্যানকর।কিন্ত এর মানে এই দাঁড়ায় নানা যে পুরাতন সব কিছুই ফেলে দিতে হবে।সত্যি বলতে,আমরা সবাই নিয়মে আবদ্ধ থাকতে চাই,আমাদের নিয়মে আবদ্ধ থাকতে হয়।সত্যি বলতে প্রকৃতি নিজেই নিয়মে আবদ্ধ।তা না হলে,লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে নিয়ম করে একই গতিতে ঘুরত না।প্রোটন আর নিউট্রন কে কেন্দ্র করে ইলেকট্রন নিয়ম করে ঘুরত না।প্রানীজগতের জেনেটিক কোডিং এত নিয়ম করে হত না।সুতরাং যত চিতকার করা হোক না কেন,আমাদের নিয়মের মাঝে থেকেই বিকশিত হতে হবে।অনেক নারীবাদী বিয়ে প্রথা মানে না,আরো কিছু বিষয়ে দ্বিমত করে।হ্যা,পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারীরা এখনো চরম নির্যাতিত হয়।কিন্ত পরিবার প্রথার সৃষ্টি কিন্ত তাদের অত্যাচার করার নিমিত্তে তৈরী হয় না।।মূলত গোত্র তথা সমাজ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে।দলবদ্ধ হয়ে চলার প্রবনতা প্রাণীজগতে অহড়হ চোখে পড়ে।এবং এটা দেখে গেছে- যেসব প্রাণী দলবদ্ধ হয়ে থাকে,বিবর্তনের ধারায় তারাই বেশি টিকে থাকে।সমকাম প্রকৃতির একটি স্বাভাবিক ঘটনা।এটাকে সমর্থন দিতে গিয়ে অনেকে ইনসিস্ট /পশুকাম কেও সমর্থন দিয়ে বসেন- কারন তা ধর্মে বলা আছে কিংবা পুরানো ধারনা,তাই এর বিরোধিতা করা উচিত!কিন্ত বিজ্ঞান কি বলে? নিজ বংশধর দূরের কথা,নিকট আত্মীয় এর সাথে ক্রস হলেও জেনেটিক ভেরিয়েশন কমে যায় অনেক।ইনহেরিটেড কিছু রোগের প্রতিরোধ হয় না।আরো আছে বহুল আলোচিত RH-Factor।আর এইডস নামক ভয়াবহ রোগটির উদ্ভব কিভাবে হয়েছিল সবার জানা।বানরের সাথে মানুষের মিলনের ফলে। তাই পুরানো বলেই সব নিয়ম পরিতাজ্য নয়।এখন প্রশ্ন আসবে-তাহলে বৈচিত্র আসবে কিভাবে? নিয়মের মাঝেই যে বৈচিত্র আসে,তার উদাহরন এই ইকোসিস্টেম।অসম্ভব জটিল এই ইকোসিস্টেমে লাখো প্রাণী,উদ্ভিদ, কীট,প্রোটোজোয়াপ্রোটোজোয়ার সমাহার।প্রত্যেকের খাদ্যাভ্যাস,এনাটমি,ফিজিওলজি সব আলাদা।কারো সাথে কারো মিল নেই।কিন্ত কি অদ্ভুদ এক নিয়মে তারা সবাই সবার সাথে যুক্ত।ইকোসিস্টেমে খাদ্য ও শক্তির প্রবাহ নিয়ে কারো পড়াশুনা থাকলেই জিনিসটা বুঝে আসবে।তাই আমরা চাই আর না চাই- অস্তিত্ব রক্ষার্থে আমাদের কিছু নিয়মে আবদ্ধ থাকতেই হবে।শুধু কোন নিয়মে আবদ্ধ থাকব- সেটা চয়েজের ব্যাপার!
প্রসঙ্গ- Humanism: Humanism মানে মানব ধর্ম।তথা মানুষের ধর্ম।সব জায়গায় এটিকে একটি পজিটিভ শব্দ বলেই মনে করা হয়।কিন্ত যদি এটির মানে মানবধর্ম হয়,তবে এটিকে ভাল ও মন্দ দুইটি দিক ই তুলে ধরতে হবে।কারন ভাল খারাপ দুই দিকই মানুষের বৈশিষ্ট্য। এবং লজিকালি প্রাণীকুলে ভাল ও মন্দ- এই দুই সত্তা কেবলমাত্র মানুষ ই ধারন করে।তার বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতির জন্য।অন্য প্রানীরা যা করে তা কেবল তাদের জৈবিক বৈশিষ্ট্যের বহি:প্রকাশ।সৎ ব্যাক্তি,ভাল ব্যক্তি,মন্দ ব্যক্তি,ম্যানিয়াক ব্যক্তি,স্যাডিস্ট ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য কিন্ত মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোয্য।আরেকদিক দিয়ে লক্ষ্য করলে,এই শব্দটা মানুষের সুপিরিয়রিটির পরিচায়ক।তবে বাংলাদেশে এই শব্দটির আলাদা মাজেজা রয়েছে।এখানে এই শব্দটি মানুষকে ভালবাসার অর্থে ব্যবহৃত হয়।অধিকাংশ নাস্তিক তাদের রিলিজিয়াস ভিউতে Humanism লিখতে পছন্দ করেন।এই শব্দটা লেখা মানে দুনিয়ার সব মানুষকে ভালবাসা।তাই কেউ ধর্ম পালন করে বলে তার প্রতি তীব্র ঘৃনা পুষে রাখার আগে একটু ভাবা উচিত- বিষয়টা হিপোক্রেসি হয়ে যাচ্ছে কিনা!

শেষকথা: নানা মত,না পথের অসীম বৈচিত্রের মানুষ নিয়েই আমাদের পৃথিবী।মত ও চিন্তার পার্থক্য আছে বলেই চিন্তার চর্চা এখনো চলছে।নতুন ধারনা আসছে,পৃথিবী বদলে যাচ্ছে।সবাই যদি, একই মতের অনুসারী হত,তাহলে চিন্তার কায়িক মৃত্যু ঘটত।তাই আলোচনা,সমালোচনায় অন্যের মতকে শ্রদ্ধা ও চিন্তাকে যত সম্ভব বাধাহীন করার মাধ্যমেই প্রকৃত কল্যান সম্ভব।