লেখকঃ পলাশ পাল

বাঙালি রোমান্টিসিজম বিলাসী। বীরপুজো করেও আত্মতৃপ্তি লাভ করতে ভালোবাসে। তাতে আপাতদৃষ্টিতে কোনো ক্ষতি নেই, যদি-না তা ইতিহাসের গতিকে পিচ্ছিল করে। ঔপনিবেশিক শাসনকালে ইতিহাসের ওই পিচ্ছিল পথেই আর্বিভাব হয়েছিল সিরাজোদ্দৌলার। একজন অকর্মন্য শাসক বাঙালির কাছে স্বাধীন, নির্ভীক, দেশপ্রেমিকের গৌরবজনক সম্মান পেলেন। তাকে নিয়ে লেখা হয়েছে ভুরি ভুরি বীরোচিত আখ্যান। যা পড়ে বাঙালির হৃদয় বিগলিত হয়। অথচ বাস্তবে সিরাজের এই সম্মান মোটেই প্রাপ্য ছিল না। তাঁর অপদার্থতা, কুপমন্ডুকতা ইতিহাসের পাতায় লুকিয়ে থাকলেও বাঙালি তাকে পাশ কাটিয়ে যেতেই অধিক পছন্দ করে। যুক্তি ও বাস্তবতা নয়, আখ্যানের ট্রাজেডিক কাহিনিতে সে ডুব মেরে রয়েছে। ব্রিটিশ চলে গেছে, মিরজাফরের বংশ নিশ্চিহ্ন। তবু এই রোমান্টিসিজম থেকে বাঙালির বেরিয়ে আসার কোনো লক্ষণ নেই।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে সিরাজের কোনো তুলনাই খাটে না। তিনি প্রকৃত অর্থেই জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেমিক এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম কান্ডারি। ভারতবাসীর কাছে তাঁর স্থান হিমালয় সদৃশ্য। তাঁর আদর্শ, মুল্যবোধ, রাজনৈতিক ভবনা ও কর্মকান্ড চিরকাল কোটি কোটি মানুষকে অনুপ্রাণীত করবে। যদিও তার সমগ্র রাজনৈতিক জীবন বিতর্কের উর্ধ্বে নয়, অক্ষশক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে তিনি কতটা দুরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন, সেটাও আরেক বিতর্ক। ইতিহাসের সে বিচার এখনো অসমাপ্ত। সে দিকে যাচ্ছি না। সে হবে অন্য কোথাও।
তিনি তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় সত্যি নিহত হয়েছেন কী-না তার সত্যতা যাচাই করা জরুরী ছিল। কিন্তু তা করতে গিয়ে স্বাধীন ভারতে তাকে নিয়ে যে সমস্ত কাল্পকাহিনির সৃষ্টি হয়েছে তার কোনো ঐতিহাসিক গুরুত্ব নেই, অন্তত ইতিহাসের বিচারে। কেউ তাকে সন্যাসী বানিয়েছে, কেউ বা চিহ্নিত করেছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া বিপ্লবের নেপথ্য নায়ক। তামিলনাড়ুর এক বিধায়ক তো বলেছিলেন—‘নেতাজির সঙ্গে তার নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ হয়’। কখনো শোনা গেছে তিনি নাকি রাশিয়ার জেলে বন্দি কিংবা মঙ্গোলিয়ায় আত্মগোপন করে আছেন। বাঙালির একজন জনপ্রিয় আধ্যাতিক গুরু সদর্পে চ্যলেঞ্জ করেছিলেন—‘নেতাজি বেঁচে আছেন, নেতাজি নেতার বেশেই ফিরবেন’। গত শতাব্দীর গোড়ার দিকেও এই নিয়ে যত্রতত্র দেওয়াল লিখন দেখা যেত। সন্যাসী সারদানন্দ, ভগবানজী বা গুমনামি বাবার কথা না হয় বাদ দিলাম। বাঙালির বয়স বেড়েছে, কিন্তু নেতাজির বয়স বাড়াতে তাদের ঘোর আপত্তি।
কখনো আবার শোনা গেছে, প্লাস্টিক সার্জারি করে নেতাজি তাঁর চেহারা আমূল বদলে ফেলেছেন। একজন তো কাটা হাত-পা-মুণ্ডুর ছবি লাগিয়ে তৈরি করেছিলেন এক নতুন নেতাজির ছবি। আজকাল নানা টিভি চ্যানেলে নানা রকম আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক, ভিডিও দেখা যায়। সেরকম একটি চ্যানেলে এক অজ্ঞাত পরিচয়হীন ব্যক্তিকে নেতাজি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এরকমই একজন ব্যক্তিকে ঘিরে নানা রহস্য দানা বেধেছিল। তার চেহারার সঙ্গে নাকি নেতাজির অদ্ভুত মিল। নেতাজি দুহিতা অনিতা পাফ একবার ওই ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করেছিলেন। আধুনিক বিজ্ঞানের দৌলতে মানুষের আসল চেহারার অনেকটাই বদলে ফেলতে পারে। কিন্তু উচ্চতার রাতারাতি পরিবর্তন একেবারেই সম্ভব নয়—বলেছিলেন অনিতা পাফ। কেননা নেতাজি হিসাবে দাবি করা ওই উন্মাদ ব্যক্তিটি নাকি প্রকৃত নেতাজির চেয়ে অনেকটা লম্বা ছিলেন।
নেতাজি অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে গঠিত তিনটি কমিশনের দুটি (শাহনেয়াজ ও খোসলা কমিটি) বিমান দুর্ঘটনাকে সত্যি বলে মেনে নিয়েছে। একমাত্র চন্দ্র বসু বাদ দিয়ে নেতাজি পরিবারও এই ঘটনার সত্যতা মেনে নিয়েছিলেন। দুর্ঘটনায় পড়া অভিশপ্ত সেই বিমানের চালক একই কথা জানিয়েছিলেন। হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স থেকে শুরু করে প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানও অভিন্ন হয়নি। নেতাজির সঙ্গী ও দেহরক্ষী হাবিবুর রহমান ও দোভাষী নাকামুরার ভাষ্য একই। একই মত নেতাজির ভ্রাতষ্পুত্র ইতিহাসবিদ সুগত বসু সহ অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের। সম্প্রতি একটি ব্রিটিশ ওয়েব সাইট-ও একই দাবি করে বলেছে যে—১৯৪৫ সালের ১৮ আগষ্ট রাত এগারোটা নাগাদ তাইহোকুর নানমোন মিলিটারি হাসপাতালে বিমান দুর্ঘটনার কারণে নেতাজির মৃত্যু হয়।
যদিও তাইহোকুর বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন, এমন বিশ্বাসী-গবেষকের সংখ্যাও কম নয়। গবেষক জয়ন্ত চৌধুরী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী শোভললাল দত্তগুপ্তর মতো পণ্ডিতেরা প্রশ্ন তুলেছেন দুর্ঘটনার সত্যতা নিয়ে। মুখার্জী কমিশন বিমান দুর্ঘটনার খবরের সত্যতা না মানলেও নেতাজিকে নিয়ে ওইসব অখ্যানে কান দেয়নি। বিরল ব্যতিক্রম কিছু রোমান্টিসিজম বিলাসী বাঙালি, যারা কীনা যুক্তি বা প্রমান নয়, বিশ্বাসকেই ইতিহাস রচনার মূল ভিত্তি বলে মনে করেন।
রোমান্টিসিজম, আবেগ কিংবা বিশ্বাস দিয়ে ইতিহাস রচনা সম্ভব নয়। ইতিহাস নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করা, আর ইতিহাসচর্চাও সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। ইতিহাসের প্রয়োজন পর্যাপ্ত তথ্য, প্রমান ও তার চুলচেড়া বিশ্লেষণ। নেতাজিও যে আর পাঁচজনের মতো রক্ত-মাংসের মানুষ ছিলেন সে কথা ভুলে গিয়ে তাকে দেবতা হিসাবে পুজো করলে, তা যাই হোক, ইতিহাস নয়। বড়োজোর আখ্যান বলা যেতে পারে।
কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকার নেতাজি সংক্রান্ত ৬৪টি ফাইল প্রকাশ করেছে। আগামি ২৩ জানুয়ারী নেতাজির জন্মদিনে কেন্দ্রও নেতাজি সম্পর্কিত কয়েকটি গোপন নথি প্রকাশ করবে–এমনটাই শোনা যাচ্ছে। তবে রাজ্যের মতো সেও যে একটা অশ্বডিম্ব প্রসব করবে তা হলফ করে বলা যায়। কেননা, ও পথ যে রাজনীতির। ভোট আসছে, তাই নেতাজি নামক ঢাকের বাদ্যি আরো চড়া হবে। ভোটের বাজারে নেতাজির অন্তর্ধান আজো মহা মূল্যবান। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো বলেই দিলেন, ‘তাইহোকুর বিমান দুর্ঘটনা তিনি মানতে পারেন না’। তাই সে কথা ভিন্ন। রাজনীতির ময়দানে এ বিতর্কের সমাধান নেই। তবে হুজুগে বাঙালি এই ফাইল, বিতর্ক থেকে সত্যিকারের ইতিহাস খুঁজতে আগ্রহী হবে নাকি আবার নতুন কোনো অখ্যানের জন্ম দেবে আশঙ্কার কারণ সেটাই। কথায় যে বলে—বিশ্বাসে মিলায় সুভাষ, ইতিহাসে নয়।
মন্তব্যঃ লেখাটি মুক্তমনার জন্য কতটা উপযুক্ত, পাঠকদের কাছে কতটা আকর্ষণীয় হবে জানি না। তবু নিজের কিছু ভাবনাকে ‘মুক্তমনা’ বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে নেবার জন্য এই চেষ্টা।