মুক্তিযুদ্ধকালে নির্বাসিত লেখকদের বত্রিশটা বই নিয়া ৭২-এ মুক্তধারার হাতে যে একুশে বইমেলার সূচনা; মুক্তবুদ্ধি চর্চার কালে সেই মেলা কি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে মুক্তমনা লেখক-প্রকাশকগো নির্বাসন দিয়া?

০২
বইমেলারে বাংলা একাডেমি কোনোদিনও আপদ ছাড়া কিছু ভাবে নাই। তাগো ঝিমাইন্না আরামের সরকারি জীবনে এই বইমেলার লাইগা বচ্ছরে দুই আড়াইমাস থাকতে হয় দৌড়ের উপর। মেলা শুরুর আগে মন্ত্রী-আইজিপি আইসা মিটিং করে; ভার্সিটি নেতারা দেন দরবার করে; কর্পোরেট দরদাম করে; প্রকাশকরা চিল্লাফাল্লা করে; আরো কত্ত কি ঝামেলা….

তাও না হয় হইল। সামলানো গেলো। কিন্তু এই মেলাটা শুরু হয় রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা প্রধানমন্ত্রীর হাতে। বচ্ছরে অন্তত একবার রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা প্রধানমন্ত্রীর লাইগা বাধ্যতামূলকভাবে অনুষ্ঠান করার ঝামেলা খুব কম সরকারি প্রতিষ্ঠানেরই আছে। প্রধানমন্ত্রী আসা মানে ফেব্রুয়ারির আগেই সমস্ত ঝুট ঝামেলা সামলাইয়া অন্তত কয়েকটা দোকানের লগে নিরাপত্তা পানি টয়লেট ফায়ার ব্রিগেড জলছাদ বাতি ইত্যাতি সব কিছু একটু একটু কইরা সাজাইয়া ফেব্রুয়ারির পয়লা দিনই দেখাইতে হয় অথবা রিপোর্ট করতে হয় যে সবকিছু ঠিকঠাক আছে। তার উপরে ডেলি ডেলি বিদ্যা শিক্ষা সাহিত্য বিষয়ে বক্তৃতা দিবার লাইগা বুদ্ধিজীবীগো ডাইকা আনা আর ঢোল তাল করতাল বাজাইয়া গানের লাইগা শিল্পী রেডি রাখার লগে লগে চুল দাড়িতে কলপ দিয়া চেহারা মাঞ্জা মইরা ডেলি ডেলি হাসিখুশি থাকতে হয় সাক্ষাৎকারের লাইগা…

অবশ্য প্রধানমন্ত্রী আসলে যেমন কাজকর্ম দেখেন। তেমনি তিনারে পাইলে নিজের কৃতিত্বও দেখান যায়। খারাপ না। উদ্বোধনীর দিন পর্যন্ত মোটামুটি বইমেলাটা একটা সরকারি প্রগ্রাম হিসাবে ভালোই চালাইয়া নেওয়া যায়। কিন্তু উদ্বোধন কইরা প্রধানমন্ত্রী চইলা যাবার লগে লগে পুরা বাংলা একাডেমিটা হইয়া পড়ে পাব্লিক প্রপার্টি। লেখকরা আসে। লিটল ম্যাগাজিন আসে। আসে কলম-ক্যামেরা মাইক্রোফোন নিয়া হাজারে হাজারে সাংবাদিক। এরা আবার বাংলা একাডেমিরে যেমন সরকারি দপ্তর হিসাবে পোছে না তেমনি কর্মকর্তাগোও দিতে চায় না ন্যায্য সরকারি প্রটোকল। প্রকাশ্যে চিল্লায়- এত ধুলা ক্যান? রাস্তা এত চিপা ক্যান? পানি নাই ক্যান? পেশশাবের জায়গা এরম ক্যান? রাস্তায় দোকান ক্যান? মেলার মইদ্যে কর্পোারেট ক্যান ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি…

মাসের প্রতিটা দিন; দেশের সবগুলা পত্রিকায় টিভিতে কমপক্ষে আট-দশটা সংবাদ প্রচার হওয়ার মতো আর কোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আছে বাংলা একাডেমি ছাড়া? নাই। নিশ্চিত নাই। তারপরেও আগে পত্রিকা আর সাংবাদিক আছিল হাতে গোনা। সাংবাদিকগো বসেরে তেলাইয়া বহু কিছু চাইপা যাওয়া যাইত। কিন্তু এখন তো আবার হাতে হাতে মোবাইল ক্যামেরা আর ইন্টারনেট কানেকশনে সকল জনতাই সাংবাদিক। এই দিকে ক্লিক কইরা ছবি তোলে তো তিন সেকেন্ডের মইদ্যে ছাইড়া দেয় ইন্টারনেটে। সেইখান থাইকা সেই সংবাদ নিয়া সাংবাদিক করে রিপোটর্; মন্ত্রী করে ফোন- ডিজি সাব। এইগুলা যে ঘটে দেখেন না আপনে?

তো ডিজি সাব তো আর সবকিছু নিজের চোখে দেখেন না। দেখেন বহু বহু পাতি সাবের চোখে। তো সােেথ সাথে তিনিও ঝাড়ি লাগান পাতিগো ডাইকা- এইসব কেমেন ঘটে এইখানে…

তার উপ্রেও আছে বহুত বিপদ। ব্যারাক থাইকা আইসা হুসেন মোহাম্মদ এরশাদ যখন সকল কিছুর কর্তা হইয়া উঠলেন বাংলাদেশে। তখন আমলারা পড়লেন খুবই বিপদে। নতুন বস কী করলে খুশি হন আর কী করলে হন না তা তারা বুইঝা উঠতে পারতাছিলেন না প্রথমে। তখন তারা শুনলেন এক নতুন সংবাদ। বসে কিন্তু কবিতার লাইগা এক্কেবারে মাই ডিয়ার মানুষ। কবিতা যেমন লেখেন তেমনি কবিগোরে বহুত খাতিরও করেন তিনি। তো আহমদ ছফার ভাষ্য অনুযায়ী তখন নাকি আমলাগণ সচিবালয়ে শুরু করলেন সাহিত্য চর্চার সংস্কৃতি। রাইতে বইসা কবিতা লেখেন আর দিনে সবাইরে ডাইকা শোনান সে কবিতা। আর চামে চামে চান্সে থাকেন পকেটে কবিতা নিয়া জীবনে অন্তত একবার বসের হুজরায় দর্শন দিবার…

এরশাদ সাব গেছে গা। কিন্তু তার সেই সংস্কৃতির উত্তরাধিকার কিন্তু এখনো রইয়া গেছে। এরশাদ যুগের ছোট আমলারা কিন্তু এখন প্রশাসনের মাথা। ছুটু মানুষ বইলা সেইকালে নিজের লেখা কবিতা বিশেষ কাউরে দেখাইতে না পারলেও একদিন না একদিন দেখাইবার আশায় অব্যাহত চর্চা কইরা যাইতে যাইতে তাগো অনেকেই এখন রীতিমতো লেখক। তিনারা লিখতেই আছেন। আর প্রকাশকরাও তিনাগো বর্তমান পদবীর মূল্য ও মূল্যমান নির্ধারণ কইরা বাড়ি থাইকা পা-ুলিপি আইনা প্রতি বছর দুই তিনটা বই নামায়ে ফালায়। ঝামেলাটা অবশ্য সেইখানে না। ঝামেলা হইল এইসব স্যার লেখকরা তো বিনা নোটিশেই আইসা হাজির হন বইমেলায়; মোড়ক উন্মোচন- টিভি সাক্ষাৎকার কিংবা অটোগ্রাফ প্রদান অনুষ্ঠানে। কিছু কিছু মন্ত্রীও কিন্তু আইসা হাজির হন ধাক্কা মারি ফুলের টবে’ টাইপের কবিতার বইয়ের উদ্বোধনে…

তিনারা আসেন কিন্তু না জানাইয়া। কিন্তু আইসা আশা করেন সরকারি প্রটোকল। অমুক নাই কেন। তমুক কই গেল ডট ডট ডট। তিনাগো প্রশ্নের ঠিকঠাকমতো উত্তর দিয়া অনুষ্ঠান শেষে অফিসে নিয়া চা খাওয়াইতে না পারলে আবার পরের দিন শুনতে হয় অফিসিয়াল সরকারি ধমক…

বাংলা একাডেমি বহুবারই চাইছে বইমেলার ঝামেলাটা সরাইয়া ফালাইতে। কিন্তু দেয় নাই পাব্লিক। কয়- এইটা বাংলা একাডেমিতেই শুরু হইছে বাংলা একাডেমিতেই থাকব। আরে বেটা এইটা কি বাংলা একাডেমি শুরু করছিল? শুরু তো করছিল চিত্তরঞ্জন; বাংলা একাডেমির মাঠে চট বিছাইয়া কয়েকটা বই নিয়া। তখন কি আর বুঝতে পারছিলাম যে একটা চট বিছাইয়া সে পারমানেন্টলি বাংলা একাডেমিরে বচ্ছরে পুরা একমাস দখল কইরা রাখব?

এখন অবশ্য সেই প্রসঙ্গ তুললে মাইর খাওয়া ছাড়া কোনো গতি নাই। কারণ সেই এক টুকরা চট দিয়া বহু কিছু প্যাচাইয়া ফালাইছে চিত্তরঞ্জন। স্বাধীন দেশে পয়লাবারের মতো সে বসছে মুক্তিযুদ্ধ কালে নির্বাসিত লেখকগো বই নিয়া; সেইটা একটা পয়েন্ট। বইগুলার প্রকাশক হইল স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ; সেইটাও একটা পয়েন্ট। তো বেডা যদি স্বাধীন বাংলার বই নিয়া মার্চ কিংবা ডিসেম্বরে বসত কোথাও তাইলে কিন্তু ঝামেলা অত দূর যায় না। কিন্তু না। প্যাচটারে আরেকটু পাকাইবার লাইগা স্বাধীন বাংলার লগে ভাষা আন্দোলনটারেও গিঠটু মাইরা দিয়া চাটাই বিছাইয়া বসল ফেব্রুয়ারি মাসে। নাম একুশে বইমেলা। হইলনি? এইবার আর কতা কওয়ার জায়গা থাকল কিছু? হয়ত তবুও আছিল কিছু। বস্তি উচ্ছেদের মতো তার ছেড়া চাটাইয়ের বইমেলা উচ্ছেদ কইরা টিএসসিতে পাঠানো কোনো সমস্যা আছিল না। কিন্তু ৭৮ সালে আবার চিত্তরঞ্জনের চাটাইয়ের বইমেলারে মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী কইরা ফালাইলেন বাংলা একাডেমির অংশ। আশরাফ সিদ্দিকী তো আর আমলা আছিলেন না; তাই বুঝেন নাই আমলাগো যন্ত্রণা। এবং তারপরেই শুরু হইল এই গর্দিশ। এই বইমলো ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি অম্লান রাখতে শুরু। এই বইমেলা স্বাধীনা আর মুক্তিযুদ্ধের ঐহিত্য। এই বইমেলা বাংলা একাডেমির দায়িত্ব…

মর হালা। সকল আমলা কাগজেপত্রে পাবলিক সার্ভেন্ট হইলেও বাংলা একাডেমির মতো সত্যি সত্যি এক মাসের লাইগা পাব্লিক সার্ভেন্ট বোধহয় আর কোনো সরকারি কর্মচারি হয় না। পুরা একটা মাস বাংলা একাডেমি থাকে পাব্লিকের দখলে। সরকারি চাকরি কইরা পুরা জাতির ঐতিহ্য বজায় রাখা যে কী কাম সেইটা একমাত্র বাংলা একাডেমি জানে…

চামে চুমে তাই বাংলা একাডেমি বহুবারই চাইছে বইমেলাটা নিজের ঘাড় থাইকা বিদায় করতে। পারে নাই। না পাইরা তারা মেলারে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নœভাবে বারোয়ারি বানাইয়া চেষ্টা করছে মেলাটারে যাচ্ছে তাই কইরা দিতে। ক্যাসেট মেসেটা হাবিজাবি বহুত কিছুর দোকান ঢুকাইছিল তারা বইমেলায়…। ডিসেম্বর মাসে ঢাকা বইমেলা নাম দিয়া অন্য ভেনুতে আরেকটা বইমেলা কইরা সরকারি ভাবে চাইছে একুশে মেলার জমজমাটি কমাইয়া দিতে। কিন্তু কেউ পাত্তা দেয় নাই। ঢাকা বইমেলা মরছে। তার ঠিক একমাস পরে একুশে মেলা ঠিকই বাড়াইছে তার ভীড়। কারণ একুশে মেলার ভীড় খালি বই বিক্রি আর বই কিনার ভীড় না। এই ভীড় ঐহিত্য সন্ধানী মানুষগো দেখা সাক্ষাতের ভীড়। এই ভীড় বছরে একবার লেখকগো আড্ডা দিবার কিংবা পরস্পর পরিচিত হইবার ভীড়। এই ভীড় লেখকগো দেখার লাইগা বছরে একবার পাঠকগো ভীড়। আর তাই বাংলা একাডেমি বইমেলাটারে বন্ধ করতে পারে নাই…

অবশেষে বিএনপি সময়ে জিয়ার ছবিওয়ালা ত্রিশটা আর মুজিবের ছবিওয়ালা দুইটা স্টল; এবং আওয়ামীলীগ সময়ে মুজিবের ছবিওয়ালা ত্রিশ আর জিয়ার ছবিওয়ালা দুইটা স্টল; সব আমলেই কিছু এনজিও; কিছু সরকারি দপ্তর আর সর্বযুগে নিজে বইসা নিজের ছবি ছাপাইন্না পোস্টারে চুল ঝাকানিসহ অটোগ্রাফ দিয়া বিক্রি করার লাইগা ফকির আলমগীররে একটা স্টল বরাদ্দ দিয়া বাকি স্টলগুলাতে মোটামুটি প্রকাশকগোই বই নিয়া বসতে দিত বাংলা একাডেমি। অবশ্য বাইরের রাস্তার দোকানগুলা আলাদা বাণিজ্য…

মেলায় ঢোকার লাইগা টিকিট সিস্টেম কইরা টাইট দিতে না পারলেও অবশ্য ধীরে ধীরে বহুত কিছু তারা টাইট দিয়া দিছে। বইমেলার সবথিকা বেয়াড়া প্রাণী হইল লেখক আর লিটল ম্যাগাজিনের লোকজন। তারা মেলায় আসে সব থিকা বেশি; আড্ডা দেয় বেশি; চিল্লায় বেশি কিন্তু পোছে না কিছুই। যেখানে সেখানে বইসা যায় ভক্তগো নিয়া। যেখানে সেখানে গিয়া উন্মোচন করে বইয়ের মোড়ক। গাছতলায় ছাপড়া বিছাইয়া বিক্রি করে লিটল ম্যাগাজিন আর করে হাউ কাউ…

কর্পোরেট ভাইয়েগো সহায়তায় মেলাতে চিড়িয়াখানর খাচার মতো একটা লেখককুঞ্জ বানাইয়া লেখকগো ঢুকাইতে না পারলেও কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনরে আটকাইয়া দিছে কফিনের মাপে স্টলের ভিতর। আগে ম্যাগাজিনগুলা ভাগাভাগি কইরা জারুলতলায় বসত। একটা দুইটা খাট ভাড়া কইরা আইনা বসত ভাগেজুগে সবাই। সেইখানে ম্যাগাজিন যেমন থাকত তেমানি থাকতো তরুণদের বই। তার থাইকা বেশি থাকত তরুণ লেখকগো আড্ডা। সেইসব স্টলে বসত সবাই। কার স্টল কে মালিক দেখত না কেউ। এই জারুলতলাটাই মূলত আছিল বাংলাদেশের তরুণ লেখকগো বইমেলায় আসার মূল আকর্ষণ। সারা বচ্ছর পয়সা জমায়ে ফেব্রুয়ারিতে প্রায় সব তরুণ লেখকরাই ঢাকায় আইসা হোটেলে থাইকা এই জারুলতলায় আড্ডা দিত দশ বারো দিন। সারা বাংলাদেশের এক তরুণ লেখকের সাথে আরেক তরুণ লেখকের পরিচয়ের প্রধান মাধ্যমটাই আছিল বইমেলার এই জারুল তলা…

একদম চুপচাপ সেই জারুলতলাটারে ভাইঙা দিলো বাংলা একাডেমি। সিস্টেম কইরা দিলো যে সব লিটল ম্যাগাজিন মেলায় বসতে চায় তাগো আগে আবেদন করতে হইব টেকা পয়সা দিয়া। আর আবেদনের পরে দেখা যায়; জারুল তলারে মাটি দিয়া ঘিরা তার আশেপাশে কফিন সাইজের কয়েকটা স্টল বানাইয়া একেকটা ম্যাগাজিনের নাম লেইখা লটকাইয়া রাখছে বাংলা একাডেমি। মানে তোমার কব্বরে তুমি ঝিমাও; অন্য দিকে নজর দিবা না…

এই চত্বরটা এখন একটা ভূতুড়ে পাড়া। কোনো স্টলে কিছু ম্যাগাজিন আছে; কোনো স্টলে একটা; কোনো স্টলে বসার কেউ নাই। কারণ লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক তো আর ভাড়া করা লোক রাখতে পারে না স্টলে। আগে তো দোস্তরাই পালা কইরা বসত। এখন দোস্তের দোকান তো বিশহাত দূরে। মাঝখানে আরো দশটা স্টল। … তো? তো আর কি? লিটল ম্যাগাজিনরে কফিনে ঢোকাইবার পর আস্তে আস্তে সেই ভীড়টা কমতে আছে। আশা করা যায় আর কয়েক বছর পরে লিটল ম্যাগাজিনের স্টল চাইব না কেউ। তখন এই জায়গাটা এনজিওগো দিয়া বেশ কিছু ভাড়া পাওয়া যাবে…

লেখকগো আরেকটা বিকট ঝামেলা আছিল মোড়ক উন্মোচন। যেইখানে সেইখানে দোস্তবন্ধুগো ডাইকা তারা মোড়ক উন্মোচন করত নিজের বইয়ের। সেইটার একটা ভালো সুরাহা হইছে। বাংলা একাডেমির যে গাছতলায় কবি নজরুলের একটা থ্যাবড়ানো এবং সোনালি রংয়ের মূর্তি আছে; সেই গাছের গোড়া কয়েক ফুট সিমেন্ট দিয়া বান্ধাইয়া একটা উচু মঞ্চ বানাইছে তারা। সেইটার নাম নজরুল মঞ্চ। বইমেলায় এখন আইনত সব ধরনের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করতে হয় সেইখানে। লাইন ধইরা। আলোচকরা থাকেন মঞ্চে। আর দর্শক হইল নীচ দিয়া হাইটা যাওয়া মানুষ। এই মঞ্চে উন্মোচিত না হইলে কোনো বইয়ের সংবাদ প্রচার করে না বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্র। তো লেখকরা এখন মিডিয়া কাভারেজের লাইগা সেইখানেই গিয়া উঠেন…

২০০৮ সালেই মহাপরিচালক কইয়া দিছেন বইমেলার লাইগা তাগো কাজে ক্ষতি হয়। এইটা সরানো দরকার। কিন্তু মেলাটারে এক্কেবারে সরাইতে না পাইরা বাংলা একাডেমি ধীরে ধীরে সরানোর পায়তারা করছে এখন। দুই হাজার ১৪তে পরীক্ষামূলকভাবে তারা অর্ধেক মেলা একাডেমিতে রাইখা অর্ধেক সরাইয়া দিছিল উল্টা দিকের সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে। তাগো দোহাই আছিল যে পুরানা দালানে তাগো জায়গা হয় না তাই মাঠের মাথায় তারা নতুন দালান তুলতে আছে। জায়গা কম। তাই মেলার অর্ধেক গেছে বাইরে। আহারে। যেই দেশে শহরে শহরে বচ্ছরে মাত্র দুইদিন ব্যবহার করার লাইগা বড়ো বড়ো ঈদগা মাঠ রাইখা দেওয়া হয়। সেই দেশে পুরা একমাসের একটা মাত্র একুশে বইমেলার মাঠ দখল কইরা বানাইতে হয় দালান…

২০১৫ সালে তারা মেলাটারে পুরা দুইভাগ কইরা ফালায়। একাডেমিতে থাকে নিজেগো স্টল; চিত্তরঞ্জনের মুক্তধারা; এনজিও; সরকারি প্রতিষ্ঠান। আর বহু বহু দূরে উদ্যানের মাথায় বইমেলা। বাংলা একাডেমি আর মেলার মাঝখানে উন্মুক্ত প্রান্তর; খাবার দোকান; চাইনিজ খেলনা হাজিবাজি সব। মেলা তো মূলত দুইটা। লিটল ম্যাগাজিনরে এক্কেবারে আলাদা কইরা দিল লেখক আর পাঠকগো থাইকা- গাছতলায় থাকতে চাইছিলা তাই তোমাগো মনুষ্যবিহীন গাছতলাতেই কফিন বানাইয়া দিলাম। থাকো…

এইসব বিষয়ে আপত্তি থাকলেও যেহেতু আমাগো বিকল্প কিছু নাই সেহেতু মিনমিন কইরা মাইনাই নিছে সবাই। কিন্তু হঠাৎ একদিন ২০১৫’র মেলায় সক্কলে দেখে একটা স্টলের ঝাপটি বন্ধ কইরা সামনে পুলিশ বইসা আছে। বন্ধ স্টলের সামনে কাগজের একটা নোটিস- রোদেলা প্রকাশনী/স্টলটি বন্ধ করা হলো/-বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ।’ কারণ কী এইটা বন্ধ করার?

কারণ বর্ণনা পাওয়া গেলো পত্রিকায়। কারণ হইল রোদেলা একটা বইয়ের অনুবাদ প্রকাশ করছে। মোল্লারা কইছে বইটাতে ইসলাম ধর্মের অপমান আছে। আর সেইটা শুইনা বাংলা একাডেমি স্টল বন্ধ কইরা সামনে বসাইয়া দিছে পুলিশ। যখন তিনাগো জিগানো হইল স্টলটা কেন বন্ধ করলেন? উনারা কইলেন বাংলা একাডেমির ২০১৫ সালের নীতিমালা বিরুদ্ধ বইলা। …যখন জিগানো হইল বইটা আপনারা পড়ছেন? উত্তর হইল- না। আমরা খালি শুনছি…

শুইনা তিনারা খালি রোদেলার স্টল বন্ধ কইরা ক্ষ্যান্ত দেন নাই। পরের বছরের লাইগাও মেলা থাইকা রোদেলারে নিষিদ্ধ করছেন। তার থাইকা বড়ো কথা হইল বইটা কিন্তু স্টলে আছিলই না। মোল্লাগো হুমকির মুখে রোদেলার প্রকাশক রিয়াজ খান আগেই বইটা সরাইয়া ফালান স্টল থাইকা। অথচ বাংলা একাডেমি কইল স্টলে বই রাখার অপরাধে তারা বন্ধ করছে রোদেলার স্টল; কিন্তু তারা তো স্টলে তদন্ত করে নাই। তদন্ত কইরা বই পাইলে একটা কথা আছিল। কিন্তু কথা হইল তদন্ত কইরা বই বাইর কইরা কিছু করতে গেলে তো বইটা পইড়া সালিশ করতে হইত। সেই সালিশে রোদেলার প্রকাশকরেও কিছু কইতে দিতে হইত। আর প্রকাশকরে সালিশে কথা কইতে দিলে তো সে দিত যুক্তি। কিন্তু বাংলা একাডেমি তো যুক্তির থাইকা বিশ^াসের দাম দিতে চায় বেশি। তাই তারা স্টলটা বন্ধ কইরা দিছে- বই রাখার অপরাধে। অথচ তারা স্টলটা বন্ধ করছে মূলত বইটা প্রকাশের অপরাধে; যেই অপরাধের শাস্তি দিবার অধিকার মোল্লাগো যেমন নাই; বাংলা একাডেমিরও নাই। এই বিষয়ে কথা বলার একমাত্র অধিকার আদালতের…

বাংলাদেশে বইয়ের বিরুদ্ধে; লেখকের বিরুদ্ধে মোল্লাগো আন্দোলন প্রতিবাদ তো নতুন কিছু না। সেই যে কবি দাউদ হাদার দিয়া শুরু। বাংলাদেশে বই নিষিদ্ধও তো নতুন কিছু না। কিন্তু সেটা করছে আদালত কিংবা সরকারি অফিস আদেশ। কিন্তু বাংলা একাডেমির এই উদ্যোগ তো নতুন। মোল্লাদের কাছে নাস্তিক খেতাব পাওয়া বহু লেখকের বইতো এর আগে বইমেলায় গেছে। আরজ আলী মাতুব্বর- আহমদ শরীফ- হুমায়ুন আজাদ- তসলিমা নাসরিন ইনাদের বইতো এখনো মেলায় বিক্রি হয়। বাংলা একাডেমিরে তো এর লাইগা কোনো স্টল বন্ধ করতে দেখি নাই?

আর বাংলা একাডেমি ২০১৫ নীতিমালা। এইডা কী? এইটা কি নতুন নীতিমালা? বাংলাদেশে এক সাবেক কমিউনিস্ট শিক্ষামন্ত্রী হইবার পর স্কুল শিক্ষাে মোটামুটি মাদ্রাসা শিক্ষায় পরিণত কইরা ফালাইছন। আগে প্রাইমারি ইস্কুলের বাচ্চাগো সমাপনী যোগ্যতার তালিকায় বলা আছিল ৫ বছর শিক্ষার পর তারা এই পর্যন্ত গণিত পারবে; সেই পর্যন্ত ভাষা পারবে। আর এখন সমাপনী যোগ্যতার এক থাইকা দশ নম্বর পর্যন্ত বলা হইছে ৫ বচ্ছর শিক্ষার পর শিশুরা আল্লার উপর কতখানি বিশ^াস অর্জন করতে পারব তার বিবরণ। তো আরেক সাবেক কমিউনিস্ট হইলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী। যিনার আন্ডারে এই বাংলা একাডেমি। তো বাংলা একাডেমরি ২০১৫ নীতিমালা কইরা কি তিনি তবে বইমেলারে মাদ্রাসা উপযোগী করার চেষ্টায় আছেন? কে জানে হইতে পারে। কারণ মন্ত্রীগো লগে এখন ওলামা লীগ যুক্ত হইয়া দলে আর সরকারে বহুত বৈচিত্র বাড়ছে; বহুবিধ ডিমান্ডও বাড়ছে। তাই মন্ত্রীগোও এখন বহুরে খুশি রাখতে হয়। তার উপরে নতুন বচ্ছরে আবার ইসলামি ঐক্য জোট আইসা লাইনে খাড়াইছে। অন্যদিকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনি এখন আর দেশে কোনো জঙ্গি খুইজা পায় না। তারা যেন কোথায় মিলাইয়া গেছেগা হঠাৎ…

আমাগো প্রধানমন্ত্রীর কৌশলটা কিন্তু দারুণ। দেশরে ইসলামিকরণের লাইগা তিনি বাইছা নিছেন সব সাবেক কমুনিস্টগো। কমুনিষ্ট হইতে গিয়া যেহেতু ইনাগো ধর্মটর্ম বিসয়ে বিস্তর পড়াশোনা করতে হইছে; সেইহেতু দেশরে ধার্মিক করার লাইগা মূলত ইনাগো মতো এলেমদার লোক আর নাই। তাই ইনাগো একজনে শিক্ষারে ইসালামি বানায় তো আরেকজন বানায় সংস্কৃতিরে। অন্যদিকে দুই গৃহপালিত আলহাজ¦ বামপন্থী গিয়া টিভিতে টকশো করে- ইসলাম ও শেখ মুজিব…

০৩
জাগৃতির নিহত প্রকাশক ফয়সর আরেফিন দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক ঘোষণা দিয়েছেন জাগৃতি ২০১৬’র বইমেলায় যাবে। তিনি এও পরিষ্কার জানায়ে দিছেন যে জাগৃতি আগে যে ধরনের বই করত; সেই ধরনের বইই প্রকাশ করবে এবং সেইগুলা নিয়াই বইমেলায় যাবে। কিন্তু বাংলা একাডেমরি হুজুর ছাহেবানরা কি এই পিতারে জাগৃতি নিয়া মেলায় যাইতে দিবেন? আর যাইতে দিলেও অভিজিৎ রায়ের বইগুলা কি স্টলে রাখতে দিবেন তিনারা? একই প্রশ্ন শুদ্ধস্বরের ক্ষেত্রেও। শুদ্ধস্বরও ইচ্ছা করে ২০১৬’র বইমেলায় যাবার। কিন্তু স্টল কি পাওয়া যাবে এইবার? নাকি এইবার তিনারা পত্রিকায় ঘোষণা দিয়া আগাম জানাইয়া দিবেন যে একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬-তে লটারিতে হাইরা গিয়া যারা স্টল পায় নাই তাগো মধ্যে আছে জাগৃতি আর শুদ্ধস্বর নামের দুইখান প্রকাশনা…

আর কিছুই কইবেন না তিনারা। খালি আমরা বুইঝা নিব যা কিছু বুঝার। আমরা বুইঝা নিব যে গত বইমেলা শেষ হইবার দুইদিন আগেই তিনারা জাইনা গেছেন শুদ্ধস্বর আর জাগৃতি নাস্তিকগো পুস্তক ছাপায়। আর ৩১ অক্টোবরের ঘটনার পর আনসারউল্লার দেওয়া বিবৃতি মুখস্থ কইরা তিনারা এখন বইয়ের পৃষ্ঠাসহ বইলা দিতে পারবেন যে অভিজিতের অমুক বইয়ের অমুকখানে নাস্তিকতা আছে। আর সেইসব বই যে অত সালে ছাপাইছে শুদ্ধস্বর আর তত সালে জাগৃতি সেইটাতো সেই বিবৃতিতে অতিশয় স্পষ্টভাবেই আছে। সুতরাং জাগৃতি আর শুদ্ধস্বরের উপর রোদেলা-বিধান আরোপ করায় ধর্মীয় ও সরকারি আইনে কোনো বাধা নাই…

২০১৬.০১.০৮ শুক্রবার

আপডেট ১২ জানুয়ারি ২০১৬

মাত্র জানলাম বইমেলায় শুদ্ধস্বর স্টল বরাদ্দ পেয়েছে। ৩টা স্টল। বাংলা একাডেমিকে ধন্যবাদ। জাগৃতির সংবাদ জানি না। মূল লেখাটা এখনই সংশোধন করছি না। বইমেলাটা হোক; তারপরে না হয় নিজের সন্দেহের জন্য বাংলা একামেরি কাছে ক্ষমা চেয়ে লেখাটা সংশোধন করে দেবো


আপডেট ৩১ জানুয়ারি ২০১৬

অবশেষে ৩০ জানুয়ারি ২০১৫ বইমেলা ২০১৬র প্রস্তুতি বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে করতে গিয়া গত বছর নিহত লেখক প্রকাশকগো ‘স্মরণ’ করতে পারছেন বাংলা একাডেমির টানা তিন বারের মতো মহাপরিচালক শামুজ্জামান খান। তয় কোনো সমবেদনা জানান নাই তিনি। তিনি সেই ঘটনা স্মরণ কইরা হুশিয়ার কইরা দিছেন লেখক প্রকাশকগো- উস্কানিমূলক কিছু নিয়া কিন্তু বইমেলায় যাইয়েন না কেউ। এই কথাটার মানে হইতে পারে দুইটা; (১) উস্কানিমূলক কিছু পাইলে আমরা কিন্তু সবাইরে ‘রোদেলা’ বানাইয়া দিমু। আর (২) উস্কানিমূলক কিছু লিখলে কিংবা প্রকাশ করলে কিন্তু অভিজিৎ অনন্ত দীপন হইতে সময় লাগবে না বেশি…

যদিও ডক্টর গবেষক মহাপরিচালক উস্কানি শব্দটার কোনো সজ্ঞা দেন নাই তবু আমাগো বুঝতে অসুবিধা হয় নাই যে উস্কানি বলতে এইখানে তিনাগো তেতুল হুজুরগো কলিজায় লাগার মতো কিছু বিষয় ইঙ্গিত করছেন তিনি…

কাইল মেলা শুরু হবে। দেখা যাক আর কী আপডেট আসে এই বিষয়ে…

আপডেট ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

৮ ফেব্রুয়ারি সোমবার ২০১৬; বইমেলা চলাকালেই মহাপরিচালক আবারও মনে করাইয়া দিছেন যে বইমেলায় তাগো সমস্যা হয়। মানে
তাগো গবেষণাটনায় ঝামেলা পাকায়। তো মোদ্দা কথা হইল এই ঝামেলা নিজেগো ঘাড় থাইকা সরাইবার লাইগা তিন তিনবারের হ্যাট্রিক মহপরিচালক আবারও খোলসের ভিতর থাইকা কচ্ছপ গলা বাইর করছেন। উনি মইরা যাইবার আগে নিশ্চিত মেলাডারে বাংলা একাডেমি থাইকা বাইর কইরা বায়তুল মোকারামে স্থানান্তর কইরা যাইবেন। সরকারের কাছে তিনার অনেক ঋণ। এখন পর্যন্ত শিল্পকলা-জাদুঘর আর বাংলা একাডেমি; তিন তিনটা প্রতিষ্ঠানে যেমন কেউ মহাপরিচালক হইতে পারে নাই। তেমনি টানা তিন তিনবারের মতো বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকও থাকতে পারে নাই কেউ। এই রেকর্ডটা একমাত্র তিনার। মহান শামসুজ্জামান খানের…

১৫ ফেব্রুয়ারি সোমবার ২০১৬ তে শামসুজ্জামানের বাংলা একাডেমি মেলায় আরেকটা প্রকাশনী; ব-দ্বীপ এর স্টল বন্ধ কইরা দিছে। এইবার একটু কৌশলী তিনারা। পুরা দোষ আর দায় এইবার চাপায়ে দিছেন শাহবাগ পুলিশের উপর। পুলিশ নাকি ধর্মীয় অনুভূতির বিপক্ষ বইপুস্তক থাকায় মেলায় ঢুইকা স্টল বন্ধ কইরা দিছে। প্রশ্ন হইল- পুলিশ সেটা পারে কি না। পুলিশগো কাছে কি সেইটা করার কোনো আদালত আদেশ আছে?

পুলিশ কইছে ফেসবুক থাইকা সংবাদ সংগ্রহ কইরা তারা মেলায় গিয়া স্টল বন্ধ কইরা দিছে। আগের বছর বাংলা একাডেমি কইছিল
তাগো নীতিমালার বাইরে হওয়ায় তারা রোদেলা বন্ধ কইরা দিছে। কিন্তু এইবার পুলিশ কয় ফেসবুকে তথ্য পাইয়া গিয়া তারা মেলায় ঢুইকা স্টল বন্ধ করছে?

এইটা কি পুলিশের করার কথা? নাকি এখতিয়ারে আছে? ঘটনা কিন্তু সেই সরকারি শামসুজ্জামান খান। এইবার তিনি পিছনে থাকবেন সিদ্ধান্ত নিয়া পুলিশ আগাইয়া দিছেন…

আরেকটা সংবাদ হইল; লেখক শামসুজ্জোহা মানিক-কে গ্রেফতার করছে। তিনি ব-দ্বীপের যেমন প্রকাশক তেমনি অভিযুক্ত বইটার লেখক। যদিও একশোটা প্রশ্ন করা যায় যে ওয়ারেন্ট ছাড়া তিনারে কীসের ভিত্তিকে গ্রেফতার করা হইছে। তারপর একদিনে একটু শান্তিও লাগে। যদি না পুলিশের হাতে তিনার ‘ধর্মীয় ক্রস ফায়ারা বা ধর্মীয় হার্ট-এ্যাটাক হয়; তাইলে অন্তত মোল্লাগো চাপাতির কোপ থাইকা বাইচা গেলেন এই সিনিয়র লেখক