ছত্তিশগড় সরকার সুরগূজা জেলার ঘাটবারা গ্রাম, আদিবাসিদের কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নেবে বলে ডিক্রি জারি করেছে। আদিবাসিদের পঞ্চায়েত খুব পরিস্কার ভাবেই ওই এলাকাতে কোন কোলমাইনিং চায় নি। তবুও মোদি পেয়ারী আদানী মাইনিং এর বলপূর্বক অধিগ্রহণ সম্পূর্ন করতে জারি হল আদিবাসী উচ্ছেদ নামা। ফরেস্ট রাইট এক্ট মানা হলো না-যাতে আদিবাসিদের সম্পূর্ন সহমতি ছাড়া মাইনিং এর জন্য বন অধিগ্রহণ করা যায় না।

মে ২৮, ১৮৩০ সাল। প্রেসিডেন্ট এন্ড ু জ্যাকসন জারি করলেন রেড ইন্ডিয়ান রিম্যুভাল এক্ট। সেনেটে ২৮-১৯, কংগ্রেসে ১০২-৯৭ ভোটে পাস হয় ইন্ডিয়ান রিম্যুভাল বিল। মিসিসিপি নদীর পূর্বদিকে বসবাস করা সব আদিবাসিদের নদীর পশ্চিম দিকে চলে যেতে হবে। কারন আমেরিকাতে সাদা ইউরোপিয়ান পপুলেশন আর কটনের চাহিদা বেড়েই চলেছে। এর আগে পর্যন্ত আমেরিকার ফাউন্ডিং ফাদাররা-জর্জ ওয়াশিংটন, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিং এবং থমাস জেফারসন চাইছিলেন আদিবাসীরা আমেরিকানদের সাথে মিশে যাক-কৃষিকাজ শুরু করুক। জোর করে আদিবাসিদের জমি দখলের বিরুদ্ধে ছিলেন এরা। কিন্ত তুলো চাষ দক্ষিনে লাভহজনক হওয়া শুরু হতেই, শুরু হল শেতাঙ্গদের জমির খিদে। এতেব আদিবাসি উচ্ছেদ।

চেরোকি, মুসকোগি, সেমিনল, চিকস, চোটকাও-এই পাঁচটি আদিবাসিদের তাড়িয়ে দেওয়া হল তাদের ভূমি থেকে-যেখানে তারা বসবাস করেছে হাজার হাজার বছর। দশ হাজার চেরোকি মারা যায় এই রিলোকেশনে-যা মাস মার্ডার ছাড়া কিছু না। মিলিটারি এসে রাউন্ড আপ করে গাড়িতে শুয়োরের মতন গাদা করে ফেলে বন্দুকের নলের সামনে, তাদের অজানা অববাসযোগ্য জমিতে ফেলে দেওয়া হত। না খেতে পেয়ে রোগেই মারা যায় আদিবাসিদের অধিকাংশ লোক।

এই যদি সভ্য আমেরিকানদের ইতিহাস হয়, সোভিয়েত ইউনিয়ানে আদিবাসিরা কেমনছিল সেটাও জানুন। স্টালিন বিদ্রোহের ভয়ে অসংখ্য আদিবাসী গোষ্ঠিবাসিকে একদেশ থেকে অন্যদেশে পাঠিয়েছিলেন-যাদের অধিকাংশই রাস্তায় অক্কাপেত। তবে সোভিয়েত ইতিহাসের সব থেকে কুখ্যাত আদিবাসি নিধন মধ্য এশিয়াতে বাসমাসি বিদ্রোহ দমন। ফারগানা উপত্যকা এবং টুর্কেমিনিস্থানের মুসলমান আদিবাসীরা বহুদিন থেকেই জারের আধিপত্য মানতে চায়নি। ১৯১৭ সালে যখন বলশেভিক বিপ্লব হয়, এইসব আদিবাসিদের মনে আশার সঞ্চার হয়, যে তারা এবার রাশিয়ান আধিপত্য থেকে মুক্তি পাবে। ফলে ওক্টবর বিপ্লবের সময়, এরা রেড আর্মিকে সমর্থন করেছিল লেনিনের স্বয়ত্বশাসনের ঢপে বিশ্বাস করে। রেড আর্মি ক্ষমতা পেতেই এই আদিবাসিরা বুঝে যায়, বেসিক্যালি বলশেভিকরা জারের থেকেও বড় দানব। তাদের স্বাধীনতা দেওয়ার কোন ইচ্ছা লেনিনের নেই। ফলে ইসমাইল বে এর নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে আদিবাসিরা। ১৯১৮ সালে কোকান্ড শহরে রেড আর্মি ২৫,০০০ কৃষক, আদিবাসি হত্যার মাধ্যমে তাদের ঋন পরিশোধ করেন। হত্যালীলা এখানেই শেষ হয় না। ১৯২৩ শাল পর্যন্ত রেড আর্মি মধ্য এশিয়ার এই উপজাতি অঞ্চলে রক্তবন্যা বইয়ে দখলে আনবে। এসব হত্যালীলার সব কিছুই হয়েছে লেনিনের নির্দেশে। শুধু তাই না। গর্ভাচেভের দিন পর্যন্তও এদের বিশ্বাস করত না রাশিয়ানরা। এদের স্থানীয় কমিনিউস্ট পার্টির মাথায় সব সময় একজন রাশিয়ানকে বসানো হত। কোথায় লাগে কাশ্মীর! মধ্য এশিয়ার মুসলিম উপজাতিগুলিকে যেভাবে গণহত্যার মাধ্যমে কমিনিউস্টরা সোভিয়েতের দখলে এনেছিল-তার তুলনায় কাষ্মীর ত নস্যি! তবে ঘাবরাবেন না। লেনিন এমনি এমনি এমন করেন নি। এটা ছিল কটন বেল্ট। সুতরাং এই অঞ্চলের দখল না পেলে “সাম্রাজ্যবাদ বিরোধি মহান নেতা লেনিনের” চলছিল না। শুধু তাই না-তেলের দখল পেতে আজারবাইজান এবং বাকুর নির্বাচিত সরকারকে মিলিটারি দিয়ে ধ্বংস করে সোভিয়েতের দখলে আনেন লেনিন-হ! সাম্রাজ্যবাদ বিরোধি লেনিন!! যারা লেনিনকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধি নেতা বলে পূজো করে তারা ১৯১৭-১৯২২ সাল পর্যন্ত লেনিনের ইতিহাস কিছুই জানে না। তারা জানে না কিভাবে মধ্য এশিয়ার আদিবাসীদের ওপর রক্তের হোলি খেলে, এইসব এলাকাকে সোভিয়েতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তারা জানে না এই মধ্য এশিয়ার কত স্বাধিনতা আন্দোলনকে গণহত্যা আর গণ ধর্ষনের মাধ্যমে বাগে এনেছিলেন মহান লেনিন।

আমি যেটা লিখতে চাইছি-ক্যাপিটালিস্ট, কমিনিউস্ট, গণতান্ত্রিক-সোকল্ড শিক্ষিত, সভ্য সমাজ কোনদিনই আদিবাসিদের সমকক্ষ ভাবে নি-সব সময় ভেবেছে, ওইসব বনবাসীরা ইনফেরিয়র-তাদের জোর করে তাড়িয়ে দাও-না হলে বন্দুকের নলের সামনে সভ্য কর।

আদিবাসিদের সাথে আমার প্রত্যক্ষ মোলাকাত আই আই টি খরগপুরের শেষ বছরগুলিতে। রুরাল টেকনোলজিতে প্রফেসার পি কে ভৌমিক আদিবাসিদের ওপর গবেষনা করতেন। উনি সারা জীবন আদিবাসিদের মধ্যেই কাটিয়েছেন-উনার বাবা আদিবাসি ছেলেমেয়েদের জন্য একটা হোস্টেল ও চালাতেন। উনিই আমাকে নিয়ে গিয়েছেন অনেক আদিবাসি গ্রামে। ইনফাক্ট আই আই টির আশেপাশের গ্রামগুলো আগে আদিবাসিদেরই ছিল-আস্তে আস্তে তাদের সরিয়ে শিল্প এসেছে। আমি আস্তে আস্তে বুঝেছিলাম এরা বন জঙ্গলকে প্রকৃতিকে যত ভালবাসে সভ্য মানুষদের মধ্যে তার ছিঁটেফোঁটাও নেই।

আমাদের মতন সভ্য মানুষদের চালিকা শক্তি হচ্ছে লোভ-অর্থ, ক্ষমতা, যশের জন্য আমরা লালায়িত। নিমপুরাতে রবিবার সকালে আদিবাসিদের হাটে যেতাম নিয়মিত। হাজারে হাজারে লোক-শয়ে শয়ে হাড়িয়ার ঠেক। আদিবাসী রমনীরা হাড়িয়া নিয়ে বসে -তাদের ঘিরে পুরুষদের জটলা। প্রাণের ওমন স্বাধীন উচ্ছাস আমি কোথাও দেখিনি। ওরা খুব টক একধরনের লেবু আনত হাটে-দারুন সস্তা। টাকায় তিনটে করে । একদিন একটা লোক ওমন ডজন দুই লেবু নিয়ে বসে আছে। আমি দুটাকা ধরিয়ে দিলাম-ছটা নেব। ও দেখি আমাকে দুডজন লেবুই তুলে দিল! অবাক কান্ড!! আমি বোঝাচ্ছি, আমার মোটে ছটা দরকার-বাকীগুলো ফেরত দিলাম। ও আবার আমার হাতে বাকীগুলো তুলে দিল। বলে দুটাকার বেশী দিতে হবে না! বাকী সব নিয়ে যাও! এমন আজব বিক্রেতা সভ্য সমাজে কোনদিন দেখি নি! শেষ লজ্জায়, আমি ওকে দশটাকা ধরাতেই ও আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে কাছের এক হাড়িয়ার ঠেকে দে ছুট। আমি এবার বুঝলাম। আসলে এসবের বেচাকেনার কোন ইচ্ছা ওর নেই-হাটে এসেছে-কোন রকমে একটা টাকা পেলেও, সব তুলে দিয়ে হাড়িয়ার আড্ডায় বসবে। ওটাই ওর জীবনের মোক্ষ। এদের জীবনের চাওয়া পাওয়া আকাঙ্খা -কোন কিছুতেই লোভ চোখে পড়ে নি।

আমি জানি না কেন আমরা নিজেদের সভ্য বলে মনে করি। এমন সভ্যতা যেখানে চাইলেও জীবনের সরলতা নেই- চাইলেও সৎ থাকা যায় না। চাইলেও নির্লোভ থাকা যায় না। সাধে বিদ্যাসাগর শেষ জীবন আদিবাসীদের মধ্যে কাটিয়েছিলেন!