বিশ্বের একমাত্র সাংবিধানিক হিন্দু রাষ্ট্র নেপাল ২০১৫ সালে ২০শে অক্টোবর সংবিধান পরিবর্তন করে তাদের দেশকে সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষনা করেছে, কারণ, আধুনিক রাষ্ট্রের ধারনার সাথে ধর্ম এখন আর কোনভাবেই মানানসই নয়। রাষ্ট্র এখন কোন ধর্মীয় রাজা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় না, ধর্ম প্রতিষ্ঠার নিমিত্ত কোন রাষ্ট্র এবং এর শাসক চালিত হন না। বর্তমান সভ্য সমাজে রাষ্ট্র মানুষের কল্যানার্থে মানুষের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিষ্ঠান। এর লক্ষ্য বিশেষ কোন ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা নয়, বরং ধর্মীয় পরিচয়ের উর্দ্ধে থেকে এর অভ্যন্তরস্থ সার্বজনীন মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ, উন্নয়ন ও কল্যাণ সাধনই রাষ্ট্রের লক্ষ্য। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ও কিছু মুসলমান অধ্যুষিত দেশ ব্যতিত এখন বিশ্বের আর কোন দেশ সংবিধানে ঘোষনা দিয়ে ধর্মকে রাষ্ট্রীয় অধিকার প্রদান হয় না, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ধর্মকে ধারন করা হয় না। রাষ্ট্রের কাছে মানুষের পরিচয় শুধুই তাঁর নাগরিকতায়, ধর্মে নয়। আধুনিক বিশ্বে ধর্ম একটি লজ্জাজনক মধ্যযুগীয় বিষয়।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সংবিধানের মূল স্তম্ভ ছিলো চারটি; জাতীয়তা, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে যুক্ত হয়েছে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নামক এক প্রহসন, যা একাত্তরের মূল চেতনার পরিপন্থি। একটা আধুনিক, সভ্য দেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম নামক মধ্যযুগীয় ঘোষনা কিভাবে থাকে তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। বিশ্ব রাষ্ট্র ব্যবস্থাগুলো যেখানে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করছে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা থেকে ধর্মকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, সেখানে আমরা একটি ধর্মকে রাষ্ট্রের ধর্ম হিসেবে ঘোষনা করেছি। মজার বিষয় হলো, এরপরও আমরা দেশকে সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে দাবী করি।

২০০৮ সালে আওয়ামিলীগ ক্ষমতায় আসার পর আমরা ভেবেছিলাম এবার মনে হয় দেশ ৭২এর সংবিধানে ফিরে যাবে, রাষ্ট্রধর্ম নামক প্রহসনটি বিদায় হবে, দেশ সত্যিকার অর্থেই সেক্যুলার হিসেবে প্রতিষ্ঠটা পাবে। তখন সংবিধান সংশোধন প্রনয়ন করার জন্য আওয়ামিলিগের তোড়জোড়ও ছিল লক্ষ্য করার মত। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে কো-চেয়ারম্যান করে সংবিধান সংশোধন কমিটিও গঠন করা হয়, দিনের পর দিন চলে আলোচনা, গবেষনা, চলে মত বিনিময়। আদালত ৫ম সশোধনী বাতিল করে রায় দিলে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, “আদালত পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করার অর্থ ৭২-র সংবিধানে ফিরতেই হবে”। দেশের মুক্তিকামী মুক্তচিন্তকগণ একটা আশার আলো দেখেছিলেন, এবার মনে হয় রাষ্ট্রের ঘাড় থেকে রাষ্ট্র ধর্ম নামক প্রহসনটা নামতে চললো, দেশ মনে হয় এবার সত্যিকার অর্থেই সেক্যুলার হতে চললো। অসাড়ের তর্জন গর্জন সাড় প্রমাণ করে যেই লাউ সেই কদু হলো। সকল মুক্তিকামী মানুষদের আশায় গুড়েবালি দিয়ে ৭২ এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার বদলে আওয়ামিলীগ মনযোগ দিলো নির্বাচন ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার দিকে।

যাই হোক, মুক্তিকামী মুক্তচিন্তক, মুক্তমনাদের আশায় গুড়ে বালিও তবু মেনে নেয়ার মত ছিলো। কিন্তু, জামাত শিবিরের হাত ধরে, তাদের ইন্দন ও পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে যখন জঙ্গিবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, একের পর এক মুক্তমনা, ভিন্নমতাবলম্বী লোকেদের কোরানিক নির্দেশ মোতাবেক (কোরান ৪৭:০৪) হত্যা করতে শুরু করেছে, সরকার তথা আওয়ামিলীগ এদের বিচার দূরে থাক, জঙ্গিদের সুরেই কথা বলতে থাকে তখন তাদেরকে উস্কানিদাতা না বলে কোন উপায় থাকে না। অন্যায়ের প্রতিবাদ না করার অর্থ আপনি অন্যায়কে মেনে নিলেন। যেখানে নীরবতাই অন্যায়ের প্রশ্রয়, সেখানে সরকার এবং এর উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ বরং মুক্তচিন্তকদেরকে উলটো তাদের লেখালেখির জন্য সাবধান করে দেন। এসব ঘটনা কি রাষ্ট্রীয়ভাবে জঙ্গিবাদের দিকে দেশকে উস্কে দেয়া নয়?
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তিবর্গ যখন হত্যাকান্ডের বিচার না করে খুনীদের সুরেই কথা বলেন, তখন বুঝতে বাকী থাকে না, উস্কানীর পেছনে কারা, কারা মুক্তচিন্তকদের হত্যার জন্য উস্কানি দিচ্ছেন। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির দাবীদার আওয়ামিলীগ যখন মোল্লাদের মাথায় হাত বোলানোর জন্য, কাঠামোল্লাদের ভোট পাবার জন্য গোটা দেশকে জিয়া আর এরশাদের মতই দাবী যে তাদেরও অনুভূতি আছে, তারাও ধর্মীয় অনুভূতি নামক অলীক তামাশায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে যান, তখন প্যান্ডোরা বক্সের শেষ উপাদানটিও কর্পূরের মত উবে যায়।

উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, আইজিপি কিংবা মন্ত্রীমহোদয়গণের চোখ রাঙানি, তাদের বেঁধে দেয়া সীমারেখার দোহাই হয়ত মেনে নেয়ার মত ছিলো। কিন্তু, এক দিনে যেখানে দুই স্থানে চাপাতিওয়ালারা তাদের মধ্যযুগীয় কায়দায় হত্যার চেষ্টা করে, একজনকে হত্যাও করে (ভাগ্য ভাল থাকায় হয়ত অন্যরা বেঁচে গেছেন) তখন কোথায় দ্রুত আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে, তা না করে সেখানে খোদ প্রধানমন্ত্রী উলটো লেখালেখির জন্য লেখক প্রকাশকদের সতর্ক করে দেন। তখন আর বুঝতে বাকী থাকে না দেশ এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের পুরোটাই এখন নষ্টদের দখলে।

বাংলা ভাষাভাষী ও বাঙালীর প্রাণের মেলা হলো অমর একুশে বই মেলা। লেখক, সাহিত্যিক থেকে শুরু মুক্ত বুদ্ধি, জ্ঞান চর্চা আর অজানাকে জানা প্রধান উপকরন বই।এই বইয়ে কি লিখতে হবে, কি না লিখতে হবে, বই থেকে কে কি জানবে, কে কি কারণে বই কিনবে, কি পড়বে তা একান্তই লেখক আর পাঠকের ব্যক্তিগত ব্যপার। কিন্তু, মোল্লাতন্ত্রের অংগুলি নির্দেশের কাছে রাষ্ট্র আজ এতটাই নতি স্বীকার করেছে যে এখন বইয়ে কি ছাপা হবে, কি লিখা হবে, কি ছাপা হবে না, কি প্রকাশ করা যাবে না তা নির্দেশ দিয়ে দেয়ার মত দুঃসাহস দেখায় বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালকের মত হর্তাকর্তারা। যা বই লিখা, প্রকাশ এবং জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে এক বিরল মাথামোটার দৃষ্টান্ত বৈ কিছু নয়।

তবে, বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মুক্তিচিন্তক ও জ্ঞানান্বেষণকারীদের বই লেখা আর প্রকাশের ব্যক্তিস্বাধীনতার দাবী করাটাও এক ধরনের বাতুলতা ছাড়া কিছুই নয়। সংবিধান যেখানে রাষ্ট্রের একটা ধর্ম নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, সেখানে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরস্থ প্রকাশনাগুলোকেও সেই ধর্মসম্মত হওয়াটা স্বাভাবিক।

যতদিন সংবিধানে জগদ্দল পাথরের মত রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বসে থাকবে ততদিন রাষ্ট্রের কাছ থেকে লেখালেখির ব্যাপারে সীমারেখা টেনে দেয়া, উস্কানীর সবক চলতেই থাকবে, চলতেই থাকবে রাষ্ট্রের সকল কিছুতে ধর্মীয় আগ্রাসন, চলতেই থাকবে সকল কিছুতে ইসলামায়ন।
সর্বোপরি এসবের বিরুদ্ধে এখনই রুখে না দাঁড়ালে চলতেই থাকবে ধর্মনিরপেক্ষতার(!) বাংলাদেশে ধর্মায়ন তথা ইসলামায়ন। আর এ জন্য চাই, মুক্তচিন্তকদের ঐকান্তিক এবং ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা। আর প্রচেষ্টাটা শুরু করতে হবে সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে বিদায় করার মাধ্যমে। এছাড়া, এদেশে মুক্তচিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা অলীক একটা কল্পনাই থেকে যাবে।