এক

মানুষের আজ চাই নতুন এক চৈতন্যলোক। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, ঈশ্বর ধারণা, মানবসম্পর্ক আমুল বদলে যাচ্ছে। মানুষ নতুন প্রত্যয়ে বলছে, তাকে অশেষ সংগ্রাম করে জীবনের অক্ষমতায় উত্তীর্ণ হতে হবে। সীমার মাঝে অসীমকে অনুভব করতে হবে। এই অনুভবের ভিতরেই ঈশ্বরের বসবাস।

রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি’তে এই মানুষ-ঈশ্বরের ভালবাসার কথা বলেছেন। এই ভালোবাসার সম্পূর্ণ ও বিশুদ্ধতম দৃষ্টান্ত গৌতম বুদ্ধ ও মহাত্মা গান্ধী। এরা মানুষকে বললেন, মানুষের যা অত্যন্ত দরকার তা হলো নতুন আত্মসচেতনতা। সময় ও সমস্যা, জীবন ও মানবতা দাবী করছে এই নতুন বিশুদ্ধ মানুষ। রবীন্দ্রনাথের বলাকা মনে করিয়ে দিচ্ছে নৈবেদ্যকে, দাবী করছে মানুষের কাছে নতুন নৈতিক মুল্যবোধ, নতুন জীবন দর্শন। পূর্ব ও পশ্চিম দুই পৃথিবীতেই আজ চিন্তাশীল মানুষ মাত্রই বুঝতে পারছে নতুন ধর্ম চাই। নতুন আধ্যাত্মিক বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে পারা চাই। আসলে মানুষের জীবনতৃষ্ঞা কোথায় মিটতে পারে? সেই সংবাদটাই আজ সংগ্রহ করার সময় এসেছে। এই সমস্যার নিষ্পত্তি করবে কে? করবে দার্শনিক, লেখক, শিল্পী। অর্থাৎ কবিতা, নাটক, উপন্যাস এবং উচ্চাঙ্গের নতুন নতুন সংবাদপত্র, ক্যাসেট, সিডি, ডিভিডি, ইন্টারনেটের বিশাল তথ্যভান্ডার মানুষের তৃষ্ঞা মিটাবে। এই পথেই পূর্ণতাপ্রাপ্ত মানুষ যন্ত্রের অপ্রতিহত গতিকে মানুষের মঙ্গলের জন্য আরো সংযত করে আনবে। যন্ত্রও থাকবে, মন্ত্রও থাকবে। কে কোথায় থাকবে সেটাই বড় কথা। মজার ব্যপার হচ্ছে, তাও নির্ধারণ করবে মানুষ।

এখান থেকেই নতুন ধর্ম জিজ্ঞাসার সূচনা। এই ধর্ম মানুষের জীবনদেবতাকে নিয়ে। আধুনিক মানুষ আবিষ্কার করতে শুরু করেছে তার এই স্থূল জগতের কতটা চাই, আর অসীমের কাছে কি চাই? গীতাঞ্জলির মুল কথা- “ঈশ্বরের জন্য মানুষের ভক্তি, আবার সেই ভক্তির মধ্যেই ঈশ্বরের দেবোপম পূর্ণতা (divine perfection)”। একের অপরকে চাই। কেউ কাউকে বিযুক্ত করে নয়। ভক্ত যে ঈশ্বরকে চায়, সে তো তার নিজের পূর্ণতার জন্যেই। সেই পূর্ণতার জন্যেই ঈশ্বরকে বার বার মানুষের এই পৃথিবীতে ফিরে আসতে হয়, মানুষের ভালোবাসা প্রার্থনা করতে হয়। তাইতো গীতাঞ্জলির কবি পত্রপুটে নতুন করে আত্মপ্রকাশ করেন, মানুষের এই পৃথিবীকে দু’হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরেন।

মৃত্যুর গ্রন্থি থেকে ছিনিয়ে ছিনিয়ে
যে উদ্ধার করে জীবনকে
সেই রুদ্র মানবের আত্ম পরিচয়ে বঞ্চিত
ক্ষীণ পান্ডুর আমি,
অপরিস্ফুটতার অসম্মান নিয়ে যাচ্ছি চলে।

মর্মকথা হচ্ছে, মানুষের মুক্তি চাই। আনন্দলোকের মুক্তি। যে ধর্ম চাই সে তার হ্রদয়ের, তার অর্ন্তলোকের, এই ধর্ম প্রতিটি মানুষের নিজস্ব ঘরণায় ফুটে উঠে; এ ধর্ম কোন সাম্প্রদায়িক ধর্ম হতে পারে না। এখানে কোন অলৌকিকতার স্থান নেই। অবশ্যই মানুষ একটি সম্প্রদায়ের মধ্যে জন্মগ্রহন করে। পরবর্তীকালে মনের মাধুরী মিশিয়ে সে তার মনোজগত তৈরী করে, কিন্তু সেটা আরোপিত নয়। এই ধর্ম সজীব সজাগ মানুষের অর্ন্তদেশে ক্রমবর্ধমান। এর ক্রিড নেই, এ কোন ফেথ নয়। এ এক নতুন অর্ন্তদৃষ্টি। এর কোন শাস্ত্র, আচার-বিচার, জাতিভেদ নেই। নেই কোন বাহিরের নিবিঢ় বন্ধন। মানুষ বার বার পরাজিত হয়েছে। কারণ বাহিরের অথরিটি তাকে দংশন করেছে, তার ঐশ্বর্যকে খর্ব করেছে। ধর্মজ্ঞ আবুল কালাম আজাদ তার জীবন দেবতা সম্পর্কে এমন কথাই বলেছেন, “There is no conviction in my heart which the thorns of doubt have failed to pierce. There is no faith in soul which has not been subjected to all the conspiracies” (Azad, Memorial Volume, page-92). একই বইয়ে অন্যত্র বলেছেন, “I am under no obligation for guidance to any man’s hand or tongue, nor to my family nor to any syllabus of education. All the guidance I have received has been from the Divine Throne.”

মানুষ স্বয়ংসম্পূর্ণ। মানুষ রবীন্দ্রনাথের নৈবেদ্য বুঝেন, বলাকা থেকে পত্রপুট পড়তে পড়তে মুগ্ধ হন, চিন্তার জগতে প্রবেশ করেন। মানুষের ধর্মে রবীন্দ্রনাথ মানুষের ধারণাকে তুলে ধরেছেন এই ভাবেঃ

“একদিন ব্রাহ্মণ রামানন্দ তাঁর শিষ্যদের কাছ থেকে চলে গিয়ে আলিঙ্গন করলেন নাভা চন্ডালকে, মুসলমান জোলা কবিরকে, রবিদাস চামারকে। সেদিনকার সমাজ তাঁকে জাতিচ্যুত করল। কিন্তু তিনি একলাই সেদিন সকলের চেয়ে বড় জাতিতে উঠেছিলেন, যে জাতি নিখিল মানুষের। সেদিন ব্রাহ্মণমন্ডলীর ধিক্কারের মাঝখানে একা দাঁড়িয়ে রামানন্দই বলেছিলেন- সোহহ্‌ম, সেই সত্যের শক্তিতেই তিনি পার হয়ে গিয়েছিলেন সেই ক্ষুদ্র সংস্কারগত ঘৃণাকে, যা নিষ্ঠুর হয়ে মানুষে মানুষে ভেদ ঘটিয়ে সমাজ স্থিতির নামে সমাজধর্মের মুলে আঘাত করে”।

দুই

একদিন যিশুখৃষ্ট বলেছিলেন, ‘সোহহম’। আমি আর আমার পরম পিতা একই। কেননা, তার যে প্রীতি, যে কল্যাণ বুদ্ধি সকল মানুষের প্রতি সমান প্রসারিত সেই প্রীতির আলোকেই আপন অহংসীমাকে ছাড়িয়ে পরম মানবের সঙ্গে তিনি আপন অভেদ দেখেছিলেন।

গৌতম বুদ্ধ উপদেশ দিলেন, সমস্ত জগতের প্রতি বাধাশুন্য, হিংসাশুন্য, শত্রুশুন্য মানুষে অপরিমাণ মৈত্রী পোষন করবে।দাঁড়াতে, বসতে, চলতে, শুতে, যাবৎ নিদ্রিত না হবে; এই মৈত্র্র্রীস্মৃতিতে অধিষ্ঠিত থাকবে – একেই বলে ব্রহ্মবিহার।

এতবড় বড় উপদেশ মানুষকেই দেওয়া চলে। কেননা মানুষের মধ্যে গভীর হয়ে আছে সোহহংতত্ত্ব। সে কথা বুদ্ধ নিজের মধ্য থেকেই জেনেছেন। তাই বলেছেন, অপরিমাণ প্রেমেই আপনার অন্তরের অপরিমেয় সত্যকে মানুষ প্রকাশ করে।

আধুনিক মানুষকে এই অপরিমাণ প্রেমেই নিজেকে বিলীন করে দিতে হবে। একে এক নতুন আত্মসমর্পণ বলা যায়। বলা যায় নতুন মুল্যবোধ, যে মুল্যবোধ হল ব্যালেন্সের। মুল্যবোধ সমৃদ্ধ এই মানুষগুলো পৃথিবীর কাছে নতুন সেনসিটিভিটি দাবি করছে। বলছে, আর অতিশয্য নয়, কোন দীর্ঘকালীন পরিকল্পনা নয়। যা দরকার তা হল মানুষের সঙ্গে মানুষের নিবিঢ় যোগাযোগ। মানুষ বাজার ছেড়ে, যুদ্ধ বিমান ছেড়ে, নির্দ্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে তাক করা আনবিক বোমার সুইচবোর্ড ছেড়ে মানুষের কাছে আসুক; মুখোমুখি বসুক। বিভিন্ন সংযোগ কেন্দ্র গড়ে উঠুক। শুধুমাত্র কিছু শক্তিশালী মানুষের নিয়ন্ত্রনাধীন একটি জাতিসংঘ নয়, অজস্র ছোট ছোট ক্লাব অব রোম গড়ে উঠুক। বড় হয়ে উঠুক মানুষের কল্পনা শক্তি, যার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠুক হাজার হাজার আন্তর্জাতিক কলা, সাহিত্য, দর্শন, সঙ্গীত চর্চা কেন্দ্র। বিভিন্ন ধরনের শিল্প চর্চাকেন্দ্রে ছেলেমেয়েরা নিজেদের সৃজনশীলতার অভিব্যক্তি ঘটাক। অভিভূত করে দিক প্রবীণদের। শহরের সঙ্গে শহরতলীর যোগাযোগ গড়ে তুললে দেখা যাবে দু’পক্ষই কত নতুন দিগন্তবিস্তৃত শিল্পসম্ভার উপহার দিচ্ছে জগৎকে। এগুলোই হবে নতুন মানুষের নতুন জীবনাভিযান। এই মানুষগুলোই তখন নিজে নিজেই তার নতুন এথিকস্‌, নতুন নীতিবোধ গড়ে তুলবে। তার আর নতুন রাজনীতি বা ধর্মনীতির দরকার হবে না। এত তন্ত্র-মন্ত্রের রাজনৈতিক সংঘাত থেকে মানুষ পাবে মুক্তি। ধর্ম দিয়ে তখন আর মানুষের মানব সভ্যতাকে কদর্য করার প্রয়োজনীয়তা ম্লান হয়ে যাবে। বিজ্ঞান আর ধর্মকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর প্রচেষ্টা হবে হাস্যকর। বিজ্ঞানের চাহিদা ধর্ম দিয়ে বা ধর্মের চাহিদা বিজ্ঞান পুরণ করা কখনই সম্ভব নয়। মানুষের এই আধুনিক চিন্তা শক্তির প্রসারতায় ধর্মের উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র বা সমাজ ব্যবস্থা মানুষ এখন চিন্তাই করতে পারছে না। আধুনিক এই মানুষগুলো তাদের সমস্যা সমাধানে চিন্তা করছে এইভাবেঃ

আধুনিক মানুষের দায় অনেক। তাকে প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, আচার-আচরণ, এমন কি সম্পর্ক পরিবর্তন করতে হবে। একক সংসার, পুরনো দিনের বহুজনের সংসার এ সব কথা এখন কাজের কথা নয়। কাজের কথা হল, এই মুক্ত পৃথিবীতে একা মানুষ আর একা নেই। একক সংসারের মধ্যে ছোট্ট পৃথিবীর মানুষ এসে ঢুকে পড়েছে। একা মানুষ বহু উদ্দ্যোগের মধ্যে নতুন এক মানব সংসার আবিষ্কার করছে। অবসরপ্রাপ্ত মানুষ পঞ্চাশ বছর আগের মত আর মৃত্যুর জন্য দিন গুনছে না। আগামীকালের কর্মসূচী হাতে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠছে। এই ব্যস্ত মানুষকে আরো ব্যস্ত করে তোলার আয়োজন করবে এই আধুনিক পৃথিবী। তার অনেক কাজ চাই। যন্ত্র তো সব কাজ করে দিলে চলবে না। যে কাজ যন্ত্র করছে, সেটা যন্ত্রের উপর ছেড়ে দিয়ে মানুষ নতুন কাজের সন্ধানে ছুটছে।

সমাজকে উন্নত করতে হলে ব্যক্তি মানুষকে স্বার্থক মানুষে পরিণত হতে হবে। মানব উন্নয়নের অর্থ ইকোনমিক গ্রোথ নয়, মানুষের সার্বিক অবস্থার উন্নতি। আমরা এতদিন ধরে নিয়েছিলাম ক্রমবর্ধমান সম্পদ, চারিদিকে বৈভব, মানুষ সভ্যতার স্বরূপ। আজ হঠাৎ অন্য কথা বুঝতে হচ্ছে। এমন সম্পদ, সার্বিক বৈভবের অর্থ একটাই- “ক্রমবর্ধমান কনসিউমারিজম, ক্রিমানালাইজেশন, করাপশন”। এই অবস্থায় মানুষ তার ‘inner certainty’ হারিয়ে ফেলে। অথচ অন্তরের অন্তরতম শক্তিটাই তার ধর্মবোধের স্বরূপ। সেই তাকে চালনা করে। আজ চারদিকে দেখা যাচ্ছে হিংসার ছড়াছড়ি। এমন কি ধর্মযাজক, ধর্মগুরু, ধর্মতত্ত্ববিদ সবাই হিংসা, হিংসাত্মক আচরণ, সন্ত্রাস স্বাচ্ছন্দে চর্চা করে যেতে পারে। ধর্মগুরুরাও হিংসা অনুমোদন করেন। অনেক সময় তাদের দেখলে বোঝা যায় তাদের হিংসা করার দরকার হয় না। কারণ, তারা নিজেরাই হিংসার আগুন হয়ে উঠতে পেরেছে। তারা হিংসা পরিকীর্ণ করে দিচ্ছে।