লেখকঃ সৌমিত্র
গত ৩১ ডিসেম্বর গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যা মামলার রায় হয়েছে। এ রায়ে চাপাতির দিয়ে আঘাতের জন্য ফয়সাল বিন নাঈম দীপ এবং পলাতক রেদোয়ানুল আজাদ রানার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সেই চাপাতি কিনে আনার জন্য মাকসুদুল হাসান অনিককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং এহসান রেজা রুম্মান, নাঈম ইরাদ ও নাফিজ ইমতিয়াজকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। মুফতি মো. জসীমউদ্দিন রাহমানীর লেখা বই এবং মসজিদের খুতবা হত্যাকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করেছে বলে মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল। তাই দীপ-রানাদের গুরু মুফতি মো. জসীমউদ্দিন রাহমানীকে ‘প্ররোচনার অভিযোগে’ ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
এখন জঙ্গিনেতা মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানীর লেখা ‘উন্মুক্ত তরবারী’ বইতে কি লেখা আছে পড়ে দেখা যাক। “অপারেশনের রোগীকে মলম বা এন্টিবায়োটিক দিলে চলে না। বরং তার একমাত্র চিকিৎসা হল অপারেশন করা। নতুবা উক্ত ক্যান্সারযুক্ত অঙ্গটি অন্য অংশকেও নষ্ট করে ফেলবে। ঠিক তেমনিভাবে নাস্তিক মুরতাদদের ব্যাপারেও শুধু মিছিল-মিটিং, বক্তৃতা-বিবৃতি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। বরং আল্লাহ রসুলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক নির্দেশিত নাস্তিক-মুরতাদ, কবি-সাহিত্যিক ব্লগারদের যথাযথ পাওনা মৃত্যুদন্ডই হচ্ছে চূড়ান্ত শাস্তি। এদের পাওনা শাস্তি চুকিয়ে দিতে প্রয়োজনে যুদ্ধ করতে হবে। এই ব্লগারচক্র মুসলিম জাতির বিরুদ্ধে ইয়াহুদি-খৃস্টানদের গভীর নীলনকশা বাস্তবায়নের এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নেমেছে। এরা আইম্মাতুল কুফর। এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা প্রতিটি মুসলিমের জন্য ফরজ করা হয়েছে। আজকে যারা পাকিস্তান আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ করতে যেতে আগ্রহী তাদের উদ্দেশ্যে বলব আপনাদের এখন আর বিদেশ যেয়ে যুদ্ধ করার প্রয়োজন নেই। বরং আপনাদের প্রতি ফরজ হল আপনার নিকটবর্তী নাস্তিক-মুরতাদ ব্লগার ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা” [১] । আদালতে মুফতি রাহমানী দাবি করেছেন “ব্লগার কী- এর আগে আমি জানতাম না” [২] । তবে এ কথার পর জানতে চাওয়া হল না “তাহলে ২০১৩ সালের মার্চে প্রকাশিত বইতে ‘ব্লগারদের যথাযথ পাওনা মৃত্যুদন্ডই হচ্ছে চূড়ান্ত শাস্তি’ কথাটা কে লিখেছে?”
গত ২৯ ডিসেম্বর নিউইয়র্ক টাইমসে The Imperiled Bloggers of Bangladesh শিরোনামে বিশাল একটা লেখা ছাপানো হয়েছে [৩] । সেখানে ডিবির মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম বলেছেন ঢাকায় নিরাপদ কিছু জায়গায় মুফতি রাহমানী তার শিষ্যদের মানুষ হত্যার ট্রেনিং দিত। তার নিজের কম্পিউটার ব্যবহারের কোন জ্ঞান নাই। তবে সে দুইজন এসিট্যান্ট রেখেছিল যাদের কাজ ছিল বিভিন্ন ওয়েবসাইট খুঁজে টার্গেটদের বের করা। বাসায় সে নিজেই ছাত্রদের চাপাতি ব্যবহার করার প্রশিক্ষণ দিত। মুফতি রাহমানী শিক্ষা দিতেন কিভাবে কাঁধের পেছনে চাপাতির দুইটা কোপে স্পাইনাল কর্ড বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যায়। তিনি বন্দুকের চেয়ে চাপাতি পছন্দ করেন। কারণ এতে শব্দ ছাড়াই কাউকে হত্যা করা যায়। তিনি শিষ্যদের বলেছিলেন তলোয়ার দিয়ে হত্যা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক পবিত্র।
মুফতি জসীমউদ্দীন রাহমানীর কার্যালয় থেকে ১২ জনের ছবিসহ একটি তালিকা উদ্ধার করা হয়েছিল। সংবাদপত্র পড়ে আমরা জেনেছিলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আহমেদ রাজীব হায়দার প্রমুখ সহ তালিকায় দুজন মন্ত্রীর নামও রয়েছে [৪] । এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইনান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট রাহমানীর ব্যাংক হিসাবের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে। এতে মুফতি রাহমানীর বিভিন্ন ব্যাংক একাউন্টে কয়েক কোটি টাকা সন্ধান পাওয়ার খবর উঠে আসে [৫] । বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেনের এই ঘটনা ছিল কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়ার মতো। সে টাকার কত অংশ কোন কাজে খরচ হয়? ব্লগার প্রকাশক হত্যার পেছনে কত টাকা খরচ হয়? পুলিশ বলেছিল “তাকে রিমান্ডে এনে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে”। তবে আজ পর্যন্ত লেনদেনের সাথে জড়িতের বিরুদ্ধে কোন মামলার কথা শোনা যায়নি। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে আদালতে দেওয়া বক্তব্যে মুফতি জসিম উদ্দিন রাহমানি টাকার অভাবে ভালো কোন আইনজীবীর ব্যবস্থা করতে না পারার কথা বলেছিলেন [৬] । মুফতি রাহমানী কারাগারে গিয়েও বসে নাই। গত আগস্টে গ্রেফতার তিন জঙ্গির কাছ থেকে জানা গেছে কারাগার থেকে রাহমানী সকল হত্যাকাণ্ডের নির্দেশনা দিয়ে থাকেন [৭] । এমনকি জঙ্গি কর্মকান্ডের সাথে জড়িতরা নিয়মিত কারাগারে গিয়ে তার সাথে দেখা করেন। এই সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছে তদন্ত কর্মকর্তারা মামলাটিকে যথাযথভাবে আদালতে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
সন্তানহারা বাবা ডা. নাজিম উদ্দিন ছেলের মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন ” দীর্ঘ ৪১ বছর মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের বিচার না হওয়ার যে কলঙ্ক বয়ে বেড়াচ্ছি সেই কলঙ্ক মোচন করতে হবে। আমার সন্তান হত্যার বিচার করলেই দেশের মুক্তি আসবে না। রাজীবের হত্যাকারীসহ সব রাজাকার নির্মূল করতে হবে। আর সেই লক্ষ্যে সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকুন। আসুন আমরা রাজীবের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে শপথ নিই এই দেশ রাজাকারমুক্ত করবই”। বাংলাদেশ একাত্তরের রাজাকার থেকে মুক্ত হচ্ছে; কিন্তু এখনও ধর্মান্ধতার বলি হতে হয় অভিজিৎ রায়-ওয়াশিকুর রহমান বাবু-অনন্ত বিজয় দাশ-নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়-ফয়সল আরেফিন দীপনকে। এখনও রাজীবের বাবাকে বলতে হয় “মৌলবাদের জয় হলো। আমরা যারা মুক্তমনা, তাদের পরাজয় হলো”।

তথ্যসূত্র
[১] শায়খুল হাদিস মুফতি মুহাম্মাদ জসীমুদ্দিন রাহমানী, উন্মুক্ত তরবারী, মার্চ ২০১৩, মারকাজুল উলুম আল ইসলামিয়া, ঢাকা
[২] হিন্দুরা আমাকে ভগবানের মতো ভালোবাসে, বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডট কম, ডিসেম্বর ২২, ২০১৫
http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article1076031.bdnews
[৩]The Imperiled Bloggers of Bangladesh, The New York Times Magazine, December 29, 2015

[৪] হত্যার তালিকায় শেখ হাসিনা, জাফর ইকবালসহ ১২ জন, কালের কণ্ঠ, আগস্ট ১৫, ২০১৩
http://www.kalerkantho.com/online/national/2013/08/15/3266
[৫] মুফতি রাহমানীর ব্যাংক হিসাবে বিশাল অংকের লেনদেন, যুগান্তর, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৪
http://www.jugantor.com/first-page/2014/02/19/70421
[৬] অভিজিৎ-অনন্ত হত্যায় ‘একই দল’, বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডট কম, আগস্ট ১৮, ২০১৫
http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article1013004.bdnews