মুহম্মদ মনসুর উদ্দিনের বাউল-গানের সংগ্রহের গ্রন্থ “হারামনি”-র প্রথম ভাগের ভূমিকা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৌষ সংক্রান্তির দিন ১৩৩৪ বংগাব্দে। এ গ্রন্থ-ভূমিকার শেষ অধ্যায়ে রবীন্দ্রনাথ বাউল সম্প্রদায় বাংলায় হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতিতে কিভাবে অবদান রাখছে সে প্রসংগে বলেছেন,

“আমাদের দেশে যাঁরা নিজেদের শিক্ষিত বলেন তাঁরা প্রয়োজনের তাড়নায় হিন্দু-মুসলমানের মিলনের নানা কৌশল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। অন্য দেশের ঐতিহাসিক স্কুলে তাঁদের শিক্ষা। কিন্তু, আমাদের দেশের ইতিহাস আজ পর্যন্ত, প্রয়োজনের মধ্যে নয়, পরন্তু মানুষের অন্তরতর গভীর সত্যের মধ্যে মিলনের সাধনাকে বহন করে এসেছে। বাউল-সাহিত্যে বাউল সম্প্রদায়ের সেই সাধনা দেখি–এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই; একত্র হয়েছে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করে নি। এই মিলনে সভাসমিতির প্রতিষ্ঠা হয় নি; এই মিলনে গান জেগেছে, সেই গানের ভাষা ও সুর অশিক্ষিত মাধুর্যে সরস। এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠ মিলেছে, কোরান পুরাণে ঝগড়া বাধে নি। এই মিলনেই ভারতের সভ্যতার সত্য পরিচয়, বিবাদে বিরোধে বর্বরতা। বাংলাদেশের গ্রামের গভীর চিত্তে উচ্চ সভ্যতার প্রেরণা ইস্কুল-কলেজের অগোচরে আপনা-আপনি কিরকম কাজ করে এসেছে, হিন্দু-মুসলমানের জন্য এক আসন রচনার চেষ্টা করেছে, এই বাউল গানে তারই পরিচয় পাওয়া যায়”।

রবিঠাকুরবর্ণিত “কোরান পুরাণের” ঝগড়াহীন যে বাউল সমাজ, তাদের চিত্তের গভীরে ছিল সুর এবং সাম্যের বাণী। বাউলদের কাছে জাতিত্ব,শাস্ত্র, মৌলবী কিংবা বামুনের বিধান ছিল ব্রাত্য। তাদের বিশ্বাস ছিল সাধারণ মানুষ আর সে সাধারণ মানুষের মধ্যেই বাসকরা ঈশ্বর। বিভিন্ন জায়গায় ছিল সে ঈশ্বরের বিভিন্ন নাম; কেউ বলতো দয়ালহরি, কেউ দীনবন্ধু, কেউ দীনদয়াল, কেউ সাহেবধনী, কেউ কর্তাভজা ইত্যাদি। কিন্তু সব কিছুর ভিতরে বিশ্বাসের মূল কিন্তু সে মানুষই।

একসময়ে সারা বাংলামুলুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এ বাউল সম্প্রদায়। তারা কিভাবে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল? এ নিয়ে সবিস্তারে বর্ণনা আছে বিখ্যাত লোকগবেষক অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তীর “গভীর নির্জন পথে” গ্রন্থটিতে। তিনি বলেছেন,

“ সম্ভবত উনিশ শতকের হিন্দু ও মুসলমান সংস্কার আন্দোলন, মিশনারীদের প্রচার, ব্রাহ্মধর্মের উত্থান এবং শ্রীরামকৃষ্ণ-বিজয়কৃষ্ণদের জীবন সাধনা এমন প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে যে এই সব উপসম্প্রদায়ী পিছোতে পিছোতে গ্রামের প্রত্যন্তে লুকিয়ে পড়ে। একদিকে হিন্দুদের উচ্চ ধর্মাদর্শ আরেকদিকে কট্টর মুসলমানের সক্রিয় দমননীতি বাউল ফকিরদের ধ্বংস করে দেয়”।

অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তী দেখিয়েছেন স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ এসব লোকায়িত জাতিভেদহীন ধর্মসাধনাকে সরাসরি অভিযুক্ত করে “ পায়খানা দিয়ে বাড়িতে ঢুকে গায়ে নোংরা লাগানো” বলেছেন। স্বামী বিজয়কৃষ্ণ তো সরাসরি একে “ বিষ্ঠামূত্র খেয়ে ধর্মসাধনা” নামে অভিহিত করেছেন। উচ্চস্তরের হিন্দু সাধকদের এ সব প্রতিরোধে হিন্দুদের মধ্যে বাউল-ফকিরের সংখ্যা কমে যায়। নিম্নবর্ণের হিন্দুদের বিপুল যে অংশটি বাউল কিংবা ফকিরী ধর্মে দীক্ষা নিচ্ছিল তাদের সংখ্যাও কমতে থাকে।

আশ্চর্যের বিষয়, বাউল ফকিরদের মধ্যে যারা মুসলমান ধর্মত্যাগী তারা কিন্তু প্রচণ্ড লড়াই চালিয়ে এসেছেন সেই আঠারো শতক থেকেই। বাউলদের বড় সংগ্রাম শুরু হয় উনিশ শতকে নদীয়া, যশোর এবং পূর্ববংগের শরীয়তী মুসলমানদের সাথে। বাউলদের ঝুঁটি কেটে নেয়া, গান-বাজনা বেশরীয়তী বলে ফতোয়া দেয়া এবং নানারকম দৈহিক নির্যাতন করা ছিল নির্যাতনের উপায়। আর এ নির্যাতনকারীদের অগ্রনী ছিল “ সে সময়কার ওহাবী,ফারায়জী এবং আহলে হাদীস আন্দোলন”।

একটা কথা অপ্রাসংগিক হ’লেও এসে যায়, সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস “মনের মানুষ” অবলম্বনে যে সিনেমাটি পরিচালক গৌতম ঘোষ বানিয়েছেন সেখানে দেখানো হয়েছে যে “বিষাদসিন্ধু” খ্যাত মীর মোশাররফ হোসেন লালন ফকিরের আড্ডায় গিয়ে লালন ফকিরের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। এটা অত্যন্ত ভুল এবং বিকৃত উপস্থাপনা। মীর মোশাররফ হোসেন ছিলেন প্রচন্ড বাউল-ফকির বিরোধী কট্টর মুসলমান। “গভীর নির্জন পথে” গ্রন্থেই অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তী বলেছেন,

“ সে সময়কার কিছু লেখকের রচনায় বাউলফকির-বিরোধী ভাষ্য চোখে পড়ে। যেমন, মীর মশাররফ হোসেন লিখেছেনঃ ঠ্যাঁটা গুরু ঝুটা পীর/ বালা হাতে নেড়া ফকীর/ এরা আসল শয়তান কাফের বেঈমান”।

১৩৩২ বংগাব্দে প্রকাশিত রংপুরের মৌলানা রেয়াজউদ্দিন আহমেদের লেখা “ বাউল ধ্বংসের ফতোয়া” বইটি কট্টর মুসলমান সমাজে সে সময় প্রচন্ড জনপ্রিয় ছিল। কারণ, সেখানে বাউল ফকিরদের মুসলমান সমাজ থেকে বিতাড়নের আহবান করা হয়েছিল। কুষ্টিয়ার ছেঁউরিতে লালনপন্থী সমস্ত বাউলের ঝুঁটি কেটে নেয়া হয়েছিল ১৩৫৩ বংগাব্দে তখনকার দিনের প্রভাবশালী মাওলানা আফছার উদ্দিনের নেতৃত্বে। বাউল-ফকিরদের প্রতি নির্যাতন এখনো সমানতালেই চলছে এপার-ওপার দু’বাংলাতেই। আর এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন কট্রর হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মের সাম্প্রদায়িক মানুষেরাই।

লালন ফকির ও আউল-বাউল সম্পর্কিত তথ্য-তত্ব নিয়ে সাহিত্যকর্ম, চিত্রকর্ম, গান, নাটক-যাত্রা-চলচিত্র হয়েছে অসংখ্য। কিন্তু লালন ফকিরসহ বাংলার আরো শতাধিক লোকায়ত উপধর্মধারা কিভাবে সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হ’লো সে নিয়ে খুব কমই লেখালেখি হয়েছে। এ নিয়ে তথ্যবহুল একটি বইয়ের সন্ধান মেলে; লেখক শক্তিনাথ ঝা- বইয়ের নাম “ বাউল-ফকির ধ্বংসের আন্দোলনের ইতিবৃত্ত”। কলকাতার সুবর্ণরেখা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত এ বইটিই মনে হয় একমাত্র বই যেখানে দেখানো হয়েছে বাংলার এ অসম্প্রদায়িকধারাটি কিভাবে সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।

আজ যাঁরা বাংলার সামাজিক আন্দোলন ও হিন্দু-মুসলমানের বিভেদের ইতিহাস নিয়ে কাজ করেন,তাঁদের উচিত এ নিয়ে আরও বিস্তর গবেষনা করা। আমরা কথায় কথায় ব্রিটিশের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশনা করেই হিন্দু-মুসলমান বিভেদের মূল কারণে উপনীত হ’বার চেষ্টা করি। কিন্তু লোকায়ত ধর্মসাধনা, যার মূলেই ছিল জাতি-বর্ণ-ধর্মসহ বিভাজনের সমস্ত রেখাগুলোকে সহজ কথা, সহজ সুর ও সহজ দর্শণের মাধ্যমে মুছে দেয়ার আকুতি, তা কিভাবে আমাদের সমাজ থেকে নিঃশেষ করে দেয়া হলো এবং সে চেষ্টা এখনও হচ্ছে; সে দিকটা বরাবরের মতো বোধহয় উপেক্ষিতই আছে।